ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, স্বাধিকার আন্দোলনের মুখরতায় টালমাটাল ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখ ছিলো পবিত্র জুমাবার।

লিখেছেন লিখেছেন সালমান ফারসি ৩০ নভেম্বর, ২০১৫, ০৮:৩৯:৩৬ রাত



প্রতিদিনের মতো আজও ভোরের সূর্যের আলো রাঙাবে পুষ্পকে। গ্রামের পথের শেষে নদীর তীরে গাছের শাখা থেকে ভেসে আসবে কোকিলের কুহুতান। শ্যামল প্রান্তরের দূরদূরান্ত থেকে আজও বাজবে রাখালিয়ার মনকাড়া বাঁশির সুর। নীল আকাশের বুকে ডানা মেলবে বলাকার ঝাঁক, কলকাকলিতে মুখর হবে জনপদ। তবুও অন্য যে কোনো দিনের চেয়ে আজকের দিনটি আলাদা। ভিন্ন আমেজের, ভিন্ন অনুভূতি প্রিয় স্বাধীনতা দিবস। জাতীয় জীবনের সবচেয়ে অহঙ্কার, সবচেয়ে গৌরবের স্মৃতি নিয়ে আবারও ফিরে এসেছে চিরঅম্লান, আনন্দ- বেদনায় মিশ্রিত এ দিন।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, স্বাধিকার আন্দোলনের মুখরতায় টালমাটাল ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখ ছিলো পবিত্র জুমাবার। সেদিন সুউচ্চ মিনার থেকে ভেসে আসা মুয়াজ্জিনের আযানের ধ্বনি। সেদিন শাশ্বত সূর্যোদয়ের মধ্যেও নিহিত ছিলো অন্যরকম দ্যোতনা। কারণ সেদিন এ দেশের নির্বিশেষে মানুষ স্বাধীনতা লাভের অদম্য বাসনা নিয়ে দখলদার পশ্চিম পাকিস্তানিদের সীমাহীন ও অব্যাহত শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা করেছিলেন। তাইতো দিনটি আবেগমথিত, মহিমান্বিত ও স্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর।

লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক দিন আজ। টানা নয় মাসের মরণপণ লড়াই ও সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের পর সাড়ে সাত কোটি মানুষ পেয়েছিলো নিজস্ব মানচিত্র, নিজের মতো করে একটি লাল-সবুজ পতাকা। অযুত জনতার আপোষহীন মনোভাব ও বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা স্বতন্ত্র স্বাধীন জাতিসত্তায় বিশ্ববুকে অধিষ্ঠিত।

বাংলাদেশ ও এ জাতির পরাধীনতার শৃঙ্খলামুক্ত হবার কৃতিত্ব কোনো বিশেষ ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর একার নয়। সামরিক-বেসামরিক নির্বিশেষে সকল পেশা ও বয়সের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো স্বাধীনতা সংগ্রামে। শরীরের রক্ত ঝরানো ছাড়াও তাদেরকে সহ্য করতে হয়েছিল বহু জুলুম, নির্যাতন ও নিপীড়নের অব্যক্ত যন্ত্রণা। কিন্তু এখনো দিকে দিকে শকুনিরা ফেলিছে নিঃশ্বাস। একটি মহল এ দেশকে সাম্রাজ্যবাদী, আধিপত্যবাদীর ঘাঁটি বানাতে চায়।

আমাদের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল শুধু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়া নয়; গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। বিগত চার দশকের বেশি সময়েও এসবের কোনোটিই পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

আজ প্রত্যেকের উপলব্ধির সময় এসেছে ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন’। সময়ের আবর্তে চার দশকেরও বেশি পেরিয়ে এবার এমন একটি আমরা দিবসটি পালন করছি যখন শাসকদল আওয়ামী লীগ দেশি-বিদেশি সব মহলকে উপেক্ষা করে ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়েছেন। নির্লিপ্ত ও ব্যর্থ নির্বাচন কমিশনের অধীনে কয়েক দফায় উপজেলা নির্বাচনের নামে নজিরবিহীন ভোট জালিয়াতির উত্সব চেলেছে দেশজুড়ে। যখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে অব্যাহত রেখেছে রাজনৈতিক প্রহসন।

জননিরাপত্তার নামে পুলিশ প্রশাসন নির্বিচারে গণহত্যায় লিপ্ত। ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে এবং প্রশ্রয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মনুষের ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর নগ্নভাবে আঘাত হানা হচ্ছে। রাষ্ট্রের সব শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর চালানো হচ্ছে চরম নির্যাতন। সারাদেশের চলছে লাগামহীন সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দেশের মানুষ দিশেহারা। দেশি-বিদেশি চিহ্নিত অপশক্তির গভীর ষড়যন্ত্রে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন। পানি আগ্রাসনে বিপন্ন দেশের নদ-নদী। সীমান্তে পাখির মতো হত্যা করা হচ্ছে এদেশের নাগরিকদের। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী নিরীহ বাংলাদেশীকে হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখছে কাঁটাতারের বেড়ায়। রাষ্ট্র ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তির মাধ্যমে দেশের জাতীয় সম্পদ তুলে দেয়া হচ্ছে বিদেশিদের হাতে। আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে দেশের আইন ব্যবহার করা হচ্ছে ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার হিসেবে।

আইনশৃঙ্খলার চরমতম অবনতি আর প্রতিপক্ষ দলনের রাজনীতির কারণে মৃত্যু উপত্যকা হয়ে উঠেছে দেশটা। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। সত্য বলার অপরাধে টুঁটি চেপে ধরা হচ্ছে গণমাধ্যমের। একের পর এক বন্ধ হচ্ছে গণমাধ্যম। খুনের শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকরা। আইন উপেক্ষা করে শাস্তি দেয়া হচ্ছে তাদেরকে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সব ভিত ভেঙে পড়ছে। চারপাশে বিপন্ন মানবাধিকার। বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম; কমছে মানুষের আয়। বাড়ছে ক্ষুধার্ত মানুষের মিছিল। শেয়ারবাজার হয়ে পড়েছে তলাবিহীন ঝুড়ি। অর্থনীতি চরমভাবে বিপর্যস্ত। সব মিলিয়ে এক সীমাহীন নৈরাজ্য এবং চরম অনিশ্চয়তা গ্রাস করেছে সব ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণী-পেশার মানুষকে।

তবুও প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবস আমাদের জীবনে নিয়ে আসে নতুন প্রেরণা। ৪৪ বছর আগে এ দিনে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় জাতিকে এনে দিয়েছিল আত্মপরিচয়ের একমাত্র ঠিকানা। স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ পথপরিক্রমা মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলন ও ২৫ মার্চ ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার পর ২৬ মার্চের সূর্যোদয় বয়ে এনেছিল বহু প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা, এ দিনই সূচিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এদেশের মানুষ সরকারবিরোধী সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকার আওয়ামী লীগের সরকার গঠনে টালবাহানা শুরু করে। ছলচাতুরী ও কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান একাত্তরের ৩ মার্চ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্ধারিত অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। রেডিওতে এ খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে গোটা জাতি। শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তার পাশে এসে দাঁড়ান মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশের স্কুল-কলেজ, মাদরাসা-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, কল-কারখানা কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। অচল হয়ে পড়ে দেশ। স্বাধীনতা আদায়ের ইস্পাতকঠিন দৃঢ় সংকল্পে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দিন দিন তীব্র হয়ে উঠতে থাকে। রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চের ভাষণের পর স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ জাতি চূড়ান্ত সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে। পাকিস্তানি সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষকসহ সর্বস্তরের মানুষ। এদেশের মানুষের স্বাধীনতার আন্দোলন দমন করতে একাত্তরের ২৫ মার্চ দখলদার বাহিনী ঢাকাসহ সমগ্র দেশে মানব ইতিহাসের বর্বরতম হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ওইদিন সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। তার নির্দেশে ২৫ মার্চ মধ্য রাতে নিরস্ত্র ছাত্র, জনতা, পুলিশ ও ইপিআর সদস্যদের ওপর দখলদার বাহিনী নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। গুলির গগনবিদারি শব্দ ও চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখায় কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।

আজ ৪৪ বছর পর বাংলার জনগন কি পাবে সেই সূর্যের আলোয় আলোকিত পুষ্পকে। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, বিরোধীদলীয় নেত্রী আলাদা আলাদা বাণী প্রদান করবে। তাদের বাণীতে থাকবে মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও বিরত্বগাধা। স্টেডিয়ামে চলবে কুচকাওয়াজ। মানুষ মরবে, মা বোনদের ইজ্জত লুন্ঠিত হবে, ক্ষূধার মিছিলে মানুষ ভারি হবে। এটাই কি স্বাধীনতা আসুন না দেশকে ও দেশের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে দলমত নির্বিশেষে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব শান্তি ও সমৃদ্ধির ধারা অব্যহত রাখতে সকলে একসাথে কাজ করি। আর সাধারণ জনগনের মতামতের মুল্য দেই। তবেই পাবো আমাদের কাঙ্খিত স্বাধীনতা।

বিষয়: রাজনীতি

৭৭৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File