ছোটগল্পঃ অঙ্ক স্যার

লিখেছেন লিখেছেন মাহফুজ তানিম ৩০ নভেম্বর, ২০১৫, ১১:২৩:৩৪ সকাল



আমি কাউসার। ক্লাশ এইটে পড়ি। আমার আসল নাম খন্দকার জাহিদুল ইসলাম কাউসার। এত বড় নাম ধরে ডাকা সম্ভব না, তাই সবাই কাউসার ডাকে।

আমাদের ভাই বোন সবার নাম বাবাই রেখেছেন। বাবার আবার ছোটখাটো নাম ভয়াবহ রকমের অপছন্দ। তার কথা হলো, খানদানি বংশের গৌরব হলো নামে, নিম্নবংশের গৌরব হলো দামে, মানে টাকায়। একটা কথা বলে রাখি, আমরা কিন্তু যথেষ্ট বিত্তশালী বংশ। আমার পরদাদা বৃটিশ আমলে এক ইংরেজ অফিসারের নায়েব ছিলেন। আমাদের সেই বিত্ত -গৌরবের ছিটেফোঁটাও এখন নেই। বাবা আমাদের বড় বড় নাম রেখে সেই গৌরব রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

বড় আপার মেয়ের নাম প্রথমে রাখা হয়েছিল সু। বাবা নাম শুনেই চোখমুখ কুঁচকে ফেললেন।

গম্ভীর গলায় আপাকে প্রশ্ন করলেন -' সু আবার কেমন নাম? '

- 'মেয়ের বাবা এই নাম রেখেছে, তাকে জিজ্ঞেস কর ' আপা ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলেন ।

বাবা নাছোড়বান্দা। ঠিকই দুলাভাইকে চট করে প্রশ্ন করে বসলেন -'সু নামের ব্যাখ্যা কি? '

দুলাভাই নিতান্তই নিরীহ গোছের মানুষ। বাবার চেহারা দেখেই তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। আমতা আমতা করে বললেন -' সু অর্থ সুন্দর, আর নামটাও আনকমন। '

'তাহলে এক কাজ করো। সু না রেখে গু রেখে দাও। এটা আরো বেশি আনকমন '।

সেদিন থেকে সু পাল্টে মেয়ের নাম রাখা হলো আরজুমান্দ আরা শেফালি।

আমাকে সবাই কাউসার ডাকে কথাটা পুরোপুরি সত্যি না। স্কুলের অসাঙ্ঘাতিক স্যার আমাকে গরু বলে ডাকেন। আমি মানুষ, আমাকে গরু ডাকার কোন কারণ নেই। কিন্তু অসাঙ্ঘাতিক স্যার আমাকে গরু ডাকার অদ্ভুত কারণ বের করে ফেললেন। তার যুক্তি হলো, কাউসার নামের প্রথম অংশ হলো কাউ। যার অর্থ গরু। আর আমার স্বভাব -চরিত্র নাকি গরুর সাথে মিলে যায়। তাই তিনি আমাকে গরু বলে ডাকেন। আমি জানি, আমার স্বভাব চরিত্রে গরুর সাথে কোন মিলই নেই। কিন্তু আর সবার সাথে তর্ক চললেও অসাঙ্ঘাতিক স্যারের সাথে তর্ক চলে না। তিনি প্রচণ্ড বদরাগী মানুষ। দস্যু -সর্দার ভীমনাগের চেয়েও তার রাগ কয়েকগুণ বেশি।

স্যারকে আমরা সবাই অসাঙ্ঘাতিক ডাকার কারণ হলো তিনি প্রতিটি কথার আগে পরে অসাঙ্ঘাতিক শব্দ উচ্চারণ করেন। এইতো সেদিন স্যার যখন রোলকল করছেন, মুকুলটা পিছনে বসে শাওনের কান ধরে টান দিচ্ছিল। স্যার চশমার ফাঁক দিয়ে মুকুলকে দেখে ফেললেন। এরপর তার প্রথম বাক্য ছিল 'কি অসাঙ্ঘাতিক ! এই গাধাটা দেখি বাঁদরামি করতেছে। বড়ই অসাঙ্ঘাতিক '!

বেচারা মুকুলকে দুই ঘন্টা স্কুলের মাঠে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখলেন আমাদের অসাঙ্ঘাতিক স্যার।

তিনি হয়তো অতি সাঙ্ঘাতিক বোঝাতে চান। কিন্তু অসাঙ্ঘাতিক শব্দটি অভিধানে নেই। থাকলেও হয়তো এর অর্থ হবে যা সাঙ্ঘাতিক না, নিরীহ। কিন্তু যিনি তুচ্ছ কারণে ছাত্রদের ভয়ানক শাস্তি দেন, তিনি নিরীহ হতে পারেন না। তিনি যথেষ্ট সাঙ্ঘাতিক।

স্যারের পুরো নাম মোঃ নজরুল ইসলাম। তিনি আমাদের ফাইভ থেকে অঙ্ক ক্লাশ নেন । ফোরে পড়াকালীন অঙ্ক ক্লাশ তার কাছে ছিল না। ফাইভে উঠে জানতে পারলাম আমাদের অঙ্কের জন্য নতুন টিচার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রথমদিন স্যারকে দেখে আমাদের কারোই পছন্দ হয়নি। বেঁটে মতো গোলগাল শরীর। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে রেখেছেন। নাকের ডগায় একটা চশমা ঝুলছে বটে, কিন্তু ভুলেও চশমার ভেতর দিয়ে তাকান না। চশমার ফাঁক দিয়ে কুৎসিতভাবে তাকান।

তিনি আমাদের ক্লাশ শুরু করার পর থেকে আমাদের মধ্যে প্রবল অঙ্কভীতি তৈরি হলো। স্যারের অঙ্ক করানোর পদ্ধতি ছিল বড়ই অদ্ভুত। ক্লাশে ঢুকে এক হাতে ডাস্টার এক হাতে চক নিয়ে পুরো বোর্ড জুড়ে অঙ্ক কষতেন। লেখা শেষ হলে আমাদের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, 'বয়েজ মাথায় ঢুকেছে?'

তিনি আবার ধমক ছাড়া কথা বলতে পারতেন না। সেই ধমক সাধারণ ধমক না, ভয়াবহ ধমক। একবার রিকশা ভাড়া নিয়ে গণ্ডগোল হওয়ায় রিকশাওয়ালাকে ধমক দিয়েছিলেন। সেই ধমকে রিকশার সামনের চাকা বাস্ট হয়ে গিয়েছিল।

স্যারের এই ধমক খেয়ে সবাই না বুঝেই বলতাম, জি স্যার! বুঝেছি।

সাথে সাথে তিনি আরেকটি অঙ্ক লেখা শুরু করতেন। আর আমরা বেকুবের মতো হা করে বোর্ডের দিকে চেয়ে থাকতাম।

একবার ক্লাশ ক্যাপ্টেন রাতুল মিনমিন করে বলেছিল -'এই অঙ্কটা বুঝিনি।'

অঙ্ক স্যার প্রথমে রাতুলের দিকে রাগী চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। মনে হয় এমন আজগুবি কথা কখনোই শুনেন নি। এরপর বাজখাঁই কণ্ঠে বললেন,' ছাগল তো দেখেছি। তোমার মতো উন্নত জাতের ছাগল দেখিনি। তুমি দেখি হাইব্রিড ঘাস খাওয়া ছাগল।'

রাতুলের ফর্সামুখ লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল। বেচারা কেঁদে কেটে একাকার করে ফেলেছে।

যাইহোক আমাদের অঙ্কের অবস্থা দিনদিন খারাপ হতে লাগলো। তৈলাক্ত বাঁশ আর পিতাপুত্রের বয়স বের করার অঙ্ক ভয়াবহ জটিল মনে হল। আর সরল অঙ্ক যে এত গরল এই প্রথম হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। আমাদের অঙ্ক শেখানোর চেয়ে শাস্তি দিতে স্যারের আগ্রহটা বেশি ছিল।তিনি প্রতিদিন শাস্তি দেয়ার নতুন স্টাইল উদ্ভাবন করতেন। একবার শিমুলকে ' আমি গাধা ' বাক্য কাগজে বিশবার লিখে সেটা গলায় ঝুলিয়ে পুরো স্কুল ঘোরালেন। কারণ সে বাসা থেকে অঙ্ক করে আনেনি। আরেকবার ক্লাশে ঢুকে দেখলেন আমরা সবাই কি একটা বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করছি। স্যার শাস্তি ঘোষণা করলেন, সবাইকে বেঞ্চের নিচে মাথা দিয়ে ক্লাশ করতে হবে।

সিক্সের ফাইনাল পরিক্ষায় অঙ্ক ভয়ানক খারাপ হলো। আমি ডাব্বা মারলাম। ডাব্বা মানে জিরো। আমাদের স্কুলে কেউ জিরো পেলে তাকে ডাব্বা বলা হয়। আমার খাতায় স্যার বড় করে লিখলেন, গরু। খাতা দেখে মুকুলটা ফিক করে হেসে দিল। স্যার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। 'এই হাসে কে রে? এটা কি হাসির ক্লাশ।'

সেদিন আমার প্রচণ্ড অভিমান হয়েছিল। রুম থেকে বের হয়ে খাতাটা কুটিকুটি করে ছিঁড়ে বাতাসে উড়িয়ে দিলাম। আমার আবার অভিমান জিনিসটা অনেক বেশি।

এভাবে করে কোনমতে সেভেনে উঠলাম। এক বিকেলের কথা। রাতুলের কাছে শুনলাম আমাদের অঙ্ক স্যার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে হাসপাতালে নিতে হয়েছে। মনটা একটু খারাপ হল। পরদিন স্কুলে গিয়ে শুনলাম আমাদের অঙ্ক করানোর জন্য নতুন স্যার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আগের অঙ্ক স্যারের অবস্থা বেশি ভালো না। কথা বলতে গেলে গলা দিয়ে তাজা রক্ত আসছে। অপারেশন করতে হবে খুব দ্রুত।

একদিন আমাদের ব্যাচের সবাই মিলে স্যারকে দেখতে গেলাম। রাতুল বুদ্ধি করে কতগুলো ফুল নিয়ে গেল। মুখ চোখ শুকিয়ে এই কয়দিনে স্যার অর্ধেক হয়ে গেছেন। তাকে যথেষ্ট বুড়ো দেখাচ্ছিল।স্যার আমাদের দেখে খুব খুশি হলেন। তাকে দেখার জন্য পুরো ক্লাশ চলে আসব, তিনি ভাবেন নি। আমাদের সমাজে শিক্ষকদের ওপরে ওপরে সম্মান করা হয় বটে কিন্তু তাদের বিপদের সময় কাউকে কাছে পাওয়া যায়না।

ভিজিটিং আওয়ার শেষে বের হচ্ছি -স্যার গলার স্বর নামিয়ে বললেন,' তোদের কাছে আমার ক্ষমা প্রার্থনার একটা ব্যাপার আছে।'

আমরা আগ্রহ ভরে তাকালাম। স্যার বললেন, আমি তোদের অনেক শাস্তি দিয়েছি, পারলে ক্ষমা করে দিস।

আমরা কোন কথা বলতে পারলাম না। আবেগে আমাদের চোখ ভিজে গেছে। চোখ মুছতে মুছতে বাইরে চলে এলাম।

সেভেনের ফাইনাল পরিক্ষার দুই মাস বাকি। আমরা চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করলাম। অঙ্ক কিচ্ছু পারিনা। পাশ করতে পারি কিনা সেই চিন্তা মাথায় ঢুকলো। ততদিনে অসাঙ্ঘাতিক স্যার স্কুল থেকে অবসর নিয়েছেন গলার সমস্যার কারণে। কিন্তু তিনি যে স্কুল, ছাত্রছাত্রীদের প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন তা বুঝা গেল তার অবসর যাপনের পর।

স্যার প্রতিদিন ক্লাশের সময় স্কুলের পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কেউ জিজ্ঞেস করলে লাজুক গলায় বলতেন, 'পোলাপানের কিচিরমিচির না শুনলে ভালা লাগে নারে।'

এই প্রথম আমাদের মনে হল, তিনি আসলেই অসাঙ্ঘাতিক স্যার, মোটেও সাঙ্ঘাতিক নন।

সর্বশেষ অসাঙ্ঘাতিক স্যার আমাদের বিনি পয়সায় অঙ্ক কোচিং করিয়েছেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে আমাদের জন্য দিনরাত গাধার খাটুনি খেটেছেন।

ফাইনালের রেজাল্টের দিন দেখা গেল আমরা সবাই অঙ্কে গড়ে আশি নব্বুই করে পেয়েছি। আগে আমরা বলাবলি করতাম অঙ্ক স্যার হাসতে পারেন না। কারণ তাকে কখনোই হাসতে দেখা যায়নি। কিন্তু আমাদের বিস্ময়কর রেজাল্টের কথা শুনে আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে এমন প্রাণখোলা হাসি দিয়েছিলেন, যে হাসির কথা আমরা কখনোই ভুলবো না

বিষয়: সাহিত্য

১০৯১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File