চিঠি-2 (সত্য ঘটনা অবলম্বনে এক অনন্য ট্রাজেডি)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ৩০ মার্চ, ২০১৬, ০৯:৪৬:২১ সকাল
ঈদের দিন সন্ধ্যা। মুনীরার মা কোলের মেয়েটিকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে কণ্ঠনালীতে ফেনায়িত হয়ে উঠা কান্নায় বিষণ্ণ ও নিরুৎসাহিত কণ্ঠে বারবার বলছে পড়তে বস, পড়তে বস। স্কুল বন্ধ তার উপর ঈদের দিন। কাজেই পড়ার জন্য নয়, মেয়েটির অস্থিরতা দেখে সহ্য করতে না পেরে সে বারবার এই হুকুম দিচ্ছে। অগত্যা মুনীরা বই খুলে বসল, তার দৃষ্টি বইয়ের পাতায় কিন্তু মন ও মনোযোগ পড়ে আছে বাইরে, কারো পদধ্বনি শুনা যায় কিনা। সহসা বাইরে কিছু একটা শব্দ হল। সে চমকে উঠে দৌড়ে দরজায় গেল। ছিটকিনি খুলে অন্তহীন তৃষিত দুটি চোখ বিস্ফারিত করে বাইরে তাকাল। কিন্তু নির্জন প্রান্তরে ছুনছান নীরবতা, কেউ নেই। ছোট্ট হৃদয়টি সীমাহীন ব্যাথা ও বেদনায় ভরে উঠল, কষ্টে তার বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছে, সাথে সাথে কেঁদে ফেলল শিশুটি। সে দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কাঁদল। তারপর তার অবসন্ন দেহের ভার বইতে টলমলিয়ে উঠা ছোট্ট দুটি পা ফেলে এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে, খাতা কলম নিয়ে লিখতে বসল।
বাবার প্রতি,
আব্বু, আব্বু গো, তুমি তো এলে না। রোযা গেল, আজ ঈদের দিন চলে গেল তবু তুমি এলে না। আমি তো তোমার পথের পানে চেয়ে থাকতে থাকতে মরেই যাব। রোযার মধ্যে আমাদের বাসার আশে পাশের বাবুরা কত মজার মজার জিনিস খেয়েছে। তাদের আব্বুরা বাজার থেকে ফল, মিষ্টি, দই, মাখন আরো কত কিছু কিনে এনেছে। আর বাবুরা ইফতারির সময় তাদের মা বাবার সাথে বসে ইফতার করেছে, কত মজার মজার জিনিস তারা খাইতে খাইতে আর খায় না, ফেলে দিয়েছে, কুকুর বিড়ালকে দিয়েছে। কিন্তু আব্বু আমি যে পাই না, এগুলো খেতে আমার যে ভীষণ মন চায়। সানজিদার সাথে খেলার ছল ধরে আমি তাদের বাসায় যেতাম। তখন তার মা সানজিদার সাথে আমাকেও অনেক মজার মজার ইফতার দিত, আমার যে কি আনন্দ লাগত, আমি খুবই মজা করে খেতাম। কিন্তু কয়েক দিন বাদে আম্মু আর আমাকে যেতে দেয় না, ঘরে আটকে রাখে, আমি যেতে চাইলে মারে। কারণ সানজিদার মা নাকি আম্মুকে কী বলেছে। আম্মু কোন দিন ইফতার করে এক মুঠো মুড়ি দিয়ে, কোন দিন ভাত দিয়ে আর তখন আমাকে দু’য়েক লুকমা দিত। কিন্তু এসব একটা ইফতারি হল ? অন্য বাবুরা কত মজা করে তাদের আব্বুর কোলে বসে বসে খায়, কিন্তু আমি পাইনা কেন আব্বু ? বল আব্বু বল, কেন পাইনা, এসব স্বাদের জিনিস পাই না কেন? কবে পাব আব্বু বল? কবে তুমি এসব জিনিস নিয়ে এসে আমাকে কোলে নিয়ে মুখে তুলে খাওয়াবে।
জান আব্বু, ঈদের কয়েক দিন আগ থেকে সকলেরই নতুন জামা-কাপড়, জুতা, নেইল পালিস, ঠোঁট পালিস, কাজল, সাজনপাতি, খেলনা আরো কত কিছু কিনার ধুম পরে গেছে। সানজিদারা, তামান্নারা, ডলিরা, সবাই কত্ত কিছু যে কিনেছে তুমি গুনে শেষ করতে পারবে না। সবাই তাদের আব্বু আম্মুর সাথে মার্কেটে গিয়ে নতুন নতুন জিনিস কিনে এনেছে। আমি গেলে তারা সেগুলো আমাকে দেখায়, আনন্দ করে কিন্তু নতুনত্ব ভেঙ্গে যাবে বলে তারা সেগুলি গায়ে দেয় না, ঈদের দিন গায়ে দেবে। তারা আমাকে কোন কিছু ছুতে দেয় না। আমি আম্মুকে কতবার বলেছি, কত কান্নাকাটি করেছি। কিন্তু আম্মু তো আমাকে কোন কিছুই কিনে দিল না। আমি কোন কিছু চাইলেই কোন সময় আমাকে বকে, কোন সময় মরতে বলে, কোন সময় আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আঁচল দিয়ে চোখ মুছে। আচ্ছা আব্বু বলতো আমার কথায় কি ধূলা বালু আছে নাকি? আমি কোন কথা বললেই আম্মু মুখ ঘুরিয়ে চোখ মুছে। যেন আমার কথা থেকে তার চোখে ধূলা বালু ঝড়ে, আম্মু এমন করে কেন? আমার ভাল লাগে না।
আব্বু জান, আমার তো একটাই জামা তাও ছেড়া, আম্মু সেলাই করে দিয়েছে। আর আম্মু যে মানুষের কাপড় সেলাই করে- সেখান থেকে ছোট ছোট টুকরা জোড়া দিয়ে কয়েকটা হাফপ্যান্ট বানিয়ে দিয়েছে। এই হল আমার ঈদের জামা কাপড়। আমার তো কিছু নাই। তাই অন্যান্য বাবুদের জামা কাপড় দেখে আনন্দ পাই। একটু ছোয়ে দেখতে মন চায় কিন্তু ওরা আমাকে ছোতে দেয় না। ফাহিমার জামাটা একটু ছোয়ে ছিলাম বলে আমাকে মেরেছিল।
আব্বু জানো, ঈদের দুই দিন আগে থেকে সবাই তাদের আব্বু আম্মুর সাথে নিজ নিজ দাদু বাড়ি চলে গেছে, তাদের কত্ত মজা, তাই না? গাড়ি এসেছে, আব্বুর কোলে চড়ে তারা দাদু বাড়ি যাবে, সেখানে ঈদ করবে। দাদা, দাদু, কাকা, কাকীরা তাদেরকে কত আদর করবে, কোলে নিবে, কত কিছু কিনে দিবে, কত কিছু খাবে। কত আনন্দ তাদের, কত আনন্দ। কিন্তু আব্বু আমাকে কেউ কোলে নেয় না। আদরও করে না।
ঈদের দিন সকালে আম্মু একটু সেমাই পাকাইছিল কিন্তু তাতে মিঠা হয়নি খালি লবণ লবণ লাগছে, আমি খেতে পারিনি। আমার খেলার সাথীরা সবাই চলে গেছে, শুধু তানিয়ারা আছে। আমি সকালে একটু সেমাই খেয়ে খেলার জন্য বের হলাম। কিন্তু কোথায় যাব, সবাই তো চলে গেছে তাই তানিয়াদের বাসায় গেলাম। তার মা তাকে গোসল করিয়ে খাইয়ে দাইয়ে, সাজিয়ে টুক টুক করে দিয়েছে। তার আব্বা সেজে গুজে ঈদগাহে যাচ্ছে। যাবার সময় তানিয়াকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল আম্মু তোমার জন্য কি কি আনব ? সে এত্তোগুলো জিনিস আনতে বলল। তার আম্মুও সাজ গোজ করে ঘুরতে লাগল। আমি আর তানিয়া কিছুক্ষণ ঘুরলাম, খেললাম, আর রাস্তায় তাকিয়ে তাকিয়ে তামাশা দেখতে লাগলাম। বাবুরা তাদের আব্বুদের সাথে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, কত কিছু কিনে নিয়ে যাচ্ছে, বাঁশি বাজাচ্ছে, বেলুন, ফুটকা ফোলাচ্ছে, ফটকা ফোটাচ্ছে, কেউ কেউ গান বাজাচ্ছে, দল বেধে নাচছে, কত আনন্দ করছে। ঈদ শেষ হলে তানিয়ার আব্বু তার জন্য অনেক কিছু কিনে নিয়ে এল, তাকে কোলে নিয়ে চুমু দিল, আদর করল। তারপর বাসায় চলে গেল। আমিও সাথে সাথে গেলাম।
ওর আম্মু মজার মজার অনেক রান্না করেছে, নাকে কত সুন্দর ঘ্রাণ লাগছে। তারা সবাই খেতে বসল। তাদের খাওয়ার টেবিলটা মজার মজার খানায় ভরপুর। আমার খেতে খুব ইচ্ছে করছিল। সেই কোন সকালে একটু সামান্য সেমাই খেয়েছিলাম, এখন ভীষণ ক্ষিদে লেগেছে। ওরা খাচ্ছে কিন্তু আমাকে দিল না। ওদের বিড়ালটাকে এক বাটি খাবার দিল। কিন্তু আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। আব্বু একটা কথা বলি, আম্মুর মত রাগ করবে না তো ? আমার না এমনই ক্ষিদে লেগেছিল যে, মন চাইছিল ঐ বিড়ালটার খানাটা আমি খাই। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম, যদি ওরা বাটিতে করে বিড়ালটার মত আমাকেও একটু খেতে দেয়। কিন্তু না, দিল না। তানিয়ার আম্মু চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠল, এই পুনাই যাও ঘরে যাও। ওর মা কোথায়, বাচ্চাকে অন্যের ঘরে পাঠিয়ে দেয় লজ্বা করে না।
ওর বাঘের মত গলা শুনে আম্মু ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে ডাকতে লাগল। আমি বেরিয়ে গেলে আম্মু আমাকে কোলে নিল। আমি বললাম, ওরা কত মজার মজার খাবার খাচ্ছে আমাকেও খেতে দাও। আম্মু ঘরে এসে বিছানায় বসে আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করল ওরা তোকে কিছুই খেতে দেয় নি? আমি বললাম, না। আম্মু আমাকে বুকে জরিয়ে ধরে মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে নিল। কিচ্ছুক্ষণ পর দেখি আম্মুর শরীর কাঁপছে আর আমার মাথায় ও পিঠে পানি পড়ছে। আমি মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি আম্মু কাঁদছে। আম্মু আমার মুখের দিকে একটু ক্ষণ তাকিয়ে আমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে ধপাস করে বিছানায় পরে গেল। আর ছটপট করতে লাগল। আব্বু, মুরগী জবাই করে দিলে যে ভাবে ধাপড়ায় আম্মু সেভাবে ধাপড়াতে লাগল। আর চিৎকার করে বুকে মাথায় হাত মারতে লাগল আর কীসব বলতে লাগল, আমি অভিশপ্ত, আমি কলঙ্কিনী, আমি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছি, আমি নিজ হাতে আমার কপালে আগুন লাগিয়েছি---- আরো কত কিছু বলতে লাগল। আম্মুর কান্না দেখে আমারও কান্না পেল, আমিও কাঁদতে লাগলাম। আমার বোনটাও ঘুম থেকে উঠে কাঁদতে লাগল। তারপর আম্মু উঠে আমার বোনটাকে দুধ খাওয়াতে লাগল। আমাকেও কোলে তুলে নিয়ে আমার চোখ মুছে দিল, চুমু খেল, আদর করল। তারপর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলতে লাগল লক্ষ্মী সোনা আমার, আমি তো তোমাকে কিছুই দিতে পারলাম না, আমি যে গরীব। কিন্তু আম্মু দেখ, তোমার আব্বু তোমার জন্য সব কিছু নিয়ে আসবে। তোমার আব্বুর অনেক টাকা। তানভীর সানজিদা ওদের যে কারো চেয়ে তোমার আব্বুর আরো অনেক বেশি টাকা। তোমার দাদু বাড়িতে অনেক জিনিস আছে, অনেক ফল-ফলাদি, দুধ, মাছ তুমি খাবে কত। তোমার আব্বু বলত, আমার একটা মেয়ে, খাবে কয়টা ফেলবেই তো বেশি। তোমার দাদুরা যে অনেক বড় লোক। তোমার দাদু, তোমার কাকারা যে তোমাকে অনেক আদর করত। কিন্তু কপাল দোষে আজ আমার এই অবস্থা। আম্মু দেখ তারা সবাই আসবে, তোমার জন্য অনেক কিছু নিয়ে আসবে, অনেক জামা কাপড়, অনেক খেলনা, অনেক খাবার আনবে। তারপর তুমি দাদু বাড়ি গেলে কত কিছু দেখবে, খাবে, আনন্দ করবে। সবাই তোমাকে আদর করবে, কোলে নিবে, অনেক মজা হবে।
আব্বু জানো, আম্মুর কথা শুনে আমি পাগলের মত হয়ে গেলাম। তোমার জন্য আমার মনটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল। আমি আম্মুকে জিজ্ঞেস করলাম কই আব্বু তো আসে না, কখন আসবে? আম্মু বলল সময় হলেই আসবে। সানজিদা তানভীর আরো অন্যরাও বলে তুমি নাকি আসবে, আমার জন্য জামা কাপড়, খেলনা, অনেক মজার মজার খাবার নিয়ে আসবে। এজন্যই তো আমি সারাদিন তোমার পথের দিকে তাকিয়ে থাকি। আজকে ঈদের সারাটা দিন তোমার পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেটে গেল। এখন রাত তবুও তুমি এলে না। আব্বু এখনো কি তোমার আসার সময় হয় নি? কখন হবে, আমি কেঁদে কেঁদে মরে গেলে তারপর?
আব্বু তোমাকে দিব্বি দিয়ে বলছি তুমি তাড়াতাড়ি আস। তোমার জন্য আমার পরান পুড়ে যাচ্ছে। আর যদি দেরি কর তাহলে কিন্তু তুমি আসার পর আমি গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। তোমার সাথে একটা কথাও বলব না। আর হ্যাঁ, আসার সময় আমার জন্য বেশি করে ইফতার কিনে আনবে, আরো আনবে জামা-কাপড়, খেলনা, ফল, মিষ্টি, আর জানি কি... আর জানি কি... মনে নেই। আচ্ছা তুমি যা পাও সব আমার জন্য কিনে নিয়ে আসবে- সাবধান ভুল হয় না যেন। আব্বু তুমি ভাল থাক এবং তাড়াতাড়ি আস। ইতি, তোমার আম্মু মুনীরা।
বিষয়: বিবিধ
১৪২১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন