চিঠি-৫ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে এক অনন্য ট্রাজেডি)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৭ এপ্রিল, ২০১৬, ১০:৫৮:৪৪ সকাল
ছোট্ট একটি রুম ভাড়া নিয়ে ফেরদৌসি দুই মেয়েকে নিয়ে থাকে। খুবই দুখিনী বেচারি। তার ঘর কন্যার সম্বল হল, একটা চৌকি। চৌকির উপর বহু পুরানো ছেড়া ময়লা তুশক ও চাদর বিছিয়ে রেখেছে। পুরানো তালি দেয়া একটা মশারী। মুনীরার পড়ার জন্য দেড় শত টাকা দামের ফুটপাতের একটা টেবিল এবং ঘরের কোণে রাখা একটা সেলাই মেশিন, এটাই তিনটি প্রাণীর একমাত্র জীবিকার উৎস। বাসায় কোন ফ্যান নেই, গরমের দিনে হাত পাখাই ভরসা। অতিরিক্ত পরিশ্রম করে মুনীরার মা আকছর সময় অসুস্থ থাকে। তার উপর বড় মেয়েটির জ্বালাতন তার আর সহ্য হয় না। দিনরাত মেয়েটি শুধু তার আব্বুকে নিয়েই ভাবে আর সর্বদা প্রশ্নে প্রশ্নে মাকে জর্জরিত করে রাখে। আম্মু, আব্বু কি এখন আসতেছে, কখন আসবে ? আম্মু জান, আব্বু না এখন সম্ভবত আমার জন্য জামা কাপড় কিনতেছে, তারপর মিষ্টির দোকানে যাবে, তারপর রওয়ানা দিবে, তাই না আম্মু? আচ্ছা বাসা চিনবে তো ? তারপর হয়ত আনমনে সে কোন শব্দ শুনতে পেল আর অমনি দৌড়ে বাইরে গেল। কিছুক্ষণ পর মুখটা গোমড়া করে এসে মায়ের শরীরে হাত মারতে মারতে বা গা ডলতে ডলতে লাগাতার প্রশ্ন করতে থাকবে। আম্মু, আব্বু এখনো কেন আসছে না, কখন আসবে, আমার জন্য কী নিয়ে আসবে, আমাকে কী দাদু বাড়ি নিয়ে যাবে না ইত্যাদি প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে করতে মাকে অতিষ্ঠ করে ফেলে। একে তো অসুস্থ বেচারি কর্মক্লান্ত হয়ে থাকে, তার উপর বাপ পাগুলে মেয়েটির অস্থিরতা তাকে পাগল করে তোলে, সে ঠিকমত কাজও করতে পারে না। তখন কোন সময় মাথায় রাগ চড়ে যায়, মেয়েকে বেদম মারে। তারপর মা মেয়ে দুই জায়গায় পরে পরে কাঁদে। কখনো বা মেয়েকে অভিসম্পাত করে, তোর মরণ নাই, আজরাইল তোকে দেখেনা, তারপর নিজে নিজেই কাঁদে। এসব জ্বালা যন্ত্রনা থেকে বাঁচতে সে মেয়েকে ঘরে রাখে না, বলে কয়ে বা ধমকিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দেয়। যাতে অন্যান্য শিশুদের সাথে খেলা-ধুলা করে বাপের কথা ভুলে থাকতে পারে আর সে নিজেও একটু নিষ্কৃতি পায়।
মাঝে মাঝে সে ভাবে এই অভিশপ্ত জীবনের জ্বালা যন্ত্রনা সব চুকিয়ে ফেলতে। কিন্তু বাচ্চা দুটির মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনটা হাহাকার করে উঠে, এদের কী হবে? মুনীরাকে তার বাপের কাছে দিয়ে দিতে চায় কিন্তু বড় বোন বাঁধ সাধে, সে দিতে দিবে না। জিদ সাধন করবে। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে, না আমাকে বাঁচতে হবে, বাচ্চা দুটিকে মানুষ করা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে হবে তারপর আল্লাহ্ কপালে যা রাখে তাই হবে।
আজ আবার সে শুরু করেছে জন্মদিন নিয়ে, মাকে বারবার বলছে মা আমার জন্মদিন করবে না? কোন দিন তো কর না, সিনথীয়ার জন্মদিন হচ্ছে আমারও করতে হবে। এভাবে সে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে করতে মাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। তাই সে ধ্মক দিয়ে মেয়েকে ঘর থেকে বের করে দিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর চোখ মুচে মুচে মুনীরা আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকল। তার মা সেলাই মেশিনে কাপড় সেলাই করছে। সে কাছে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করে বলল, আম্মু, আমার জন্ম দিন করবে না, সবাই জন্ম দিন পালন করে, কত আনন্দ করে, মেহমান আসে, অনেক মজার মজার খাবার খায়। আম্মু জানো, আজকে না সিনথীয়ার আব্বু তাকে একটা স্বর্ণের লকেট কিনে দিয়েছে। সে গলায় দিছে, কী যে সুন্দর দেখা যায়। আম্মু আমার জন্ম দিন করনা অনেক মজা হবে। তার মা নিরুৎসাহিত দৃষ্টিতে শিশুটির দিকে একবার তাকিয়ে আবার কাজে মনোযোগ দিল। মায়ের দৃষ্টিতে সে ভয় পেয়ে গেল। মাকে আর কিছু বলার সাহস পেল না। অনেকক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে আস্তে আস্তে পা ফেলে বারান্দায় চলে গেল। সেখানে কিছুক্ষণ ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদল। তারপর ঘরে এসে খাতা কলম নিয়ে বাবাকে চিঠি লিখতে বসল।
বাবার প্রতি,
আব্বু, কই তুমি তো এলে না। তুমি কি আর কোন দিন আসবে না? তুমি না এলে তো আমি মরেই যাব। প্রতিদিন স্কুলের সময়টা বাদে তোমার পথের দিকে তাকিয়ে থাকি। প্রতিদিন সকালে, স্কুল থেকে এসে সন্ধ্যা পর্যন্ত তোমার জন্য পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকি, বাহিরে বা দরজায় কোন কিছু শব্দ হলে এমনি দৌড়ে যাই, মনে হয় যেন এই বুঝি তুমি এসে পড়েছ। কিন্তু যখন গিয়ে দেখি তুমি নেই, কেউ নেই তখন আমার খুব কষ্ট লাগে। আমার চোখে পানি এসে যায়। এভাবে আর কতদিন চলবে বাবা। এভাবে অপেক্ষা করতে করতে তো আমি মরেই যাব, তারপর আমার মরার পর কি তুমি আসবে ? আমি মরে গেলে এই দুনিয়ায় তোমার কে থাকবে, কে তোমাকে আব্বু ডাকবে ? আমাকে দেখতে চাইলে দেরি না করে তাড়াতাড়ি আস। তুমি আসলে আমি জন্মদিন পালন করব। বাবুরা তাদের আব্বুদের নিয়ে জন্ম দিন করে, কত আনন্দ করে।
আব্বু জানো, আজকে না সিনথীয়ার জন্মদিন ছিল। জন্ম দিনের জন্য ওর বাবা তাকে নতুন জামা, জুতা, একটা মাথার মুকুট কিনে দিয়েছে। ওর আম্মু তাকে সাজিয়ে গুজিয়ে মাথায় মুকুট পড়িয়ে দিয়েছে। তখন যে কি সুন্দর দেখা গেছে। সে কী খুশি, হাসতে হাসতে বাড়িময় দৌড়াদৌড়ি করছে, বিভিন্ন লোকজন আসছে, তাকে কোলে নিচ্ছে, আদর করছে। অনেক মানুষ এসেছিল। তারা সবাই সিনথীয়ার জন্য অনেক জিনিস উপহার এনেছিল। ওর মামা বিদেশ থাকে, সে বিদেশ থেকে কী সুন্দর একটা স্বর্ণের লকেট দিয়েছিল। তখন তাকে কী যে সুন্দর দেখা গেছে, এক্কে বারে ঠিক যেন রাণী। ওর মামা তাকে সারাক্ষণ কোলে রেখেছে, কত আদর করেছে।
তারপর আব্বু জানো কী হয়েছে, টেবিলের উপর ইয়া বড় একটা কেক রাখা, অনেকগুলি মোম বাতি জ্বালানো হয়েছে। সিনথীয়ার আব্বু তাকে কোলে করে কেক কাটার জন্য নিয়ে এল। কিন্তু সে তার মামার কোলে বসে কেক কাটবে বলে বায়না ধরল। তখন তার মামা তাকে কোলে নিয়ে বলল, তুমি যদি এক নিঃশ্বাসে সবগুলি মোমবাতি নিভাতে পার তাহলে তোমাকে একটা বিদেশী ল্যাপটপ কিনে দিব। তখন সিনথীয়া লম্বা একটা দম নিয়ে একবারে সবগুলি মোমবাতি নিভিয়ে দিল। তখন সবাই কী আনন্দ, হাততালি দিল, হাসাহাসি করল। আচ্ছা আব্বু, সিনথীয়ার মামার মত আমার মামা আমাকে লকেট বা অন্য কিছু কিনে দেয় না কেন? আমার মামা আসলে কয়েকটা লজেন্স বা একটা ছোট্ট চানাচুরের প্যাকেট নিয়ে আসে। ব্যস এ পর্যন্তই, আমাকে কোলেও নেয় না, আদরও করে না, আম্মুকেও কোন কিছু দেয় না। আমার মামারা ভালো না, খারাপ।
আব্বু জানো, কেক কাটার পর সিনথীয়া ওর আব্বু, আম্মু ও মামার মুখে কেক তুলে দিল তারাও সবাই সিনথীয়ার মুখে তুলে কেক খাওয়াল। সবাই হাসাহাসি করেছে, আনন্দ করেছে। দেখে আমার যে কত ভাল লাগছিল। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, তুমি আসবে, আমার কাকারা সবাই আসবে, আমার জন্য লকেট, খেলনা আরো অনেক কিছু নিয়ে আসবে। তারপর আমি তোমার কোলে বসে কেক কাটব। তুমি আমার মুখে তুলে দিবে আর আমি তোমার ও কাকাদের মুখে তুলে দিব। সবাই আমাকে নিয়ে হাসবে, আনন্দ করবে। অনেক মজা হবে। তাই না আব্বু।
আব্বু জানো, কেক কাটার পর সবাই গিয়ে খেতে বসল। অনেকগুলি টেবিলে অনেক খাবার। বড় বড় ডিশ ভর্তি গরু গোশত, খাসির গোশত, মুরগীর গোশত, মাছ, ডিম আরো অনেক জাতের খাবার । কত যে সুঘ্রাণ। আমারও একটু খেতে মন চাইছিল কিন্তু কেউ আমাকে ডাকল না। আমি শুধু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। খাওয়া দাওয়ার পর একে একে সবাই চলে গেল। টেবিলে অনেক খাবার বাড়তি ছিল, অনেকে খেয়ে শেষ করতে না পেরে থালা ভর্তি খানা রেখে উঠে গিয়েছিল। সেই সব খাবার তাদের কাজের মেয়েটা বাইরে নিয়ে কুকুরকে দিতে লাগল। আমি বলতে চাইছিলাম সবটা কুকুরকে না দিয়ে আমাকে একটু দাও, কিন্তু সাহস পাইনি। ভয় পাইছিলাম, যদি আম্মু শুনে তাহলে মারবে। এ জন্যই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম।
হঠাৎ দেখি সিনথীয়া তাদের অন্য একটা রুমের দিকে যাইতেছে, ওকে দেখে যে কী সুন্দর লাগছিল। মনে হচ্ছিল রাজরাণী। আমি ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে বললাম, সিনথীয়া কই যাইতেছ ? সে আমার সাথে কোন কথা বলল না। সোজা তার খেলার রুমটিতে চলে গেল। আমিও তার পিছু পিছু গেলাম। গিয়ে দেখি এত্তো খেলনা আমি জীবনেও দেখিনি। সে একটা করে খেলনা চালু করতে লাগল। প্রথমে ছাড়ল একটা মোটর সাইকেল, শোঁ শোঁ করে চলল, তারপর একটা বাস ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে লাগল। তারপর একটা উড়ো জাহাজ শ শ করে উড়তে লাগল। তারপর একটা রেলগাড়ি ঝক ঝক করে চলতে লাগল। দেখে আমার যে কত আনন্দ লাগছিল। আমি মনে মনে বলছিলাম তুমি এলে আমিও এভাবে অনেকগুলি খেলনা এক সাথে চালাব। তারপর হঠাৎ দেখি একটা গাড়ি দেয়ালে গিয়ে আটকে ভোঁ ভোঁ করছে, চলতে পারছে না। আমি চাইলাম গাড়িটা ধরে একটু ঘুরিয়ে দিতে যাতে চলতে পারে। যেই না আমি গিয়ে ওটা ধরলাম, অমনি সিনথীয়া এই ছোবি না ছোবি না বলে চিৎকার দিয়ে উঠে এসে আমাকে কয়েকটা চড় মারল। আর বলল, এই ছোট লোকের বাচ্ছা এটা ছোলি কেন? তারপর তার মাকে ডেকে ডেকে বলল, মাম্মি দেখে যাও মুনীরা এখানে অত্যাচার করতেছে। আর অমনি তার মা ছোটে এসে ইয়া বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এই মেয়ে এখানে কী? তোর সাহস তো কম নয় ? যা বেরো, বেরো বলছি। যত্তোসব ফকিন্নি ঢেকুন্নির উৎপাত ইত্যাদি গালি দিতে দিতে আমার ঘাড় ধরে দরজা দিয়ে বের করে হঠাৎ ধাক্কা মারল। আর অমনি আমি উপোড় হয়ে পড়ে গিয়ে নাকে ব্যথা পেলাম। তারপর কাঁদতে কাঁদতে আমাদের ঘরের কাছে গিয়ে আরো কিছুক্ষণ কেঁদে চোখ মুছে ঘরে ঢুকলাম। কারণ আম্মু জানলে তো মারবে। তারপর আম্মুকে আমার জন্ম দিনের কথা বললাম। কিন্তু সে তো কিছু না বলেই চলে গেল।
আমার যে আর সহ্য হয় না। আব্বু, তোমার এবং আমার কাকাদের সিনথীয়াদের থেকে অনেক বেশি টাকা আছে তাই না? তাহলে ওরা এত কিছু করে, সিনথীয়াকে নিয়ে এত আনন্দ করে, কিন্তু তুমি আস না কেন? আমাদের এত কিছু থাকতে আমি এত কষ্ট কেন করছি বাবা, বল, বাবা বল। কষ্টের চোটে যে আমি মরেই যাব। আব্বু, আমার মাথার দিব্বি তুমি তাড়াতাড়ি আস, আর আমার কাকাদেরও নিয়ে আসবে। আর আসার সময় মনে থাকে যেন, আমার জন্য নতুন জামা, কাপড়, জুতা আর একটা মুকুট নিয়ে আসবে। আর কাকাদের বলবে, তারা যেন আমার জন্য একটা স্বর্ণের লকেট আর অনেকগুলি খেলনা নিয়ে আসে। আর হ্যাঁ তুমি কিন্তু মনে করে একটা বড় কেক আর অনেকগুলি মোমবাতি নিয়ে আসবে। ভুল যেন না হয়, নইলে কিন্তু আমি রাগ করব। এই আমার দিব্বি থাকল। তুমি ভাল থেক, আর তাড়াতাড়ি এসো। ইতি, তোমার আম্মু মুনীরা।
বিষয়: সাহিত্য
১৫১৩ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন