চিঠি-৭ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে এক অনন্য ট্রাজেডি)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৬ মে, ২০১৬, ১১:৫০:৪৬ সকাল

মুনীরা তার মা ও ছোট বোনটা নানুবাড়ি থেকে এসেছে। তারা নানুবাড়ি থেকে কয়েকহালি ডিম, কিছু কচু পাতা, কলার থুর ও অন্যান্য কিছু শাক পাতা নিয়ে এসেছে। বাসায় এসেই মুনীরা কাপড় চোপড় খুলে সরাসরি খাতা কলম নিয়ে টেবিলে বসল।

বাবার প্রতি,

আব্বু সেই কবে থেকে কত আশা নিয়ে তোমার পথের পানে তাকিয়ে আছি কিন্তু তুমি তো আজো এলে না। আব্বু জানো, আম্মুর চাচাত বোনের বিয়ে খাওয়ার জন্য আমরা নানু বাড়ি গেছিলাম। এইমাত্র এলাম। সেখানে কি কি হয়েছে সব তোমাকে জানাব। বিয়ে উপলক্ষে আমরা কয়েকদিন আগেই গেছিলাম। নানুদের বাড়ির নাম ফকির বাড়ি, তাদের গোস্টির সবাই এক বস্তিতে থাকে, বিশাল বড় বাড়ি। সবাই বড় লোক। আমার নানুই একটু গরীব, আম্মু এসেছে শুনে বাড়ির এবং গ্রামের সব মহিলারা আম্মুকে দেখতে এসেছে। তারা কানে কানে ফিস ফিস করে অনেক কথা বলেছে আমি শুনতে পাইনি। যাও কিছু শুনেছি অর্থ বুঝিনি, শুধু বুঝেছি যে, তারা আম্মুকে অনেক খারাপ কথা বলছে। আমার বোনটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে অনেক কথা বলেছে, এটা নাকি হিন্দুর মেয়ে। আরো অনেক কথা বলেছে, সেসব কথার মানে আমি বুঝি না। এসব কথা শুনে আম্মু খাটের উপর শুয়ে শুয়ে অনেক কেঁদেছিল। সাথে সাথে আমিও অনেক কেঁদেছিলাম। এরপর থেকে আম্মু ঘর থেকেই বের হত না। শুধু খাওয়ার সময় রান্না ঘরে গিয়ে রান্না বান্না করে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকত। কেউ আসতে চাইলেও আসতে দিত না।

বিয়ের আগের দিন আমার সকল খালামণি, খালু ও তাদের পোলাপানরা এল। আব্বু জানো, আমার খালামণিদের ছেলে মেয়েদের গায়ে কত সুন্দর সুন্দর জামা। তাদের জামা চকচক ঝকমক করে, আয়নার মত আলো দেয়। সুন্দর সুন্দর পাথর ও পুতির মালা বসানো তাদের জামা ও জুতাগুলি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখিছি। আর মনে মনে বলেছি, আব্বু আসলে আমার জন্য এর চেয়েও সুন্দর জামা ও জুতা নিয়ে আসবে। আমার খালুরা অনেক মিষ্টি ও বিয়ের জন্য অনেক সুন্দর সুন্দর উপহার নিয়ে এসেছিল। তাদের বাবুদেরকে কোলে নিয়ে মিষ্টি নুডুলস খাইয়ে দিয়েছে, সারাক্ষণ কোলে নিয়ে ঘুরাঘুরি করেছে, তারা কোথাও যেতে চাইলে বাবুরা আব্বু কোথায় যাও? আমাকে নিয়ে যাও- বলতে বলতে পিছু পিছু দৌড়ে গেছে। তারপর তারা বাবুদের কোলে নিয়ে বাইরে চলে গেছে। খালুরা আমাকেও মিষ্টি খেতে দিয়েছে। কিন্তু আমাকে তো কেউ কোলে নেয়নি, আদর করে নি।

আব্বু জান, সেই দিন রাত থেকে আমাদের অনেক কষ্ট হয়েছিল। আমার খালা খালুরা একটা একটা করে বিছানা দখল করে তাদের বাবুদের নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আমাদের থাকার জায়গা নাই। আম্মু সারাদিন রাত পর্যন্ত তাদের জন্য রান্না বান্না করল, খাওয়াল, থাল বাসন ধোয়া মোছা করল, আমার বোনটা আম্মুর কোলেই ঘুমিয়েছিল। তাকে নিয়েই আম্মু সব কাজ করেছে। আর নানু যে চাটাইয়ে নামায পড়ে তাতে আমি রান্না ঘরের এক পাশে ঘুমিয়ে ছিলাম। আম্মু অর্ধেক রাতে সবকাজ শেষ করে আমাকে ডেকে তুলল।

তখন নানু এসে বলল, বিছানা যে নেই, জামাইদেরই হচ্ছে না, ছোট জামাই আর তোর দাদু (বড় ভাই) বাঘার বাড়িতে থাকতে গেছে। এখন তুই থাকবি কোথায়? আম্মু বলল, আমি এখানেই থাকতে পারব। নানু বলল, এই রান্না ঘরে, বিছানা নাই, মশারি নাই, বালিশও তো নাই, কেমনে থাকবি? আম্মু বলল, আমার মত কপালপুড়ির জন্য আবার বিছানা, মশারি, আমি এখানেই থাকতে পারব। তুমি চিন্তা করো না, যাও শুয়ে পর গিয়ে। তারপর নানু আরেকটা চাটাই দিয়ে চলে গেল। আম্মু চাটাই দুইটা বিছাল। কিন্তু বালিশ তো নাই, তাই কিছু খড় এনে মাথা রাখার জন্য শিয়রে রেখে তার উপর আম্মুর কাপড় বিছিয়ে দিল। তা মাথায় দিয়েই আমরা শুয়ে পড়লাম এবং ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর মশার কামড়ে আমি উঠে কাঁদতে লাগলাম, আমার বোনটাও কামড়ের চোটে ছটফট করতে করতে কান্নাকাটি শুরু করল। তারপর আম্মু উঠে বাতাস দিয়ে মশা তাড়াতে লাগল আর আমরা ঘুমালাম। আম্মু সারারাত ঘুমায়নি।

পরদিন সকালে উঠেই আম্মুর কাজ শুরু হল, কেউ কাজ করে না, সবাই আম্মুকে দিয়ে করায়। আম্মু যেন এ বাড়ির কাজের মেয়ে। বিয়ের রান্নার জন্য এত্তোগুলি পেঁয়াজ, রসুন, মুরগির গোশত, গরুর গোশত আরো কত কিছু আম্মুর সামনে এনে দিল এগুলো রেডি করে রান্না করার জন্য। আম্মু আমার বোনটাকে রান্না ঘরের এক কোণে ঘুম পাড়িয়ে রেখে কাজে লেগে গেল। আমি একা একা ঘুরাফিরা করলাম আর রং তামাসা দেখতে লাগলাম। আমার সাথে তো কেউ নেই, আমি একা। সব বাবুরা তাদের আব্বুদের সাথে। আমাকে কেউ কোলেও নেয় না, আদরও করে না, কাছেও ডাকে না। আমি শুধু অন্যদের দেখি আর তোমার কথা স্বরণ করি। রং তামাসা দেখতে দেখতে অনেক বেলা হয়ে গেছে। কিছু খাইনি। ক্ষুধায় আমি কাঁদতে লাগলাম। কাঁদতে কাঁদতে আম্মুর কাছে গেলাম। আম্মু বলল, আয় ভাত খেয়ে নে, তখন রান্না ঘরে কেউ ছিল না। আম্মু ভাত বেড়ে উকি দিয়ে দেখল কেউ আসে কি না। কাউকে না দেখে ইয়া বড় একটা মাছের টুকরা দিয়ে বলল, নে মাছটা আগে তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। আব্বু, জানো মাছটা দেখে আমার মনটা ভরে গেল। এত বড় টুকরা আমি জীবনেও খাইনি। আমি একটু একটু করে ভেঙ্গে ভাতের সাথে মিশিয়ে মজা করে খেতে লাগলাম। হঠাৎ আম্মুর চাচাত বোন এসে দেখে বলে উঠল আরে বিয়ের মেহমানরা এখনো খায়নি আর তুই এতবড় মাছটা মেয়ের পাতে দিয়ে দিলি। তোর সাহস তো কম না। তুলে নে, এটা তুলে নে, আম্মু মাথা নিচু করে বলল, বাচ্চাটা একটু মাছ খাওয়ার আশা করছে, তুমি এমন করতেছ কেন? তখন মহিলাটা বাজ খাই গলায় বলে উঠল- দুই জামাই খাইয়্যা আত্মা কইলজা শুকাইয়া এখানে এসেছিস কইলজা ভিজানোর জন্য, আরো কত বিশ্রি গালি গালাজ করতে করতে চলে গেল। তার গালি শুনে আম্মু বসে বসে কাঁদতে লাগল। আম্মুর কান্না দেখে আমারও কান্না পেল। খাওয়া ভাল লাগল না। আম্মুর সাথে সাথে আমিও কিছুক্ষণ কেঁদে থালা ফেলে উঠে চলে গেলাম। বাইরে একাকি ঘুরতে লাগলাম।

হঠাৎ ভীষণ হৈ চৈ পড়ে গেল। মানুষ জন বর এসেছে, বর এসেছে বলতে বলতে সামনে দৌড়ে যাচ্ছে, কিছুক্ষণ পর ফুল দিয়ে সাজানো একটা গাড়ি এসে থামল, পেছনে আরো অনেকগুলি। গাড়ি থেকে বর নামল, স্বর্ণের মত জামা কাপড় ও মাথায় মুকুটপরা বরকে একেবারে রাজ পুত্তুরের মত দেখা যায়। বর এসেছে, আম্মুকে জানানোর জন্য আমি দৌড় দিলাম। কিন্তু দেউড়ির কাছে গিয়ে দেখি অন্যান্য মহিলাদের সাথে আম্মুও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বর দেখছে। আমিও আম্মুকে জড়িয়ে ধরে দেখতে লাগলাম। আম্মুকে জড়িয়ে ধরে দেখতে দেখতে আমার মনে যে কত শান্তি লাগছিল।

হঠাৎ আম্মুর চাচী আম্মুকে দেখে বলল, এই তুমি এখানে রান্না ঘরে কেউ নেই? কুকুর বিড়াল পাতিলে মুখ দিবে তো। অমনি আম্মুর সেই চাচাত বোনটা সেদিকে উকি দিল তারপর কী সর্বনাশ বলে দৌড় দিল। সাথে আম্মুও দৌড় দিল। কী হয়েছে দেখার জন্য আমিও দৌড়ে গেলাম। দেখি কয়েকটা কুকুর রান্নাঘর থেকে বের হচ্ছে। গিয়ে দেখি দু’তিনটা পাতিলের ঢাকনা নীচে পড়ে আছে আর মহিলাটা কুকুর তাড়ানোর জন্য চেলা কাঠ হাতে রান্নাঘরে গম্ভীর হয়ে ভূতের মত দাঁড়িয়ে আছে। আম্মুকে দেখে হঠাৎ বাজের মত গলা ছেড়ে বলল, মাগি রান্নাঘর খালি রেখে ওখানে তোর লাং দেখতে গিয়েছিলি। কুকুর যে সব খেয়ে গেল। এ কথা বলেই সে তার হাতের চেলাকাঠ দিয়ে আম্মুর মুখে গুতা মারল। আম্মু হাউত করে কেঁদে উঠল, তার গাল টেরা হয়ে রক্ত পড়ছে, আম্মু মুখে কাপড় গুজে কাঁদতে লাগল। মহিলাটি রক্ত পড়া দেখে আর কিছু না বলে একটা বাটি নিয়ে ঢাকনা খোলা তিনটা পাতিল থেকে এক বাটি করে মাছ, গোশত ও তরকারি ফেলে দিল। তারপর ঢাকনা দিয়ে ঢেকে, উচিত সাজা হয়েছে বলে হন হন করে বেরিয়ে গেল। আম্মু একহাতে মুখে কাপড় গুজে অন্য হাতে আঁচল দিয়ে রক্ত মুছতে মুছতে রান্না ঘরের এক পাশে বসে কাঁদতে লাগল। আম্মুর শরীর কাঁপছে। তা দেখে আমার আর সহ্য হল না। আম্মুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার পিঠে মাথা রেখে আমিও কাঁদতে লাগলাম। আর আমাদের ভাগ্যের কথা ভাবতে লাগলাম। আমাদের কেউ দেখতে পারে না, আদর করে না, ভালবাসে না। সবাই আমাদের মারে, ঘেন্না করে, আর এসবই হয়েছে আব্বু একমাত্র তোমার জন্য। তুমি থাকলে সবাই আমাদের সম্মান করত, আদর করত, আমার খালুরা আছে বলেই তো খালামণিদের সবাই কত সম্মান করে, ভয় পায়। তাদের বাবুদেরকে আদর করে, কোলে নেয়। কিন্তু আমাকে তো কেউ আদর করে না, কোলে নেয় না, ফিরেও তাকায় না। হায় আব্বা গো, কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। বাবা গো কেন এমন হল বাবা, কেন এমন হল, এখন আমরা কী করব, কোথায় যাব? কিভাবে বাঁচব বাবা, কিভাবে বাঁচব?

আম্মু আর আমি অনেক কেঁদেছিলাম। রক্ত পড়া বন্ধ হলে আম্মু রক্তটা ধোয়ে আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে লম্বা ঘোমটা টেনে আবার কাজে লাগল। আমি বাইরে গিয়ে বর দেখতে লাগলাম। সবাই আসছে, বর দেখছে, বাবুরা এসে বরের কোলে বসছে, খেলা করছে, আনন্দ করছে। আমার তো কেউ নেই, কেউ আমাকে কাছেও ডাকে না, আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু তামাসা দেখলাম। বিকাল, সন্ধ্যা, রাত পর্যন্ত একা একা ঘুরাফিরা করলাম, আম্মুর কাছেও যেতে পাড়ি না। মানুষে ভর্তি। আম্মু বেড়ে বেড়ে দিচ্ছে লোকেরা নিয়ে নিয়ে মেহমানদের খাওয়াচ্ছে। সারা দিন না খেয়ে ঘুরাফিরা করে আমার শরীর ক্লান্ত হয়ে গেল, অনেক রাত হয়ে গেছে, আম্মুর কাছেও যেতে না পেড়ে একটা বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পরলাম।

হঠাৎ আমার এক খালাতো বোন এসে এই আমাদের বিছানায় ঘুমিয়েছিস কেন বলে আমার পা ধরে টানতে টানতে খাট থেকে মাটিতে ফেলে দিল। খাটের পাশিয়ায় ও মাটিতে লেগে আমি মাথায় প্রচন্ড ব্যথা পেলাম। তারপর উঠে রাগে আমিও ওকে দুইটা চড় মারলাম। আর অমনি সে ভ্যা ভ্যা করে ওর মাকে ডাকতে ডাকতে বলল, আম্মু মুনীরা আমাকে মেরেছে, মুনীরা মেরেছে? তার মা এসে আমাকে নাকে মুখে মাথায় অনেকগুলি থাপ্পড় দিল আর বকতে লাগল। আমি কাঁদতে লাগলাম। ওর গলা শুনে আম্মু দৌড়ে আসতেই সে আম্মুকে নিয়ে পড়ল। তোর মেয়েটাকে কী বানিয়েছিস, আমার মেয়েটাকে মেরে কী করেছে? একটা ডাকাত, বাপ ছাড়া মেয়েরা ভাল হয় না। তুই যেমন দুইদিন পর পর জামাই বদলাস তোর মেয়েরা আর ভাল হবে কদ্দুর। আরো কত অশ্লীল বকাবকি করতে লাগল। আম্মু কিছু না বলে উল্টো আমাকে দুটা থাপ্পড় দিয়ে নিয়ে চলে গেল। রান্না ঘরে নিয়ে চাটাইয়ের উপর আমার বোনের পাশে আমাকে শুইয়ে দিল, আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। গভীর রাতে আম্মু আমাকে ডেকে ঘুম থেকে তুলল। আম্মুর চাচী বলল, সারাদিন অনেক খাটাখাটি করেছ, কিছু খাওনি, মুখটা শুকিয়ে গেছে। তারপর অনেকগুলি মাছ গোশত দিয়ে চলে গেল। আম্মু শুধু আমার মুখে তুলে তুলে খাওয়াল, কিন্তু নিজে খেতে পারল না। ঐযে গাল টেরা হয়ে গেছে সেখানে ধরে, পানিও খেতে পারল না, গাল ফুলে অনেক উঁচু হয়ে গেছে। সেদিন রাত্রে আর মশা লাগেনি আম্মু আগে থেকেই কয়েল আনিয়ে রেখেছিল। পরদিনও এভাবেই কাটল। বউ উঠিয়ে নিয়ে গেছে। অনেক মেহমানও চলে গেছে। আমরা ও আমাদের খালামণিরা তার পরের দিন যাব।

কিন্তু পরদিন বাঘের মত গলা শুনে আমার ঘুম ভাঙ্গল। ঘুম ভাঙ্গতেই শুনি আমার বড় খালামণি বাজখাই গলায় আম্মুকে গালাগালি করছে আর আম্মু মাটিতে বসে বসে কাঁদছে। তোর এত সাহস, নিজের দোষ আমার উপর গড়িয়ে দিচ্ছিস। আমি তোর সংসার ভেঙ্গেছি না? তুই জামাই ছেড়ে না এলে আমি জোড় করে আনতে পারতাম। তুইই একবার বললি যাবি একবার বললি যাবি না। জামাইর বিরুদ্ধে সকলের কাছে বদনাম করে বেড়াইলি। তারপর একটা হিন্দুকে বিয়ে করলি, তুই না চাইলে কি আমরা জোর করে বিয়ে দিতে পারতাম। এখন আমাকে দোষারোপ করছিস। আমরা শুনি নাই, আগের জামাইটাকে তুই কি পরিমান অত্যাচার করেছিস, বেচারার জীবনটাকে বিষিয়ে তুলেছিস। অসহ্য হয়ে বেচারা নালিশ করতে এসেছিল। নালিশ করল কেন? এই রাগে তুই সত্য-মিথ্যা বানিয়ে বেচারার বদনাম করলি, তার ঘর ছেড়ে চলে এলি আর এখন দোষ দিচ্ছিস আমার। খারাপ মেয়ে ছেলে কোথাকার, সাহস বেড়ে গেছে, আমাকে দোষারোপ করে। আমি না থাকলে তোকে ভিক্ষে করে খেতে হত।

আম্মু বলল, তুই আর তোর জামাই শয়তান। তোদের জন্যই আজ আমার নির্মম পরিণতি। আমি তোদের ক্ষমা করব না, কখনো না। আম্মু চিৎকার শুরু করল, আপনারা কে কোথায় আছেন আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে এই শয়তানদের বিচারটা করে দেন। তারা আমার ঘর ভঙ্গেছে, আমাকে বলেছে তাদের বাসার সাথে আমাকে বাসা করে দিবে। সারা জীবন চলার ব্যবস্থা করে দিবে, এভাবে তারা আমার সন্তানদের জীবনটা ধ্বংস করে দিল। আমার মেয়েকে তার বাপের কাছে যেতে দেয় না। আপনারা কে কথায় আছেন আমি এদের বিচার চাই, বিচার করে দেন। আম্মু মরিয়া হয়ে চিৎকার করতে লাগল। বাড়ির মানুষ সবাই জড়ো হয়ে গেল। তা দেখে বর খালামণির মাথায় রক্ত উঠে গেল। তাকে কল পাড়ে নিয়ে মাথায় পানি দেয়া হতে লাগল। আম্মু মাটিতে বসে বসে কপালে ও মাথায় হাত মারতে মারতে বলতে লাগল, এই শয়তানদের কথায় আমি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরিছি। একটা ভাল মানুষকে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি আর এখন সেই পাপের ফল ভোগ করছি। হায় এদের কথায় আমি বাপ মেয়েকে দেখা পর্যন্ত করতে দিচ্ছি না। অনেক পাপ আমার, অনেক পাপ। আর না, আমি মেয়েকে তার বাপের কাছে পাঠিয়ে দিব। আম্মু এসব বলতে বলতে কান্নাকাটি করতে লাগল।

বড় খালামণি মাথায় পানি দিয়ে এসে শুয়ে থাকল। আর নূরানি খালামণি তার সাথে অনেকক্ষণ পর্যন্ত আলাপ করল। তারপর আম্মুকে ডেকে নিয়ে গেল। বড় খালামণি বলল, শুন ভুল আমাদেরও আছে তোরও আছে। এখন এ নিয়ে নিজেরা নিজেরা ঝগড়া ঝাটি করে লোক হাসালে তো আমাদেরই ক্ষতি। আমাদের পরিবারের একটা সম্মান আছে। যা হবার হয়েছে, সে সব বাদ দে। তোর এসব কথাবার্তার কারণেই তোকে টাকা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম, এজন্যই এতদিন তোর কষ্ট হয়েছে। এখন আর কষ্ট হবে না। আমরা বোনেরা সবাই মিলে তোকে মাসে কিছু টাকা পাঠাব। আর কিছু সেলাই করে উপার্জন করলে তোর ভাল চলে যাবে। আর কষ্ট হবে না। আরেকটা কথা ভাল করে শুনে রাখ, কখনো মেয়ে দেয়ার কথা বলবি না। তাহলে কিন্তু টাকা বন্ধ করে দেব। আমার সাথে তোর কোন সম্পর্কও থাকবে না। বেটাকে বলেছিলাম এক সাল লাগিয়ে আসতে কিন্তু গেল না, আমার সাথে গোয়ার্তুমি করল, যার ফলে আজ এই পরিণতি ঘটল। আমি এর প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়ব না। জীবনে কোন দিন সে তার মেয়ের মুখ দেখতে পারবে না। তুই কিছু দিন পর পর বাসা বদল করবি, কোথায় থাকিস সে যেন জানতে না পারে, ঐ বেটা কিন্তু বসে নেই, মেয়েকে নেয়ার জন্য সে একের পর এক লোক লাগিয়েই রেখেছে। মেয়ে কোথায় থাকে তা জানার চেষ্টা করছে। তুই সতর্ক থাকবি। কোন ভাবেই যেন কেউ তোর ঠিকানা না পায়। তোরও তো মেয়ে। সে তোর ঠিকানা পেলে যেভাবেই হউক তোর মেয়েকে নিয়ে যাবে। তখন তোর কষ্ট হবে না ? কাজেই সতর্ক থাকিস।

