উপমহাদেশে হাদিসের প্রথম বিদ্যাপীঠ
লিখেছেন লিখেছেন মাহফুজ তানিম ২৩ নভেম্বর, ২০১৫, ০৬:২১:৪৪ সন্ধ্যা
ইসলামের ঊষালগ্ন থেকেই তার পরশ পেয়ে ধন্য হয় ভারতীয় উপমহাদেশ। তবে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে সেন বংশের সর্বশেষ নৃপতি লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি বাংলায় সর্বপ্রথম মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলে বাংলায় ইসলাম ব্যাপকভাবে প্রচার হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্র এবং ভৌগোলিক বিবরণ থেকে জানা যায়, ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর থেকে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে এসেছেন অসংখ্য অলি-আউলিয়া, পীর-দরবেশ, সুফি-সাধক, ধর্ম প্রচারক ও আধ্যাত্মিক সাধক। যাদের সাধনায় ধন্য আমাদের এ পুণ্যভূমি বাংলাদেশ।
এসব মহাপুরুষের মধ্যে শেখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.) অন্যতম। তিনি ছিলেন ইয়েমেনের অধিবাসী। আনুমানিক ১২৭৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিল্লিতে আগমন করেন। উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম প্রচার করা। তখন গিয়াসউদ্দিন বলবনের আমল। লোকজন আল্লাহর এই অলির আগমনে সীমাহীন আনন্দিত হয়। সবাই ভিড় জমাতে থাকে তার দরবারে। এভাবে তার জনপ্রিয়তা এক পর্যায়ে বাদশাহর প্রসিদ্ধি ও প্রভাবকেও অতিক্রম করে। অবস্থা বেগতিক দেখে গিয়াসউদ্দিন বলবন আবু তাওয়ামাকে অনুরোধ করে পাঠিয়ে দেন বাংলায়। তিনি তদানীন্তন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওয়ে এসে ধর্মপ্রচার শুরু করেন।
তবে উপমহাদেশের ধর্মীয় ইতিহাসে এই মহাপুরুষ কালজয়ী হয়ে থাকবেন তার একটি মহান কর্মের কারণে। তিনি সোনারগাঁওয়ে এসেই বর্তমান মোগরাপাড়ার দরগাবাড়ি প্রাঙ্গণে গড়ে তোলেন একটি বৃহৎ মাদরাসা ও সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। হাদিস এবং ইসলামী আইনশাস্ত্রের পাশাপাশি তিনি ভেষজশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, ভূগোলশাস্ত্র এবং রসায়নশাস্ত্রেও একজন পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন বলে সেই লাইব্রেরিও ছিল বেশ আধুনিক ও মানসম্পন্ন। গবেষকদের মতে, তার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাই ছিল উপমহাদেশে ইলমে হাদিসের সর্বপ্রথম বিদ্যাপীঠ। দূর-দূরান্ত থেকে এখানে ছাত্ররা এলম অর্জনের উদ্দেশ্যে ছুটে আসত। ধারণা করা হয়, তখন এ মাদরাসার ছাত্রসংখ্যা ছিল ১০ হাজার। তিনি এখানে দীর্ঘ ২৩ বছর হাদিসের পাঠ দিয়েছেন। সেখানে একটি খানকাও প্রতিষ্ঠা করেন। ‘মানজিলে মাকামাত’ নামে তাসাউফ সম্পর্কে লিখিত তার একটি বইও পাওয়া যায়। এছাড়াও সোনারগাঁও বিদ্যাপীঠে অবস্থানকালে শায়খ ছাত্রদের উদ্দেশে ফিকাহবিষয়ক যেসব বক্তৃতা দিয়েছেন, সেগুলোর সঙ্কলন নিয়ে ফার্সি ভাষায় রচিত ‘নামায়ে হক’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এ গ্রন্থে ১৮০টি কবিতা আছে। কেউ কেউ তা ‘মছনবী বনামে হক’ নামে অভিহিত করেছেন। গ্রন্থটি ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাই থেকে এবং ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে কানপুর থেকে প্রকাশিত হয়। জানা যায়, শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামার লিখিত পান্ডুলিপির অস্তিত্ব ব্রিটিশ জাদুঘরের আর্কাইভ ভবনে রক্ষিত আছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিশ্বকোষ মতে, এর মধ্য দিয়েই উপমহাদেশের ইতিহাসে হাদিসের আনুষ্ঠানিক পাঠদান শুরু হয়। শায়খ তাওয়ামা এখানে বোখারি, মুসলিম ও মুসনাদে আবু ইয়ালার দরস প্রদান করতেন। অল্পদিনেই এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। দূর-দূরান্ত থেকে হাদিসের জ্ঞানপিপাসু শিক্ষার্থীরা তার হাদিসের দরসে শরিক হতে শুরু করে। তার শিষ্যত্ব গ্রহণের জন্য সমবেত হয় সুদূর দিল্লি এবং সেরহিন্দ থেকে আসা ছাত্ররাও। তাছাড়া পূর্ববাংলার রাজধানী হিসেবে সোনারগাঁওয়ে বহু সংখ্যক হাদিস বিশারদ সমবেত হন। এমনকি বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলায় ১৩৪৫ সালে আগমন করলে তখন তার রেহালায়ে ইবনে বতুতায় এই ঐতিহাসিক মাদরাসার কথা উল্লেখ করেন।
শায়খ আবু তাওয়ামা ৭০০ হিজরি মোতাবেক ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তার মুত্যুর পরও ওই মাদরাসা অনেক দিন স্থায়ী হয়। কিন্তু কালের পরিক্রমায় এক সময় হারিয়ে যায় এই বিদ্যাপীঠ, এখন সেই মাদরাসাটির অস্তিত্ব আর নেই। তবে ঐতিহাসিক বিদ্যাপীঠটির ভবনের কিছু ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। ১৯৮৪ সালে ইসলামী দার্শনিক ও চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.) হিন্দুস্থান থেকে সোনারগাঁওয়ে এসে খুঁজে বের করলেন সেই স্থান এবং শায়খের কবর জিয়ারত ও মোনাজাত করেন। এখানে এসে তিনি অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। তিনি এর অদূরে ওই এলাকায় শায়খ শরফুদ্দিনের স্মৃতি রক্ষার্থে ‘মাদরাসাতুশ শরফ’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করে যান।
ঐতিহ্যবাহী সেই দরসগাহে হাদিসের প্রায় সবটুকু কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে চুন-সুরকির গাঁথুনির প্রধান ফটকটি। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখন তা জরাজীর্ণ। পাশেই শুয়ে আছেন এক সময়ের প্রখ্যাত শায়খুল হাদিস হজরত শাহ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.)।
সরেজমিন গিয়ে সেখানে একটি ভগ্নপ্রায় দালান দেখা যায়। অবহেলা আর অযত্নে কোনোমতে টিকে আছে এটি। স্থানীয় জনসাধারণ জানান, দালানের অলঙ্কৃত তোরণ, প্রশস্ত কক্ষ এবং দোতলায় ওঠার সিঁড়ি প্রমাণ করে এ দালানই মাদরাসা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দেয়ালগুলো প্রশস্ত এবং পুরু, ইটগুলো ছোট ছোট পাতলা জাফরি ইট। চারপাশের দেয়ালে মেঝের তিন ফুট ওপর থেকে প্রায় ছাদ পর্যন্ত রয়েছে ইটের গাঁথুনিতে করা সেলফ। দেখেই বোঝা যায়, এটিই ছিল এক সময়ের সরগরম বিদ্যাপীঠের সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। দরজা দিয়ে ভেতরে গেলে দেখা যায় ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। জানালাবিহীন কামরা।
কামরাটির ডান পাশ দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে নেমে গেছে সরু একটি সিঁড়ি। দুজন একসঙ্গে নামার উপায় নেই তা দিয়ে। ৮ থেকে ১০টা সিঁড়ি ভাঙার পর মোড় নিতে হয় হাতের বাঁ দিকে। তখন আর খালি চোখে কিছুই দেখা সম্ভব নয়। অন্ধকারে চোখের আলো কোনো কজে আসে না। গা ছমছমে পরিবেশ। ৮ থেকে ১০ বর্গফুটের একটি কামরা। উচ্চতা হবে সর্বোচ্চ ছয় ফুট। জনশ্রুতি আছে, এটি ছিল হজরত শাহ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.) এর ইবাদতগাহ। ভগ্নপ্রায় ভবনটি ওই এলাকায় ‘আন্ধার কুটির’ নামে পরিচিত। এখানেই নীরবে-নিভৃতে ইবাদত করতেন তিনি এবং হয়তো তার ভক্তবৃন্দ ও ছাত্ররাও।
এলাকার বাসিন্দারা বলেন, কয়েক বছর আগে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দায়িত্বশীলরা এসে এই স্মৃতি সংরক্ষণের কথা বলে গেলেও এরপর আর কোনো খবর নেই। মাদরাসাতুশ শরফের প্রিন্সিপাল মাওলানা উয়ায়দুল কাদের নাদভি বলেন, এই আসনের এমপি লিয়াকত হোসেন খোকা এক বছর আগে আমাকে তার অফিসে নিয়ে সুপ্রাচীন এই মাদরাসা দখলের হাত থেকে মুক্ত করে পুনরায় সংস্কার করার কথা বলেছেন। কিন্তু এরপর আর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। অথচ অনতিবিলম্বে তা সংরক্ষণ করা না গেলে অচিরেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে ঐতিহাসিক এ স্থানটি। হাদিসশাস্ত্রের সঙ্গে এ দেশের প্রাচীন ও নিবিড় সম্পর্কের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে স্থানটির গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। যথাযথ সংস্কার ও পরিচর্যার মাধ্যমে স্থানটি উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্পটে পরিণত হতে পারে। এমনকি জাতীয়ভাবে উদ্যোগ নিলে এটি হতে পারে গবেষণার উপযুক্ত স্থান। ইতিহাসের নতুন অধ্যায় উন্মোচিত হতে পারে এর মাধ্যমেই। তাই দ্রুত এর সংস্কার প্রয়োজন। এ বিষয়ে সর্বপ্রথম এগিয়ে আসতে হবে সরকার এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের।
বিষয়: বিবিধ
২২৯৭ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন