চিঠি-৫ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে এক অনন্য ট্রাজেডি)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৩ মে, ২০১৬, ১০:৩৮:১৯ সকাল

প্রতি বছর ১০ই মে দিবসটি হাসানের জন্য যুগপৎ আনন্দ ও কষ্টের বার্তা নিয়ে আগমন করে। এটি তার মেয়ের জন্ম দিন। সারাদিন বেচারা মেয়ের খোজ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন লোকের কাছে ধর্ণা দিল। অবশেষে বিফল হয়ে একটা বড় কেক ও কয়েকটা মোমবাতি কিনে রাত দশটার পর বাসায় ফিরল। কেক ও মোমবাতি রেখে অবসন্ন দেহখানি বিছানায় এলিয়ে দিয়ে কল্পনার রাজ্যে ডুবে গেল। একবারই মেয়ের জন্মদিন পালন করা তার ভাগ্যে জুটেছিল। মুনীরা তখন এক বছরের কোলে। কত লোক এসেছিল। সবাই তাকে কোলে নিয়েছে, আদর করেছে, দোয়া করেছে। অনেক খাওয়া দাওয়া হয়েছিল। সবাই মুনীরার জন্য অনেক উপহার উপঢৌকন নিয়ে এসেছিল। অনেক আনন্দ হয়েছিল। অনেক হৈ চৈ, শিশুদের কলরব, অতিথিদের হাসা-হাসিতে বাসাটা মুখর হয়ে উঠেছিল।

না না, এত হৈ হট্টগোল ভাল লাগে না। শুধু আমি আর মুনীরা আর কেউ না। সবাই মিলে উদযাপন করলে একটা আনন্দ শত ভাগ হয়ে যায়। না, কাউকে ভাগ দিব না। শুধু আমরা বাপ বেটি, আর কাউকে অংশ দিব না। এভাবে বলতে বলতে সে কেক ও মোমবাতি নিয়ে টেবিলের উপর রাখল।

ভাবালুতায় মগ্ন। মোমবাতি সাজিয়ে কেক নিয়ে নাড়াচাড়া করছে আর বিষণ্ণ কণ্ঠে বলছে মুনীরা তুই কই মা, একটি বার, শুধু একটিবার আমার কোলে আয়। আজ যে তোর জন্মদিন। তারপর হঠাৎ পিতা কন্যার শাশ্বত বন্ধনের চিরন্তন প্রতিক সেই গানটির কলি তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল- আয় খুকু আয়, আয়রে আমার সাথে গান গেয়ে যা, নতুন নতুন সুর নে শেখে নে, কিছুই যখন ভাল লাগবে না তোর, পিয়ানোয় বসে তুই বাজাবি রে।

তার কণ্ঠ ভাল। সুর আর সুধায় প্রকৃতি যেন একাকার হয়ে গেছে। সিন্ধু বারোয়ায় লাগে তান। হৃদয় বীনার সবগুলি তার বেজে উঠে। বিষাদগ্রস্থ মোহময়তায় সে গেয়ে চলল- আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়। আয়রে আমার কাছে আয় এখনি, কোথাও ঘুরে আসি শহর ছেড়ে, ছেলে বেলার মত বায়না করে, কাজ থেকে নে না তুই আমায় কেড়ে। আয় খুকু আয়।

অনন্ত আকাশ আর প্রকৃতিও যেন তার সাথে গেয়ে চলেছে। মোহাচ্ছন্ন হয়ে গাইতে গাইতে সে চলে গেল ঘরের কোণায় রাখা খেলনার কাছে। সেখানে রাখা একটা বড় পুতুল কোলে নিয়ে সে আদর করছে আর গাইছে- আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়। আয়রে আমার কাছে আয় মা মণি, সবার আগে আমি দেখি তোকে, দেখি কেমন খোপা বেধেছিস তুই, কেমন কাজল দিলি কালো চোখে, আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়।

ভাবাবেগ আর গানের মুর্ছনায় সে বাহ্যিক অনুভূতি হারিয়ে ফেলল। মেয়ে মনে করে পুতুলটাকে চেয়ারে বসিয়ে কেক কাটল। তারপর মেয়ের মুখে দিতে দিতে আবার গাইতে শুরু করল- আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়। আয়রে আমার কাছে আয় এখনি, আয়রে আমার পাশে আয় মা মণি। এ হাতটা ভাল করে ধর এখনি, হারানো সেদিনে চল চলে যাই। ছোট্ট বেলা তোর ফিরিয়ে আনি, আয় খুকু আয়।

সে বিরামহীন ভাবে গেয়েই চলেছে, গেয়েই চলেছে কখনো মেয়েকে চেয়ারে রাখছে। কখনো কোলে নিচ্ছে, আদর করছে, চুমু খাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকল।

রাতের দ্বিতীয় প্রহর অতীত। আকাশে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। গুরু গম্ভীর মেঘ গর্জনের পর শুরু হল প্রবল বৃষ্টি। সেই সাথে ঝড়ো হাওয়া। জানালা খোলা। বাতাসের ঝাপটার সাথে সাথে বৃষ্টির ছাট ঘরে ঢুকছে। জানালার ধারে টেবিলের উপর রাখা ল্যাপটপের উপর বৃষ্টির ছাট পড়তে পড়তে পানি বেয়ে চলছে। জানালার ধারে ফ্লোরের উপর পানি জমে গেছে। হতভাগ্য বেচারার সেদিকে কোন হুসই নেই। সে ভাবালুতায় মগ্ন, সে তার অশরীরী মেয়ের সাথে ভাব বিনিময় করেই চলেছে। কিন্তু চমক ভাঙ্গল তখন যখন হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। সহসা দুই হাত প্রসারিত করে সে মুনীরা বলে চেচিয়ে উঠল। কিন্তু তার কণ্ঠ অন্তহীন নৈরাশ্য আর কান্না হয়ে তারই কর্ণ কুহরে বাজতে লাগল। অন্ধকার নিঝুম কক্ষটি সহসা ব্যথা ও যন্ত্রণায় ভরে উঠল। সেই ধকল নিয়ে বিছানায় উঠে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সে আহ বলে ব্যথা ও যন্ত্রনায় মাটিতে শুয়ে পড়ল। বাইরে ঝড়ো হাওয়া, মেঘ গর্জন আর বিদ্যুৎ চমকে প্রকৃতিতে তোলপাড় চলছে। কিন্তু তার চেয়েও ভয়ঙ্কর তোলপাড় চলছে এ হতভাগ্য মানুষটির ছোট্ট বুকের ভিতরে। বাইরের তান্ডব তার ভিতরের তাণ্ডবের মুখে ম্লান হয়ে গেছে। সে টেরও পাচ্ছে না বাইরে ঝড়োবেগ ও প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। ঘরের মেঝেটা পানিতে ভেসে যাচ্ছে। তার ল্যাপটপটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হতভাগ্য মানুষটি নির্জীব জড়বৎ পাথরের মত মাটির উপর পড়ে থাকল। তারপর একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

রাতের তৃতীয় জাম অতীত। ক্ষুদ্ধ প্রকৃতি পৃথিবীকে মন্থন করে ধীরে ধীরে স্থিমিত হয়ে এল। অর্ধেক ঘরে পানি ঢেউ খেলছে। টেবিলের উপর রাখা ল্যাপটপ এবং বই পত্র থেকে ফোটায় ফোটায় পানি গড়িয়ে নীচে পড়ছে। বিদ্যুৎ চলে এল। হায়! হতভাগ্য জন্মদাতা! বেচারা ঠাণ্ডায় কুকুর কুণ্ডলী মেরে মাটির উপর শুয়ে আছে। নাকের উপর দিয়ে গড়িয়ে আসা অশ্রু শুকিয়ে শেষ বিন্দুটা জমে রয়েছে। এ হল সেই হতভাগাদের একজন যারা ফসল ফলায় কিন্তু ভোগ করতে পারে না। যার নিজের জিনিস অন্যের করতলগত হয়ে থাকে কিন্তু তার উপর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। হিংস্র সাপদের অভয়ারণ্য এ মর্তলোক। এখানে মানুষের উপর মানুষের হিংস্রতা পশুর হিংস্রতাকেও হার মানায়। এখানে সবলরা দুর্বলদের খেয়ে ফেলে।

ফজরের আযানের ধ্বনিতে তার ঘুম ভাঙ্গল। কুকুরের মত দুই হাতে ভড় দিয়ে মাথা তুলে সে ঘরের এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছে। সে বুঝতে পারল না চেয়ারের উপরে ও নীচে টুকরো টুকরো কেক গেল কি করে। ঘরে পানি এল কোত্থেকে, ভিজা ল্যাপটপ এবং বই দেখল কিন্তু তার মধ্যে কোন ভাবান্তর হল না। এসব এখন তার কাছে মুল্যহীন, পৃথিবীর সব কিছুই বস্তুত তার কাছে মূল্যহীন ঠেকে। তারপর অযু করে নামায পড়তে বসল। নামায শেষে নিঃস্ব সর্বহারার মত অঝোরে কাঁদল। তারপর উঠে এসে তার মেয়ের কাছে চিঠি লিখতে বসল। লিখা শেষ হলে আবার সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। হঠাৎ রাতের কেক কাটার কথা তার স্বরণ হল। আর এমনি সে চঞ্চল হয়ে উঠল। চেয়ার ছেড়ে উঠে পায়চারি করতে করতে আপন মনে বলতে লাগল না, না, এভাবে চলতে পারে না, এভাবে থাকলে তো আমি পাগল হয়ে যাব। আমি বাঁচতে চাই। আমাকে বাঁচতে হবে। নিজের জন্য নয় আমার মেয়ের জন্য আমাকে বাঁচতে হবে। আমি ছাড়া আমার সন্তানের আর কে আছে। তারপর কাপড় চোপড় পড়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হল।

বিষয়: সাহিত্য

১১৪৩ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

376495
২০ আগস্ট ২০১৬ দুপুর ০২:২৭
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু! আমরাও চুপ......।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File