চিঠি-৩ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে এক অনন্য ট্রাজেডি)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০৫ এপ্রিল, ২০১৬, ০১:৩১:৫৭ দুপুর
মুনীরাদের বাসা থেকে প্রাইমারি স্কুল অনেক দূর। এ জন্য তার মা বাসার কাছে একটা কেজি স্কুলে তাকে ভর্তি করে দেয়। প্রতিষ্ঠান প্রধানকে বলে কয়ে তার বেতনটা ফ্রী করে দেয়। নিয়মানুযায়ি প্রতি বছর শীতকালে প্রতিষ্ঠানের শিশুদের শিক্ষা সফরে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে শর্ত হল প্রত্যেক শিশুর সাথে তার মা অথবা বাবাকে যেতে হয়। মা অথবা বাবা না গেলে একাকি কোন শিশুকে পিকনিকে নেয়া হয় না। মুনীরা ভর্তি হওয়ার পর স্কুল থেকে দু’বার শিক্ষা সফর হয়েছে। প্রথমবার সে ছোট ছিল বিধায় পিকনিক কাকে বলে বুঝত না। এ জন্য তার যাওয়ার আগ্রহ ছিল না।
দ্বিতীয় বছর সে যেতে চেয়েছে কিন্তু তার মা রাজি হয়নি। স্কুলে তার সাথীরা সবাই গেছে। তারা এসে আলাপ করেছে, পিকনক কত মজার জিনিস। তারা আকাশ রেলে, বাসে চড়েছে, সেগুলো নাকি আকাশ দিয়ে চলে। তারপর প্লাস্টিকের হাতি, ঘোড়ায় চড়ে বসেছে, তখন সেগুলো তাদেরকে নিয়ে চক্রাকারে ঘুরেছে, পিচল খেলেছে, পানিতে জাম্পিং খেলেছে। আরো কত মজার মজার খেলা খেলেছে। অনেক জীব-জন্তু দেখেছে। সেখানে নাকি একটা আয়না আছে এর সামনে দাঁড়ালে একটা মানুষের তিনটা মাথা দেখা যায়। এসব দেখে দেখে বিকালে যখন সবাই ক্লান্ত হয়ে গেছে এবং ক্ষিদে লেগেছে তখন সবাই একসাথে বসে গোশত, পোলাউ, বিরানি আরো কত মজার মজার খানা খেয়েছে।
এসব শুনে মুনীরা স্বপ্ন দেখে আগামীতে সেও পিকনিকে যাবে। এতদিনে নিশ্চয়ই তার আব্বু চলে আসবে, তখন তার আব্বুকে নিয়ে সে পিকনিকে যাবে। তার সাথীরা যেসব জিনিস দেখেছে, খেলেছে, খেয়েছে সেও সবগুলো দেখবে, খেলবে, খাবে, একটাও কম করবে না। তখন থেকে তার বাবার জন্য প্রতিক্ষার প্রহর গুনতে থাকে। আর মাকে বলতে থাকে, আম্মু আগামীতে কিন্তু আমিও পিকনিকে যাব। কিন্তু তার মা এগুলি গায়ে লাগায় না। কারণ মেয়ের হাজারটা বায়না কয়টা শুনবে সে। দেখতে দেখতে শীতকাল এসে গেল। ছোট শিশু স্কুলে যাওয়া আসার পথে তার বাবাকে খুঁজে। বাসায় এসে কান খাড়া করে রাখে, কখন তার বাবা আসবে। ওদিকে স্কুলে পিকনিকের চাঁদা তোলা শুরু হয়েছে এখনো তো তার বাবা এলো না।
অবশেষে সে অপারগ হয়ে মায়ের উপর আছড়ে পড়ল। মা প্রথম প্রথম বোঝাল পিকনিকে গেলে গুনাহ হয়, সেও উত্তর দিল সবাই যায় কেমনে, যে কাজে সবাই যায় সেটাতে গুনাহ হয় না, সওয়াব হয়।মেয়ের যুক্তি শুনে মা হাসে। তারপর বুঝাল পিকনিকে অনেক টাকা লাগে, এত টাকা পাব কোথায়। আমরা যে গরীব ঠিকমত খেতে পরতেই তো পারি না, টাকা দিব কোত্থেকে? মেয়ে কিছুই বুঝতে চায় না, জ্বালাতন শুরু করে দিয়েছে, মা কখনো শাসন করে, কখনো মারে, কখনো বুঝায় কিন্তু মেয়ে জেদ ধরেছে, সবাই যাবে, সে একা বাকী থাকবে কেন? সে যাবেই। অবশেষে মা অপারগ হয়ে হেড স্যারের কাছে গিয়ে আলাপ করে তার ফ্রী যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। সে গেল কিন্তু সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেই বিষণ্ণ ও থমথমে মুখে খাতা কলম নিয়ে টেবিলে বসল।
বাবার প্রতি,
আব্বু তুমি কেমন আছ। তোমাকে দেখতে আমার খুব মন চায়। কিন্তু তুমি তো আস না, তোমার বুঝি আমাকে দেখতে মন চায় না, কোলে নিতে মন চায় না? তাহলে অন্যান্য বাবুদের আব্বারা কেন তাদের বাবুদের কোলে নেয়, চুমু দেয়, আদর করে। তোমার কি মন চায় না? তোমার মন না চাইলেও তোমার কোলে উঠতে আমার খুব মন চায়। একটু আদর পেতে মন চায়। সবাই বলে তুমি আসবে, কই তুমি তো আস না। আমাদের স্কুলে কত অনুষ্ঠান হয়, সবার আব্বারা আসে কিন্তু তুমি আস না। কিছু দিন আগে খেলা হল, সবাই আসল শুধু তুমিই আসলে না। আব্বু জান, শিশুদের মধ্যে দৌড়ে আমি দ্বিতীয় হয়েছিলাম, আমাকে বড় স্যার একটা প্লেট প্রাইজ দিছে, সেটা পেয়ে কত আনন্দ আমার, তুমি যদি থাকতে তাহলে আরো আনন্দ হত।
আব্বু, আজ আমি পিকনিক থেকে এলাম। আমাদের স্কুলের সবাই গিয়েছিল। গত বছরও গিয়েছিল, কিন্তু আম্মু আমাকে যেতে দেয় নি। সব বাবুদের সাথে তাদের আম্মুরা যায় কিন্তু আমার আম্মু তো যায় না। এবারও আম্মু যাবে না আমাকেও যেতে দিবে না। আম্মু বলে আমরা তো গরীব। আমাদের এত টাকা নাই। এ জন্য গরীবদের পিকনিকে যেতে নেই। কিন্তু সবাই যাবে আমি যেতে পারব না বলে খুব কেঁদেছিলাম। তখন আম্মু গিয়ে হেড স্যারকে বলল, আর হেড স্যার বলল ঠিক আছে, আমি নিজ দায়িত্বে নিয়ে যাব। তারপর সকালে আম্মু আমাকে গাড়িতে তুলে দিতে আসল। এসে দেখি সবাই তাদের আম্মুদের কোলে বসে আছে। তা দেখে আমিও আম্মুকে যেতে বললাম, আম্মুর বোরখা ধরে কাঁদলাম। কিন্তু আমার কথায় যে তার চোখে ধুলা গেছে এজন্য শুধু চোখ মুছল, গাড়িতে এল না। আমাকে হেড স্যারের কাছে দিয়ে বাসায় চলে গেল। যাওয়ার সময় এক জায়গায় গিয়ে গাড়ি থামাল, সবাই নেমে গিয়ে কত কিছু খেল কিন্তু আমাকে কেউ কিছু দিল না।
তারপর আবার সবাই গাড়িতে উঠল। একটা জায়গায় গিয়ে গাড়ি থামল, এটাকে সবাই সাফারী পার্ক বলে। সেখানে নেমে সব বাবুরাই বাদাম, চানাচুর, ঝালমুড়ি আর এই যে বুতুলের পানি যেটা খেলে গলায় ধরে, এটা সবাই কিনে খেল। এবারও আমাকে কেউ কিছু দিল না। কেউ কেউ ঘোড়ায় চড়ল, আরো কত আনন্দ করল। আমি শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম। তারপর সবাই মিলে পার্কে ঢুকলাম সেখানে কত জাতের পাখি, মাছ, সাপ, কুমীর, উটপাখি, বানর হাতি আরো কত কিছু দেখলাম।
আব্বু তুমি উট পাখি দেখেছ? না দেখলে শুন, এটা গরুর মত বড়, বিশাল লম্বা লম্বা দুইটা ঠ্যাং, বাকানো সুপারি গাছের মত লম্বা গলা। আমি কাছে যাই নি, শুধু দূর থেকে দেখেছি। ফাহিমা বলেছে এগুলির কাছে মানুষ গেলে ঠুক্কর মেরে ধরে উড়াল দিয়ে আকাশে নিয়ে যায়, তারপর বসে বসে খায়। আব্বু সাবধান! তুমি কখনো উট পাখির কাছে যাবে না। তোমাকে খেয়ে ফেললে আমার কী হবে। আমি কাকে আব্বু ডাকব, কে আমাকে আদর করবে, কে আমাকে জামা-কাপড়, খেলনা কিনে দিবে, কে পিকনকে নিয়ে যাবে, না তোমার উটপাখি দেখার দরকার নাই। আমি দেখেছি সেই ভাল, এখন আমি তোমাকে বলব উটপাখি দেখতে কেমন।
তারপর গেলাম বানর দেখতে। লোহা পেচিয়ে পেচিয়ে বড় একটা খাচা বানাইছে, এই খাচার মধ্যে বানররা থাকে। কিন্তু অনেক বানর খাচা থেকে বেরিয়ে বাইরে ঘোরাফিরা করে। অন্য বাবুদের মত আমিও বানর দেখার জন্য যখন খাচার কাছাকাছি গেলাম। অমনি দেখি দুইটা বানর আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ইয়া বিশাল বড় বানরটা দাঁত কিড়মিড় করে আমাকে কামড়াতে আসছে। দেখেই ভয়ে আমি একটা চিৎকার দিয়ে দৌড়তে শুরু করলাম। আমি চিৎকার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়তে লাগলাম কিন্তু কেউ আমাকে ধারল না, কোলে নিল না। অনেকক্ষণ দৌড়ে যাওয়ার পর সামনে একজন মহিলা পড়ল, তার কোলে একটা বাবু, সে আমার পথ আটকিয়ে বলল কী হয়েছে মা, কী হয়েছে? আমি তাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম আর বললাম বানর আমাকে খেতে চায়। এ কথা শুনে মহিলাটি তার বাচ্চাকে নামিয়ে আমাকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল আর বলল, লক্ষ্মী সোনা, ভয় পায় না, বানর মানুষ খায় না সোনামণি। সে তোমাকে দেখে ভেংচি কেটেছে। তুমি হাত উঠিয়ে একটা থাপ্পড় দেখালেই পালিয়ে যেত। চল তো যাই, দেখি দুষ্ট বানরটা কোথায়? সে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল, তোমার আব্বু কোথায়? আমি বললাম, আমার আব্বু তো আমাকে দেখতে আসে না। কোথায় থাকে তাও জানি না, আমিও তো তাকে খুঁজি কিন্তু পাই না। একথা শুনে মহিলাটি অনেকক্ষণ পর্যন্ত কথা বলেনি। তারপর বলল, তোমার আম্মু কোথায়?
তখন দেখি আমাকে ডাকতে ডাকতে আমাদের ইংরেজি ম্যাডাম দৌড়ে আসছে। এসেই সে আমাকে কোলে নিল। আবার খাচার কাছে যেতেই আমাকে দেখে বাবুরা ও তাদের মায়েরা হাসতে লাগল। তখন ম্যাডাম বলল, এতটুকু একটা বাচ্চা বানর দেখে ভয়ে দৌড়ে গেল। কেউ তাকে ধরলেন না, এখন আবার দাঁত বের করে হাসছেন, আপনাদের লজ্বা করে না। সে আরো অনেকগুলি বকা দিল।
তারপর এক জায়গায় গেলাম, সেখানে হাতি, ঘোড়া, চেয়ার, আরো কত কিছু সাজানো। না, আসল হাতি ঘোড়া না, প্লাস্টিকের।সবাই সেগুলিতে গিয়ে বসল। তারপর তা ঘুরল। আমি বড় স্যারকে বললাম, স্যার আমিও গিয়ে বসব, তখন স্যার আমাকে ধ্মক দিল, আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তারপর সেখান থেকে আরেক জায়গায় গেলাম। সেখানে আকাশ রেল আছে। বোঝ নাই? মানে মাটি থেকে অনেক উপড়ে ট্রেন ঘোরে ঘোরে চলে। আমার সাথীরা সবাই গিয়ে ট্রেনে বসল, আমারও খুব মন চাইছিল। আমি আবারও স্যারকে বললাম, স্যার আমিও ট্রেনে উঠব। এবার স্যার রেগে ভ্যাংচি দিয়ে বলল, অ্যাঁ মেয়ের শখ দেখ, আমিও ট্রেনে উঠব। স্কুলের বেতন দিতে পারে না, আবার ট্রেনে উঠার শখ। শুনি এত স্বাধ তো তোর মা কয় টাকা দিয়েছে? যা তোর বাপকে নিয়ে আয় গিয়ে, তারপর ট্রেনে চড়। এত ভাল মানুষের মেয়ে হলে আর এ অবস্থা কেন?
স্যারের কথা শুনে কেউ কেউ হাসতে লাগল। আর কেউ কেউ আমার দিকে এমন ভাবে তাকাল যেন তারাও আমার সাথে কাঁদবে। আমার কান্না দেখে ইংরেজী ম্যাডাম এসে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল এসো মুনীরা কাঁদে না মা, চল আমি তোমাকে ট্রেনে নিয়ে যাচ্ছি। ম্যাডাম টাকা দিয়ে আমাকে তুলে দিল। কিন্তু তখন আর আমার ট্রেনে চড়ার একটুও আগ্রহ নাই। স্যার যে তোমাকে মন্দ বলল। এজন্য কষ্টে আমার বুকটা যেন ফেটে গেছে। ট্রেনে বসে বসে আমি শুধু কাঁদলাম। তারপর পিকনিক থেকে এসেই তোমাকে চিঠি লিখতে বসলাম।
আব্বু, তুমি আস না কেন? তাড়াতাড়ি আস। আর মনে রাখবা, আগামী পিকনিকে কিন্তু তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে। তারপর আমি সব কিছু কিনে কিনে ওদের দেখিয়ে দেখিয়ে খাব কিন্তু কাউকে দিব না। ওরা যেমন আমাকে দেয়নি আমিও ওদেরকে দিব না। না, না আমার মত যাদের টাকা নাই, কিনতে পারে না, তাদেরকে দিব। তারপর হাতি, ঘোড়া, ট্রেন যা কিছু আছে সব গুলিতে চড়ব আর তুমি দুরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসবে আর হাততালি দিবে, আমি তোমাকে টাটা দিব। আর হেড স্যারকে ডেকে বলব, স্যার চড়বেন আমার সাথে, বলব আর হাসব। তখন স্যারের মুখটা গুমরাহ হয়ে যাবে, ঠিক না আব্বু? তুমি ভাল থাক, আর আগামী পিকনিকের কথাটা মনে থাকে যেন। ইতি তোমার মুনীরা।
বিষয়: সাহিত্য
১৩৭২ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
লিখলেন, সত্য ঘটনা অবলম্বনে,
তাহলে ওর বাবা কোথায়??
বা কি হয়েছে??
মন্তব্য করতে লগইন করুন