শাপলা চত্বরে হেফাজত: মিডিয়ার ভুমিকা কি ছিল?

লিখেছেন লিখেছেন ওয়েলকামজুয়েল ০৫ মে, ২০১৮, ০৯:৫০:১০ রাত

ব্লগে ইসলামবিদ্বেষী লেখালেখির প্রতিবাদে এবং ১৩ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। সংখ্যায় তারা ছিলেন লাখো। তখন সরকারের পক্ষ থেকে নানা বাধা উপেক্ষা করে হেফাজত কর্মীরা সারাদেশ থেকে ঢাকা এসে পৌঁছান। শাপলায় অবস্থা নিয়ে হেফাজত নেতারা ঘোষণা দেন যে, তাদের দাবি না মানা পর্যন্ত তারা সেখান থেকে সরে যাবেন না।

সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে সরে যেতে অনুরোধ করা হলেও তা প্রত্যাখ্যান করে রাতেও অবস্থান ধরে রাখেন ধমীয় অধিকার রক্ষায় প্রতিষ্ঠিত সংগঠনটির কর্মীরা। এক পর্যায়ে সরকার জোরপূর্বক তাদেরকে শাপলা থেকে উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়। ৫ মে দিবাগত মধ্যরাতে পুলিশ-র‍্যাব-বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত বাহিনী অভিযান চালিয়ে গুলির মুখে সরিয়ে দেয় হেফাজতকর্মীদেরকে। অভিযানে বেশ কয়েকজন নিহত ও অসংখ্য মানুষ আহত হন। তবে হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের বিভিন্ন বক্তব্য রয়েছে।

মানবাধিকার সংগঠন অধিকার জানায়, অভিযানে ৬১ জন নিহত হন ও কয়েকশ আহত হন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’র দাবি, ৫০ জন নিহত হন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ওইদিন (৫ মে) বিভিন্ন ঘটনায় পুলিশের সাথে সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা সর্বমোট ১১। সংখ্যা নিয়ে আরো নানা ধরনের রাজনৈতিক বিতর্ক রয়েছে। আমরা এখানে নিহতের সংখ্যা বা রাজনৈতিক বিতর্কের দিকে যাবো না। শুধু দেখবো শাপলা অভিযানের পরের কয়েকদিন সংবাদমাধ্যমে অভিযান ও তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের খবর কিভাবে এসেছে?

‘অভিযানটিতে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আর তেমটি হওয়ার সুযোগই ছিল না, কারণ এটি খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ে শেষ হয়েছে’- পুলিশের পক্ষ থেকে এই দাবি করা হয়। তবে এই 'স্বল্প সময়ের' অভিযানের দৈর্ঘ্য নিয়ে পরের দিনের একেক পত্রিকায় একেক তথ্য এসেছে। প্রথম আলোর মতে, ‘৩০ মিনিট ধরে গুলি চালায় যৌথবাহিনী’; সমকাল ৬ মে বলেছে, ‘১০ মিনিটের সাঁড়াশি অভিযান’, আবার ৭ মে তাদের প্রথম পাতায় একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান : রুদ্ধশাস ২০মিনিট!’, যুগান্তর বলেছে, ‘শ্বাসরুদ্ধকর ১ ঘণ্টা’, অন্যান্য পত্রিকা এবং টিভি পুলিশের দেয়া ‘১০ মিনিটে’র কথাই প্রচার করেছে। তবে সে রাতে ‘সময় টিভি’ রাত আড়াইটা থেকে (প্রথম গুলি শুরু হয়) ভোর পৌনে চারটা পর্যন্ত (দেড় ঘণ্টারও বেশি সময়) একটানা লাইভ দেখায় অভিযানটি।

৫ মে সমাবেশে যোগ দিতে আসা হেফাজতকর্মীরা রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে, বিশেষ করে সমাবেশস্থলের পার্শ্ববর্তী এলাকায় যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলার শিকার হয়। অনেক জায়গায় হামলার শিকার হেফজাতকর্মীরা পাল্টা জবাব দিলে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। এসব ঘটনার সংবাদ পরিবেশনে পরের দিনগুলিতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বিপরীতধর্মী তথ্য দিয়েছে। ৫ মে দুপুরে বায়তুল মোকাররামের দক্ষিণ গেটে বইয়ের দোকানগুলোতে হামলা, অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে পরের দিনের দৈনিক কালের কণ্ঠ, সমকাল, ইত্তেফাক, ডেইলি স্টার, বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ প্রায় সব পত্রিকায় ‘হেফাজতের তাণ্ডব’ আখ্যা দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হয়।

কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে ৭ মে দৈনিক ইনকিলাব ‘স্বার্থবাদী মিডিয়া যুবলীগের সন্ত্রাসীদের বাঁচাতে মরিয়া’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানায়, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অফিস সংলগ্ন বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে যুবলীগের কিছু নেতাকর্মী বইয়ের দোকানে আগুন দেন। এ সময় সেসব দোকানে থাকা বিভিন্ন ইসলামি বইয়ের সঙ্গে পবিত্র কোরআনের অনেক কপিও পুড়ে যায়। সেদিন সকাল থেকে ওই এলাকায় কয়েকশ’ আওয়ামী লীগকর্মী অবস্থান নেয়ার কারণে সেখানে সংঘবদ্ধ হয়ে হেফাজতকর্মীদের হামলা ও অগ্নিসংযোগের কোনো সুযোগই ছিল না বলে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন সাংবাদিক ইনকিলাবকে জানান।

৫ মে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট সংলগ্ন হাউস বিল্ডিং করপোরেশনের ‘কার পার্কিংয়ে’ আগুন দিয়ে অর্ধশত গাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার জন্য হেফাজতকে দায়ী করে ৮ মে প্রথম আলো ‘ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী হাউস বিল্ডিং’ শীর্ষক একটি বিশেষ প্রতিবেদন ছাপে। কিন্তু ওইদিনই ইন্টারনেটে লিক হওয়া একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, জিন্সের প্যান্ট-শার্ট ও মাথায় হেলমেট পরা কিছু যুবক দীর্ঘ সময় ধরে প্রথমে পার্কিংয়ে থাকা গাড়িগুলো ভাংচুর করে এবং পরে আগুন ধরিয়ে দেয়। হেফাজতের সমাবেশে আসা কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা পাঞ্জাবি-পায়জামা-টুপি পরা ছিলেন।

৫ মে সমাবেশে আসা হেফাজতকর্মীদের ওপর বিভিন্ন স্থানে সরকারদলীয় লোকজনের হামলার ঘটনাগুলোর ছবি বেশিরভাগ সংবাদপত্রে এড়িয়ে যাওয়া হয়। তবে ৬ মে কালের কণ্ঠ তাদের শেষের পাতায় এ ধরনের দুটি ছবি ছেপেছে। একই দিন যুগান্তরের প্রথম পাতা, নয়া দিগন্তের তৃতীয় এবং ইনকিলাবের পঞ্চম পাতায়ও হেফাজতকর্মীদের হামলার শিকার হওয়ার একাধিক ছবি ছাপা হয়েছে।

৫ মে সকাল থেকে রাতের অভিযানের আগ পর্যন্ত সময়ে পুলিশ ও সরকারদলীয় লোকজনের সাথে সংঘর্ষে অন্তত ৯ জন নিহত হন় বলে প্রথম আলো জানায়। যদিও হেফাজতের দাবি ছিল ১৬ জন। ইনকিলাবের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘মতিঝিল-পল্টন এলাকায় র্যাব পুলিশ ও যুবলীগের হামলা : নিহত ১৬’। তবে সমকাল নিহতের সংখ্যা দেখিয়েছে ৩ এবং কালের কণ্ঠ ৪ জন। কালের কণ্ঠ-এর প্রথম পাতায় শিরোনাম ছিল ‘সংঘর্ষ গুলিতে নিহত চার : নির্বিচারে আগুন তাণ্ডব’। কালের কণ্ঠের সংবাদের পাশে আগুনের ছবি দিয়ে তার জন্য (ক্যাপশনে) হেফাজতের কর্মীদের দায়ী করা হলেও হেফাজতকর্মীদের ওপর পুলিশ বা সরকারদলীয় লোকজনের অ্যাকশনের কোনো ছবি ছিল না সেই পাতায়। ছবি প্রকাশের ক্ষেত্রে অন্যান্য পত্রিকায়ও এই পক্ষপাত বিদ্যমান ছিল। বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর মধ্যে দিগন্ত টিভি ১৬ জনের নিহতের খবর দেয়। তবে অন্যান্য চ্যানেল ৩ থেকে ৭ জন নিহতের খবর প্রচার করে। একই সময়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে নিহতের সংখ্যা ১০ বা তার বেশি বলে জানানো হয়।

এবার আসা যাক ৫ মে দিবাগত গভীর রাতে শাপলা চত্বরে অভিযানের মিডিয়া কভারেজ প্রসঙ্গে। অপারেশনটি রাত আড়াইটা থেকে সকাল পর্যন্ত চলায় পরদিনের পত্রিকায় তার পুরো কভারেজ ছিল না। মূলত ৬ মে’র টিভি চ্যানেল ও ৭ মে পত্রিকাগুলোতে এ সংক্রান্ত খবর ছাপা হয়। অভিযানে নিহতের সংখ্যা নিয়ে মিডিয়ায় কোনো একক তথ্য আসেনি। প্রথম আলো আগের দিনের নিহতের সংখ্যাসহ অভিযানে ১১ জন নিহতের তথ্য দিয়ে ৭ মে খবরের শিরোনাম দেয়, ‘রোববারের সংঘর্ষ ও অভিযান : এক পুলিশসহ নিহত ২২’। নয়া দিগন্তের শিরোনাম ছিল, ‘গভীর রাতের অভিযানে অজ্ঞাতসংখ্যক নিহত’। বাকি পত্রিকাগুলোর শিরোনামে নিহত হওয়া নিয়ে কোনো তথ্য ছিল না। যেমন জনকণ্ঠের শিরোনাম ‘দশ মিনিটেই শাপলা চত্বর মুক্ত’, সমকালের ‘যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান : রুদ্ধশাস ২০ মিনিট’, কালেরকণ্ঠ ‘রুদ্ধশ্বাস আধাঘণ্টা’, যুগান্তর ‘অপারেশন মিডনাইট : শ্বাসরুদ্ধকর ১ ঘণ্টা’ ইত্যাদি।খবরের ভেতরে পুলিশের বরাতে প্রথম আলো ১১ জন, ইত্তেফাক, বাংলাদেশ প্রতিদিনি ও সকালের খবর ৮ জন, সমকাল ৬ জন নিহতের (অভিযানে) তথ্য দেয়। তবে বিস্ময়ের বিষয়, কালের কণ্ঠ, জনকণ্ঠ, যুগান্তর নিহতের কোনো তথ্যই দেয়নি! প্রায় সব পত্রিকা আহতের সংখ্যা একশ’ থেকে দেড়শ’র মধ্যে বলে জানিয়েছে! প্রথম আলো এ সংখ্যা ‘অন্তত ২ হাজার’ বলেছে। দুইদিনে হেফাজতকর্মীদের হতাহতের সঠিক সংখ্যা এবং তাদের ওপর সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও পুলিশি নিষ্ঠুর অ্যাকশনের ছবি প্রকাশে মিডিয়ার আগ্রহ কম থাকলেও সংগঠনটির নেতাকর্মীদের দ্বারা ভাঙচুর ও হামলার ঘটনাগুলোকে অতিমাত্রায় হাইলাইট করা হয়।

প্রথম আলো ৭ মে শাপলা চত্বরের অভিযান ও হেফাজতের কর্মকাণ্ড নিয়ে মোট ৩৩টি সংবাদ ছাপিয়েছে। এর মধ্যে মাত্র তিনটি ছিল হেফাজতের পক্ষে দেয়া বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজতের বিবৃতি ভিত্তিক সংবাদ। এছাড়া ১২টি বিশেষ প্রতিবেদন ছিল যার কয়েকটির শিরোনাম হলো-

"হেফাজতের ধ্বংসযজ্ঞে নিঃস্ব অনেক ব্যবসায়ী"

"তাণ্ডবে বাদ যায়নি রাস্তার গাছও"

"ধ্বংস, তাণ্ডব আর সবুজ উপড়ানোর চিত্র"

"যেন যুদ্ধ-পরবর্তী ধ্বংসলীলা"

"শিশুদের অরক্ষিত রেখে চলে যান নেতারা"

"হাজারো কর্মী নিয়ে মাঠে নামে ডিসিসি"

"ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী হাউস বিল্ডিং"

"হেফাজতের কর্মীদের রোষানলে ব্যাংক"

"৪০০ বছর বয়সী ঢাকায় এ এক কালো অধ্যায়"

... ইত্যাদি।

বাকি সংবাদগুলো হেফাজতের বিরুদ্ধে সরকারের ও সরকার-সমর্থক বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের দেয়া বক্তব্যভিত্তিক।

হেফাজতের ‘তাণ্ডব’ নিয়ে ৫ মে এর পরের কয়েকদিন প্রথম আলোর মতো সরব ছিল কালেরকণ্ঠ, সমকাল, বাংলাদেশ প্রতিদিন, জনকণ্ঠ, সকালের খবর'সহ অন্যান্য পত্রিকাগুলোও। সরব ছিল সব টেলিভিশন চ্যানেল। 'তাণ্ডবের' ফলোআপ হয়েছে ধারাবাহিকভাবে।

কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, ৫ ও ৬ মে'তে বিভিন্ন স্থানে (ঢাকা ও ঢাকার বাইরে) নিহত ও আহত হেফাজতকর্মীদের নিয়ে কোনো সংবাদমাধ্যমে ফলোআপ প্রতিবেদন দেখা যায়নি। বিশেষ করে অভিযানের সময় ছররা গুলিতে শরীর জর্জরিত হওয়া শত শত মানুষ (যাদের বেশিরভাগ কিশোর/তরুণ) আহত হলেও বেশিরভাগই চিকিৎসা নিতে পারছিলেন না। প্রথমত; হাসপাতালগুলিতে পুলিশি নজরদারির ভয়ে চিকিৎসা না দেয়া, দ্বিতীয়ত; ভিকটিমরা আথিকভাবে দরিদ্র হওয়ায় চিকিৎসা খরচ জোগাড় করতে না পারা।

এসব মানবিক দিক বিবেচনায় নিলে বহু প্রতিবেদন হতে পারতো। কিন্তু কেউ করেনি। ফলোআপের মূল বিষয় ছিল শুধু 'হেফাজতের তাণ্ডব'। হেফাজতের ভিকটিম হওয়ার ঘটনাগুলোর কোনো ফলোআপ নেই!

আবার অভিযানের সময় নিহতের সংখ্যা নিয়ে যেসব দাবি ছিল বিভিন্ন পক্ষে সেগুলো যাচাই করতে কোনো অনুসন্ধান করেনি বাংলাদেশি কোনো সংবাদমাধ্যম মিডিয়া। মানবাধিকার সংগঠন ও বিদেশি দুয়েকটি সংবাদমাধ্যম অবশ্য অনুসন্ধান করে নিজেদের প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছিল। এমন অনুসন্ধানের সবগুলোতেই সংখ্যা নিয়ে সরকারি দাবির বিপক্ষে প্রমাণ তুলে ধরা হয়।

এই যে 'হেফাজতে তাণ্ডব' এর ফলোআপ, আর 'হেফাজতের ভিকটিম হওয়া'কে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া- ঘটনার চার বছর পরও সংবাদমাধ্যমের এমন প্রবণতা এখনও চলছে। আজ ৫ মে'র বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোর কভারেজ দেখলে যে কোনো পাঠকের কাছে তা ধরা পড়বে।

বিষয়: বিবিধ

৬৩৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File