পাহাড়ে রাজনীতিঃ আদি অন্ত
লিখেছেন লিখেছেন ওয়েলকামজুয়েল ০৬ মে, ২০১৮, ০৯:৫৯:২৫ সকাল
পাহাড়ে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ৪টা। সবচেয়ে আদিম হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। মানবেন্দ্র নারায়ণ (এমএন) লারমা এই দলের প্রতিষ্ঠাতা। আমার স্কুল দীঘিনালা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তিনি। জেএসএস-এ আমার স্কুলের অনেক শিক্ষকই যোগ দিয়েছিলেন। একসময় দলটাকে 'হেডমাস্টারদের দল'ও বলা হতো। যদিও এসব অনেক আগের ঘটনা।
কোনো এক অদ্ভুত কারণে রাঙামাটিকে সবাই গুরুত্ব দিলেও, পাহাড়ি দলগুলোর যত ভাঙ্গন হয়েছিল, সব খাগড়াছড়ি-কেন্দ্রিক। খাগড়াছড়ি যেন এক বিদ্রোহের নাম। এমনকি খাগড়াছড়ির এক ইটভাটায় এমএম লারমা জেএসএস'র সামরিক উইং শান্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 'শান্তি বাহিনী' নামকরণ কেন? একাধিক তত্ব আছে। কেউ বলেন, ভাই শন্তু লারমার নামের সঙ্গে মিল রেখে, কেউ বলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়কার 'শান্তি কমিটি' থেকে এই শান্তি বাহিনী। তবে গ্রহণযোগ্য মত হলো, 'শান্তি' (Peace) শব্দটা থেকেই শান্তি বাহিনী।
আশির দশকে শান্তিবাহিনী ভেঙ্গে জন্ম হয়েছিল 'প্রীতি' গ্রুপের। এই প্রীতি গ্রুপের হাতেই খুন হন এম এন লারমা। লারমা ও প্রীতি গ্রুপের দ্বন্দ্ব ছিল অনেক রক্তক্ষয়ী। প্রীতি গ্রুপ অবশ্য পরে এরশাদের সময়ে আত্মসমর্পন করে। ফলে দীর্ঘ বিরতির পর ফের একাধিপত্য তৈরি হয় জেএসএস'র।
১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে শান্তি চুক্তি হয় জেএসএস ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে। এই চুক্তি নিয়ে বিরোধের জেরে আবির্ভাব হয় নতুন দলের। ইউনাইটেড পিপলস' ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। শুরু থেকে এই দলের প্রধান প্রসীত খীসা। সুদর্শন ও তরুণ প্রসীত ছিলেন জেএসএস'র ছাত্র সংগঠন পিসিপি'র একসময়কার শীর্ষ নেতা।
ইউপিডিএফ'র শান্তি চুক্তি বিরোধীতার যুক্তি ছিল, এই চুক্তি পাহাড়িদের পক্ষে যথেষ্ট নয়। দলটির মূল দাবি ছিল পাহাড়ে স্বায়ত্তশাসন। খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে শান্তি চুক্তি সম্পাদনের সময়ই অনেক পাহাড়ি বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন। এরা ছিলেন ইউপিডিএফ কর্মী।
ইউপিডিএফ শক্তিশালী ছিল খাগড়াছড়িতে। প্রসীত খীসার বাড়িও খাগড়াছড়ি। বান্দরবান আর রাঙামাটি জেএসএস'র অধীনে ছিল। দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র সংঘাত চলতে থাকে। কত যে লাশ পড়েছে, তার হিসাব আমার কাছে নাই।
২০০৭ সালের জরুরী অবস্থার সময় ফের ভাঙে জেএসএস। জেএসএস'র পুরোনো কমরেড সুধাসিন্ধু খীসার নেতৃত্বে খাগড়াছড়িতেই জন্ম হয় জেএসএস (এমএন লারমা) বা সংস্কার গ্রুপের। এই দলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ছিলেন সম্প্রতি নিহত নানিয়ারচর উপজেলার চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা। শক্তিমান ছিলেন লইয়ার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্রলীগ করতেন। পরে চুক্তির পর পাহাড়ে ফিরে জেএসএস'র আইন বিষয়ক সম্পাদক হন (সম্ভবত)।
প্রথম প্রথম ইউফিডিএফ শেল্টার দিয়েছিল জেএসএস (সংস্কার) গ্রুপকে। দুই পক্ষ মিলে শন্তু লারমার মূল জেএসএস'কে কোণঠাসা করে ফেলে।
ইউপিডিএফ'র আবির্ভাবের পর থেকেই শন্তু লারমার চলাচল সীমিত হয়ে গিয়েছিল কিছুটা। এরপর খাগড়াছড়িতে একবার গুলিবর্ষণ হয় তার গাড়িতে। সেই থেকে তিনি আর খাগড়াছড়িতে ঢুকতে পারেননি। সংস্কার গ্রুপের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ইউপিডিএফ'র প্রবল শক্তিমত্তার চোটে শন্তু লারমা একেবারে গর্তে ঢুকে যান। রাঙামাটি শহর ছাড়া ওনাকে কেউ বোধ হয় সাম্প্রতিককালে পাহাড়ের কোথাও আসা-যাওয়া করতে দেখেননি। আয়রনি হলো, রাঙামাটিতে ঘুরতেও ওনার আর্মির শেল্টার প্রয়োজন হয়। আর্মির অনুষ্ঠানে আর্মিকে প্রশংসা করতে হয়। আঞ্চলিক পরিষদের জরাজীর্ণ কার্যালয়ে মধুর ফোনালাপেই ওনার সময় কাটে, যতদূর শুনি। মাঝেমাঝে ঢাকায় এসে হম্বিতম্বি করে যান। বিদেশে সভা সেমিনারে যান।
হ্যাঁ, ইউপিডিএফ শক্তিশালী হয়েছিল। একটু বেশিই হয়েছিল বোধ হয়। স্পর্ধাও জন্ম নিয়েছিল কিছুটা। যতি তা-ই না হবে, তাহলে কোন আক্কেলে খাগড়াছড়িতে শেখ হাসিনার জনসভার গাড়িবহরে বাধা দেয় দলটা? ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে জনসভায় গাড়ি যেতে দেয়নি ইউপিডিএফ। এটা ২০১৩ সালের ঘটনা। শুনেছি সেদিন প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষেপেছিলেন। এক সভায়, তিনি একটি বিশেষ বাহিনীর কর্মকর্তাদের প্রতি বলেছিলেন, ইউপিডিএফ বানিয়েছেন আপনারা, এটাকে নির্মূলও করতে হবে আপনাদেরকে।
হ্যাঁ, ইউপিডিএফ'র উত্থানের পেছনে সেনাবাহিনীকে দায়ী করা হয়েছিল। কারণ, শান্তি চুক্তি তখনকার অনেক সেনা কর্মকর্তাই মন থেকে মানতে পারেননি। আবার এটাও সত্য, যতবার পাহাড়ের আঞ্চলিক দল ভেঙেছে, ততবার সেনাবাহিনীকে বা গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়ী করা হয়েছে। এসবের কতটা সত্য, কতটা মিথ্যা, সেটা হলফ করে বলতে পারবো না। কিন্তু এখানে কিছুটা আয়রনিও আছে।
যেমন, ইউপিডিএফকে দীর্ঘদিন ধরে অচ্ছুৎ হয়ে থাকতে হয়েছে। পাহাড় নিয়ে আলোচনার মানদণ্ডই ছিল শান্তি চুক্তি। যেই দল শান্তি চুক্তিই মানে না, তাকে স্বীকৃতি দেওয়া যায় নাকি? এমনকি দীর্ঘদিন "ইন্ডিজেনাস" বা "আদিবাসী" টার্মটা নিয়ে অস্বস্তি ছিল ইউপিডিএফ'র মধ্যে।
এ কারণে দীর্ঘদিন ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলে আর্মি-ঘেঁষা তকমা নিয়ে ইউপিডিএফ একপ্রকার ব্রাত্য ছিল। এনজিও মহলে তো এখনও জেএসএস'র ছায়ায় পড়ে আছে দলটা। তবে ইউপিডিএফ'র কজকে মেইনস্ট্রিম লেফটে তুলে আনার কৃতিত্ব বদরুদ্দিন উমরের। তিনিই স্রোতের বিপরীতে গিয়ে দলটাকে প্রমোট করেছেন। এরপর জেএসএস'র ট্যাকটিক অনুসরণ করে ঢাকায় সমর্থক গোষ্ঠী বানিয়েছে ইউপিডিএফ। এখন তাদের সঙ্গে ঢাকার বড় বড় মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর কাজ করতে অসুবিধা হয় না। তবে দলটার রিক্লুসিভ কিংবা সিক্রেটিভ নেতা প্রসীত খীসা এখনও শন্তু লারমার মতো সেলেব্রেটি হতে পারেন নাই।
তো, ২০১৩ সালের পর ইউপিডিএফ'র বিরুদ্ধে প্রশাসন শক্ত অবস্থান নেওয়া শুরু করলো। যেখানে রাঙামাটি শহর ব্যতিত পুরো পাহাড় ছিল দলটার দখলে, সেখানে গত দুয়েক বছরে দলটা বেশ হোঁচট খেয়েছে। এরই মধ্যে কয়েক বছর পুরোনো মিত্র জেএসএস (সংস্কার)-এর সঙ্গে দলটার বিরোধের সূত্রপাত হয়। কে কাকে মারছে, তা বোঝার উপায় নাই। ২০১৫ সালে সব দল সমঝোতায় আসে হানাহানি অবসানের। কিন্তু সেটা যে টিকেনি, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। আধিপত্য, চাঁদার বিপুল অর্থ, রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠা - এসবই এই বিরোধের মূল কারণ।
এরই মাঝে কয়েকমাস আগে ইউপিডিএফ ভাঙ্গে। নতুন দলের নেতা ছিলেন জ্যোতি বর্মন। সেই আদি ও অকৃত্তিম খাগড়াছড়িতে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি তার দলের নাম দেন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। এবং অবধারিতভাবে এবারও এর পেছনে অনেকখানি কৃতিত্ব দেওয়া হয় সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থাকে। তবে নতুন দলের যারা ছিলেন তাদেরকে স্রেফ গুণ্ডাপাণ্ডা বা ক্যাডার বলা যায়।
ইউপিডিএফ ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-এর মধ্যে বিরোধের বয়স কয়েক মাস। এরই মধ্যে অন্তত ১৯টা লাশ পড়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল ইউপিডিএফ নেতা ও প্রোপাগান্ডিস্ট মিঠুন চাকমার খুন। মাঝে অপহৃত হন ইউপিডিএফ-অ্যাফিলিয়েটেড একটা সংগঠনের কর্মী মন্টি চাকমা ও দয়াসোনা। তারা কয়েকদিন আগে মুক্তি পেয়েছেন সম্ভবত গোপন সমঝোতায়। তাদের মুক্তি নিশ্চিত করেই ইউপিডিএফ পালটা আঘাত হেনেছে।
রাজনীতির এক অদ্ভুত খেলায়, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-এর সঙ্গে মিত্রতা তৈরি হয় জেএসএস (সংস্কার)-এর, যেই দলকে মূল ইউপিডিএফ প্রথমে শেল্টার দিয়েছিল।
সংস্কার গ্রুপের শক্তিমান যখন ৩ তারিখ খুন হলেন (সম্ভবত মূল ইউপিডিএফ'র হাতে), পরেরদিন অর্থাৎ গতকাল তার শেষকৃত্যে যোগ দিতে গিয়ে খুন হন নবগঠিত ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-এর প্রধান জ্যোতি বর্মন সহ ৫ জন।
জ্যোতি বর্মনের মৃত্যুতে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) হারিয়ে যাবে কিনা বলা কঠিন। হয়তো ভাতৃঘাতি সংঘাতের আরও তীব্রতর এক অধ্যায়ের সূচনা হলো কেবল। সাম্প্রতিক সংঘাতে কেবল লাভবান হয়েছে শন্তু লারমার মূল জেএসএস। দলটা এই বিরোধে কোনো বিবৃতিও দেয়নি। একেবারে নিশ্চুপ। ঝোপ বুঝে কোপ দেওয়ার অপেক্ষায় আছে হয়তো। কিন্তু একটা নীতিভ্রষ্ট দল আদৌ আর সুবিধা করতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে।
বিষয়: রাজনীতি
৭৪২ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন