সমসাময়িক রাজনীতি
লিখেছেন লিখেছেন ওয়েলকামজুয়েল ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১০:৪৩:৪৫ রাত
বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার পদ্ধতি জারী ছিলো ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী থেকে ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট পর্যন্ত। ৪৭ বছর বয়সী প্রজাতন্ত্রের প্রায় ১৬ বছর টানা প্রেসিডেন্ট পদটি ছিলো নির্বাহী ক্ষমতাধর। এরপর ব্যক্তিক্রম হিসেবে ২০০৬ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে ২০০৭ সনের ১১ জানুয়ারী পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা ছিলো রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন আহমদের নিকট। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর সচিবালয়ে সচিবদের সাথে বৈঠকে একথাও বলেছিলেন যে, দেশে ফের রাষ্ট্রপতির শাসন জারী হয়েছে।
১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নয় বছরের শাসনের অবসান ঘটে। ১৯৮৬ সালে সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নিজের শাসনে বেসামরিক চাদর জড়ানোর পর আরো চার বছর তিনি টিকে গিয়েছিলেন মূলত অন্যতম বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগের পরোক্ষ প্রশ্রয়ে। দলটি ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রধান বিরোধীদলের আসন অলংকৃত করে।
কিন্তু ১৯৯০ সাল নাগাদ পরিস্থিতি বদলে যায়। আওয়ামী লীগ এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়। রাজনৈতিক অঙ্গনে 'উত্তর পাড়া' নামে পরিচিত সেনাসদরও এরশাদকে সমর্থন দিতে অস্বীকৃতি জানায়। শেষমেশ যেদিন নাখালপাড়ায় রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ে গিয়ে তৎকালীন প্রধান সেনাপতি জেনারেল নূর উদ্দীন খান, সেনাবাহিনীর চীফ অভ জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল আবদুস সালাম, নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলাম প্রেসিডেন্টকে শেষ কথা শুনিয়ে দেন, সেদিন তৎক্ষনাৎ এরশাদ ইস্তিফার ফয়সালা নেন।
এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার ব্যবস্থার মৃত্যু ঘনিয়ে আসে। ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৯ বছর পর ক্ষমতাসীন হয় বিএনপি। যদিও নির্বাচনে জয়ী হয়ে বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেন, এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের বদলে মন্ত্রীসভার বৈঠকে সভাপতিত্ব করতে শুরু করেছিলেন, তথাপি দলটি প্রেসিডেন্সিয়াল ফরম্যাট বাতিলের ব্যাপারে নেতিবাচকই ছিলো। প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকারে ফেরার ব্যাপারে শুরু থেকেই দৃঢ় অবস্থান ছিলো আওয়ামী লীগের।
শেষমেশ বিএনপি দ্বাদশ সাংবিধানিক সংশোধনী পাশ করার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকারে ফিরে গেলেও দলটির পুরানো নীতি ফল্গুধারার মতো থেকে যায়। আমার মনে পড়ে, ২০০১ সালে তৃতীয়বার বেগম জিয়া সরকার গঠন করার পর তাঁর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরী বলেছিলেন, বিএনপি এখনো রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ভাবছে। পরে অবশ্য সেই কথার প্রতিফলন দেখা যায়নি।
আজ ১৭ বছর পর এসে ভাবনার ব্যাপক অনুষঙ্গ রয়েছে যে, রাষ্ট্রপতির বদলে প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাহী ক্ষমতা দেয়াতে দেশ ও দশে কী পরিবর্তন ঘটেছে। বিশেষ কোন বদল হয়নি। ১৯৯১ সালে নির্বাহী ক্ষমতা দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে আর প্রধানমন্ত্রী রাখা হয়নি, রাষ্ট্রপতির সমান ক্ষমতাসম্পন্ন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে মন্ত্রীদের মধ্যে প্রথম না বানিয়ে মন্ত্রীদের মালিকে পরিণত করায় এই বন্দোবস্ত বড় কোন পরিবর্তন দর্শাতে পারেনি।
আগেই বলেছি, প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকারে ফেরা ছিলো মূলত আওয়ামী লীগের দাবী। আর এই দাবীর অন্যতম দলীয় তাত্ত্বিক ছিলেন তখনকার আওয়ামী লীগ নেতা কামাল হোসেন। আওয়ামী লীগ নিজেই প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটালেও কামাল হোসেনের উদ্যোগে সংসদীয় গণতন্ত্র দলটির স্থায়ী মূলনীতিতে পরিণত হয়। কামাল হোসেন এর একটি তাত্ত্বিক নাম দেন। তা হচ্ছে 'বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরা'। অথচ আওয়ামী লীগ কখনো বাকশালকে প্রত্যাখ্যান বা অপ্রয়োজনীয় বলে স্বীকার করেনি। এহেন বৈপরীত্যের পেছনে কামাল হোসেনের অগ্রণী ভূমিকা থাকতে পারে, যিনি নিজের তৈরি সংবিধানকে ফেরানোর নাম করে আওয়ামী লীগকে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার বিরোধীতে পরিণত করেন।
সেই কামাল হোসেন এখন যেসব কর্মসূচী নিয়ে এগুচ্ছেন, তাতে শামিল আছে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে কার্যত ১৯৫৬ সালে প্রণীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের রোয়েদাদের মতো একটি দ্বৈত শাসন আনায়ন, এবং সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দেয়া। দুটিই বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং দুর্বল করতে পারে।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধিতে নীতিগতভাবে আমি একমত হলেও যেভাবে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার নামে সর্বদা প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের অবস্থা আনার চেষ্টা হচ্ছে, তা এদেশে স্থায়ীভাবে অকার্যকর ও কোন্দলে ভরা সরকার প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করবে। চলমান ঘোলাটে এবং জটিল দেশীয় আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক সমীকরণে বাংলাদেশের জন্য একটি শক্তিশালী এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে কাবিল সরকার অপরিহার্য। এর কোনরূপ ব্যত্যয় সহ্য করার অবস্থানে নেই দেশ।
এরপর আসা যাক ৭০ অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে। বারবার বাঁধা প্রাপ্ত হলেও বাংলায় সংসদীয় ধাঁচের বন্দোবস্তের ইতিহাস পৃথিবীর বহু দেশের চেয়ে প্রাচীন। ৭০ অনুচ্ছেদকে আমি এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতার নির্যাশ বলে মনে করি। কি আছে ৭০ অনুচ্ছেদে? এর ইংরেজী ভাষ্য তুলে দিলাম-
"A person elected as a member of Parliament at an election at which he was nominated as a candidate by a political party shall vacate his seat if he –
(a) resigns from that party ; or
(b) votes in Parliament against that party ;
but shall not thereby be disqualified for subsequent election as a member of Parliament."
সোজা কথায়, সংসদে আস্থা ভোট বা ভোটাভুটির অন্যান্য পন্থায় হুটহাট সরকার ফেলে দেয়া রুখতে এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত রক্ষাকবচের সৃষ্টি করা হয়েছে। এর দ্বারা সংসদ সদস্যদের দলীয় সিদ্ধান্তের বিপরীতে যেকোন ভোটাভুটিতে ভোট দানে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
বহু বিশ্রী এবং রক্তক্ষয়ী ঘটনার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ৭০ অনুচ্ছেদ প্রবর্তন করেছিলো। ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নজিরবিহীন সহিংসতার প্রেক্ষিতে পার্লামেন্টারিয়ানরা পার্লামেন্টের ভেতরেই ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী পাটওয়ারীকে খুন করেছিলো। তখন পাল্টাপাল্টি আস্থা ভোটে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খান এবং কেএসপির আবু হোসেন সরকার সরকার গড়ছিলেন আর পতিত হচ্ছিলেন। এহেন ঐতিহাসিক বাস্তবতায় ৭০ অনুচ্ছেদ এসেছিলো। এটি ছিলো বাংলাদেশের তরফে একটি সাহসী এবং প্রগতিশীল পদক্ষেপ ছিলো, যা ভারত বা পাকিস্তান আনতে পারেনি।
এখন ভারতে দৃশ্যত শক্তিশালী সরকার গঠনের চল শুরু হলেও কিছুদিন পরপরই আইনসভায় বিভিন্ন ভোটাভুটির সময় নগদে কালো টাকার লেনদেনে খবর দেখা যায়। ক্ষমতাসীন বিজেপির আমলে কয়েকটি প্রদেশে ত্রিশঙ্কু আইনসভা গঠিত হবার পর টাকা ছিটিয়ে, এমনকি পরিষদ সদস্যদের গুম করে বিজেপি দ্বিতীয় দল হয়েও সদস্য ভাগিয়ে এনে সরকার গঠনে সমর্থ হয়েছে। সবশেষ কয়েকমাস আগে কর্নাটক প্রদেশে কংগ্রেস এভাবেই প্রথম হওয়া বিজেপিকে কলা দেখিয়ে সরকার গঠন করেছে।
কামাল হোসেনের ঐক্য প্রক্রিয়ার বিএনপি শামিল হয়েছে। ভবিষ্যতে অভিন্ন ইস্যুতে নির্বাচনে যাওয়া এবং কামাল হোসেনের নেতৃত্বে সরকারে যাওয়ার কথাও বিএনপির অলিন্দে চাউর হয়েছে। যদি তেমনটা হয়, তাহলে বিএনপির অগণিত ভোটার বা সমর্থক দলের অঙ্গুলি হেলনে ৭০ অনুচ্ছেদের বিরুদ্ধে জনমত পুরু করার কাজে আত্মনিয়োগ করবে। এরই মধ্যে নানাবিধ প্রচারণার মাধ্যমে ৭০ অনুচ্ছেদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক আবহাওয়া ঠিকই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অথচ এই অনুচ্ছেদ উঠে গেলে রাজনীতিতে দুর্নীতি, কালোটাকার প্রবাহ এবং দুর্বৃত্তায়ন সর্বগ্রাসী হয়ে পড়বে, এরচেয়েও বড় ভয়ের কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে কোন শক্তিশালী সরকার এবং শক্তিশালী নেতৃত্ব গড়ে ওঠার সম্ভাবনা সিস্টেমেটিক উপায়েই বাঁধার সম্মুখীন হতে থাকবে।
সামনে নির্বাচন হওয়া বা তাতে নতুন রাজনৈতিক জোটের ক্ষমতাসীন হবার কোন ভৌত সম্ভাবনা এখনো দেখা যায়না। তবে কামাল হোসেনের উদ্দেশ্য সম্ভবত ক্ষমতাসীন হওয়া নয়, বরং পরবর্তী সরকারে কিং মেকারের ভূমিকা পালন করা; সেক্ষেত্রে সামনে সাংবিধানিক পন্থায় দেশে দুর্বল সরকার স্থাপন করে নানাবিধ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশকে এতীম করে দেয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে।
এই বিষয়টা আমাকে খুবই ভাবাচ্ছে। আমি জানিনা, যাদের ভয় পাওয়া দরকার তারা এই বিষয়ে সচেতন রয়েছেন কী না। I only pray that may the good sense prevail among them...!
বিষয়: বিবিধ
৭০৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন