চিঠি-১ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে এক অনন্য ট্রাজেডি)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৫ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০৩:৫৩ দুপুর
হাসান গ্রীষ্মকালীন ছুটিটা বাড়িতে কাটাচ্ছে। বিকালে তার বৃদ্ধা মা আধা জগ দুধ ও একটা গ্লাস হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে বললেন, নে সবটা খা, শহরে থেকে তো তোর দুধের নাড় বন্ধ হয়ে গেছে, দুধ না খেলে শরীর ঠিক থাকে না। সবটা খা, তাড়া দিয়ে তিনি চলে গেলেন। হাসান গ্লাসে দুধ ঢালতে ঢালতে ভাবল এই দেড় কেজি দুধ একসাথে খাওয়া যাবে? আগে পারত, তখন প্রায়ই একবারে দেড় কেজি দুধ খেত। হয়ত কেউ বিশ্বাস করবে না কিন্তু এটাই বাস্তব। তার বাবার আমল থেকেই দুধের জন্য তারা অনেক গুলি গাভী রাখত। পরিবারে সব সময় অঢেল দুধ থাকত। তাদের মা বিশাল বড় এক পাতিলে দুধ গরম করে রেখে দিতেন আর তারা ভাই-বোনেরা যার যখন মন চাইত ঘরে গিয়ে গ্লাসে ঢেলে ইচ্ছামত দুধ খেত। কতবার যে তারা দুধ ঢালতে গিয়ে পুরো পাতিল উল্টে দিয়েছে তার ইয়াত্তা নাই।
কিন্তু সে বড় হওয়ার পর আর নিজ হাতে দুধ নেয় না। মা আধা জগ ভর্তি গরম দুধ আর গ্লাস দিয়ে আসেন আর সে অল্প অল্প করে গ্লাসে ঢেলে ঢেলে ঠাণ্ডা করে খেয়েছে। এমন খুব কমই হয়েছে যে, মা তাকে গ্লাসে দুধ দিয়েছেন। তবে যখন দুধ কমে গেছে বা দুধেল গাভী দুয়েকটা থেকেছে তখনই একমাত্র জগ ছেড়ে গ্লাসে দুধ উঠেছে। অতীতের মধুর স্মৃতিগুলি তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। আসলে তাদের পরিবারটা সেই প্রাচীন কাল থেকেই স্বচ্ছল গৃহস্থ পরিবার। বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা দুধ, আর আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি ফল-ফলাদির তো কোন অভাবই ছিল না। এ সবের প্রাচুর্য্য দেখেই দেখেই সে জীবন কাটিয়েছে। সে সারা জীবন দেখেছে অধিকাংশ সময় সকালে পায়লা ( দশ সেরের পরিমাপক) দিয়ে হাস মুরগির খোয়াড় থেকে ডিম তুলা হত। বাড়িতে থাকতে ডিম খেতে খেতে এমনই অরুচি ধরে ছিল যে, সে এখনো ডিম খায় না। তার মনে আছে তাদের সাধারণত হাস মুরগির সংখ্যা থাকত তিন থেকে পাঁচশোর মধ্যে। এসব হাস মুরগির গোশত, পুকুর, বিল, মান্দার ইত্যাদির মাছ বিশেষত ছোটমাছ ও দেশী জাতের মাছ সারা জীবন এত বেশি খেয়েছিল যে, এগুলোতে তার আর রুচি নাই। ফলে শহরে গিয়ে তার জন্য সুবিধা হল এই যে, শহুরে লোকেরা ছোট মাছ, দেশী জাতের মাছ, দেশী মুরগী খেতে চায় কিন্তু এগুলির মূল্য চড়া। তারা ফার্মের মুরগী ও প্যাঙ্গাস খেতে চায় না অথচ এগুলি হাসানের নতুন রুচিতে প্রিয় খাবার এবং সহজ লভ্যও বটে।
হঠাৎ তার মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল। তার কোলের বাচ্চাটা কি এভাবে দুধ খেতে পায়। এই যে তাদের এত দুধ, মাছ, ফল-ফলাদি পাড়া শুদ্ধু মানুষে খাচ্ছে তার মেয়ে কি এসব পায়, বাড়ির লোকেরা খেতে খেতে অরুচি ধরে যায়, কিন্তু তার মেয়ে ? আর অমনি তার নতুন ব্যধিটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। শুরু হয় তার মধ্যে অস্থিরতা, জগের দুধ বিষের মত ঠেকে। অস্থির হয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বাড়ির পূর্ব দিকে তাদের একটি পতিত ভিটা আছে। সেখানে পুকুর পাড়ে প্রকান্ড এক কাঁঠাল গাছ। এটাই হল তার তীর্থস্থান। দিবসে, নিশীথে, মধ্যরাতে যখনই তার মেয়ের কথা স্বরণ হয়, সে অস্থির হয়ে উঠে তখনই সে এ কাঁঠাল গাছের নীচে এসে গাছে হেলান দিয়ে বসে থাকে। নির্জন স্বাস্থ্যকর স্থান। পুকুরের মৃদু মৃদু ঢেউ, সামনে বিশাল অবারিত সবুজ মাঠ, তার ওপারে ধোয়াশাচ্ছন্ন জনপদের মনোরম সবুজ রেখা, বন-বনানী, তার উপর দিয়ে বয়ে আসা মৃদু মন্দ বাতাস, এসব কিছু হৃদয়ের দহন যন্ত্রণা অনেকটা শীতল করে দেয়। প্রায় সময় সে এভাবে ঘুমিয়ে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে সে কাঁঠাল গাছের নীচে এসে হেলান দিয়ে বসে পড়ল।
তখন পড়ন্ত বিকেল। পাড়ার মহিলা ও দুষ্ট ছেলেদের আম খাওয়ার উপযুক্ত সময়। তারা কোটা এবং কেউ পায়লা কেউ ব্যাগ নিয়ে আম পাড়তে এসেছে। কোটা দিয়ে গুতিয়ে, বারি দিয়ে সবাই নিজেদের খেয়াল খুশিমত আম পারতে লাগল। মানা করার কেউ নেই। কারণ হাসানদের বাড়ি, তিনটা পতিত ভিটে, রাস্তার ধারে ও অন্যান্য স্থানে অনেক আম গাছ রয়েছে। আর গ্রামের অবস্থাপন্ন কৃষক পরিবারগুলি সাধারণত গাছের আম, পুকুরের মাছ, গোয়ালের দুধ এসব বিক্রি করা অসম্মান জনক মনে করে। পাড়া প্রতিবেশি সবাই মিলে খায়, আত্মীয় স্বজনের বাড়ি পাঠায়, এটা ঐতিহ্য। কিন্তু যন্ত্র সভ্যতার এ যুগে সবাই যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে, বাংলার চিরন্তন সেই ঐতিহ্য দ্রুত পাল্টাচ্ছে। এজন্যই হাসানদের দুধ, মাছ, আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি বিক্রি করে না। বাড়ির গাছের আম কিছু নিজেরা খায় কিছু অন্যেরা নিয়ে যায়। কিন্তু বাইরের গাছের সকল আম পথচারী ও পাড়ার লোকেরা যার যখন যেমন মন চায়-পেড়ে পেড়ে নিয়ে যায়। এসব দৃশ্য দেখতে তার ভাল লাগে। চোখে প্রশান্তি নেমে আসে।
কিন্তু যখনই তার মেয়ের কথা স্বরণ হয় তখন এসব তার চোখে জ্বালা ধরায়, তার মনে হিংসার আগুন জ্বালিয়ে দেয় অন্যেরা খাবে আর আমার সন্তান পাবে না, সে হিংস্র হয়ে উঠে। গালাগালি করে তাড়িয়ে দেয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে পাড়ার ছেলে মেয়েরা ভিটে ও বাইরের গাছের আম তো কুড়িয়ে নিয়েছেই আবার নিয়ম মাফিক বাড়ির গাছের আম কুড়াতে এসেছে। সে এদেরকে গালাগালি করে তাড়িয়ে দিয়ে পশ্চিমের বিলে চলে গেল। শালজান বিল, প্রায় সম্পূর্ণ বিলটা তাদের। বিলটাকে খন্ড খন্ড করে পাড় তুলে ফিশারি করা হয়েছে। একটি পুকুরের মাছ বিক্রির জন্য জেলে নামানো হয়েছে। মাছ তোলা হবে শুনে পাড়ার বুড়ো পুলা সবাই জড়ো হল। আর নিজ নিজ পসন্দ মাফিক একটা দুটা মাছ নিয়ে যেতে লাগল। কেউ দুয়ের অধিক বা খুব বড় মাছ নিতে চাইলে তার চতুর্থ ভাইটা-যে একটু রাগী তা রেখে মানানসই মাছ দিয়ে বিদায় করে। কিন্তু নরম মেজাজের তৃতীয় ভাইটা বলতে থাকে আরে নিতে দে আল্লায় দিলে নিবে কয়টা। আসলে এ পরিবারের সব কিছুতেই পাড়া পড়শিরা ইজমালি সম্পত্তি মনে করে, নিজেদের অধিকার আছে বলে মনে করে। এর কারণ হচ্ছে দীর্ঘ কালের প্রাপ্তি। আর এর প্রচলন করে গেছেন তার বাবা। তিনি ছিলেন বিখ্যাত আলেম, বুজুর্গ মানুষ। তিনি বলতেন পাড়া প্রতিবেশীদের রেখে কোন কিছু খেতে নেই। এজন্যই দুধ, মাছ, ফল-ফলাদি ও অন্যান্য যা কিছু উৎপন্ন হত পরিমাণ করে প্রায় এক তৃতীয়াংশ দিয়ে দিতেন। এমনকি যতক্ষণ থাকত ততক্ষণ তিনিও দিতে থাকতেন অন্যরাও নিতে থাকত। দুধ সাধারণত কেউ কাউকে দেয় না। কিন্তু প্রতিদিন বিকালে দেখা যায় কেউ গ্লাস কেউ জগ নিয়ে এসে কম বেশি দুধ নিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই এ পরিবারের সম্পত্তিতে পাড়া পড়শিরা নিজেদের অংশীদার মনে করে। তাতে পরিবারের লোকেরাও যেমন খুশি আল্লাহ্ও তাদেরকে প্রতিদান দেয়।
হাসান বিল থেকে ফিরে ঘরে ঢোকার সময় দেখে সিঁড়ির উপর ছড়ানো ছিটানো ভাত, ভাতের থালা ও একটা বড় ভাজা কার্পু মাছ পড়ে আছে। তার ছোট্ট একটা ভাতিজী কাঁদছে আর বলছে, আমি মাছ খামু না নুডুলস খামু। কিন্তু অন্যবারের মত সে আদর করে তাকে কোলে তুলে নিল না, “হু তুই খাবি না, আরেক জন যে নিরুদ্দেশের দেশে পড়ে আছে সে কি এমন একটা মাছ পায়” মনে মনে বলে ঘরে গিয়ে বিষণ্ণ হয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকল। বসে বসে ভাবল, একটু শান্তির জন্য বাড়িতে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে তো দেখি মনের জ্বালা আরো বেড়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর সে খাতা কলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসল।
সন্তানের প্রতি,
মুনীরা, মা আমার, তুমি কোথায় আছ কেমন আছ, আমি তো কিছুই জানতে পারছিনা বাপ। এই যে, একটা আম কাঁঠালের সিজন যাচ্ছে তুমি কি আম, কাঁঠাল, দুধ ইত্যাদি পাচ্ছ কিনা তাও তো জানতে পারছি না। হায়! দুর্ভাগ্য আমার, আমি তো স্বচ্ছন্দে গোগ্রাসে সব কিছুই খাচ্ছি কিন্তু জানি না আমার সন্তান কি খাচ্ছে। মাগো আমার, তুমি কি জান তোমার কত প্রাচুর্য্য। তোমার বাড়িতে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, কলা, কামরাঙ্গা, দুধ, মাছ, ফল-ফসলের কত প্রাচুর্য্য কত সমৃদ্ধি, তা কি তুমি জান? আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শি, গ্রামবাসী এখান থেকে কি পরিমাণ নিচ্ছে খাচ্ছে তা কি তুমি জান মা ? মাগো তোমার সম্পদ মানুষ নিচ্ছে, খাচ্ছে, উপকৃত হচ্ছে কিন্তু তুমি কী করছ?
তুমি যদি না পাও তোমার ছোট্ট হৃদয়ে যদি অপ্রাপ্তির হাহাকার থাকে তাহলে বল মা আমি কী করব, কেন আমি বেঁচে থাকব, আমার বেঁচে থাকার স্বার্থকতা কোথায়? তোর সম্পদ রাজ্যির মানুষ ভোগ করবে, আর তুই যদি অতৃপ্তির বেদনায় হাহাকার করিস, অন্যের হাতের দিকে, মুখের দিকে তাকিয়ে থাকিস, অন্যেরটা দেখে যদি তোর চোখ না পাওয়ার বেদনায় সিক্ত হয়ে উঠে, তাহলে বল আমার এই জীবন, এই সম্পদ সমৃদ্দির কী মূল্য আছে ? এসব মনে হলে তো আমার মরে যেতে ইচ্ছে হয়, বেঁচে থাকার সকল সূত্র হারিয়ে ফেলি।
বাপ আমার, আমি জানি না তুমি কেমন আছ। কিন্তু তুমি ভাল আছ, দুধে-ভাতে, সুখে আছ আমার মনকে সব সময় এ প্রবোধ দিয়ে রাখি। অন্যথায় আমি যে বেঁচে থাকতে পারব না। অথচ নিজের জন্য না হলেও তোমার জন্য তো আমাকে বেঁচে থাকতেই হবে। মাগো আমি কেন এত অসহায়। নিজের সন্তানের কোন খোঁজ খবর পাচ্ছি না। আমার সোনার প্রতিমাকে এক নজর দেখতে পাচ্ছি না। হায়! আমার অদৃষ্ট। যারা স্বামী-স্ত্রী ও পিতা-সন্তানের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাল, যারা আমার কোল খালি করল তারা আর যাই হউক মানুষ হতে পারে না। আমি তাদের ক্ষমা করলেও আল্লাহ্ কখনো তাদের ক্ষমা করবেন না।
মা আমার, আমি কী করব, বল? তোমার জন্য ফোরকান ডাক্তারের দরজায় একমাস পর্যন্ত ধর্না দিলাম। তাকে অনেক বলে কয়ে তোমার বড় খালুর কাছে কয়েক বার পাঠালাম। কিন্তু সে নাকি ঠিক মত কথাই বলে না, অবশেষে জবাব দিয়েছে তোমাকে আমার নিকট দিবে না, তাহলে নাকি তার শালির মানে তোমার মায়ের কষ্ট হবে। তারপর আবার অনেক অনুনয় করে পাঠালাম যেন আমার মেয়েকে অন্তত দেখতে দেয়, দেখার একটু সুযোগ করে দেয়। আর তোমার জন্য কয়েক হাজার টাকা পাঠালাম। কিন্তু সেই শয়তান টাকাটা তো ফেরত পাঠালই, উত্তর দিয়ে দিল আমাকে দেখতেও দিবে না। কারণ আমি দেখতে গেলে নাকি তোমার মায়ের কষ্ট হবে, এ জন্য দেখতেও দিবে না। আর আমি যেন কোন দিন দেখার আশাও না করি। সেই যালিম তার শালির বিষয়টা চিন্তা করল কিন্তু আমার ও আমার সন্তানের বিষয়টা চিন্তা করল না। অবশেষে অনেক ভেবে চিন্তে গেলাম মোস্তফা জব্বারের কাছে। তোমার বড় খালুর সাথে তার ঘনিস্ট সম্পর্ক, দুজনে এক সাথেই তাবলীগ করে। সে বলল, তোমার বড় খালুকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে একটা সুরাহার চেষ্টা করবে। এখন আমি সেই আশায় বুক বেধে বসে আছি। সে কিছু দিনের সময় নিয়েছে। বাড়ি থেকে গিয়ে আমি সোজা তার কাছে যাব। দেখি আল্লাহ্ কপালে কী রেখেছেন। যাই হউক বাপ, তোমাকে ওরা যেখানেই রাখুক না কেন, আমি তোমাকে খুঁজে বের করবই ইংশাআল্লাহ। ভাল থাক মা, ভাল থাক। ইতি, তোমার ভাগ্যাহত বাবা।
বিষয়: সাহিত্য
১৮৫০ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন