চিঠি- ৭ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে এক অনন্য ট্রাজেডি)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৭ মে, ২০১৬, ১০:০৫:০০ সকাল
হাসান বাড়িতে গেল। তার মা হজ্বে যাবে, তাই বাড়িতে বিদায় অনুষ্ঠানে গিয়েছে। মায়ের উপর হজ্ব ফরয, তাই প্রথমে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেছিল। কিন্তু হাসান উত্তর দিয়েছিল হজ্বের চেয়ে আমার মেয়ের একটা ব্যবস্থা করা আমার উপর বড় ফরয। মেয়েকে খোজে না পাওয়া পর্যন্ত আমি কোথাও যাব না। অগত্যা তার ছোট ভাই নিয়ে যাচ্ছে। এখন বিদায় উপলক্ষে বাড়িতে রীতিমত উৎসব অনুষ্ঠান চলছে। গ্রামের প্রথম মহিলা হজ্বযাত্রি হিসাবে তাকে দেখার জন্য আশপাশের মহিলারা আসছে। আত্মীয় স্বজনরা আসছে। বাড়িতে লোক সমাগম হৈ হল্লা লেগেই আছে। বিয়ে বাড়ির মত উৎসব অনুষ্ঠান চলছে। রান্না বান্না চলছে অবিরত। কেউ খাচ্ছে, কেউ চা নাস্তা সেরে চলে যাচ্ছে। দূর থেকে যেসব মহিলারা আসছে তাদেরকে জোর করে হলেও খাওয়ানো হচ্ছে।
হাসান বাড়িতে যাওয়ার দুই দিন পর স্বপরিবারে তার বোন আসল। চারটি ভাগ্নি একটা ভাগ্নে। ছোট মেয়েটি প্রায় মুনীরার সম বয়সী। হাসানের মা তাকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ আদর করল। তারপর বলল, মুনীরাও তো বোধ হয় এতটুকু বড়ই হয়েছে। এ কথা বলেই তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। রীতিমত বিলাপ শুরু করে দিলেন। আমার বড় ছেলের একমাত্র মেয়ে আজ কতটা বছর ধরে দেখতে পারি না। মেয়েটা কোথায় আছে, কী করছে, কী খাচ্ছে কিছুই জানি না। তোরা পারলে না, পারলে না মেয়েটাকে আনতে। কত মানুষ আসছে, কত মানুষ দেখছি। কিন্তু আমার নাতীটাকে এক নজর দেখার ভাগ্য আমার হল না। হায়রে কপাল, হজ্ব থেকে যদি আর ফিরে আসতে না পারি, কত মানুষই তো সেখানে মারা যায়। আমার বয়েস হয়েছে আমিও ফিরে আসব না। হায় আমার নাতীটার কি হবে। সবাই আনন্দ করছে সবাই আছে শুধু আমার নাতীটাই নাই। আমার এতগুলি ছেলে বাচ্চাটাকে খোজে বের করতে পারল না। এই সবগুলি অপদার্থ, মেয়ে মাইনসের মত অকর্মা, তোরা কেউ আমার সামনে আসিস না। বেহায়ার দল, এই সব আবুল তাবুল বকতে বকতে তিনি কাঁদতে লাগলেন, হাসান কান্নাকাটি শুনে নিজেকে শক্ত করে মাকে সান্তনা দিতে এল। মা তাকেও কিছু কটু কথা বলল, আর ধমকে উঠে বলল, তুই যা আমার সামনে থেকে। হাসান মায়ের হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে শান্তনা দিয়ে বলল, আপনি এত চিন্তা করেন কেন? একটা তথ্য পেয়েছি খুব শীঘ্রই মেয়েকে পেয়ে যাব ইংশাআল্লাহ। একটু শক্ত হন, আমি তো কাঁদি না। মা তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই কাঁদিস না, আমি জানি না? হাতির মত ছেলেটা আমার মেয়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে মশা হয়ে গেছে তবুও বলে কাঁদে না। তিনি আবার কান্না শুরু করলেন।
হাসান বুঝতে পারল তার ভিতরে মহা সমুদ্রের কল্লোল উথলে উঠছে। খুব শীঘ্রই তরঙ্গাভিঘাত শুরু হবে। সে মাকে ছেড়ে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাড়ির ঈশান কোণে একটি বাঁশ ঝাড়। এটাই হল তার তীর্থস্থান। দিবসে নিশীথে যখনই তার মেয়ের কথা স্বরণ হয় এই নিভৃত স্থানটিতে এসে তার বুকের আগ্নেয় লাভা চোখের অশ্রুতে ঝড়িয়ে দেয়। তার অসহায় দুটি হাত তুলে নিজের বঞ্চনা আর মেয়ের কল্যাণের জন্য ফরিয়াদ জানায় তার দরবারে যিনি সর্বজ্ঞাত, সর্বদ্রস্টা। হাসান বাঁশ ঝাড়ের তলায় এসে ডুকরে কেঁদে উঠল, এতদিনে তার ভিতরে যে বাষ্প জমে উঠেছিল তা অশ্রু হয়ে ঝরতে লাগল।
সেখানে বসে বসে অনেকক্ষণ কাঁদল, তারপর রিক্ত দুটি হাত তুলে বলতে লাগল- মালিক আমার আমি গুনাহগার, আমি পাপী, আমার পাপের শাস্তি আমি ভোগ করছি। কিন্তু আমার কোলের শিশুটি তো কোন পাপ করে নি। কেন তুমি তাকে শাস্তি দিচ্ছ? তোমার ফিতরাত অনুসারে শিশুরা মা বাপের কোলে হেসে খেলে মানুষ হবে, জীব জন্তু পশুপাখি সবাই নিজ নিজ বাচ্চাকে বুক দিয়ে আগলে রাখে। ঝঞ্জা বিক্ষুদ্ধ পৃথিবীর শরারত থেকে পাঞ্জা দিয়ে আপন বাচ্চাকে হেফাজত করে, কিন্তু এতো মানব শিশু। কেন তাকে বাবার বুকের উষ্ণ পরশ থেকে বঞ্চিত করছ, কে তার প্রয়োজনগুলি পূরণ করবে? মহাবিশ্বের বিধায়ক ওগো, আমি তো জানি না কোথায় আছে আমার সন্তান, কেমন আছে, সে আদৌ কি খেতে পড়তে পারছে কি না? আমাকেও ১৫ বছর বয়সে ইয়াতিম করেছ, আর ইয়াতিমের যাতনা আমি বুঝি। আমি জীবিত থাকতে তুমি আমার মেয়েকে ইয়াতিম করলে কেন?
আদল ও ইনসাফের মালিক, যেখানেই থাকুক আমার সন্তান, তাকে তুমি সুখে রেখ, শান্তিতে রেখ, রেখ তাকে দুধে ভাতে, আমার পাপের জন্য তাকে শাস্তি দিওনা। আমার সুখটুকু তাকে দাও। তার দুঃখটুকু আমাকে দাও। এ পৃথিবীর একজন সদস্য হিসাবে পৃথিবীর হাসিতে আমারও তো একটা অংশ আছে আমার হাসির অংশটুকু আমার সন্তানকে দিয়ে দিলাম। আর পৃথিবীর কান্নায় তারও তো একটা অংশ আছে, তার কান্নাটুকু আমি নিয়ে নিলাম। তার হাসি ফুলের হাসিতে একাকার করে দাও। প্রভু আমার, তাকে আমার বুকে শীঘ্রই ফিরিয়ে দাও। এভাবে বসে বসে কাঁদতে লাগল। মধ্যরাতে আস্তে আস্তে ঘরে ফিরে এসে পকেট থেকে ছোট্ট জুতা জোড়া বের করে বুকের উপর চেপে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন বাড়ির মেয়েদের মধ্যে হৈ চৈ পড়ে গেল। তাদের পাশের বাড়ির এমদাদ নামে এক লোক সৌদি থাকত। সে আসার সময় গিনি সোনার অনেকগুলি চেইন নিয়ে এসেছে বিক্রির জন্য। এখন মেয়েদের মধ্যে সেই চেইন কেনার ধুম পড়ে গেছে। হাসান চেইনগুলি আনিয়ে তার ছোট ভাইকে দিয়ে বাজারে পাঠাল, বলে দিল, স্বর্ণকারের ঘরে গিয়ে এগুলি পরীক্ষা করবি, আর কত ক্যারট জেনে আসবে। তার ভাই ফিরে এসে বলল। এগুলি খাটি, বাইশ ক্যারট। সবাই একটি একটি করে চেইন দখল করল, বড় তিন ভাগ্নি তিনটা নিল। কিন্তু তাদের টাকা দেবে কে? সবাই বলল, তোমার বড় মামার কাছে যাও, তার টাকা খাওয়ার লোক নাই। মেয়েরা এসে হাসানকে ধরে বসল, মামা চেইন কিনে দাও, টাকা দাও। হাসান এমদাদকে ডাকিয়ে এনে ভাল দেখে চারটি চেইন নিল। তিনটি তিন ভাগ্নিকে দিল। একটি মুনীরার জন্য রাখল। এমদাদকে বলল, আমি বাসায় গিয়ে তোমার নামে টাকা পাঠিয়ে দিব।
বিকালে হাসান বারান্দায় বসে আছে। অদুরেই একটি গাভী বাধা। তার কয়েক মাসের বাছুরটি অনেকক্ষণ এদিক ওদিক খুব ছোটাছোটি করল, তারপর ক্লান্ত হয়ে এসে বেজান হয়ে মায়ের দুধ খাওয়া শুরু করল। বাছুর দুধ খাচ্ছে গাভিটা তাকে চাটছে। দুধ খাওয়া শেষ হলে বাছুরটি গাভীর মুখের কাছে গিয়ে তার মুখ শুকতে লাগল, গাভীটিও ক্ষনেক বাছুরের মুখ শুকল, মনে হল যেন তারা ভাব বিনিময় করছে, তারপর আবার বাছুরটিকে চাটতে লাগল। অনেকক্ষণ চাটাচাটির পর গাভীটি তার মুখের নিন্মাংশ থুতনিটা বাছুরটার পিঠে ঠেকিয়ে চাপ দিয়ে টেনে টেনে নিজের কাছে আনতে লাগল। এভাবে চেপে চেপে বাছুরটাকে তার সামনের বাম পায়ের পাশে ঠেকাল। তারপর গলাটা লম্বা করে ঘুরিয়ে চোয়ালটা বাছুরের পেটে লাগিয়ে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরল। হাসান বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগল। একটা বোবা প্রাণীর বাৎসল্য দেখে সে অবাক হয়ে গেল। আসলে এ অবোধ প্রাণীটি তার বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েছে। কী আশ্চর্য্য কান্ড, আরামে মা ছেলে উভয়েই চোখ বন্ধ করে রেখেছে। এক অপার মমতায় একে অন্যকে জড়িয়ে ধরেছে। একটা ইতর প্রাণীর বাৎসল্য দেখে তার মনটা বিষিয়ে উঠল। চোখের কোণায় জল এসে গেল। একটা প্রাণী তার সন্তানকে গভীর মমতায় বুকের সাথে জড়িয়ে ধরছে, সোহাগ করছে অথচ এ প্রাণীর ভাগ্যটুকুও তার হল না। নিজ সন্তানকে একটু আদর করার একটু সোহাগ করার, একটু বুকের সাথে জড়িয়ে ধরার ভাগ্য তার হল না। আর একটা ইতর বাচ্চার অধিকারটুকুও তার সন্তান পেল না। সে শুন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকায়, পৃথিবীটা তার কাছে ফাকা মনে হয়। এ বাস্তু চরাচর এ মহাবিশ্ব সবই তার কাছে মিথ্যা, সবই প্রতারণা ও সবই ফাও ঠেকে।
দু’দিন পর সে মা ও ছোট ভাইকে ঢাকায় রেখে এল। আসার সময় মা ও ছেলে উভয়েই গলাগলি ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছে। মা অসুস্থ, ফিরে আসতে পারবে কিনা সন্দেহ। তবুও ফরয কাজ না করলেই নয়। বহুদিন ধরে যাওয়ার আলোচনা কিন্তু সাহস পায় না। গ্রামের মানুষ, বড় বেশি একটা গাড়ি ঘোড়ায় উঠা হয়নি। মাথা ঘুরায় বমি আসে। কিন্তু এখন ফরয লঙ্ঘনের ভয়ে নিয়ত চূড়ান্ত হল। আসার সময় মায়ের জন্য মনটা বারবার উথলে উঠছে। পুরা রাস্তাটা সে গাড়িতে বসে কেঁদে কেঁদে এসেছে। কিন্তু বাসায় এসে শুন্য ঘর দেখে তার মনটা হাহাকার করে উঠেল। প্রকৃতির কী বিধান মায়ের কথা ভুলে এবার মেয়ের কথা স্বরণ হল। পকেট থেকে চেইনটা বের করে টেবিলের উপর রাখল। তারপর বিষণ্ণ গম্ভীর হয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকল। অবশেষে খাতা কলম নিয়ে লিখতে বসল।
সন্তানের প্রতি।
মুনীরা, বাপ আমার, তুমি কেমন আছ? এত যে চেষ্টা করছি তবুও তো আল্লাহ্ আমাকে তোমার সন্ধান পাইয়ে দিচ্ছেন না। জানি না কোন জন্মের পাপের এ শাস্তি আমাকে ভোগ করতে হচ্ছে। মা আমার, তোমার দাদু ও কাকু হজ্বে গেল। তোমাকে এক নজর দেখার জন্য তোমার দাদু অনেক কান্নাকাটি করে ছিল কিন্তু দেখার ভাগ্য হয়নি। জানি না, তিনি ফিরে আসবেন কিনা? আর ইহজন্মে তোমাকে দেখার ভাগ্য তার হবে কি না? মাগো, তোমার জন্য আমি দুই সপ্তাহ আগে অসির কাছে গিয়েছিলাম। সে আমাদের এলাকার। গিয়েই আমি তাকে বলেছিলাম। আমার ভাইয়েরা ক্ষমতার আসনে বসা আর আমি কেঁদে ফিরি পথে পথে। সে খুব মনোযোগ সহকারে আমার কথা শুনল, দুঃখিত হল আর কথা দিল, এর সুরাহা করে দিবে। তারপর সে আমাকে খুশি করার জন্য আমাদের এলাকার ও দেশ বিদেশের অনেক আলাপ করল, আপ্যায়ন করল। সবশেষে বলল, বিষয়টা তো পারিবারিক এটা তো ফোজদারি বিষয় নয়, তাই আমার সরাসরি হস্তক্ষেপ করাটা সমস্যা। আপনি আগে মেয়রের কাছে যান। তাকে বলেন, সে কোন ব্যবস্থা করুক বা না করুক তারপরই আমি হাত দেব। এরপর কয়েক দিন ঘুরাঘুরি করে মেয়রের সাক্ষাত পেলাম। তার সাথে পূর্ব পরিচয় ছিল। সেও মনোযোগ সহকারে শুনে বলল, আপনি আহমদ আলী ভাই ও আঃ আলিম ভাইয়ের কাছে যান। তারা ও ইঞ্জিনিয়ার আঃ রউফ এক সাথে তাবলীগ করে, কাজেই তারা আলাপ আলোচনা করে সুন্দর একটা মীমাংসা করতে পারবে। মেয়রের কথা যুক্তিসঙ্গত মনে হল। কারণ ঐ দুই জন তারা দুই ভাই এবং মেয়রের ভগ্নিপতি, আর মেয়র তাদের বাসাতেই থাকে।
আলীম সাবের সাথে সাক্ষাত করে সব কিছু খুলে বললাম। তিনি আশ্বাস দিলেন। একমাস ঘুরাঘুরির পর তিনি বললেন, ইঞ্জিনিয়ারকে তো আপনি চিনেন, লোকটা রুক্ষ প্রকৃতির। আপনার জন্য আমি অনেক চেষ্টা করেছি, এজন্যই এত দেরি হল। সে নাকি আপনাকে এক সালের শর্ত দিয়ে ছিল কিন্তু আপনি শর্ত পূরণ করেন নি। যার দরুন বিয়েটা ভেঙ্গেছে। আর এসবের জন্য সে আপনাকেই দায়ী করে। এজন্য সে আপনার মেয়েকে দিবেও না দেখতেও দিবে না। এটাই তার লাস্ট কথা। আমি তো ব্যর্থ হলাম, আপনি আরো চেষ্টা করলেও মনে হয় কাজ হবে না। এজন্যই আমি বলি ধৈর্য্য ধরেন, মেয়ে বড় হলে একদিন আপনার মেয়ে আপনার কাছেই আসবে। বুঝলাম আমার শেষ ভরসা ভেঙ্গে গেল। অসিকে ফোন দিলাম, দুর্ভাগ্য আমার সে বদলি হয়ে মুন্সিগঞ্জ চলে গেছে। সে পরামর্শ দিল স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বিষয়টা মীমাংসা করতে। অসহায় হয়ে তাবলীগি কয়েকজন বন্ধুর সাথে পরামর্শ করলাম। তারা বলল, বড় মাপের একজন রাজনৈতিক নেতা আছে যিনি তাবলীগের সাথে সংশ্লিষ্ট- আমাকে নিয়ে তার সাথে বসবে। নেতাকে নিয়ে আমার বিষয়টা ফয়সালা করার আশ্বাস দিল। আগামী সপ্তাহে যাব তার কাছে দেখি আল্লাহ কি করে। যাই হউক মা, তুমি ভাল থেক আর দোয়া কর। ইতি, তোমার আব্বু।
( প্রথম পর্ব সমাপ্ত)
বিষয়: সাহিত্য
১৪৪৩ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন