চিঠি-১ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে এক অনন্য ট্রাজেডি)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৮ মার্চ, ২০১৬, ০৯:৩৪:৪৮ সকাল



ছোট্ট মেয়ে মুনিরা। ঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। আর তার মা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ মুচছে। অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করে সে আবার গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করল, মা আব্বু কেন আসে না? আমাকে কোলে নিয়ে আদর করে না। তার মা আবার ক্রোধে তার নাকে, মুখে ও পিঠে কয়েকটি থাপ্পড় মেরে ঝাঝালো কণ্ঠে বলল- মরতে পারিস না কপালপুরী, তোর মরণ নাই, আজরাইল তোকে চোখে দেখে না...। মুনীরা মেঝেতে পড়ে আবার কাঁদতে লাগল। অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করে ক্লান্ত হয়ে উঠে গেল। তারপর স্কুল ব্যাগ খুলে খাতা কলম বের করে বাবার উদ্দেশ্যে চিঠি লিখতে বসল।

বাবার প্রতি,

আব্বা, আব্বা গো, তুমি কোথায়? তুমি কেন আস না, আমাকে কোলে নাও না, আদর কর না, চুমু দেও না। সবারই তো আব্বা আছে। তারা তাদের বাবুদের কোলে নেয়, আদর করে, চুমু দেয়, সদাই কিনে দেয়, ফল কিনে দেয় তাদের কত আনন্দ। আমারও তো তোমার কোলে উঠতে মন চায়। তুমি আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরবে, আদর করবে, চিপস, বাদাম, চানাচুর, আঙ্গুর, আপেল, মিষ্টি কত্ত কিছু কিনে দিবে। আমি খাব আর দুষ্টুমি করব, কিন্তু দুষ্টুমি করলে তুমি ধমক দিবে না, কোলে নিয়ে চুমু দিবে, বুকে জড়িয়ে ধরবে, কত মজা হবে। তাহলে কই তুমি আস না কেন? আব্বু তুমি কী রাগ করেছ? আমার বুঝি তোমার কোলে উঠতে মন চায় না? সারাক্ষণ আমি তোমাকে খুঁজি, তোমার জন্য কাঁদি। অন্যরা যখন তাদের বাবুদের কোলে নিয়ে ঘোরে, আদর করে তখন আমার খুব খারাপ লাগে, তখন তোমাকে খুঁজি, না পেয়ে ঘরে এসে কান্না করি। আব্বু তুমি তাড়াতাড়ি আস, নইলে কিন্তু আমি রাগ করব। তারপর আসলেও কথা বলব না, তোমার সাথে রাজ্যির আড়ি।

আব্বু জানো, আজকে না আমাদের ক্লাসে অনুষ্ঠান হয়েছে। আমি আর আদনান ক্লাস ওয়ানে বৃত্তি পেয়েছি। ওমা আদনানের আব্বু আম্মু এত্তোগুলি প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে এসেছে। সব ছাত্ররা ও স্যারেরা খাইছে, আমিও খাইছি। আব্বু জানো আদনান কেমন দুষ্টু? সে সারাক্ষণ শুধু দৌড়াদৌড়ি করেছে, ওর মা বাবা আসছে, মিষ্টি নিয়ে আসছে বলে সে যেন রাজা হয়ে গেছে। সে ছাত্রদের কারো মাথায় টুল্লুস মারে, কারো গালে ঠুক্কুর মেরে চলে যায়, কখনো প্যাকেট থেকে মিষ্টি এনে এনে তার বন্ধুদের দেয়, কখনো দুষ্টুমি করে দৌড়ে গিয়ে তার আম্মুর কোলে উঠে, কখনো তার আব্বুর কোলে। আজকে অনুষ্ঠান বলে স্যারেরা তাকে কিচ্ছু বলে নি। তার আব্বু আম্মু দুষ্টামি দেখে খালি বলেছে, আদনান দুষ্টামি করে না, এতুকু বলে তাকে কোলে নিয়েছে, কোলে বসিয়ে মুখে তুলে তুলে মিষ্টি খাওয়াইছে। এটা দেখে আমার মনে খুব খারাপ লাগছে। তোমার কোলে বসে বসে মিষ্টি খাইতে আমার খুব ইচ্ছা করছিল। আমি কয়বার আম্মুর কোলে উঠতে চাইছি কিন্তু আম্মু আমাকে কোলে নেয় নি, সে তো এক জায়গায় ভূতের মত দাঁড়িয়ে ছিল, নাড়াচাড়াও করেনি। একটি কথাও বলেনি। আম্মুকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদনানের আব্বু বলল কী ব্যাপার আমরা কি মুনীরার মিষ্টি খাব না, ওর আব্বু কোথায়? আম্মু কোন কথা বলল না কিন্তু হেড স্যার তাকে আস্তে আস্তে কি জানি বলল। তখন সে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকাল, আমি আম্মুর বোরকায় মুখ লুকিয়ে রাখলাম। আচ্ছা আব্বু অনেকেই আমার দিকে এভাবে তাকায় কেন? আমার কিন্তু একদম ভাল লাগে না, খুব খারাপ লাগে। তারপর আদনানের আব্বু আমাকে ডাকল কিন্তু আমি যাইনি। তারপর সে উঠে এসে আমাকে নিয়ে কোলে বসিয়ে মিষ্টি খাওয়াল, আদর করল, মাথায় হাত বুলিয়ে দিল আর বলল, মুনীরার বাপ না আছে তো কী হয়েছে, আমরা তো আছি, আমরা তো ওর বাবার মতই। এ কথা বলে সে আমার থুতনি ধরে তার মুখের দিকে ঘুরিয়ে বলল, মুনীরা আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে – এটা বলে সে আমার মাথায় হাত বুলাতে থাকল। কিন্তু এসব আমার ভাল লাগে নি। সে বলল মুনীরার বাপ না আছে তো কি হয়েছে। এটা শুনেই আমার পিত্তিটা জ্বলে গেল, বেটার সাহস কত আমার আব্বুকে নাই বলে। আমার এমন রাগ হচ্ছিল না যে, মন চাইছিল বেটাকে পাঁচটা চিমটি কেটে দেই।

আব্বু জানো, আদনান বৃত্তি পেয়েছে বলে তার আব্বু আম্মু তাকে নতুন জামা-কাপড়, নতুন জুতা-মোজা, স্কুল ব্যাগ, একটা স্বর্ণের কলম, একটা স্বর্ণের পিচ্ছি সাইকেল কিনে দিয়েছে। এগুলি নিয়ে সে কী বাহাদুরী আর কী গপ্প। সে কী গপ্প করে জানো, হলুদ রঙের যে নতুন কলমটা সে এনেছে সেটা নাকি স্বর্ণের, সারা দুনিয়াতে নাকি একটা কলমই ছিল সেইটা তার বাবা তার জন্য কিনে এনেছে। আরো তাকে নাকি ছোট্ট স্বর্ণের একটা সাইকেল কিনে দিয়েছে। এই সাইকেলে চড়ে সে নাকি বাস, ট্রাক, রেলগাড়িকে পিছনে ফেলে দেয়। সে যখন হাত ছেড়ে সাইকেল চালায় তখন নাকি বাতাসকে পিছনে ফেলে দেয়। তার সাইকেলটা নাকি বেশি চালু করলে পাখির মত উড়তে পারে, আরো কত কী গপ্প। এখন নাকি তার আব্বু তাকে বলেছে, ক্লাস টুতে বৃত্তি পেলে তাকে একটা এ্যারোপ্লেন কিনে দিবে। তারপর সে এ্যারোপ্লেন দিয়ে তার নানা বাড়ি যাবে, দাদু বাড়ি যাবে। আর এ্যারোপ্লেন দিয়ে গাছে উঠে আম, জাম, কলা, লিচু পেড়ে খাবে। কিন্তু আব্বু আমি সত্যি বলছি, সে এ্যারোপ্লেন পেলে মানুষের গাছে একটাও আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, কলা থাকবে না। সে এ্যারোপ্লেন দিয়ে মানুষের গাছে গাছে উঠে সব কিছু চুরি করে নিয়ে যাবে। এই যে আমাদের বাসায় নারিকেল গাছটা আছে না, সে একটা নারিকেলও আস্ত রাখবে না। সবগুলি এ্যারোপ্লেন দিয়ে চুরি করে নিয়ে খেয়ে ফেলবে। সে তো একটা চোর। একবার সে কি করেছিল জানো, ফারজানার ব্যাগে দশটা লজেন্স ছিল, সে চুপি চুপি একটা একটা করে নিয়ে পাঁচটা লজেন্স খেয়ে ফেলল। ফারজানা টের পেয়ে বলল, তুই আমার লজেন্স খেলি কেন, এখন কিনে দে। কী বাটপার দেখ, সে উত্তর দিল- এগুলো আমার লজেন্স, কিনে তোর ব্যাগে রেখেছিলাম। তখন ফারজানা কাঁদতে কাঁদতে স্যারকে গিয়ে বিচার দিল। স্যারকে দেখেই সে কান্না শুরু করল। তখন স্যার এসে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, কাঁদে না বাবু, কাঁদে না, এগুলি তোমারই ছিল। তারপর ফারজানাকে নিয়ে গিয়ে স্যার তাকে পাঁচটি লজেন্স কিনে দিল।

আব্বু সে কত মজা করতেছে, আর আমার তো কিছুই নেই, যা আছে সব পুরান। আমাকে তো একটা জামাও কিনে দিলে না। আম্মুকে বললে সে কিছুই বলে না, শুধু মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আঁচল দিয়ে চোখ মুছে। আব্বু আমি তোমাকে দিব্যি দিয়ে বলছি, তুমি যেখানেই থাক তাড়াতাড়ি আস। আর আসার সময় মনে রাখবে, আমার জন্য নতুন জামা কাপড়, জুতা, মোজা, একটা স্বর্ণের কলম, একটা স্বর্ণের এ্যারোপ্লেন নিয়ে আসবে কিন্তু। আর যদি তাড়াতাড়ি না আস, আর আসার সময় আমার এই জিনিসগুলি না নিয়ে আস-তাহলে আমি তোমার সামনে আসব না, গিয়ে লুকিয়ে থাকব। আর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখব তুমি আমার জন্য কিভাবে কাঁদ। তুমি ভাল থাক এবং তাড়াতাড়ি আস। ইতি, তোমার আম্মু মুনীরা।

বিষয়: বিবিধ

১২৭১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

363944
২৯ মার্চ ২০১৬ রাত ০১:১৪
শেখের পোলা লিখেছেন : ভাল লাগল৷ ধন্যবাদ৷
376131
১১ আগস্ট ২০১৬ দুপুর ০১:০০
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু! ভালো লাগলো জাযাকুমুল্লাহ্

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File