যাই হউক, এখন থেকে তোর আর কষ্ট হবে না, আমরা টাকা পাঠাব, আর সেলাই করে কিছু রোজগার করলেই তোর ভাল চলে যাবে। আর নূরানি, তুইও তো ঢাকা থাকিস। কিছু দিন পর পর ওর বাসাটা বদল করে দিস। তারপর তারা সবাই মিলে আম্মুকে কিছু টাকা দিল আর আমরা বাসায় চলে এলাম। আব্বু জানো, আগে আম্মু বড় খালামণির সাথে ঝগড়া করত, আমাকেও আম্মু মাঝে মাঝে বলত কিন্তু বুঝতাম না। কিন্তু এখন তো একটু বড় হয়েছি বুঝতে পারছি, আসলে বড় খালামণিই তোমার কাছ থেকে আমাকে আর আম্মুকে নিয়ে এসেছে। সেই তোমার সাথে আমাকে দেখা করতে দেয় না। এই মহিলা একটা শয়তান। সে আমাকেও দেখতে পারে না, সে জীবনেও কোন দিন আমাকে আদর করেনি, কোলে নেয়নি। আমার দিকে কিভাবে কটমট করে তাকায় দেখে ভয় করে। এজন্যই আমি গাড়িতে আসার সময় একটা চিন্তা করেছি, তুমি এলে আমি আর তুমি গিয়ে তাকে গাছের সাথে শক্ত করে বাধব। না না আমি তো ছোট আমি বাধতে পারব না, আমাকে মারবে। তুমি আর আম্মু মিলে বাধবে আর পিটাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত সে আমাদেরকে তোমার কাছ থেকে নিয়ে আসার কারণে মাফ চায় ততক্ষণ পর্যন্ত মারবে। আব্বু ভাল থাক। ইতি, তোমার মুনীরা।

বিষয়: সাহিত্য

২৬৩৫ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

369248
১৬ মে ২০১৬ দুপুর ০২:৩৩
সায়িদ মাহমুদ লিখেছেন : খুবি ট্রেজিক, খুবি ট্রেজিক।
369249
১৬ মে ২০১৬ দুপুর ০২:৩৭
সায়িদ মাহমুদ লিখেছেন : নকিব, ভাই আপনার লিখিত ব্লগ গুলান মইধ্যে, এইটা আমার প্র্রথম পাঠ। এছাড়াও অন্য অনেক গুলা লিখার উপর ভাসা ভাসা চোখ বুলিয়েছি। ভাল লাগছে। সময় সুযোগ বের করে অন্য লিখাগুলোও পড়ে নিবো ভাবছি, দোয়া করবেন। আমার মনে হয় আপনার লিখা পড়ে খুশী হতে পারবো। আপনার লিখার স্টাইল আমার ভাল লাগছে। আল্লাহ আপনাকে সুস্থ এবং সুখে রাখুক।
369374
১৭ মে ২০১৬ সকাল ০৮:০৩
নকীব আরসালান২ লিখেছেন : ধন্যবাদ ভাই, সময় ব্যয় করে পড়ার জন্য। অসং্খ্য ধন্যবাদ উতসাহের জন্য। উতসাহ অযোগ্যকে যোগ্য করে তুলে। ভালো লাগলো।
370051
২৫ মে ২০১৬ দুপুর ১২:৪৬
প্রেসিডেন্ট লিখেছেন : পরের পর্বের অপেক্ষায়।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File