সাবধান! প্রতারণার নয়া সিস্টেম

লিখেছেন লিখেছেন মুফতি আইয়ুব ধর্মপুরী ০১ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৯:৩৯:০২ রাত



হ্যালো, আমি শেখ হেলাল বলছি।আপনি কি ডিসি বলছেন? হ্যাঁ বলছি। আপনি কোন শেখ হেলাল? চিনতে পারছেন না ডিসি সাহেব। বাংলাদেশে কয়টা শেখ হেলাল আছে। ‘স্যার’। কি মনে করে ফোন করেছেন, স্যার। ডিসি সাহেব, আপনার পুলিশ তো আমার এক আত্মীয়কে ধরে নিয়ে এসেছে। বলেন কি স্যার। এখনই ছাড়ার ব্যবস্থা করছি। আর কিছু করতে হবে স্যার। না। তবে পারলে ওকে কিছু টাকা দিয়ে দিয়েন। কত দিব স্যার? হাজার পঞ্চাশেক দিয়েন।

এভাবেই ভুয়া এক শেখ হেলালের কথোপকথন ধরা পড়ে একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার ফোন কল মনিটরিংয়ে। পরে শেখ হেলাল পরিচয় দেয়া ওই ব্যক্তি সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করে গোয়েন্দারা। দেখা যায় প্রায় প্রতিদিনই সে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে শেখ হেলাল পরিচয় দিয়ে ফোন করছে। পরে তাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাবের হাতে তুলে দেয়া হয়। প্রতিদিনই অপরিচিত মোবাইল নম্বর থেকে ফোন আসে। কোন নম্বর কি বার্তা নিয়ে আসছে আগে থেকে জানার উপায় নেই। কিন্তু ফোন ধরলেই এখন বিপত্তিতে পড়ছেন অনেকে। গ্রামীণফোনের কাস্টমার কেয়ার থেকে বলছি… এমন ফোন আসছে প্রায়ই। ফোন করে বলা হচ্ছে আপনি গ্রামীণফোনের পুরস্কার জিতেছেন। এ চিত্র প্রতিদিনই বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে। গত বৃহস্পতিবার একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকের মোবাইলেও ফোন আসে। পুরস্কার জয়ের সংবাদ জানিয়ে ফোন আসে ০১৭৭১৯৮৪১১৯- এই নম্বর থেকে। বলা হয়, গ্রামীণফোনে আপনাকে স্বাগতম! আমাদের র‌্যানডম সিলেকশন ছিল। তাতে আপনি ৯ লাখ ৯৮ হাজার টাকা পুরস্কার পেয়েছেন। এটি দ্বিতীয় পুরস্কার। এর আগে আপনাকে একাধিক এসএমএস করা হয়েছে। কিন্তু আপনি সাড়া দেননি। এর পর কথিত কাস্টমার কেয়ার অফিসার প্রশ্ন করেন, আপনার মোবাইল ফোন কি প্রিপেইড না পোস্টপেইড? আপনি সর্বশেষ কত টাকা রিচার্জ করেছেন? (এসব কথা বলার সময়ে পাশ থেকে গ্রামীণফোনের রেকর্ড বাজানো হয়, তাতে শোনা যাচ্ছিল- গ্রামীণফোনে আপনাকে স্বাগতম…)। আপনি এই নম্বরে ফোন করে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। বিষয়টি আর কাউকে বলবেন না। নম্বরটি কাউকে জানাবেন না। একপর্যায়ে ফোনকারীকে প্রশ্ন করা হয়- প্রিপেইড না পোস্টপেইড তা তো আপনার জানার কথা। জেরার মুখে ফোন লাইন কেটে দেয় প্রতারক। এ রকম আরও কিছু ফোনের নমুনা। ফোন করা হয় বাসার কাজের বুয়াকেও। বুয়া তার গৃহকর্ত্রীকে বলেন, আফা এক বেটায় আমারে ফোন কইরা কইছে আমি নাকি ১৫ লাখ টাকা পাইছি। কয় ১৫ হাজার ট্যাকা নাকি নিয়া যাইতে হইব। তইলে ১৫ লাখ ট্যাকা পামু। সচেতন গৃহকর্ত্রী তাকে এ প্রতারণা থেকে সাবধান থাকতে বলেন। আদাবরের একটি মেসের বোর্ডার পলাশ তার বন্ধুদের নিয়ে তাস খেলছিলেন। হঠাৎ তার মোবাইল বেজে ওঠে। নম্বর অপরিচিত। ফোন ধরতেই অস্বাভাবিক যান্ত্রিক একটি কণ্ঠ বেজে ওঠে। অপর প্রান্ত থেকে বলা হয় তিনি জিনের বাদশা। দুনিয়ার কয়েক কোটি মানুষের মধ্য থেকে ভাগ্যবান কতিপয় মানুষকে জিন প্রজাতির পক্ষ থেকে ফোন করা হয়। পলাশ সেই ভাগ্যবানদের একজন। পলাশ উৎসাহ বোধ করেন। কিছুক্ষণ পর তাকে কল ব্যাক করতে বলা হয়। কারণ হিসাবে বলা হয় এটি জিন প্রজাতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন। তাকে কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করে শোনানো হয়। ইসলামের নানা শাশ্বত বাণী শুনিয়ে নামাজ পড়তে উৎসাহিত করেন কথিত জিনের বাদশা। এভাবে কথা চলতে থাকে। প্রতিদিন এশার নামাজের পর অপরিচিত সব নম্বর থেকে ফোন আসত। কিছুক্ষণ কথা বলার পরই ফোন ব্যাক করতে হতো পলাশকে। একদিন জিনের বাদশা পলাশকে তাদের অপরূপ সুন্দরী নাতনির সঙ্গে বিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেন। বলেন, জিন প্রজাতির বিশাল ধনভাণ্ডার তার নামেই। তাই তাদের নাতনির সঙ্গে বিয়ে হলে তিনি রাজার রাজা বনে যাবেন। পলাশ কিছুটা দ্বিধায় পড়েন। কিন্তু তিনি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। এক শুক্রবারে তাকে বগুড়া মহাস্থানগড়ে যেতে বলা হয়। নতুন সাদা পাঞ্জাবি, পাজামা ও টুপি পরে খুব ভোরে মহাস্থানগড়ের দক্ষিণ পাশের ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে কথিত জিনের বাদশা। পলাশ চলে যান নির্দিষ্ট দিনে। ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে থাকার পর একজন লোক তার পাশ দিয়ে দ্রুত হেঁটে চলে যান। যাওয়ার সময় পলাশের হাতে আলগোছে ধরিয়ে দেয় একটি ছোট প্যাকেট। এরও ঘণ্টাখানেক পর ফোন। বাড়ি যাও। গোসল করে নামাজ পড়ে প্যাকেট খোল। পলাশ বাড়ি গিয়ে প্যাকেট খোলেন। দ্যাখেন সোনালি কাগজে মোড়ানো দুটো স্বর্ণের মোহর। কিছুটা ভয়, শঙ্কা আর বিস্ময়ে অভিভূত হন পলাশ। এরপর চলতে থাকে ফোনালাপ। এর মধ্যে জিনের বাদশার নাতনির সঙ্গে পলাশের ভাব জমে ওঠে। ভাব-ভালবাসা বিনিময় হয়। একদিন জিনের বাদশা পলাশকে ফোন করে বলেন, বিয়ের আগে ১০ মণ স্বর্ণের মোহর পলাশের বাড়িতে পাঠানো হবে জিন জাতির পক্ষ থেকে। এজন্য মসজিদে ২০ হাজার টাকা দিতে হবে। পলাশকে সে টাকা মহাস্থান গড়ে পৌঁছে দিতে বলা হয়। নিঃশঙ্কচিত্তে পলাশ সেই টাকা দিয়ে আসেন। পলাশকে একদিন একটি স্বর্ণের মূর্তি দেয়া হয়। যার ওজন অন্তত দেড় কেজি। এরপর শুরু হয় টাকার বায়না। বিয়ের আগে গরু কোরবানি দেয়ার জন্য ১ লাখ। নাতনির গায়েবি পোশাকের জন্য ৭৫ হাজার। মানুষ জাতির পক্ষ থেকে কিছু গয়নার জন্য ৫ ভরি স্বর্ণ। সবই দিয়ে আসেন পলাশ। পলাশ বলেন, শেষের দিকে আমার ফিরে আসার পথ ছিল না। সন্দেহ হচ্ছিল খুব। কিন্তু ক্ষীণ আশা ছিল। যদি সবকিছু সত্যি হয়। পলাশ বাবার টাকা ও মায়ের গহনা চুরি করে তাদের দিয়ে আসেন। এভাবে মাসখানেক চলার পর পলাশ তাদের বলে দেন আর একটি টাকাও নয়। এখনই তার মোহর চাই। পরদিন থেকেই কথিত জিনদের সব মোবাইল নম্বর বন্ধ হয়ে যায়। সর্বস্বান্ত পলাশ পরিবারের কাছে সব খুলে বলেন। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান পলাশকে নিয়ে পরিবারটি এখন শঙ্কিত। তাদের ধারণা প্রতারকরা হয়তো বড় ধরনের কোন ক্ষতি করতে পারে তাদের সন্তানের। সবগুলো নম্বর পুলিশকে জানিয়েছে পলাশের পরিবার। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, বগুড়ার মহাস্থানগড় এলাকা থেকে একাধিক জিনের বাদশা পরিচয় দেয়া প্রতারককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, প্রতারকরা মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে ফ্লেক্সিলোডের দোকান থেকে। আন্দাজে তারা ঢিল ছোড়ে। কয়েক শ ফোন করলে একটি লেগে যায়। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে তারা দেখেছেন অনেক সময় গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্যও পেয়ে যায় প্রতারকরা। অনেক ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন কোম্পানির অসাধু কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। গত ১৩ই জুলাই মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ জসিম ও জনি নামের দুই মোবাইল ফোন প্রতারককে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছ থেকে ১৭৫টি বিভিন্ন মোবাইল ফোন কোম্পানির সিম উদ্ধার করা হয়। প্রতারকরা অকপটে স্বীকার করে কিভাবে তারা ফোন করে চাঁদা দাবি করত। কিভাবে বিভিন্ন ব্যক্তিকে নানা প্রলোভন দিয়ে টাকা হাতিয়ে নিত। জনি জানায় সে মূলত এসএ পরিবহন কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মচারী পরিচয় দিয়ে ফোন করত। ফোনে সে বলত ‘আপনার নামে উপহার এসেছে। সার্ভিস চার্জ ফ্লেক্সিলোড করেন।’ আরেকজন নিজেকে দুদকের সহকারী পরিচালক পরিচয় দিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়ার কথা বলে অর্থ আদায় করত। অপরিচিত ফোনের এ বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পেতে এখন অনেকে অপরিচিত নম্বর দেখলে ফোন ধরাই বাদ দিয়েছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ইন্সপেক্টর রাজু আহমেদ চৌধুরী বলেন, আমি বিরক্ত। অপরিচিত নম্বর থেকে আসা কোন ফোনই রিসিভ করি না। প্রতারণার শিকার হয়ে ১০ হাজার টাকা খোয়ানোর পর এখন অপরিচিত নম্বরের ফোন রিসিভ করেন না উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মচারী আলাউদ্দীন। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার এম সোহায়েল বলেন, এ ধরনের অভিযোগ প্রায়ই আসছে আমাদের কাছে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দেখা গেছে, তারা সংঘবদ্ধ প্রতারক। তারা শুধু টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয় না, ফোন করে হুমকি দিয়ে চাঁদাও দাবি করে। তিনি বলেন, এ অপরাধ রোধ করার জন্য মোবাইল ফোন অপারেটরদের ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। তারা অনিবন্ধিত (আনরেজিস্টার্ড) সিম অবাধে বিক্রি করছে। নাম-ঠিকানা না থাকায় অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয় না। এ বিষয়ে মোবাইল ফোন অপারেটরদের একাধিকবার বলা হলেও তারা কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি।

বিষয়: বিবিধ

১২০৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File