কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণঃ স্বপ্ন বনাম বাস্তবতা

লিখেছেন লিখেছেন ওয়েলকামজুয়েল ২৯ এপ্রিল, ২০১৮, ১০:০৪:৫৭ সকাল



কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি স্থাপন আর দুই কোরিয়ার একত্রীকরণ কার্যত সমার্থক। গতকাল পানমুনজমে কিম জং উন এবং মুন জে ইনের মধ্যে ঐতিহাসিক বৈঠকের সূত্রে কোরীয় পুনরেকত্রীকরণের কথা আবার উত্থিত হওয়া শুরু হয়েছে।

কিন্তু কোরিয়ায় শান্তির মানে দুই কোরিয়ার পুনর্মিলন নয়। অন্তত এখনকার সময়ে, যখন নতুন এক স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, এই সময়ে একীকরণের সম্ভাবনা একটি সুকঠিন চ্যালেঞ্জের বিষয়। এই চ্যালেঞ্জের কারণ ক্ষয়িষ্ণু হলেও এখন বিশ্বের প্রধান সামরিক শক্তি, এবং বিশেষভাবে নৌশক্তি হিসেবে আমেরিকার বহাল থাকা। এহেন বোঝার উপর শাকের আঁটি হয়ে এসেছে শিনজো আবের নেতৃত্বে সামরিক ক্লীবত্ব থেকে বেরিয়ে এসে জাপান কতৃক আগ্রাসী সমরনীতি গ্রহণের উপক্রম করা।

অর্থাৎ কোরিয়া কেন্দ্রিক বিশ্ব শক্তির অবস্থান আবার আগের অবস্থানেই ফিরে গেছে। এই আগের অবস্থান জানতে হলে গত শতকের প্রথমে যেতে হবে। ১৯০৫ সালে ঐক্যবদ্ধ কোরিয়া শাসনকারী রাজবংশের দুর্বলতার সুযোগে জাপান দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। পাঁচ বছর জাপানের আশ্রিত রাজ্য হিসেবে থাকার পর ১৯১০ সালে কোরিয়ায় জাপানের সরাসরি শাসন কায়েম হয়। এটা ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানের পরাজয় পর্যন্ত কায়েম থাকে।

১৯৪৫ সালে জাপানের পরাজয় নিশ্চিত হবার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা যথাক্রমে উত্তর ও দক্ষিণ দিয়ে কোরিয়ায় প্রবেশ করে। উত্তরে সোভিয়েত মদতমাশ কমিউনিস্টরা সরকার গঠন করে। এর নেতৃত্বে আসেন একটি মধ্যবিত্ত কোরীয় খ্রীষ্টান পরিবার থেকে আসা কমিউনিস্ট নেতা কিম ইল সুং। বর্তমান নেতা কিম জং উনের দাদা কিম ইল সুং কিছুদিন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যও ছিলেন।

অপরদিকে কোরিয়ায় জাপানের দখলদারিত্ব শেষ হওয়া আর বিভক্তির অন্তর্বর্তীকালে গঠিত অখণ্ড কোরিয়া আরজি হুকুমত বা অস্থায়ী সরকার সিংমান রির নেতৃত্বে সিউলে সরকার গঠন করে। সিউল ছিলো ঐক্যবদ্ধ কোরিয়ার রাজধানী। এভাবেই জন্ম হয় উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার।

৩৮ ডিগ্রী অক্ষ তখনো দুই অংশের দরমেয়ান সীমানা হিসেবে চিন্হিত থাকলেও দুই কোরিয়ার কেউ কাউকে স্বীকৃতি দেয়নি, এবং দুই সরকারই নিজ নিজ হাতে সাড়ে তিন হাত, তথা নিখিল কোরিয়ার বৈধ সরকার হিসেবে নিজেদের ঘোষণা দেয়। এর রেশ হিসেবে এখনো উত্তর ও দক্ষিণ দুই কোরিয়ার সরকারী নামের সাথে যুক্ত নয়।

যাহোক, সামরিক শক্তির দিক থেকে উত্তরের সরকার ছিলো বলীয়ান। দক্ষিণ তখনো গুছিয়ে উঠতে পারেনি। এই সুযোগে সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিনের সমর্থন পেয়ে ১৯৫০ সালের ২৫ জুন কিম ইল সুং দক্ষিণে হামলা করেন। এবার কিম সমর্থক হিসেবে পেয়ে যান চীনকেও, যেখানে বছর খানেক আগেই মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে চিয়াং কাই শেকের জাতীয়তাবাদী সরকারকে তাইওয়ানে খেদিয়ে দিয়ে কমিউনিস্টারা ক্ষমতাসীন হয়েছে।

কিম ইল সুংকে সিংমান রির উপর লেলিয়ে দেয়ার পেছনে স্টালিন এবং মাওয়ের উদ্দেশ্য ছিলো অভিন্ন- কোরিয়া থেকে আমেরিকার উৎখাত এবং ভবিষ্যতে জাপানের বিরুদ্ধে অগ্রবর্তী অবস্থান হিসেবে কোরিয়াকে ধরে রাখা। বলা বাহুল্য, তখন মরা হাতী হলেও জাপান ছিলো চীন ও রাশিয়ার ঐতিহাসিক শত্রু।

যাহোক, দক্ষিণ কোরিয়ায় হামলা করে কিম ইল সুং বিস্ময়কর সাফল্য পান। দক্ষিণ কোরীয় সৈন্যদের ছত্রভঙ্গ করে একে একে উত্তর কোরীয় সৈন্যরা রাজধানী সিউল থেকে শুরু করে প্রায় পুরো দক্ষিণ কোরিয়া দখল করে নেয়। কেবল দক্ষিণাংশে অবস্থিত প্রধান বন্দরনগরী পুসান (বর্তমান উচ্চারণ বুসান) এবং তার আশেপাশের কিছু এলাকায় দক্ষিণী ফৌজ মাটি কামড়ে পড়ে থাকে।

আমেরিকার জন্য এটা কেবল কোরীয় উপদ্বীপ হাতছাড়া হবার বিষয় ছিলোনা, এটা ছিলো জাপান থেকে গুয়াম, গুয়াম থেকে হাওয়াই; অর্থাৎ সমুদয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পরাজয়ের নামান্তর।

নতুন করে বিশ্বযুদ্ধের জন্ম না দিয়ে পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে আমেরিকা নবগঠিত জাতিসংঘকে ব্যবহার করে। কোরিয়ায় পাল্টা হামলা চালানোর জন্য গঠিত হয় একটি জাতিসংঘ বাহিনীর, যার ৯০% সেনাই ছিলো মার্কিন। প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান তাঁর অন্যতম সেরা সমরনায়ক ফিল্ড মার্শাল ডগলাস ম্যাকআর্থারকে কোরিয়া উদ্ধারে পাঠান। ম্যাকআর্থার ছিলেন পাঁচ বছর আগে জাপানের আত্মসমর্পণের প্রধান কারিগর।

জেনারেল ম্যাকআর্থারকে জাতিসংঘ বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে তাঁর অধীনে দেয়া হয় লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াল্টন ওয়াকারের নেতৃত্বে মার্কিন অষ্টম আর্মিকে। মার্কিনীরা কোরিয়ায় অবতরণের পর যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। চীন ও সোভিয়েত সমর্থনপুষ্ট উত্তর কোরীয় বাহিনীকে ঠেলে ৩৮ ডিগ্রী অক্ষের উত্তরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১৯৫৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এই সীমান্তকে মান্যতা দেয়ার মাধ্যমে কোরিয়া যুদ্ধের অবসান হয়।

আজ এতোগুলো বছর পর এসেও কোরীয় উপদ্বীপ ঘিরে ভূরাজনৈতিক হিসাবনিকাশের একচুল বদল হয়নি। আমি গতকাল লিখেছিলাম, ঐক্যবদ্ধ কোরিয়া চীনের জন্য প্রার্থিত হলেও আমেরিকার জন্য নয়। গতকাল কোরিয়ার দুই শীর্ষ নেতা যে বৈঠকে বসলেন, তার নেপথ্য কারিগর ছিলো চীন, আমেরিকা নয়।

কোরীয় পুনর্মিলনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় ছিলো গত শতকের শেষ দশকে। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের খতম হয়েছে। জিয়াং জেমিনের নেতৃত্বাধীন চীন তখন নিজেকে কমিউনিজম পরবর্তী বিশ্বের প্রেক্ষাপটে ঢেলে সাজাচ্ছে। আর স্বল্পস্থায়ী প্রধানমন্ত্রীদের শাসনে থাকা জাপান তখনো আমেরিকার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে, আর কোলবালিশ হিসেবে রেখেছে স্বীয় সামরিক ক্লীবত্বকে।

এখন পরিস্থিতি আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের মতো, কিংবা তার চেয়েও জটিল। বিশ্বশক্তি হিসেবে চীন তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চীনকে বৃহৎ নৌশক্তি হওয়া থেকে ঠেকাতে আমেরিকা দক্ষিণ চীন সাগরেই কেবল আসেনি, চীনের চিরশত্রু জাপানকে আগ্রাসী সমরসজ্জা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। যদিও দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান নেতৃত্ব চীনের প্রতি মিত্রতার সওগাত দিয়েছে, তথাপি পুরো পরিস্থিতিতে আমেরিকা ও জাপানের বলার, এমনকি করারও অনেক কিছু আছে।

চীনের দরমেয়ানিতে যদি কোরিয়া উপদ্বীপ এক হয়ে যায়, তাহলে তার রেশ গুয়াম পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। আর জাপান নিজের স্কন্ধদেশে চীনের বিষবাস্প অনুভব করা শুরু করবে। সম্ভাব্য অখণ্ড কোরিয়া তখন প্রধান হুমকি অনুভব করবে জাপান থেকে, যার পারমাণবিক অস্ত্রগুলো ততোদিনে হয় চীনের জিম্মায়, নয়তো আন্তর্জাতিক আণবিক সংস্থার জিম্মায় গিয়ে অকেজো হয়ে পড়বে। অপরদিকে চীন চাইবে কোরিয়া তার আর জাপানের মধ্যে প্রতিরক্ষা দেয়াল হয়ে থাকুক।

এহেন পরিস্থিতিতে দূরপ্রাচ্যে এক মহাযুদ্ধের দামামা বেজে উঠতে পারে। আর যদি এতো কিছু মাড়িয়ে চীনের দৃশ্যমান সমর্থনে কোরিয়া একীভূত হয়, তাহলে দূরপ্রাচ্য ও প্রশান্ত মহাসাগরে চীনই হয়ে যাবে শেষ কথার উৎপত্তিস্থল। আপাতত এতোটাও সুখস্বপ্ন প্রত্যাশা করা যায়না।

অর্থাৎ, কিম জং উন এবং মুন জে ইন যতো ফলপ্রসূ সম্মেলনই করুন না কেন, একটি ঐক্যবদ্ধ কোরিয়ার পথ এখনো ভীষণভাবে কণ্টকাকীর্ণ এবং সুদূর পরাহত এক বিষয়। আপাতত আমরা বরং কোরীয় উপদ্বীপ ঘিরে নতুন ধরণের টানাপোড়ন দেখার তৈয়ারী করতে পারি।

ফলে আমি পানমুনজম শান্তি সম্মেলন থেকে আপাতত বড়জোপ মধ্যপন্থী ও বিদ্যমান রাজনৈতিক স্থিতাবস্থার অক্ষুণ্নতামূলক একটি ফলাফল প্রত্যাশা করছি...।

ইমরান চৌধুরী

বিষয়: আন্তর্জাতিক

৬১৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

385189
২৯ এপ্রিল ২০১৮ সকাল ১০:৪৬
হতভাগা লিখেছেন : দুই কোরিয়া এক হয়ে গেলে আমেরিকা তথা পশ্চিমাদের জন্য মাথা ব্যথার কারণ হয়ে যাবে।
385190
২৯ এপ্রিল ২০১৮ সকাল ১১:০৫
ওয়েলকামজুয়েল লিখেছেন : চিন সাময়িকভাবে এটাই চায়। তবে কোরিয়ার জন্য জাপান সবসময়ই একটা হুমকি হয়ে থাকবে। পশ্চিমারা সর্বশেষ জাপানকে ব্যবহার করতে পারে।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File