সতেরো বছর আগের এই দিনটি
লিখেছেন লিখেছেন ওয়েলকামজুয়েল ০২ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৩:১৫:৫৩ দুপুর
আমার স্পষ্ট মনে আছে আজ থেকে সতেরো বছর আগের এই দিনটির কথা। সেদিনের রৌদ্রোজ্জ্বল মিষ্টি শীতের সকালে ঘরের দাওয়ায় রোদে পিঠ দিয়ে বসে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়াম থেকে সরাসরি সম্প্রচারকৃত অনুষ্ঠানটি দেখছিলাম। স্টেডিয়ামজুড়ে ছিল জলপাই রঙের এলোমেলো উর্দি পরিহিত পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্রিয়াশীল বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন জেএসএস শান্তিবাহিনীর সদস্যরা। তাদের থেকে কিছুটা তফাতে সাজানো ছিল তাদের ব্যবহার করা বেশ কিছু রাইফেল। তারা এখানে অস্ত্র সমর্পণ করতে এসেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা ইতিউতি বিক্ষিপ্তভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন মাঠজুড়ে। কিন্তু তাঁদের কালো চশমার পেছনে তখন ব্যাপক চাঞ্চল্য।
বেলা গড়াতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নেতা সাফারি স্যুট পরিহিত সন্তু লারমা প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ওয়াজেদের হাতে একটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল তুলে দিলেন। কলাপাতা রঙের শাড়ী পরিহিত প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়ানো বিমানবাহিনীর অফিসার, যিনি প্রেষণে এসএসএফে এসেছিলেন, ছিলার মতো টানটান স্নায়ু নিয়ে দৃঢ় মুষ্টিতে পাকড়ে রেখেছেন সন্তু লারমার রাইফেলটি।
সতেরো বছর আগে নেহায়েত একজন ছোট শিশু হিসেবে এসব আমার নজরে আসছিলো। তাছাড়া চতুর্দিকে গ্যালারী ছাওয়া জনাকীর্ণ খাগড়াছড়ি স্টেডিয়াম নিয়েও ভাবছিলাম। শক্ত মুড়ির মোয়ায় কামড় বসাতে বসাতে কেন যেন ভাবছিলাম, এই স্টেডিয়ামে ক্রিকেটের বড় বড় ম্যাচ আয়োজন করা সম্ভব!
সেদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির গুরুত্ব সম্পর্কে বেখবর থাকলেও এখন অনেকটাই বুঝতে পারি। এই শান্তিচুক্তি শুধু পাহাড়ে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠাই করেনি, অন্যরকম এক সম্ভাবনার দ্বারও উন্মোচন করেছে। সম্ভবত পাহাড়ে সেনাবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি গাড়তে পারাই ছিল সরকারের উদ্দেশ্য। কারণ এর আগে কাপ্তাইয়ের পূর্ব দিকের গহীন অরণ্যে বাংলাদেশের সামরিক উপস্থিতি ছিলোনা বললেই চলে। সতেরো বছরে সেই উদ্দেশ্য অনেকটাই সফল হয়েছে। পাহাড়ে এখন বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ আধিপত্য।
তবে বিদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা অভিযানের মতোই এখানেও সেনাবাহিনী ব্যাপক জনকল্যাণমূলক কাজে নিজেকে লিপ্ত করেছে। কিন্তু এই কথা কেউ বলেনা। আমার নিজের চোখ সাক্ষী, সুদূর থানচির এমন এমন সব দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় দুই হাজার মিটার উঁচু পাহাড় দিয়ে এমন সব পিচঢালা পথ হয়েছে, যা শান্তিচুক্তির আগে কল্পনাও করা যায়নি। ব্রহ্মদেশ সীমান্তের কাছাকাছি সুদূর রেমাক্রি বাজার পর্যন্ত আমি গেছিলাম ২০১২ সালে। দেখেছি পুরো অঞ্চলে কিভাবে যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নত হচ্ছে, যার একক কৃতিত্ব সেনাবাহিনীর নির্মাণ প্রকৌশলীদের।
১৭ ইসিবি কতৃক নির্মিত থানচি উপজেলার সেই পাহাড়ি পথে পিকআপে চড়ে যেতে যেতে প্রায়ই দেখতাম খুটখুট করে নিবিষ্ট মনে কাজ করে যাচ্ছে একাকী কোন সৈন্য। আশেপাশের অসাধারণ ভূপ্রকৃতির পটভূমিকায় নিঃসঙ্গ সেই সৈন্যকে আমাদের নূরালদীন বা ইতালির গ্যারিবাল্ডির মতোই লাগতো। এমন অনেকবার হয়েছে, রাস্তা দিয়ে যাবার সময় এরকম কর্মরত কোন সৈন্যকে দেখে পরম আফসোস হয়েছে, আমি কেন ছবি আঁকতে পারিনা! যদি পারতাম তাহলে পাহাড়ি পটভূমিকায় সেই নিঃসঙ্গ সৈন্যের ছবি বড় নিষ্ঠার সাথে আঁকতাম আমি।
আমি কখনো ভুলবো না, সভ্য জগত থেকে বিচ্ছিন্ন রেমাক্রির বিজিবি ফাঁড়ীর মাটির তৈরি পাহারা চৌকিতে একটি এলএমজি হাতে দাঁড়ানো সেই তরুণ বিজিবি সৈন্যের কথা! অচেনা এই তরুণ যেন আমার যুগযুগের আত্মীয়। তাঁর চোখে স্পষ্ট হয়ে খেলা করছিলো একরাশ বেদনা- সুদূর ঠাকুরগাঁওয়ে রেখে আসা পরিবারের, নিঃসঙ্গ জীবনের, ব্যারাকের বিছানার নিচে ফণা তোলা এক বিষধর শঙ্খচূড় সাপের, মোবাইল নেটওয়ার্কহীন ফাঁড়ী থেকে এক মাইল দূরে আরেক দুর্গম পাহাড়চূড়ায় উঠে পরিবারের সাথে প্রতিদিন কথা বলার চেষ্টা করা অথবা খাবার পাতে বরাদ্দ টকে যাওয়া সিদ্ধ ডিমের তরকারীর। ভৌগলিক দুর্গমতার কারণে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার সপ্তাহে একদিন তাদের জন্য রসদ পাঠায়। বিদ্যুৎ না থাকায় সেসব ফ্রিজে সংরক্ষণেরও উপায় নেই।
কিন্তু তারপরও তাঁর মুখে নানা পরামর্শ, কিভাবে কৌশলে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি আনা যায়, কিভাবে চক্রান্তকারীদের হাত থেকে দেশের অখণ্ডত্ব সুরক্ষিত রাখা যায়। সেদিন প্রায় তিন ঘণ্টা টানা আড্ডা দেয়া সেই তরুণ সৈন্যের নামও এখন মনে পড়ছে না। ১০ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন এখন বান্দরবানে নেই, সম্ভবত কুমিল্লায়। সেই সৈন্য জানবেন না, আমি কতোটা কৃতজ্ঞচিত্তে সেদিন সেই ক্যাম্প থেকে ফিরেছিলাম। কৃতজ্ঞতা স্বীকারের তালিকায় নামের অভাব নাই- সেই লেফটেন্যান্ট মুশফিকুর রহমান থেকে শুরু করে কয়েকশো মৃত সৈন্য, যারা সত্তুর থেকে নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাঁচাতে প্রাণ দিয়েছেন।
শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো পার্বত্য চট্টগ্রামের, বিশেষত বান্দরবানের মারমা বা বম জাতিগোষ্ঠীর সরল ও সাদা মনের মানুষদের, যারা অত্যন্ত তুখোড় ফুটবল খেলে, ফোকলা দাঁতে একগাল হেসে বলে, "বাবু, নাপ্পি খাইতে মজা আছে যে", এবং সন্তু লারমার রাজনীতির সাথে যাদের সংশ্রব নেই।
এখন বুঝি, কারা কেন পাহাড় থেকে সেনা প্রত্যাহারের দাবী জানায়। কাদের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে সন্তু লারমা ২০১৫ সালের মে মাস থেকে ফের পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টির হুমকি দেয়।
অবশ্য আমার মতে, পাহাড়ে সত্তুর-আশির দশকের পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনা এখন এদের পক্ষে বেশ কঠিন। পাহাড়ের সর্বত্র এখন বাংলাদেশের সামরিক উপস্থিতি, কৌটিল্যনীতির আশ্রয় নিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে বহুদাবিভক্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। এখন তারা নিজেরাই গোলাগুলি করে মরছে। এছাড়াও বাংলাদেশের এই অবিচ্ছেদ্য ভূখণ্ডে পাহাড়ি-বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক অবস্থিতির ভারসাম্য আনার কাজও মোটামুটি ভালোই হয়েছে।
এলাহী ভরসা...!
বিষয়: বিবিধ
১১৯৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন