আল-কোরানের কাঠগড়ায় বিভক্তিবাদ- ১২
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১১:১৮:১৯ সকাল
শিরক মিশ্রিত ঈমান-
وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُم بِاللَّهِ إِلَّا وَهُم مُّشْرِكُونَ ﴿يوسف: ١٠٦﴾
অনেক মানুষ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, কিন্তু সাথে সাথে শিরকও করে। (১২: ১০৬)
كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ = মুশরিকদের জন্য এ বড় কঠিন ব্যাপার যার প্রতি তুমি তাদের আহ্বান করছ!
ব্যাখ্যাঃ- কোরানের অনুবাদ হয় না, বিশেষত উক্ত আয়াতটির যথার্থ বঙ্গানুবাদ সম্ভব নয়। আয়াতটি মা ও ইল্লা দ্বারা হসর- সীমাবদ্ধকরণ হয়েছে অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষ ঈমান আনে বটে কিন্তু তারা শুধুই মুশরিক তথা ঈমান আনার পরেও মুশরিক থেকে যায় বা শিরকে লিপ্ত থাকে। পৃথিবীর প্রায় সকল মানুষ এ ক্ষুদ্র আয়াতটির অন্তর্ভুক্ত। কারণ পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ আস্তিক কিন্তু মুশরিক। যেমন অমুসলিমদের যদি প্রশ্ন করা হয়, (وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ) [سورة لقمان: 25/ سورة الزمر:38] অর্থাৎ আসমান যমিন কে সৃষ্টি করেছেন অবশ্যি কাফেররা বলবে আল্লাহ। যদি বলা হয়, من خلق السماوات؟ قالوا: الله. وإذا سئلوا: من خلقهم؟ قالوا: الله. وهم يشركون به بَعْدُ. আসমান যমিন ও তোমাদেরকে কে সৃষ্টি করেছেন ? তখন তারা বলে আল্লাহ কিন্তু এরপরেও তারা শিরকে লিপ্ত থাকে। অর্থাৎ বিভিন্ন জাতিকে যদি প্রশ্ন করা হয় এ মহাবিশ্বের ও তোমাদের স্রষ্টা কে, উত্তরে হিন্দুরা বলে ভগবান, ইহুদী খৃষ্টানরা বলে গড, পারসিকরা বলে আহুরা মাজদা, মুসলমানরা বলে আল্লাহ। এভাবে প্রত্যেক জাতিই স্ব স্ব পরিভাষা অনুযায়ী একক স্রষ্টাকে স্বীকার করে নেয়। এমনকি নাস্তিকদের গড বর্তমানের শ্রেষ্ঠ পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস বলেছে, এ মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছনে কোন মহাজাগতিক শক্তির হাত রয়েছে। আর আমরা জানি এ মহাজাগতিক শক্তিই হচ্ছেন আল্লাহ। রুশদী, তসলিমা, আসিফ, থাবা ইত্যাদিদের প্রশ্ন করলেও তারা বলবে সব কিছুরই স্রষ্টা আল্লাহ। হৃদয় পাঠের যন্ত্র থাকলে দেখা যেত তাদের অন্তরে তাওহীদ প্রোথিত রয়েছে। বস্তুত একক স্রষ্টার মাদ্দা হৃদয়ে ধারণ করে শিশু পৃথিবীতে আসে, তারপর পিতামাতা ও পরিবেশ পরিস্থিতি তাদেরকে বিভিন্ন অবস্থায় রুপান্তরিত করে দেয়। আর যার অন্তরে একবার ঈমান প্রবেশ করে তা হৃদয়ে বিক্রিয়া হয়ে যায়, কখনো বের হয় না। তবে রুশদি তসলীমারা আসলে নাস্তিক নয়, এরা ধর্মদ্রোহি। আর তজ্জন্য সিংহভাগ দায় আলেম সমাজের, এ সম্পর্কে অন্যত্র আলোচনা হবে ইনশাল্লাহ। বস্তুত পৃথিবীতে প্রকৃত নাস্তিক বলতে সম্ভবত খুব বেশি কেউ নেই, প্রায় সবাই আস্তিক তবে মুশরিক। যেমন হিন্দুরা ভগমানের সাথে তেত্রিশ কোটির লেজ লাগিয়েছে, খৃষ্টানরা গডের সাথে স্ত্রী-সন্তান জুরে দিয়েছে, ইহুদীরা উজাইরকে আল্লাহর বেটা বানিয়েছে, এভাবে সকল জাতিই কোন না কোন ভাবে আল্লাহর সাথে শিরক করছে। সুতরাং বুঝা গেল, অমুসলিমরাও আল্লাহ বা একক স্রষ্টার প্রতি ঈমান রাখে বটে তবে শিরক করে। আর মুসলমানরাও দস্তুরমত শিরকে লিপ্ত আছে। বিষয়টা ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
শিরক দুই প্রকার।(১) شرك بالله - আল্লাহ্র সাথে শিরক।(২) شرك بالرسالة- রিসালতে শিরক। (১) আল্লাহ্র সাথে শিরক দুই প্রকার- (ক) শিরক বিযযাত বা আল্লাহর যাতের সাথে শিরক। যেমন কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে আল্লাহর সমকক্ষ গণ্য করা, মূর্তি, চন্দ্র, সূর্য, সাপ, পাহাড় ইত্যাদির পূজা করা। একমাত্র মুসলমানরা ছাড়া পৃথিবীর সকল জাতি এ শ্রেনীভুক্ত। যদিও এরা একক স্রষ্টাকে ভগবান, গড, ঈশ্বর, আহুরা মাজদা ইত্যাদি নামে ডাকে ও মানে।
(খ) আল্লাহ্র সিফাতের সাথে শরীক করা। যেমন-মাজারে মান্নত করা, মাজারে বা খাজা বাবা বা পীর দরবেশের কাছে সন্তান, চাকরি, ধন-সম্পত্তি, প্রেমে সাফল্য, ব্যবসায়ে উন্নতি ইত্যাদি কামনা করা বা প্রার্থনা করা। অর্থাৎ যেসব বিষয় একমাত্র আল্লাহর আয়ত্বাধিন সেগুলো অন্যের কাছে কামনা করা। উলামায়ে কেরামের মতে উক্ত উভয় শ্রেণীই মুশরিক কিছুটা পার্থক্য সহ।
(২) রিসালাতের সাথে শিরক। এটি দ্বিতীয় স্তরের শিরক এবং দ্বিতীয় স্তরের অপরাধ। অর্থাৎ আল্লাহর সাথে শিরক কারী চিরস্থায়ী জাহান্নামী, কিন্তু রিসালতে শিরক কারী তাওহীদের ভিত্তিতে সর্বশেষে ক্ষমা পেতে পারে। যেমন রাসূল (সাঃ) বলেন, -من قال لا الاه الا الله فدخل الجنة – অর্থাৎ যে তাওহীদের স্বীকৃতি দিবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। উল্লেখ্য যে, উলামায়ে মুতাক্বাদ্দিমীন ও মুতা-আখখিরীন আল্লাহর সাথে অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে শিরক শব্দটি পরিভাষা হিসাবে ব্যবহার করেছেন, কিন্তু নবীর সাথে অংশীদারিত্ব তথা নবী দাবীদারদের ক্ষেত্রে শিরক শব্দ পরিভাষা হিসাবে ব্যবহার করেন নি। অথচ এ ক্ষেত্রেও কোন পারিভাষিক শব্দ দরকার। কিন্তু না পেয়ে আমি শিরক শব্দটিই উল্লেখ করলাম, তবে বিষয়টি বিজ্ঞ আলেমগণের বিবেচনায় ন্যাস্ত থাকল।
শিরক বির-রিসালতও দুই প্রকার। (ক) শিরক বিযাতির রিসালাত অর্থাৎ রিসালাতের দরজা খোলা আছে, আরো নবী-রাসূল আসবেন বলে বিশ্বাস করা, রাসূলের সমকক্ষ দাড় করা। যেমন একক স্রষ্টাকে মেনে নিয়েও মুশরিকরা যেমন অসংখ্য দেব দেবিকে ঈশ্বর বানিয়ে নেয়ার কারণে মুশরিক হয়েছে- অনুরূপভাবে বাহায়ি ও কাদিয়ানিরা মুহাম্মদ (সঃ) কে রাসূল মেনে নিয়েও বাহাউদ্দিন ও গোলাম আহমদকে নবী হিসাবে বিশ্বাস করে, কাজেই রিসালতের মধ্যে শিরক করার কারণে এ দুটি ফিরকা উম্মতের সর্বসম্মতিক্রমে মুসলিম জামাত থেকে খারিজ হয়ে গেছে, তারা অমুসলিম।
(খ) শিরক বিসিফাতির রাসূল বা রাসূল (সাঃ) এর সিফাতের সাথে শিরক। অর্থাৎ নবী রাসূলের ন্যায় অন্য কোন সাধারণ মানুষের নিঃশর্ত আনুগত্য করা, অন্ধ অনুসরণ করা অবশ্যানুসরনীয় মনে করা। এটা রাসূলের সিফাত বা বৈশিষ্টের সাথে শিরক বলে গন্য হবে। কারণ নবী রাসূলগণ নিষ্পাপ, মাসুম। তারা ভুল করেন না, করতে পারেন না, ভুল না করাটা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক। কারণ, তারা সরাসরি আল্লাহ্ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হন, আল্লাহই তাদেরকে ভুল ত্রুটির উর্ধ্বে রাখেন। কাজেই নিষ্পাপ হওয়াটা তাদের সিফত। যেহেতু তারা নিষ্পাপ, মিথ্যা বলেন না, প্রতারণা করেন না-বিধায় তাদের প্রতি নিঃর্শত আনুগত্য করা ফরয, মুমিন হওয়ার পূর্বশর্ত। তাদেরকে ও তাদের প্রতি অবতারিত অহীকে সংশয় সংকোচহীন ভাবে মেনে নিতে হবে। অন্যথায় সে মুমিন বলে গন্য হবে না।
পক্ষান্তরে, সাধারণ মানুষ তিনি যত বড় আলেম, আবেদ, বুজুর্গ, গওস-কুতুব, পীর-মুশির্দ, দরবেশ হউন না কেন, তিনি ভুল করেন, করবেন, ভুল করাটা বাধ্যতামূলক। কারণ তারা ওহী প্রাপ্ত নন, আল্লাহ্ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত নয়। কাজেই তারা ভুল করবেন, করতে বাধ্য। আর এ ভুলের কারণেই আল্লাহ্ তা’লা ক্ষমার ব্যবস্থা রেখেছেন ইবাদতের মাধ্যমে, তওবার মাধ্যমে, কাফফারার মাধ্যমে। কাজেই তারা পাপ মুক্ত নয় বিধায় কখনো তাদের নিঃশর্ত আনুগত্য করা যাবে না। কোন বুজুর্গের নিঃর্শত আনুগত্য করলে তার প্রতি রিসালাতের সিফাত-মা’সুমিয়্যত আরোপ করা হল। আর এটা সিফাতে রিসালাতের সাথে শিরক বলে গন্য হবে যা শিরক বিসিফাতিল্লাহ এর ন্যায় হারাম। আর এমন অনুসারী ব্যক্তি মুমিন বলে গন্য হতে পারে না।
এখন বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে উম্মাহর মধ্যে যতটি ফিরকা আছে প্রত্যেকটি ফেরকার অনুসারীরা সংশ্লিষ্ট ফেরকার প্রবর্তক বা শায়খকে নিঃর্শত আনুগত্য করছে। এমনকি নিজ নিজ ফেরকার মুরুব্বি বা নেতৃবৃন্দেরও নিঃর্শত আনুগত্য করছে। এর প্রমাণ হচ্ছে, প্রত্যেক ফেরকা নিজেদের ভুলত্রুটি গুলি সঠিক মনে করছে, সংশোধন করছে না। কিন্তু অন্যদের বাতিল পন্থি মনে করছে। অর্থাৎ প্রত্যেকেই স্ব স্ব মুরুব্বিদের ভুলের উর্ধ্বে মনে করছে বিধায় ঈমান আনার পরেও তারা মুশরিক। আল্লাহ তা’লা অত্র আয়াতে এদিকেই ইঙ্গিত করে বলেন- (﴿وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُم بِاللَّهِ إِلَّا وَهُم مُّشْرِكُونَ১০৬) তাদের বেশীর ভাগ আল্লাহকে বিশ্বাস করে অথচ তারা মুশরিক)।
উল্লেখ্য যে, উক্ত চার প্রকার মুশরিকের মধ্যে একমাত্র প্রথম শ্রেনী অর্থাৎ আল্লাহর যাতের সাথে শিরককারীরাই হচ্ছে প্রকৃত খাটি আদি আসল ও খান্দানি মুশরিক, এরা চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে। আর বাকী তিন প্রকার নকল মুশরিক। তারা নিজ নিজ পাপের শাস্তি ভোগের পর তাওহীদের ভিত্তিতে মুক্তি পাবে।
আমাদের করণীয়ঃ- আব্দুল কাদির জিলানী, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী থেকে নিয়ে শাহ জালাল (রঃ) পর্যন্ত, আবার মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব নজদী, হাসান বান্না, মাওঃ মওদুদী, মাওঃ ইলিয়াস, মাওঃ আবুল কাশেম নানুতুবী ( রাহিমাহুমুল্লাহু আজমায়ীন) ইনারা ছিলেন আল্লাহর রাহে নিবেদিত, আল্লাহর খাটি বান্দাহ। দ্বীনের একেকটা শাখায় তারা বিরাট অবদান রেখে গেছেন। কিন্তু এর অর্থ তো এ নয় যে তারা ভুলের উর্ধ্বে ছিলেন এবং নিঃশর্ত অনুসরন যোগ্য। তারা যেহেতু নবী- রাসূল ছিলেন না বিধায় তাদের অবশ্যি ভুল ত্রুটি আছে, তারাও নিজেদেরকে ত্রুটিমুক্ত ও তাদের প্রবর্তিত পন্থাই একমাত্র ইসলাম, এজাতীয় কোন দাবী করে যান নি। যত গুল বাধিয়েছে পরবর্তী মুর্খ অনুসারীরা। এখন বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের জন্য কোরআন সুন্নাহই যথেষ্ট, এর বাইরে কোন বুজুর্গের অনুসরণ প্রয়োজন নাই।কারণ রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, - عن مالك أنه بلغه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال تركت فيكم أمرين لن تضلوا ما تمسكتم بهما كتاب الله وسنة نبيه (রাসূল সাঃ বলেন, আমি তোমাদের মধ্যে দুটি জিনিস রেখে গেলাম, তোমরা কখনই পথভ্রষ্ট হবে না যতক্ষন সে দুটি আঁকড়ে ধরে থাকবে, তা হল কোরান ও সুন্নাহ)। তিনি কোন পীর বুজুর্গ আল্লামার অনুসরণ করতে বলেননি। তবুও কেউ অনুসরণ করতে চাইলে তা হতে হবে দুটি শর্তের ভিত্তিতে। প্রথম শর্ত, অনুসৃত বুজুর্গও আমাদের মতই একজন মানুষ, তারও ভুল ত্রুটি আছে বিধায় তার সঠিক কাজ গুলির অনুসরণ করতে হবে এবং ভুল-ত্রুটি গুলি বর্জন করতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত, অনুসৃত বুজুর্গের প্রবর্তিত পন্থাই একমাত্র ইসলাম নয় অন্যান্য ধারাগুলিও ইসলামের কাজ করছে বিধায় তাদের সঠিক কাজগুলিতে সহযোগিতা করতে হবে এবং মন্দ কাজের জন্য বিরুপ সমালোচনা না করে একসাথে বসে বুঝিয়ে বলতে হবে। এ দুটি শর্ত বিহীন কারো অনুসরণ জায়েয নাই এবং অনুসারী ব্যক্তি মুশরিক বলে গণ্য হবে।
বিষয়: রাজনীতি
১৩৮৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন