চিঠি-১ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে এক অনন্য ট্রাজেডি)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৮ মে, ২০১৬, ১১:৪৭:৫৬ সকাল
দ্বিতীয় পর্ব ।
পনের বছরের বালক আমি। এগারই রমযান, যখন বাড়ি ফিরলাম তখন ইফতারির সময় হয়ে গেছে। ভূমণ্ডল আর নভোমণ্ডল আমার মাথায় চেপে আছে। আমি যেন ধীরে ধীরে কোন অজানা বিষাদ সিন্ধুতে তলিয়ে যাচ্ছি। শরীরটা অসম্ভব ভারি মনে হচ্ছিল। পা দু’টি দেহের বুঝা বইতে পারছিল না, টাকনুতে ব্যাথা অনুভব করছিলাম। আমার অনুভূতি শক্তি লোপ পেয়ে গিয়েছিল, কোথায় কী হচ্ছে না হচ্ছে ঠাহর ছিল না। কোন রকম মাগরিবের নামাযটা পড়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বাড়ি ভর্তি মানুষ, পাড়ার লোকেরা আসছে, যাচ্ছে। কেউ কাঁদছে, কেউ গম্ভীর হয়ে বসে আছে, কেউ শান্তনা দিচ্ছে। আমার ছোট ছোট ভাই বোনগুলি যে যেখানে পারছে পড়ে পড়ে কাঁদছে। মা বেহুঁশ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন।
এক কিলোমিটার দুরে মামা বাড়ি। সেখান থেকে ভাত, গোশত ও ডাল রান্না করে পাঠিয়েছে। গায়ের মহিলারা এসে একেক জনকে একেক জায়গা থেকে টেনে তুলে জোর করে মুখে তুলে খাওয়াচ্ছে। অবশেষে আমাকে টেনে তুলে হাত ধুইয়ে খেতে বাধ্য করল। সারাদিন খাওয়া নেই, প্রচণ্ড ক্ষুধায় কয়েক লুকমা খেয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। অল্পক্ষণেই ক্লান্তি আর অবসাদ গ্রস্থ দু’টি চোখে ঘুম নেমে এল। আসলে এটা ঘুম নয়। মানুষ যখন ক্লান্তি বা কোন কষ্টে চরমভাবে অবসাদ গ্রস্থ থাকে তখন তার চোখে ক্লান্তির তন্দ্রা বা ক্লান্তির ঘুম নামে। তারপর ক্লান্তি কেটে গেলে ঘুম ভেঙ্গে যায় আর ঘুম হয় না। জীবনে কয়েক বার চরম দুঃখের সময় আমার এমন হয়েছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। অন্তহীন বেদনা নিয়ে কিছুক্ষণ বিছানায় পড়ে থাকলাম। নিজের জীবন, ছোট ছোট ভাই বোন গুলির জীবন, মা, পরিবার ইত্যাদি নিয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলাম। কলজেটা চিন চিন করে ব্যাথা করছে। কষ্টের একটা গিরা যেন গলায় আটকে আছে। না নীচে যাচ্ছে আর না উদগিরণ হচ্ছে। গলাটা ব্যথা করছে। সহসা মনে হল আমিই পৃথিবীর সবচেয়ে অভিশপ্ত জীব। আর শুয়ে থাকা সম্ভব হল না। আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা খুলে বাইরে তাকালাম, শুল্কা পক্ষ, রমযানের একাদ্বশি চাঁদের লালাভ আভা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। উঠানটা আমার কাছে রক্তিমাভ মনে হল।
মধ্যরাত, প্রকৃতি নীরব-নিথর, কোথাও কোন সাড়া শব্দ নাই। জীব জগত ঘুমের কোলে গা ঢেলে দিয়েছে। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে আস্তে আস্তে বাইরে গেলাম। কিন্তু দেউড়ি পেরিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম। বাহির বাড়ির উঠানে দেউড়ির কাছেই একটা চৌকি পড়ে আছে। এ চৌকিতেই আজ দুপুরে আমার বাবার গোসল দেয়া হয়েছিল। আমার সদ্য বিধবা মাতা এ চৌকিটির পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। মুক্ত আকাশ, তার নীচে সুবিস্তৃত পৃথিবী, তারই বুকে দাঁড়িয়ে দশ হাত ব্যবধানে সদ্য বিধবা এক অসহায় নারী আর তার পনের বছরের সন্তান। মহাবিশ্ব আমার সামনে সঙ্কুচিত হয়ে এল। প্রকৃতি জগত হু হু করে কেঁদে উঠল। আমার পায়ের তলার মাটি দুলে উঠল, হৃদয় তন্ত্রির সবগুলি তার এক সাথে ছিঁড়ে গেল। গতকালও আমি এবং আমার পরিবার ছিলাম সুখি সমৃদ্ধশালী পরিবার। কিন্তু আজ বিকালে বাবাকে মৃত্তিকা গর্ভে সমর্পন করে এসে আমরা হয়ে গেলাম নিঃসহায় সর্বহারা। আজ থেকে আমাদের পরিচয় আমরা ইয়াতিম।
মায়ের কান্না দেখে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে, মন চাইছে চিৎকার করে কাঁদি। কিন্তু মাকে টের পেতে না দিয়ে পা টিপে টিপে চলে গেলাম বাড়ির ঈশান কোণের বাঁশ ঝাড়ের তলায়। সদ্য ইয়াতিম হওয়া এক বালকের বক্ষ আর চক্ষু আগ্নেয়গিরির মত ফেটে পড়ে। তার ছোট্ট দেহটি গড়িয়ে পরে মাটির উপর। অন্তহীন বেদনায় মাতম করে উঠে প্রভু একি করলে প্রভু, একি করলে, কেন আমাদেরকে অভিশপ্ত করলে, কেন এতবড় শাস্তি দিলে। মর্তলোক থেকে অনন্তলোক পর্যন্ত শুধু কান্না, রোদন মাতম আর আর্তনাদ। কষ্ট ও বেদনার আতিশয্যে নিঃসহায় বালক মাটিতে গড়াগড়ি যায়, চিৎ হয়ে পড়ে থেকে তার দুটি হাত উর্ধ্বে মেলে ধরে, তার মর্মভেদি আর্তনাদ পাথরের পৃথিবীতে প্রত্যাখ্যাত হয়ে উঠে উর্ধ্বে, আরো উর্ধ্বে, শুন্যে, মহাশূন্যে, হয়ত কেঁপে উঠে আরশে আজিম। অবশেষে ক্লান্ত শরীরটা কাত হয়ে মাটির উপর পড়ে থাকে। প্রায় অবশ দু’টি হাত টেনে এনে সে মুখের সামনে ধরে, তারপর এক ভাগ্যাহত বালক তার মুনীবের দোয়ারে পেশ করতে থাকে তার দুঃখ ব্যথা ও যন্ত্রনার আবেদন গুলি, চলতে থাকে প্রভু ভৃত্যের গোপন অভিষার।
তারপর যখন উঠে দাঁড়ালাম তখন রাতের তৃতীয় প্রহর অতীত। সেহেরীর সময় হয়ে গেছে। পাকা তিন ঘন্টা আমার মুনীবের সাথে কথা হল, কাধের ভার হালকা হয়ে এল, মনে সাহস সঞ্চার হল। ভাগ্য বিধায়কের দরবারে আমার আবেদনগুলি জানিয়ে এসে সেহেরি খেতে বসলাম।
সেই দিন থেকে এক বিশাল পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে পৃথিবীর কন্টকাকীর্ণ পথে শুরু হয়েছিল আমার অভিযাত্রা। ছয় ভাই তিন বোন। শুধু একটি বোন বড়-যাকে আব্বাই বিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। বাকী সবাই আমার ছোট। দুটি বছুরে কামলা, দুটি কাজের মেয়ে, একজন লজিং বিশাল ব্যয়বহুল পোষ্য ভারাক্রান্ত এক পরিবার। যে পরিবারের শুধু মাসিক খোরাকই লাগত চব্বিশ মণ ধান।
সময়টা ছিল আমার তারুণ্যের শেষ প্রান্ত। আর যৌবনের ঊষা লগ্ন। এটা ছিল সেই সময় যখন কোন উঠতি বয়সী তরুণের পাদ বিক্ষেপে মাটি কেঁপে উঠে, যার বাহু সঞ্জালনে বাতাসে গতির সঞ্চার হয়। এ সময়ে মানব সন্তান মানব থাকে না, দানব হয়ে উঠে। হ্যাঁ সত্যি, আমি হয়ে উঠেছিলাম এক দানব। বিশেষত আত্মীয় নামের কিছু বিচ্ছু যখন ঠোটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে চাপা আনন্দ প্রকাশ করত, অমুক মারা গেছে এখন সংসারটা ধ্বংস হয়ে যাবে। ছেলেটা (মানে আমি) যে খারাপ, কয়েকদিনেই জমি বাড়ি বিক্রি করে সব ধ্বংস করে দেবে। ছোট ছোট ছেলেগুলিকে লেখা পড়া তো করাবেই না ওদের মেরে ফেলবে ইত্যাদি ইত্যাদি বলে বেড়াত আর তাদের উল্লাস জাহির করত। একটা ইয়াতিম পরিবারের প্রতি কর্তব্য পালন না করে বৈরিতা করে বেরাত। এটা গ্রামীন কালসার।
আর তখন আমার দুর্বল দু’টি হাত উঠে যেত উর্ধ্বে, ইযযত ও লাঞ্চনার মালিক, আমার দুর্বল দেহে দানবের শক্তি ও সাহস দান কর। হ্যাঁ দিয়েছিলেন, দুটি বাহুর দিকে তাকিয়ে ভাবতাম, এটা কি মাংস পেশি নাকি পেটানো ইস্পাত। টোকা দিতাম, ঝনঝন করে বেজে উঠত। তখন মনে হত, এ দুটি বাহুর বলে আমি পৃথিবীর মাটি উলট-পালট করে দিতে পারি, পালটে ফেলতে পারি পৃথিবীর চেহারা। মা এক জগ দুধ দিয়ে যেতেন, মানে দেড় থেকে দুই কেজি। ঢকঢক করে গলায় ঢেলে দিতাম। তারপর বুঝতাম দুধ আসলে পানীয় নয় খাদ্য। কারণ এটা পায়খানা হয়, পেশাব হয় না (বেশি পরিমান খেলে)। আধা কেজি চালের ভাত খেয়ে একটা মোচড় দিতাম, অমনি টয়লেটে দৌড়াতে হত। মনে মনে ভাবতাম, ধুত্তুরি ছাই আর ভাত খাব না, কঙ্কর খাব। এক পেট কঙ্কর বড়জোর দুই ঘন্টা, পেশাব হয়ে বেরিয়ে যাবে।
যখন কোন কাজ ধরতাম পরিবেশটা থরথর করে কাঁপত। কাজটা ইয়া নাফসী ইয়া নাফসী করতে থাকত। মহুর্তেই তা হাওয়া হয়ে যেত। যখন পড়তে বসতাম, চারিপার্শ্ব ভীতগ্রস্থ হয়ে উঠত, কেউ আমাকে ডাক দিবার সাহস পেত না। ছাত্র ছিলাম কিন্তু ক্লাস জীবনে কমই করেছি, পৃথিবীর কয়েকটা ভাষা জানা কিন্তু উস্তাদ নাই, পরীক্ষা জীবনে বহু দিয়েছি কিন্তু কোনটাতে দেড় মাসের বেশি প্রস্তুতি নেয়ার সময় ও সুযোগ মিলেনি। এই ভাবে পনের বছরের এক দানব, বিশাল সংসার কাঁধে নিয়ে যার যাত্রা শুরু। যার সামনে কোহ কাপের দেও দানা, তেপান্তরের রাক্ষস খোক্ষস পদদলিত হয়ে যায়, হিমালয় তুলো ধুলো হয়ে উড়ে যায়। অবদান? গ্রামীণ পরিবেশে যেটুকু সম্পদ যথেষ্ট মনে করা হয় আল্লাহ্র রহমতে তা করতে সক্ষম হয়েছিলাম। ছয় ভাইয়ের চার জন উচ্চ শিক্ষিত, দু’জন কর্ম দোষে উচ্চ মাধ্যমিকের পর ঝড়ে পরে।
১৫ থেকে ৩০- জীবনের এ স্বর্নযুগটা আমার বাবার সংসারে উৎসর্গ করেছিলাম- যার সুফল এখন আমার সহোদররা ভোগ করছে। আজ পরিনত বয়সে এসে চিন্তা করি নিশ্চয়ই সেদিন আল্লাহ্ আমার দোয়া কবুল করেছিলেন, নচেৎ আমার মত এক দুর্বল বালকের পক্ষে এমন বিশাল একটি পরিবারের বোঝা বহন করা সম্ভব ছিল না। যে অবস্থায় বাবার ইন্তিকাল হয়েছিল বিবেক বলে পরিবারটি তছনছ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমার ভাইয়েরা পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে বটে তবে পার্থিব তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। এসবই হল আলাহর রহম ও করম। কিন্তু তজ্জন্য আমাকে জীবন বাজি রাখতে হয়েছিল।
বিষয়: সাহিত্য
১৩৫৫ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন