কাল কি হলো? ভুলটা কি ছিল?
লিখেছেন লিখেছেন ওয়েলকামজুয়েল ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১১:০৬:৩৪ সকাল
তিরিশ তারিখের এই ধাক্কাটা খাওয়ার প্রয়োজন ছিলো। প্রয়োজন ছিলো, কারণ আওয়ামি লিগ সরকারের স্বরূপটা কেউই বুঝতেছি না, এমনকি তার কঠিন সমালোচকরাও সেইটা বুঝতেছি না। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী থেকে বামপন্থী, আর উদারনীতিক থেকে ইসলামপন্থী সবাই একটা ঘোরের ভিতরে আছি। এই ঘোরটা আওয়ামি লিগ সরকারের তৈরি করা। প্যারাডক্সিকালি তিরিশ তারিখে সেইটা ভাঙাইছেও তারা। সবারটা ভাঙে নাই, অনেকেই ঘোরের মধ্যে আছে। তারা সবসময়ই থাকবে।
তাই বহু উদারনীতিক/প্রগতিশীলও ভাবতেছে এই রেজিম খারাপ, তবে রাক্ষুসে নয়, এদের পরে নাকি একটা রাক্ষুসে রেজিম আসবে। ওটা ঠেকানোর জন্য তোমাদের ভালো হওয়া দরকার, তারা আওয়ামি লিগরে এই অ্যাডভাইস দেয়। এগুলা হচ্ছে ডিল্যুশন। কুমিল্লারে কার্ডিফ আর কুড়িগ্রামরে ক্যালিফোর্নিয়া ভাবলে, কই আছি সে-সম্পর্কে ক্লিয়ার আইডিয়া না ত্থাকলে, এমন ডিল্যুশন তৈরি হয়। এবং এই ডিল্যুশনের একটা সাইকোলজিকাল দিক আছে। আপনি একসময় এমন ডিল্যুশনের প্রেমে পড়ে যাবেন, সরকার যতোই আপনার প্রগতিশীল অ্যাডভাইসরে প্রত্যাখ্যান করবে, ততোই আপনি আরো বেশি জোশ নিয়ে তারে আরো নিখুঁত অ্যাডভাইস দেয়ার চেষ্টা করবেন। তাই ঘোরের ভেতর থিকা বাইর হওয়া দরকার।
করাপ্ট রেজিম আর এবসলিউটিস্ট রেজিম এক না। ট্রাম্প সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়া প্রচুর সমালোচনা আছে, কিন্তু ট্রাম্পের আমেরিকা এবসলিউটিস্ট না, মিডিয়া থেকে মিলিটারি সব সে গিলে খেতে পারে নাই। সিভিল সোসাইটির বিশাল একটা অংশ সরকারের বিরুদ্ধে, ইন্সটিটিউশনগুলো মোটামুটি স্বাধীন, আর ইলেকশন সেখানে ফিল-গুড পলিটিকাল থিয়েটার নয়।
করাপ্ট রেজিমের অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে, কারণ সেইখানে সরকার আর রাষ্ট্রের ফারাক থাকে, ন্যূনতম হইলেও থাকে। আওয়ামি লিগ সরকার কোনো করাপ্ট রেজিম না। এইটা এবসলিউটিস্ট রেজিম।
এদের পলিটিকাল মডেলটা বুঝতে রাশিয়ার দিকে তাকান। রাশিয়া উত্তর কোরিয়া বা চিনের মতো স্ট্রাকচারালি ওয়ান-পার্টি স্টেট না, অ্যাপেয়ারেন্সের জায়গায় ডিমোক্রেটিক, নিয়মিত নির্বাচন হয় সেখানে। কিন্তু সেই নির্বাচনে পুতিনও নিয়মিতই জেতে, এবং ইওরোপের ইন্ডাস্ট্রিগুলা যেহেতু রুশ তেলের কাছে বান্ধা, আরো বহুদিন জিতবে।
পুতিনরে নিয়া হারারির একটা মারাত্মক পর্যবেক্ষণ আছে। বিশশতকে সারা দুনিয়া ডমিনেট করেছে তিনটা ইডিওলজি। লিবারালিজম, মার্ক্সিজম, ফ্যাসিজম। এমন কোনো কোহেরেন্ট ইডিওলজি পুতিনের রাশিয়ায় নাই, সেইখানে যা আছে, তা হচ্ছে বিভিন্ন ইডিওলজির একটা হাইব্রিড সংস্করণ। বাইজান্টাইন চার্চের আশীর্বাদ নিয়া সে এক ধরণের উগ্র জাতীয়তাবাদী আবেগ তৈরি করে ক্ষমতায় আছে, যে-কোনো ধরণের রাজনৈতিক সংকটে পড়ার পরিস্থিতি তৈরি হলেও চেচনিয়ায় আরেকদফা হামলা চালায় বা ইউক্রেনের সাথে স্কিরমিশে যায়, পাবলিকরে মিলিটারিস্ট দেশপ্রেমের আফিম খাওয়ায়ে ঘুম পাড়ায়ে রাখে। কিন্তু এই পুতিনিজম এক্সপোর্টেবল কোনো ইডিওলজি না। জর্দান বা সুদানে এর পলিটিকাল ভ্যালু জিরো।
রাশিয়ার কোনোকিছু এক্সপোর্ট করা লাগে নাই, আওয়ামি লিগ রাশিয়ারে দেখে সেলফ-মোটিভেটেড হইছে, হয়া বাংলাদেশরে গরিবের রাশিয়া বানাইতেছে। ২০১৪র পর থেকে। ২০১৮র জাতীয় নির্বাচন তার সবচে বড়ো প্রমাণ।
খেয়াল করেন, ভোটার তথ্য জানার দুইটা অপশন রাখা হইছিলো, একটা ইলেকশন কমিশনের ওয়েবসাইট আর অন্যটা স্থানীয় আওয়ামি লিগের নির্বাচনী প্রচার কেন্দ্র। প্রথম অপশনটা অ্যাপেয়ারেন্স আর দ্বিতীয় অপশনটা অ্যাসেন্স। দুনিয়ার যে কেউ তথ্য প্রবাহের উন্মুক্ততা সম্পর্কে জানতে চাইলে সে প্রথম অপশনটা দেখাবে, যদিও জানা আছে কার্যকর আসলে দ্বিতীয় অপশনটা।
কথা হইলো, অন্যরা কী এইসব জানতো না? জাতীয় যুক্তফ্রন্ট জানতো না কেমন ইলেকশন হবে? বাম গণতান্ত্রিক জোট?
জানতো। অভাবটা জ্ঞানের না। অভাবটা হচ্ছে বোঝাপড়ার।
সামহাউ সবাই ভাবছে আওয়ামি লিগ করাপ্ট রেজিম। কিন্তু রাষ্ট্র আর নির্বাচন ব্যবস্থা মোটামুটি স্বাধীন। তাই করাপ্ট রেজিমের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় আসবে, বামপন্থীরা কিছু আসনে জিতে ভবিষ্যতের করবিন-স্যান্ডার্স হবে। ফেসবুক ভিডিওতে কয়েকহাজার লাইক থেকে ভাবছে তিরিশ তারিখে ভোটকেন্দ্রে লোকে লাঠিসোটা নিয়ে যাবে সরকারের সাথে মারামারি করতে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট অ্যানালিস্ট জিয়া হাসান যেমনটা বলেন, ভোট কোনো ট্রফি না যে ছিনিয়ে আনা যাবে, ভোট একটা প্রসেস। আর এই প্রসেসের পুরোটাই সরকারের দখলে আছে। আওয়ামি লিগের জন্য ইলেকশন একটা অ্যাপেয়ারেন্স মাত্র, বহির্বিশ্বকে দেখানোর জন্য, আদারওয়াইজ তার কাছে ইলেকশনের কোনো ভ্যালু নাই।
আওয়ামি লিগ করাপ্ট রেজিম না, এবসলিউটিস্ট রেজিম।
করাপ্ট রেজিমরে ভোট দিয়া নিয়মতান্ত্রিকভাবে সরানো যায়। আওয়ামি লিগরে ভোট দিয়া সরানো যাবে না। কারণ এরা এবসলিউটিস্ট।
এবসলিউটিস্ট রেজিমরে সরানোর জাস্ট দুইটা রাস্তা থাকে। একটা আর্মড স্ট্রাগলের আর অন্যটা মাস মুভমেন্টের। বাংলাদেশে আর্মড স্ট্রাগলে নেমে জেতা সম্ভব না, নেপালের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো রাজতন্ত্রের উপস্থিতি নাই এখানে, এখানে খুব মহৎ উদ্দেশ্যে আর্মড স্ট্রাগলে নামলেও তা আরেকটা লিবিয়াসিরিয়া তৈরি করবে।
মাস মুভমেন্ট মানেই আবার জ্বালাও পোড়াও না, নিজেদের জানমালের ক্ষতি নিজেরাই করা না, অরাজকতা সৃষ্টি করা না। মাস মুভমেন্ট মানে এবসলিউটিস্ট রেজিমের সাথে অসহযোগিতা। অস্তিত্ব টিকায়ে রাখার জন্য যতোটুকু দরকার, এর বাইরে এই রেজিমের সাথে পাবলিকের কোনো সম্পর্ক থাকবে না, এই দাবিতে দেশের মানুষ এক হয়ে গেলে এরা একসময় হার মানবে। নূর হোসেন হয়া জীবন দিতে হবে না। জীবন দেয়া কঠিন। ধামা না ধইরা বাঁইচা থাকা তারচেও কঠিন। এই এবসলিউটিস্ট রেজিমের সাথে অসহযোগিতার নীতি নিয়া নিজের রাস্তা নিজে মাপার লাইন নেন, দেখবেন এরা ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে, একসময় বাধ্য হচ্ছে ক্ষমতা ছাড়তে।
অর্থবহভাবে ভোট করতে একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ লাগে, এবলিউটিস্ট রেজিমের অধীনে ভোট কইরা নিজেরে এমপাওয়ার্ড মনে করার সাথে মনোপলি খেইলা নিজেরে বড়লোক মনে করার কোনো ফারাক নাই, আমরা যতো তাড়াতাড়ি এই সহজ জিনিশটা বুঝবো ততোই তা আমাদের জন্য কল্যানকর হবে।
বিষয়: রাজনীতি
৮৫৯ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন