চিঠি-2 (সত্য ঘটনা অবলম্বনে এক অনন্য ট্রাজেডি)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০২ এপ্রিল, ২০১৬, ১১:৩০:৩৮ সকাল

স্ত্রী বিচ্ছেদ আর সন্তানহারা হওয়ার পর থেকে হাসানের জীবনটা হয়ে উঠে ছন্নছাড়া, অগোছালো, রুটিন বিহীন এক আওয়ারা জীবন। খাওয়া, গোসল, ঘুম ইত্যাদির কোন নিয়ম নীতি থাকে না। এ জন্যই তার মা প্রতিবার ঈদের আগে তাকে ডেকে বাড়ি নিয়ে যায়। কারণ মা জানেন, সন্তান বিরহে ক্লিষ্ট তার ছেলে ঈদের দিনও না খেয়ে না নেয়ে বিছানায় পড়ে থাকবে। বাড়িতে গেলে মায়ের অনুশাসন, ভাই বোন ও তাদের সন্তানদের কোলাহলে তার সময় ভালই কেটে যায়। ঈদের নামাযের পর নিয়মানুযায়ি তাদের বাড়িতে দরিদ্র মানুষের ঢল নামে। এ নিয়ম তার পিতার আমল থেকেই চলে আসছে। ঈদের দিন এলাকার দরিদ্র মহিলা ও মেয়ে-ছেলেরা তাদের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করে। তাছাড়াও অন্যান্য সময় এলাকার মানুষের যার যা প্রয়োজন সাধারণত এ বাড়ি থেকেই পুরা করে। কারণ সে গ্রামে তাদের পরিবারটিই অবস্থাসম্পন্ন এবং দানশীল পরিবার হিসাবে খ্যাত। হাসান ঈদগাহ থেকে এসে কাপড় চোপড় খুলে কিছুক্ষণ পায়চারী করল। তারপর ভিতর বাড়িতে গিয়ে দেখল অনেক হৈ হুল্লা। সবাই গোশত পোলাউ খাচ্ছে, আনন্দ করছে। এ দৃশ্যটা তার কাছে খুবই মধুর, সে এই আনন্দটা উপভোগ করে। হাসি খুশিতে সে রান্না ঘরের কাছাকাছি গেল। আর তারপরই হাসিটা বিষাদে রুপান্তরিত হয়ে গেল। কারণ তাদের গ্রামেরই একজন মহিলা তার বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে খাওয়াচ্ছিল যার বয়স এবং দেখতেও অনেকটা মুনীরার মতই। কেউ যেন কালি হাতে তার মুখটার উপর একটা পোচ দিয়ে গেল এবং তার প্রফুল্ল হৃদয়ে শলাকাবিদ্ধ করে দিল। সহসাই হরিষে বিষাদ। এক হতভাগ্য বাবার মন তাকে স্থির থাকতে দিল না, ছোটে চলল, কোথায় চলল, কেন চলল সে জানে না। আল-বাতর, ক্ষেত, কাদা ভেঙ্গে সে ছোটে চলেছে উদভ্রান্তের মত।

বস্তুত সে বেঁচে থাকার জন্য একটা কৌশল অবলম্বন করেছে। মুনীরার বয়সী বাচ্চাদের পিতা মাতার কোলে বা কোন কিছু খেতে দেখলে সে দ্রুত অন্যদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। কারণ তখন নিজের সন্তানের কথা স্বরণ করে মনের আগুনে সে নিজেকে দগ্ধ করতে চায় না, সেই যন্ত্রনা সে ভুলে থাকতে চায়। কিন্তু সেই মেয়ে লোকটির কোলে বাচ্চাটিকে দেখে তার মুনীরার কথা স্বরণ হয়ে যায়। আর শুধু স্বরণ হলেই সে কাতর হয় না কিন্তু যখনই তার মনে হয় তার সন্তান ঠিকমত খেতে পরতে পারছে তো, তার সব চাহিদা পূরণ হচ্ছে তো? যদি না হয়, যদি সে অন্যের হাতের দিকে, মুখের দিকে, খাদ্যের দিকে তাকিয়ে থাকে তাহলে? এই তাহলে চিন্তাটাই তার সকল চিন্তা এলোমেলো করে দেয়। সর্বগ্রাসি নৈরাশ্যের ঘেরাটোপ তাকে একেবারে উন্মাদ করে দেয়, তার মনে যে ঝড় উঠে সেই ঝড় তাকে উড়িয়ে নিয়ে চলে। সে যেন তার সন্তানের কাছে যেতে চায়, তার সন্তান পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, কোন রাক্ষস-খোক্ষস বা কোহ কাপের দেও দানার গুহায় আটক থাকুক না কেন, তার মন তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে আসতে চায়, নিজের কোলে বসিয়ে তাকে খাওয়াতে চায়, পরাতে চায়, পৃথিবীর সব সুখ শান্তি তার উপর ঢেলে দিতে চায়। আর এ জন্যই সে বাতাসে উড়ে যেতে থাকে। কিন্তু তখন তার পা কোথা দিয়ে চলেছে, সে অনুভূতি তার থাকে না। তখন তার পদতলে আল, ক্ষেত, কাদা, জঙ্গল, ঝোপ-ঝাড় একাকার হয়ে যায়। হাসান যখন দেখল, শিশুটি তার মায়ের কোলে বসে খাচ্ছে তখনই তার মুনীরার কথা স্বরণ হল, আমাদের বাড়িতে কত লোক খাচ্ছে আমার মুনীরা খেতে পাচ্ছে তো, যদি না পায় ? এই চিন্তা তাকে নিয়ে চলল তার মেয়ের কাছে। বিগত কিছু দিন ধরে তার মধ্যে এ নতুন ব্যধি দেখা দিয়েছে।

তাদের বাড়ির দক্ষিণ পাশ থেকে শুরু হয়েছে দিক চক্রবাল ব্যাপ্ত মাঠ। বেচারা উদভ্রান্তের মত সেই মাঠ পাড়ি দিয়ে যাচ্ছে। ক্ষেত, কাদা, আল, খাল ভেঙ্গে সে ছোটে চলেছে। বিশাল মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে এক বিরাট বটবৃক্ষ, কাজের সময় কৃষক শ্রমিকরা এর ছায়ায় বিশ্রাম নেয়। সে ক্ষেত কাদা ভেঙ্গে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে সেই গাছের নীচে গিয়ে পৌঁছল। সর্বরিক্তের হাহাকার তাকে ঘাসের উপর শুইয়ে দিল। যন্ত্রনার দহন তার দেহ মন দাহ করে যাচ্ছিল কিন্তু প্রকৃতিতে বইছে ঝিরি ঝিরি বাতাস। আর এই বাতাসের পরশ ধীরে ধীরে তাকে ঠাণ্ডা করে তুলল এবং সে ঘুমিয়ে পড়ল।

দুনিয়ার এক বদবখত পিতা-আল্লাহ্‌ যাকে জীবনোপকরনের সব কিছুই দিয়েছেন কিন্তু ঈদের দিনেও তার ভাগ্যে এক মুঠি অন্য জুটল না। একটু আরামের বিছানা জুটল না, মাটি হল তার বিছানা। আবার তার সন্তান এক মুঠো খাদ্যের জন্য মানুষের ঘরে ঘরে কুকুর বিড়ালের মত বুভুক্ষু দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে ঘোরে। আর এ সবই হল বাঘিনীর মত হিংস্র এক অপরিনামদর্শি স্ত্রী এবং এমন লোকদের জন্য যারা আকৃতিতে মানুষ হলেও প্রকৃতিতে শয়তান।

মাগরিবের আযানে তার ঘুম ভাঙ্গল। উঠে বসল। কিন্তু প্রথমটায় সে বুঝতে পারল না সে কোথায় এবং কেন? যখন স্বরণ হল আবার তার মনটা বিষাদে ভরে উঠল। তারপর পরিশ্রান্ত ও অবসন্ন দেহে বাড়ির দিকে হাটা শুরু করল। ঘরে পৌছতেই মা আহাজারি শুরু করলেন। তার ছোট ভায়েরা গালাগালি শুরু করল “বেশি মেয়ে ওয়ালা হয়ে গেছে। এমন মেয়ে আর মানুষের নাই। মেয়ের জন্য জীবন দিয়ে দিতে হবে ? দুদিন আগে পরে মেয়ে তো বাপের কাছে আসবেই তাহলে এত ভাব কেন, দুদিন পর পর ভাব ধরে ধরে মাকে উপোস রাখা। এসব ভাব আর সহ্য হয় না ইত্যাদি ইত্যাদি।

হাসান বুঝতে পারল, তারই জন্য তার মা সারা দিন খায় নি, সে অনোসুচনায় মাকে জড়িয়ে ধরল এবং মায়ের কাঁধে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠল। মাগো, মা আমি তো বড় হয়েছি, আমার খাওয়া না খাওয়া আপনার দেখা প্রয়োজন পরে না। এরপরও যদি আমাকে রেখে না খেতে পারেন তাহলে আমার কোলের সন্তানকে রেখে আমি কেমনে খাই। আমি তো জানি না, আমার সন্তান আদৌ খেতে পাচ্ছে কি না, তার প্রয়োজন পুরা হচ্ছে কিনা। যদি জানতাম ওরা ধনী মানুষ, ভাল কোন অবলম্বন আছে, আমার মেয়ে ভাল আছে, সুখে আছে তাহলে একবারও তার কথা স্বরণ করতাম না। কিন্তু আম্মা বলেন, আমার মেয়ে কি ঈদের দিনে নতুন জামা কাপড় পেয়েছে, ভালমন্দ খেতে পাচ্ছে, তার ছোট্ট মনের আশা-আকাংখা গুলি পূরণ হচ্ছে ? তারপরই শুরু হল মা ছেলের কান্না।কিছুক্ষণ কান্নাকাটির পর তারা খেতে বসল।

হাসানের ছোট ভাইগুলি পিঠাপিঠি। ওরা সবাই তখনো ছাত্র। তাদের বৈশিষ্ট্য হল, যখন তারা একসাথে আড্ডা দিতে বসে তখন তাদের আলাপ শুনলে যে কেউ হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবে আর ভাববে তারা ভাই নয় বন্ধু-বান্ধব। তখন তারা বারান্দায় আড্ডা জমিয়েছে। একজন বলল, আচ্ছা মাজু ভাই, কওছাইন দেহি, একখান বউ গেছে তো দেশে কী বউয়ের অভাব পড়ছে। আমি অইলে কী করতাম জান, পর দিনেই বিয়া করে বউকে বলতাম, বছর বছর একটা করে বাচ্চা দিতে অইব। মেজু ভাই বলল, আরে দুঃ, ঐ গাধাটার কথা কইলে লাভ নাই, তার জন্য কত বিয়া দেখলাম কিন্তু সে মেয়েকে না এনে বিয়ে করবে না। আরে মেয়ের জন্য এতই যখন পাগল, তাহলে তুই ব্যাটা মেয়ে উৎপাদনের একটা মেশিন আন ঘরে। তারপর আমরা সবাই মিলে মিলাদ পড়ে দোয়া করে দেই আল্লাহ্‌ যেন বছর বছর একটা করে মেয়ে দিয়ে কয়েক বছরেই ঘর দোর গোয়াল ভরে দেয়। এভাবেই তাদের মধ্যে আড্ডা জমে উঠেছে।

মা প্রশ্ন করলেন, কত মানুষ বিয়ের আলাপ করে, বিয়েটা করে ফেল। হাসান বলল, বিয়ে মানুষ কয়টা করে ? মা রেগে গেলেন, কয়টা করে দেখস না? যাদের বউ মরে তারা কি বিয়ে ছাড়া থাকে? তাহলে তোর এত আপত্তি কেন? না, আগেও বহুবার বলেছি, আমার আপত্তি নাই। আগে আমি মেয়েটাকে আনি, তারপর আমার মেয়েকে যে মেনে নিবে তাকে বিয়ে করতে আমার আপত্তি নাই। কিন্তু মেয়েকে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত কোন আলাপ চলবে না।

খাওয়া দাওয়ার পর সে বারান্দায় গিয়ে চেয়ারে বসল। নিকষ কালো অন্ধকার। সেই অন্ধকারে এক হতভাগ্য বাপ নিজের ও সন্তানের ভবিষ্যৎ দ্বীপ শিখাটি হাতরে খোজে ফিরছে। তার দেহ, মন, মস্তিস্ক আচ্ছন্ন করে শুধু একটি ভাবনাই আবর্তিত হয়, কোথায় আছে তার সন্তান, কেমন আছে, তার খাওয়া, পরা, চাহিদা সব ঠিক আছে তো। চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ে। মধ্যরাতে ঘরে গিয়ে খাতা কলম নিয়ে টেবিলে বসল।

বিষয়: সাহিত্য

১১৮৩ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

376133
১১ আগস্ট ২০১৬ দুপুর ০১:৩২
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু! বাস্তবতার কঠিন রুপ। জাযাকুমুল্লাহ্

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File