নির্বাচন: অাওয়ামী স্টাইল ৭৩ থেকে ২০১৮..
লিখেছেন লিখেছেন ওয়েলকামজুয়েল ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৮, ০৩:১৫:০০ রাত
৭ই মার্চ নির্বাচন হইল। ৩০০ সীটের মধ্যে ২৯২টি আওয়ামী লীগ ও মাত্র ৭টি অপরপক্ষ পাইল। একটি সীটে একজন প্রার্থী মোটর দূর্ঘটনায় নিহত হওয়ায় তার নির্বাচন পরে হইল। সেটিও আওয়ামী লীগই পাইল। বিরোধী পক্ষের ৭টির মধ্যে জাসদের ৩, জাতীয় লীগের ১ ও নির্দলীয় ৩ জন নির্বাচিত হইলেন। দুইটি ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি কোন সীট পাইল না। জাতীয় লীগের প্রেসিডেন্ট জনাব আতাউর রহমান খাঁ নির্বাচিত হইয়া তার পার্টির নামটা জীবন্ত রাখিলেন। পরে নির্বাচিত মেম্বরদের ভোটে যে ১৫টি মহিলা আসনের নির্বাচন হইল তার সব কয়টি আওয়ামী লীগই পাইল। এইভাবে পার্লামেন্টের ৩১৫ জন মেম্বরের মধ্যে ৩০৮ জনই হইলেন আওয়ামী লীগের। মাত্র ৭ জন হইলেন অপযিশন।
... তিনশ' পনর সদস্যের পার্লামেন্টে জনা-পঁচিশেক অপযিশন মেম্বর থাকিলে সরকারী দলের কোনই অসুবিধা হইত না। বরঞ্চ ঐ সব অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান অপযিশনে থাকিলে পার্লামেন্টের সৌষ্ঠব ও সজীবতা বৃদ্ধি পাইত। তাদের বক্তৃতা বাগ্মিতায় পার্লামেন্ট প্রাণবন্ত, দর্শনীয় ও উপভোগ্য হইত। সরকারী দলও তাতে উপকৃত হইতেন। তাদের গঠনমূলক সমালোচনার জবাবে বক্তৃতা দিতে গিয়া সরকারী দলের মেম্বররা নিজেরা ভাল-ভাল দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হইয়া উঠিতেন। বাংলাদেশের পার্লামেন্ট পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের একটা ট্রেনিং কলেজ হইয়া উঠিত। আর এ সব শুভ পরিণামের সমস্ত প্রশংসা পাইতেন শেখ মুজিব।
কিন্তু দেশের দূর্ভাগ্য এই যে শেখ মুজিব এই উদারতার পথে না গিয়া উল্টা পথ ধরিলেন। এই সব প্রবীণ ও দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ানকে পার্লামেন্টে ঢুকিতে না দিবার জন্য তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করিলেন। জনাব আতাউর রহমানকে হারাইবার জন্য আওয়ামী-নেতৃত্ব যে পন্থা অবলম্বন করিলেন, সেটাকে কিছুতেই নির্বাচন প্রচারনার সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক নীতি বলা যায় না। বরঞ্চ আমার বিবেচনায় সেটা ছিল খোদ আওয়ামী লীগের জন্যই আত্মঘাতী। তার মত ধীরস্থির অভিজ্ঞ গঠনাত্মক চিন্তাবিদ পার্লামেন্টের অপযিশন বেঞ্চের শুধু শোভা বর্ধনই করেন না, সরকারকে গঠনমূলক উপদেশ দিয়া এবং গোটা অপযিশনকে পার্লামেন্টারি রীতি-কানুনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখিয়া পার্লামেন্টারি পদ্ধতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া থাকেন। এমন একজন ব্যক্তিকে পার্লামেন্টে ঢুকিতে না দিবার সর্বাত্মক চেষ্টা আওয়ামী নেতৃত্ব কেন করিলেন, তা আমি আজও বুঝিতে পারি নাই। কারন এমন চেষ্টা যে মনোভাবের প্রকাশ, সে মনোভাব পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সাফল্যের অনুকূল নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের মত অভিজ্ঞ ও প্রবীন পার্লামেন্টারি নেতা কিছুতেই এমন আত্মঘাতী নীতির সমর্থক হইতে পারেন না। যদি খোদা-না-খাস্তা শেখ মুজিব কোনও দিন তেমন মনোভাবে প্রভাবিত হন, তবে সেটা হইবে দেশের জন্য চরম অশুভ মুহুর্ত।
কিন্তু আমি দেখিয়া খুবই আতংকিত ও চিন্তাযুক্ত হইলাম যে নির্বাচন চলাকালে আওয়ামী নেতৃত্ব অপযিশনের প্রতি যে মনোভাব অবলম্বন করিয়াছিলেন, সেটা সাময়িক অবিবেচনা-প্রসূত ভুল ছিল না। তারা যেন নীতি হিসাবেই এই পন্থা গ্রহন করিয়াছিলেন॥"
- আবুল মনসুর আহমদ / আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর ॥ [ খোশরোজ কিতাব মহল - সেপ্টেম্বর, ২০১৩ (পুনর্মুদ্রণ) । পৃ: ৬২৬-৬২৭ ]
★★
"... ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে সাধারণ নির্বাচনে ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মোজাফফর), নবগঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে জাতীয় লীগ এবং আরো দুই-একটি ছোট দল অংশগ্রহণ করে। এসবের কোন দলই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্ধীতা করার মত শক্তিশালী ছিল না। তদুপরি, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামী লীগের পক্ষে ব্যাপকভাবে হয় নির্বাচন কারচুপি। এমনকি, সশস্ত্র রক্ষীবাহিনী প্রকাশ্যে ভোট কারচুপিতে অংশগ্রহণ করে। ভোট গণনা শেষে ফলাফল ঘোষনাকালেও শাসকদলের পক্ষে চরম দূর্নীতির অবলম্বন করা হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, চট্টগ্রাম থেকে একটি আসনে মোজাফফর ন্যাপের একজন প্রার্থী রাতে নির্বাচনে জয়ী ঘোষিত হলেও পরদিন সকালে তাকে পরাজিত বলে ঘোষণা দেয়া হয়। জাসদ সভাপতি মেজর জলিলের বিজয় নাকচ হযে যায়। বলা বাহুল্য নির্বাচনে কোন কারচুপি ব্যতীতই আওয়ামী লীগ বিরাট সংখ্যক আসন নিয়ে পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করত। কারণ, প্রপ্রতিদ্বন্ধীদের মধ্যে কোন দলই আওয়ামী লীগের সমকক্ষ ছিল না। তথাপি, নির্বাচনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপক কারচুপি এই ইঙ্গিতই বহন করে যে, আওয়ামী লীগ জনমত ও জনসমর্থন সম্পর্কে ছিল সন্দিহান। ১৯৭৩ মার্চের এই নির্বাচন স্পষ্ট করে তোলে যে, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জনমত যতই যাক, কোনদিন আওয়ামী লীগকে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না। সরকারবিরোধী দলগুলোর জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় সদস্যের সংখ্যা ছিল ৭ জন। সংসদের রীতি অনুযায়ী তারা ১০ জন না হওয়ায় সংসদে কোন বিরোধী দল গঠিত হয়নি। এ ছিল প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগেরই এমন এক রাজনৈতিক ভুল বা ব্যর্থতা যার কারণে বাংলাদেশের পার্লামেন্টে 'বিরোধী দল' নামীয় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানটি দাঁড়াতে পারেনি। অন্য কথায়, ১৯৭৩ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচন বাংলাদেশের পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দিল॥"
- সিরাজুল হোসেন খান / উপমহাদেশের সামাজিক- রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত ॥ [ ঝিনুক প্রকাশ - ফেব্রুয়ারি, ২০০২ । পৃ: ১৮৭ ]
বিষয়: রাজনীতি
৮৭১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পরিস্থিতি দেখিয়া ইহাই প্রতীয়মান হইতেছে যে- আওয়ামী লীগ ৩০ তারিখ মাঠে নামিয়া জয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারিবে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন