চিঠি-3 (সত্য ঘটনা অবলম্বনে এক অনন্য ট্রাজেডি)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০৬ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:১৯:৫৭ দুপুর

হাসান রাত দশটায় ঘরে ফিরে দরজা খুলে সরাসরি ঘরের কোণায় গিয়ে বসল। সেখানে খেলনার একটা স্তূপ। পিকনিক থেকে নিয়ে আসা আরো দু’টি খেলনা সেখানে রেখে সেগুলি নাড়াচাড়া করতে লাগল, খালি হাতেই ধূলা বালি পরিষ্কার করতে লাগল এবং বাচ্চাদের মত খেলা শুরু করল। সে যখন যেখানে গিয়েছে কোন খেলনা দেখে পসন্দ হলে কিনে নিয়ে এসেছে। এভাবে একটি দু’টি করে কিনে আনতে আনতে ঘরের এক কোণায় স্তূপ বানিয়ে ফেলেছে। তার আশা একদিন মুনীরা আসবে সেগুলি দিয়ে খেলা করবে, তার চোখ জোড়াবে। কিন্তু কখন আসবে, কিভাবে আসবে। শত চেষ্টা করেও তো সে আনতে পারছে না। তার মেয়ে কোথায় আছে , কেমন আছে এতটুকুও জানতে পারছে না। হতভাগ্য বেচারা খেলনার পাশে বসে বসে অনেকক্ষণ কাঁদল। তারপর ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে খাতা কলম নিয়ে টেবিলে বসল।

সন্তানের প্রতিঃ

মুনীরা, বাপ আমার। তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ মা? এত যে অনুসন্ধান করছি, লোক লাগিয়েছি, মানুষের দোয়ারে দোয়ারে ঘুরছি তবুও এ সংবাদটা পাচ্ছি না তুমি ও তোমার মা কোথায় আছ। আসলে তোমার খালারা অনেকগুলি বোন। তাদের জীবন পদ্ধতি অনেকটা এলিয়েনের মত। এরা কোন সমাজ করে না, নিজেদের অহংকারের গরমে অন্যদের সাথে মিশে না, অন্যরাও তাদের সাথে মিশে না। তারা তোমার বড় খালা কেন্দ্রিক একটা সমাজ গড়ে তুলেছে। নারী শাসিত আলাদা একটা ভুবন তৈরি করেছে। সেখানে সমাজের অন্য কেউ যেতে পারে না। এমনকি নিকটাত্মীয়রাও না। এজন্যই তারা কি করছে, কে কোথায় আছে এসব খবর তোমার খালারা ব্যতীত অন্যরা জানে না। তাদের সমাজ পৃথিবীর রীতি-নীতি ও পদ্ধতির বাইরে একটা ব্যতিক্রমধর্মী সমাজ ব্যবস্থা যেখানে নারীরাই সর্বেসর্বা আর পুরুষরা হল স্ত্রৈণ এবং কৃতদাস।

বাপ আমার, বহুবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোমার খোঁজে আর কারো কাছে যাব না, কপালে যা আছে তাই হবে। কারণ, তোমার খালুদের কাছে গিয়ে পূর্বে বহুবার অপমানিত হয়েছি। আবার গেলে আমার আশংখা ওরা আমাকে দৈহিক আঘাত করবে। এজন্য একের পর এক অনেক লোক লাগিয়েছি তোমাকে পাওয়ার জন্য, অন্তত তোমার খবরটা জানার জন্য। কিন্তু ওরা এতটাই হিংস্র আর পশু যে, তোমার সংবাদ জানাবে তো দুরের কথা এ বিষয়ে কথাই বলে না। মামলা ব্যতীত আর কোন উপায় দেখতে পেলাম না। অবশেষে আমার এক বন্ধু যে বিখ্যাত আইন বিশারদ তার দ্বারস্ত হলাম। কিন্তু সে আমাকে নিরাশ করল। সে বলল, নয় বছর পর্যন্ত সন্তান মায়ের কাছে থাকবে, এটাই আইন। মামলা করে কোন লাভ নাই। আমি বললাম, কোথায় থাকবে সেটা পরে বুঝা যাবে, আমাকে তো দেখতে দিচ্ছে না। এর তো একটা বিহিত হওয়া দরকার। সে বলল, হ্যাঁ কোর্টে যখন হাজিরা দিতে আসবে তখন দেখতে পাবি। এর বাইরে দেখানোর কথা থাকল কিন্তু দেখালো না। এ জন্য তো আর বাচ্চার মাকে রিমান্ডে নেয়া যাবে না। কাজেই আমার সঠিক পরামর্শ হল, তুই সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে একটা সালিশির মাধ্যমে বিষয়টা সুরাহা কর। আমি বললাম, গণ্যমান্য থেকে জঘন্য পর্যন্ত সবাই তাদের ভয় পায়, কেউ তাদের ত্রিসীমানার কাছে ঘেঁষে না, কে করবে বিচার? আমি তো বহুত চেষ্টা করেছি, অনেক সম্মানী মানুষও লাগিয়েছি কিন্তু কেউ তাদের মুখ থেকে কথাটা পর্যন্ত বের করতে সক্ষম হয়নি। তাদের উপর বিচার করবে, ফয়সালা করবে এমন কাউকে আমি দেখছি না। কাজেই ভাই তুই দয়া করে মামলাটা করে দে, তারপর যা হবার হবে। সে বলল, এ ব্যর্থ মামলা আমি করতে পারব না। কারণ এ মামলাটা করলে আমাকে হারতে হবে অথচ জীবনে কোন মামলা আমি হারিনি। কাজেই তোর এত শখ থাকলে অন্য কাউকে দিয়ে করিয়ে নে, অগত্যা সেখান থেকে চলে এলাম।

তারপর অন্য অনেকের সাথে পরামর্শ করলাম কিন্তু কেউ আর সায় দিল না। অবশেষে মামলার চিন্তা বাদ দিয়ে আবার মানুষের দোয়ারে দোয়ারে হানা দিতে শুরু করলাম। অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করে গেলাম তোমার মায়ের চাচাত ভগ্নিপতি ফোরকান ডাক্তারের কাছে। সে বলল, ওরা তো অহংকারী, ওদের ভিতরের কথা বাইরের কারো জানার সুযোগ নেই। তবুও আপনার মেয়েকে না দিলেও অন্তত যেন দেখতে দেয় মানবিকতার খাতিরে সে চেষ্টা আমি করব। আমাকে কিছু দিন সময় দেন। এ কথার উপরই আমি তার কাছ থেকে ফিরে এলাম, আগামী শুক্রবারে যাওয়ার কথা, আশা করি তখন একটা ফয়সালা পাব।

আব্বু, আমার যে আর তর সইছে না। তুমি কবে আসবে। তোমার জন্য আমি কত জিনিস, কত কাপড়- চোপড়, খেলনা, আরো কত্তো কিছু কিনে রেখেছি। তুমি কাপড়-চোপড় পড়বে, খেলনা খেলবে আমি দেখব, হাসব আর হাততালি দিব।

আব্বু জানো, আজকে পিকনিকে গিয়ে ছিলাম। প্রতিবছর এই সময়টাতে আমাদের প্রতিষ্ঠানের সবাই মিলে পিকনিকে যাই। এবারও গেলাম। সবাই অনেক আনন্দ করল, অনেক খাওয়া দাওয়া হল। সকলেই নিজ নিজ গিন্নী ও বাচ্চাদের সাথে নিয়ে গিয়েছিল। বাচ্চারাই বেশি আনন্দ করল। কেউ ঘোড়ায় চড়ল, কেউ হাতির পিঠে চড়ল, কেউ ওয়াটারে নামল, কেউ আকাশ রেলে চড়ল। খাওয়ার সময় কত গপ্প, হাসাহাসি আর আনন্দ হল। আব্বু তুমি তো জিজ্ঞেস করলে না, আমি কেমন আনন্দ করলাম। হ্যাঁ আমার আনন্দ? আমি যখন দেখলাম, প্রত্যেকের বাচ্চারা কেউ পিতার কোলে চড়ে যাচ্ছে, কেউ হেটে, কেউ দৌড়াদৌড়ি ছোটাছোটি করছে, লাফালাফি করছে, এটা ওটা কিনে কিনে খাচ্ছে, বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিভিন্ন জিনিসে চড়ছে তখন তুমিই বল বাপ আমার মনের অবস্থাটা কেমন হতে পারে। যতক্ষণ স্পটে ছিলাম একটা বিষাক্ত কাটা যে অনুক্ষণ আমার কলজেটা বিদীর্ন করেছে। আমার বিষায়িত মন শুধু বারবার বলছে, আজ আমার মুনীরা থাকলে তো সেও এভাবেই আনন্দ করত, হাসাহাসি, দৌড়াদৌড়ি করত। এটা ওটায় চড়ত, খেলত, আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম খুশিতে আমার মনটা ভরে উঠত। কিন্তু আমি তো এমন এক হতভাগ্য বাপ যে অন্যের সন্তানদের আনন্দ দেখে অহর্নিশ শুধু হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করে চলেছি।

বাপ, আমার তো টাকা খরচ করার জায়গা নেই। আমাদের পিয়ন মুস্তফার ছেলেটা বার দুয়েক বাপের কাছ থেকে টাকা নিল। কিন্তু তারপর আর দেয় না, আসলে তার কাছে আর টাকা নাই। ছেলেটা আকাশ রেলে উঠার জন্য কান্নাকাটি করছিল। তা দেখে আমি উঠিয়ে দিলাম। নেমে এলে তার হাতে দুইশত টাকা দিয়ে বললাম, বাবু তোমার যেখানে যেখানে চড়তে মন চায়, যা খেতে মন চায় এ টাকা দিয়ে তাই কর, আরো লাগলে আমাকে বলবে, আমি দিব। তোমার বাবাকে দিতে হবে না। তারপর ছেলেটা অনেক আনন্দ করল, অনেক কিছু কিনে কিনে খেল। স্পট থেকে নিয়ে ফিরা পর্যন্ত সে একটা উচ্ছসিত আবেগের হাওয়ায় উড়ে বেড়াল। তা দেখে আমার মনটা কিছুটা হলেও শান্ত হল।

মা আমার, তুমি তো অবশ্যি পড়ছ। তুমি পড়ছ না বা পড়তে পারছ না আমি কখনো এমনটা স্বরণ করি না। কারণ তাহলে আমি হার্টফেল করে মারা যাব। আচ্ছা তুমি যে স্কুলে পড় নিশ্চয়ই সে স্কুল থেকে পিকনিকে যায়। তাদের সাথে তুমি ও তোমার মাও যাও, তাই না? আর সম্ভবত এমন তো কখনো হয়নি যে, টাকার জন্য তুমি যেতে পারনি বা গিয়ে টাকার অভাবে তোমার ইচ্ছা পূরণ হয়নি। কোন কিছু খেতে মন চেয়েছে অথচ খেতে পারনি, এমনটা শুনলে তো আমি মারা যাব বাপ, আমি মারা যাব। তোমার বাপ চাচাদের সম্পদ অন্যরা খাচ্ছে আর তুমি যদি থাক নিরন্ন, দিগম্বর, আশাভগ্ন তাহলে এ পৃথিবীতে আমার বেঁচে থেকে লাভ কি ?

যাক সেসব কথা, আমি আশা করি তুমি সুখে ও স্বচ্ছন্দেই আছ। আর বাপকে ভুলে বসে আছ। কিন্তু তোমার বাপ তোমাকে ভুলে নাই, ভুলতে পারে না, ভুলা সম্ভব নয়। কারণ বাপ কখনো সন্তানকে ভুলতে পারে না। কাজেই থাক বাপ, আমি আসছি। পৃথিবীর কোন সিংহের গুহা অথবা মুশিকের গর্তে কেউ তোমাকে লুকিয়ে রাখতে পাড়বে না- আমি খুজে বের করবই ইংশাআল্লাহ। তুমি আসার পর আমরা কিছু দিন পর পর বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাব, তোমার যত্তো জিনিস পসন্দ হয় সব কিনে কিনে আনব। এই যে দেখনা কত্তো খেলনা আমি তোমার জন্য কিনে রেখেছি। আরো অনেক খেলনা আনব। তোমার যা পসন্দ হয় তাই কিনে আনবে। খেলনা দিয়ে তোমার জন্য একটা ঘর সাজিয়ে দিব। ভাল থাক আম্মু, আমি শীঘ্রই আসছি। ইতি, তোমার হতভাগ্য বাবা।

বিষয়: সাহিত্য

১২৩৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

376135
১১ আগস্ট ২০১৬ দুপুর ০১:৪৬
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু! ভালো লাগলো জাযাকুমুল্লাহ্

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File