এক বীরের কথা
লিখেছেন লিখেছেন ওয়েলকামজুয়েল ১৯ এপ্রিল, ২০১৮, ১০:৪৭:১৫ সকাল
১৮ বছর আগে ২০০১ সালের ১৬ এপ্রিল সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পদুয়ায় ভারতের কব্জা থেকে বাংলাদেশ কতৃক একটি অপদখলি ভূখণ্ড অতর্কিত আক্রমণের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বহুল আলোচিত পদুয়া-বড়াইবাড়ীর যুদ্ধের। এর দুই দিন পর ভারত পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পদুয়া থেকে আনুমানিক আড়াইশো কিলোমিটার দূরে কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার বড়াইবাড়ীতে হামলা করে। সেখানেও ভারতের সামরিক শিকস্ত ঘটে। আর বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করে এমন এক যুদ্ধের, যেখানে প্রশিক্ষিত বিডিআর সৈন্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিলেন ১৯৭১ সালে অস্ত্র সমর্পণ করা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। এমনকি ছমিরন বেওয়া নামের এক ষাটোর্ধ বৃদ্ধাও রামদা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো আঙ্গিনায় অনুপ্রবিষ্ট বিএসএফ সৈন্যদের প্রতিহত করতে।
৪/৫ দিন স্থায়ী এই যুদ্ধের ঠিক দুই মাস পরই তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলো। অর্থাৎ সময়টি ছিল নির্বাচনের, এবং অতীব স্পর্শকাতর।
ফলে নির্বাচনী বছরে ঘটা এই যুদ্ধ নিয়ে কানাঘুষা শুরু হতে বেশি সময় নেয়নি। ব্যাপকভাবে ছড়ানো হয়েছিলো, নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলতেই এই যুদ্ধ ঘটানো হয়েছিলো। এটা এমনকি ২০১১ সালেও শুনতে পেয়েছি। সেই বছর স্বাধীন বাংলাদেশের চল্লিশতম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিবিসি বাংলা কতৃক আয়োজিত 'চল্লিশে বাংলাদেশ' নামের একটি সিরিজে স্বাধীনতার পরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি হিসেবে ২০০১ সালের বাংলাদেশ-ভারত যুদ্ধও আলোচিত হয়। সেখানে বিবিসির সাংবাদিক কাদির কল্লোল সরাসরিই ২০০১ সালের যুদ্ধের নায়ক জেনারেল ফজলুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এই বিষয়ে। এও অভিযোগ তোলা হয়েছিলো জেনারেল ফজলুর রহমান পাকিস্তান থেকে উৎকোচের বিনিময়ে এই যুদ্ধ লাগিয়েছিলেন।
কিন্তু কথা হচ্ছে, যেখানে দুই দুইটি স্থানে যুদ্ধে ভারত বাংলাদেশের নিকট পরাজিত হয়েছিলো, সেখানে কিভাবে বাংলাদেশ সরকার তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে?
যাহোক, পাকিস্তানের কথা যখন আসেই, তখন জেনারেলের একটি মজার ঘটনার উল্লেখ না করে আর পারলাম না। এটা ২০১৪ সালের দিকে শোনা। আজ মনে হয় সেই ঘটনা উল্লেখ করার সময় এসেছে!
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি যখন জেনারেল ব্রিগেডিয়ার মনসবে ছিলেন, তখন তিনি উচ্চতর প্রশিক্ষণে আমেরিকায় যাবার জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিতে ফেলে তাঁর কোর্স আমেরিকার বদলে পাকিস্তানে ফেলে দেয়া হয়। আর বাংলাদেশে অলিখিত দস্তুর হচ্ছে, যে অফিসার পাকিস্তান থেকে এনডিসি করে আসবেন, তিনি প্রধান সেনাপতির পদের জন্য কার্যত অযোগ্য। অর্থাৎ জেনারেল ফজলুর রহমানের ক্যারিয়ার ধ্বংস করার ছক কষা হয়ে গেছিলো।
যাহোক, পাকিস্তানের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে কোর্সে যোগদানের জন্য নিজের বৃত্তান্ত ঢাকাস্থ পাকিস্তানী হাইকমিশনে দাখিল করার সময় তিনি নিজের বৃত্তান্তে লাল বোল্ড ইংরেজি হরফে নিজের বিশেষ যোগ্যতা সম্পর্কে লিখেছিলেন, "PARTICIPATED IN THE WAR OF LIBERATION OF BANGLADESH ACTIVELY IN 1971 AS A MUKTI BAHINI CAMP COMMANDER"!
ইসলামাবাদে গিয়েও বেশ কয়েকবার তিনি পাকিস্তানীদের কয়েকটি করে হার্ট বিট মিস করান। স্থানাভাবে এমন দুটির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া যেতে পারে।
কোর্স চলাকালীন সময়ে বিদেশী শিক্ষার্থীদের কান্ট্রি প্রেজেন্টেশনের সময় এনডিসিতে উন্মুক্ত আলোচনা হয়ে থাকে। উন্মুক্ত মানে উন্মুক্ত। এতে মত প্রকাশে কোন কূট কৌশল অবলম্বনের ধার ধারতে হয়না। এমনই এক উন্মুক্ত আলোচনায় হল ভর্তি বিভিন্ন মনসবের বিভিন্ন দেশীয় অফিসারদের সামনে ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমানের সামনে কতিপয় পাকিস্তানী অফিসারদের দিক থেকে বাঙ্গালীদের পাকিস্তান ভাঙ্গার দায়ে অভিযুক্ত করে বিভিন্ন প্রশ্ন তোলা হয়।
তির্যক প্রশ্নের তির্যক জবাব দিতে গিয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল উল্লেখ করে জেনারেল ফজলুর রহমান বলেন, ১৯৭১ সালে বেয়াড়া সংখ্যালঘিষ্ঠদের স্বেচ্ছাচারিতা থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করতেই বাঙ্গালীরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলো! অধিকিন্তু, তিনি মনে করেন বর্তমান পাকিস্তান বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এবং বাংলাদেশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে তিনি পাকিস্তানকে এখানে দাঁড়িয়ে ক্লেইম করতে পারেন! কেবল তাই নয়, তিনি মনে করেন বাংলাদেশের মত না নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের নাম বদলে কেবল পাকিস্তান রাখা আইন বহির্ভূত কাজ হয়েছে!
এটা শুনে রাগে কাঁপতে কাঁপতে এক পাকিস্তানী অফিসার বলে ওঠেন, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের নাম বদলালো কেন? তখন ফজলুর রহমান বললেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে বাঙ্গালীর সেই অধিকার রয়েছে, যা সংখ্যালঘিষ্ঠ হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের নেই!
আর যায় কই! হল জুড়ে তীব্র হৈহৈ শুরু হয়ে যায়। অফিসারদের শান্ত করতে স্বয়ং এনডিসি কমান্ডেন্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুহাম্মদ মকবুল উঠে দাঁড়ান এবং বলেন, "Gentlemen, I think Fazl has a point. I am agree with him!" এটা শুনে নাকি পুরো হল নিস্তব্ধ হয়ে গেছিলো। তবে এই ঘটনার পর জেনারেল ফজলুর রহমান বেশ কয়েকদিন কতিপয় পাকিস্তানী অফিসারের চোখের আগুনে ভস্মীভূত হতে থাকেন।
আরেকবার এরচেয়েও আরও স্পর্শকাতর বেজায়গায় আঘাত করেন তিনি। একবার এনডিসির রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস গ্রুপে 'Aim and Objective of Pakistan in 21st century' নিয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান ভারত বা পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির বদলে কাশ্মীরের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে মত দিয়ে পুরা এনডিসির মাথার উপরে আকাশ ভেঙ্গে ফেলেন! এই মন্তব্যের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ অফিসাররা ফজলুর রহমানকে ঘেরাও করে প্রতিবাদ ও রক্তচক্ষু দেখানো শুরু করে। কয়েক ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর কমান্ডেন্ট জেনারেল মকবুলের মধ্যস্থতায় ফজলুর রহমান ছাড়া পান। তবে তাকে তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছিলো, যার জন্য তিনি এখনো প্রায়ই দুঃখ করে থাকেন! :D
যাহোক, কথা শুরু হয়েছিলো ২০০১ সালের বাংলাদেশ-ভারত যুদ্ধ নিয়ে। সেই যুদ্ধের শেষে ভারত একটি সরকারী চিঠি দিয়েছিলো। সেই চিঠিতে নিঃশর্ত আলোচনার কথা ছিল। আমার মনে হয়, বিভিন্ন স্থানে থাকা ওই চিঠির অনুলিপি প্রকাশ করলেই ল্যাঠা চুকে যায়। এতে স্পষ্ট হবে, ওই যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো, নাকি ভারত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো!
কারণ পরে কিন্তু আমরা দেখলাম, জেনারেল ফজলুর রহমানকে প্রথমে বিডিআর থেকে বদলী করে বগুড়ার জিওসি করা হলো। ২০০১ সালের অক্টোবরে নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হবার কয়েক মাসের মাথায় জেনারেল ফজলুর রহমানকে সেনাবাহিনী থেকেই বের করে দেয়া হলো।
আরেকটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, তাঁকে পূর্ণ মেয়াদে চাকুরি করার সুযোগ দেয়া হলে, আর জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরীর পর ছয় জেনারেলকে ডিঙ্গিয়ে জেনারেল মইন উদ্দীন আহমেদকে প্রধান সেনাপতি না করা হলে, ২০০৬-০৭ সালে জেনারেল ফজলুর রহমানই হয়তো সেনাপ্রধান থাকতেন। সেক্ষেত্রে দেশের বর্তমান ইতিহাস আর যাই হোক, ঠিক আজকের মতো থাকতো না...!
কৃতজ্ঞতা ইমরান চৌধুরী
বিষয়: বিবিধ
৬৪২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন