ঐশীর ফাঁসি ও আমাদের দায়বদ্ধতা
লিখেছেন লিখেছেন এস কে দোয়েল ১৯ নভেম্বর, ২০১৫, ১২:৫৯:৩৭ দুপুর
সন্তানের হাতে মা-বাবা নৃশংসভাবে খুন! কথাটা জাতির বিবেকের কাঠগড়ায় চরমভাবে ধাক্কা দেয়। প্রচন্ডভাবে আহত করে। ধিক্কার দিয়ে উঠে বিবেক। এই কী চেয়েছিলাম এমন সন্তান! যার হাতে নির্দয়ভাবে খুনের শিকার হতে হবে? যাকে লালন-পালন করতে গিয়ে ঝরাতে হয়েছে অগাধ শ্রম। যার সুন্দর ভবিষ্যত তৈরির জন্য প্রতিনিয়ত লড়তে হয় কঠিন বাস্তবতার সাথে। সেই সন্তান! এই প্রশ্নটা এখন ঘুর্ণিপাকের মত ঘোল খাচ্ছে ঐশী ঘটনায়। ২০১৩ সালের ১৫ আগস্ট রাজধানীর মালিবাগের চামেলীবাগের একটি ফ্ল্যাটে বসবাসকারীা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (রাজনৈতিক শাখা) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের রোমহর্ষক হত্যার ঘটনায় ঐশীর মৃত্যুদন্ড হয়তো পৃথিবীর প্রত্যেক মা-বাবার মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলাটা স্বাভাবিক, জীবনের দাম তো প্রত্যেকের কাছেই সমান। যে জীবন একবার হারায়, সেটা কি আর ফিরিয়ে আনা যায়? আমরা কিছু হত্যাকান্ড নিয়তির ওপরই ছেড়ে দিয়ে সৃষ্টিকর্তার চিরন্তন কার্যক্রমকে মেনে নেই। যা হবার তো হয়েই গেছে’। এই যে যা হবার তো হয়েই গেছে এই কথাটার ওপর পৃষ্ঠের যন্ত্রণাটা কে বুঝে? তারপরও মানবিকতাে ক জয় করতেই আমরা সাময়িক ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি, অতি কষ্টে শোকার্ত ক্ষতকে ধৈর্য্যরে ঔষুধ দিয়ে সারানোর চেষ্টা করি। ভুলে যাই খুনের বিচার, যা হবার তো হয়েই গেছে এ নিয়তি যে আমাদের বিচার না চাওয়ার যন্ত্রণা জীবনের বাকী সময়টা পর্যন্ত নিবি নিবি প্রদীপের মত জাগ্রত করে রাখি। ইহলৌকিক বিচার প্রত্যাশা বাদ দিয়ে পারলৌকিক বিচারের জন্য প্রার্থনা করে বলি, হে আল্লাহ্ তুমিই এর বিচার করিও।
মা-বাবা খুনের ঘটনায় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ ঐশীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। হত্যার দায়ে আদালতের রায় অবশ্যই সঠিক, তারপরও এ রায় আমাদেরকে মর্মস্পর্শী করে তুলেছে। ভাবিয়ে তুলছে ঐশীর পিতা-মাতার মত আমাদেরও অনেক বাবা-মা সন্তানকে কী পরিমান স্বাধীনতা দিচ্ছি। আমরা কি পারছি আমাদের সন্তানদের নিয়ন্ত্রণ করতে, ধর্মীয় আদলে পরিপুষ্ট করে রাখতে। সন্তান কি আমাদের কথা শুনে, কথা মানে না আমরা সন্তানের কথা শোনার চেষ্টা করি? সন্তান যেমন অভিভাবকের কথা শোনার, মানার বাধ্য থাকবে, তেমনি সন্তানের কথাও শোনার অভিভাবকের সচেষ্ট মন থাকতে হবে। পরস্পর দায়বদ্ধতা না থাকলে কোন সফলতা আশা করা যায় না। ১৭-১৮ বছরের কিশোরী ঐশী কি হঠাৎ করেই বেপরোয়া হয়ে গেল? মা-বাবাকে খুনের জন্য উন্মাদ হয়ে গেল? আমি মনে করি, অবশ্যই এটা একদিনেই তৈরি হয়নি। এই মানসিক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে তার অবিভাবকের সান্নিধ্য শূণ্যতার কারণে, নিয়ন্ত্রনহীন অবাধ স্বাধীনতার কারণে এবং প্রাশ্চাত্য সভ্যতায় সন্তান আসক্ত হওয়া এবং সঙ্গদোষের কারণে। ধানমন্ডির অক্সফোর্ড স্কুলে ভর্তি হয়েই পাল্টে যায় কিশোরী ঐশী। বেপরোয়া জীবনযাপন, অনিয়ন্ত্রিত প্রেম ও মাদক সেবনে ডুবে যাওয়ায় একসময়। এই চুড়ান্ত সময়ে বাবা-মার বাধা দেয়ায় খেপে যায় ঐশী। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে শুরু করে নিজের বাবা-মাকে হত্যার কথা। সে চিন্তা ধরে রাতে কোনো এক সময় কফির সঙ্গে ঘুমের বড়ি খাইয়ে বাবা-মাকে কুপিয়ে হত্যা করে। খুনের পর সে আত্মসমর্পন করে। এ খুনের অন্যতম ক্ষতিকারক বিষয় হচ্ছে প্রচন্ড হতাশা, চরম পর্যায় বাঁধা প্রদানে নিয়ন্ত্রীন আবেগের ক্ষোভ। যা শুরু থেকেই যদি ঐশীকে নিয়ন্ত্রণ এবং ধর্মীয় আদলে লালন করা যেত তাহলে এই লোমহর্ষক ঘটনা কখনোই ঘটতো বলে মনে হয় না।
বাবা-মা হত্যার দায়ে মৃত্যুদন্ড রায়ে ঐশী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে এমন সংবাদ আমরা পড়েছি। টিভিতে দেখেছি পুলিশ কড়া নিরাপত্তায় নিয়ে যাওয়ার সময় চরম লজ্জায় ঐশী তার ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছিল। এ মুখ দেখাবে কিভাবে? সে যে মানসিকভাবে বুঝতে পেরেছে, পৃথিবীর সবচে ঘৃণিত কাজটি সে করেছে। নিজের হাতে নিজের স্বাধীনতাকে উপভোগ করতে সবচেয়ে আপন মা-বাবাকে খুন করেছে। এ লজ্জা কি রাখার কোন ডাস্টবিন পাওয়া যাবে? হয়তো ডাস্টবিনও ধিক্কার দিয়ে বলে উঠবে, ছিঃ ঐশী নিজের বাবা-মাকে? পৃথিবীতে পিতা-মাতা ছাড়া দ্বিতীয় কেউ আপন হতে পারে? ঐশী আপনজনকে যখন হত্যা করেছে, তখন তো সে জীবিত মৃত্যুর স্বাদ পরতে পারতে অনুভব করছে। পেশাদারি খুনি ছাড়া সাধারণ খুনিরা কখনোই শান্তিতে থাকতে পারেনা। তাদের মধ্যে অনুশোচনা তৈরি হয়, সেই অনুশোচনার দগ্ধতা তাকে তিলে তিলে মারে। যতক্ষণ না সে সংশোধনের পথ খুঁজে পায় ততোক্ষন সে অনুশোচনার দগ্ধতা চরমভাবে অনুভব করতে থাকে। পুলিশ তদন্ত রিপোর্টে জানা যায়, ২০১১ সালে ঐশী ধানমন্ডির অক্সফোর্ড স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরপরই পাল্টে যায়। সেখানে ভর্তির পরই ঐশীর আচরণ ও জীবনযাপনে দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। বেপরোয়া জীবনযাপনের কারণে কখনো কখনো তার মা বকাঝকা করতেন। স্কুলের কথা বলে সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে কখনো রাত ১০টা, কখনো ১১টায় ফিরত। স্কুল ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দিত ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে। যোগ দিত ইয়াবা ও গাঁজার আসরে। এসব আড্ডার আসরেই পরিচয় হয় পুরান ঢাকার ডিজে জনির সঙ্গে। তার সঙ্গে কিছু দিন মেলামেশার পর তারই বন্ধু রনির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়। এ রনি ও জনির মাধ্যমেই মূলত নেশার জগতে প্রবেশ করে ঐশী।
ঐশী তার অবাধ স্বাধীনতা এবং বেপরোয়া অস্থির জীবন যাপনের এক পর্যায়ে ১২ পৃষ্ঠার সুইসাইডাল নোট লিখে বাসায় রেখে দেয়। লাশ উদ্ধারের পর বিভিন্ন আলামতের পাশাপাশি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ঐশীর হাতে লেখা ওই চিঠি উদ্ধার করেছে। সেখানে তার জীবনের সুখ, দুঃখ ও কষ্টের কথা প্রকাশ করেছে। নিজেকে খারাপ প্রকৃতির মেয়ে হিসেবে দাবি করার পাশাপাশি কেউ তার কষ্ট বুঝতে চায়নি বলেও দাবি করেছে। আর এ কারণেই আতœহত্যার মাধ্যমে নিজেকে ঈশ্বরের কাছে সমর্পণের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেছে। ঐশী চরম হিংস্রতা হওয়ার আরেকটি কারণ দেখা যায়, ঐশীর উদ্ধত আচরন এবং বেপরোয়া গতির কারণে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন কেড়ে নেন মা। তার পর থেকে বন্ধুমহলের সঙ্গে যোগাযোগে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে ঐশী। তখন তার কাছে নিজের বাবা-মাকেই প্রধান শত্র“ বলে মনে হয়। কখনো নিজেকে শেষ করার, আবার কখনো বাবা-মাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে সে। অবশ্য ঐশী আতœহত্যা না করে পরে তার বাবা-মাকেই হত্যা করে।
জন্মদাতা বাবা-মা’র হত্যার দায়ে আদালত যে রায় দিয়েছে সেই আইনের ভিত্তিতেই হয়েছে। তারপরও কথা থেকে যায়, ঐশীর এই পরিণতির জন্য পরিবারই দায়ী। কেননা আমাদের পরিবারও মাঝে মধ্যে ভুল করে বসেন। সন্তানের মন মানসিকতাকে না বুঝে যেটা সেটা চাপিয়ে দেন। কখনো অবাধ স্বাধীনতা দেন, কখনো কঠোর শাসনের মধ্য দিয়ে সন্তানের মনকে বিষিয়ে তুলেন। এ দায় এড়াতে পারে না ব্যক্তি পরিবার এবং সমাজও। শিশুরা হচ্ছে কাদামাটির মত, সেটাকে যেভাবে গড়ে তোলা হবে সেটা সেভাবেই গড়ে উঠবে। ঐশী যে একটা মেয়ে, তা হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন পুলিশ দম্পতি। মেয়েকে ঢেলে দিয়েছিলেন অপরিমিত স্বাধীনতা, অপরিমিত হাত খরচ। এ বিলাসবহুল স্বাধীনতায় ঐশী জড়িয়ে পড়ে নেশার ঘোরে। ঐশী রহমানের চাচা কর্তৃক মামলার সূত্র থেকে জানা যায়, অষ্টম শ্রেণী থেকেই ঐশী মাদক গ্রহণ শুরু করে ক্রমেই বিপথগামী হতে থাকে। পরে তার মাদক গ্রহণ ও উচছৃঙ্খল আচরণ অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। হেরোইন, প্যাথেডিন ইঞ্জেকশন, ইয়াবা, অ্যালকোহল এমনকি গাঁজা সেবনেও অভ্যস্ত ছিল সে। এসব কারণেই প্রতিমাসে নতুন নতুন কৌশলে বাবা-মাকে বলে হাত খরচ হিসেবে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিত ঐশী। তবে শত চেষ্টা করেও বাবা-মা তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন। অক্সফোর্ডে ভর্তি হওয়ার জড়িয়ে পড়ে ডিজ ও ড্যান্স পার্টিতে। গোয়েন্দাদের তথ্যমতে, ডিজে ও ড্যান্স পার্টিও আড়ালে অনৈতিক কর্মকান্ড ও মাদক কেনাবেচার রমরমা ব্যবসা চলে। বিত্তশাল ও প্রভাবশালী লোকজনের ছত্রছায়ায় সক্রিয় একাধিক সিন্ডিকেট ডিজে পার্টিও নাম করে উচ্চাকাংখী তরুণীদের টার্গেট করে। নানা ধরনের লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে বিপথে নামিয়ে আনে। এমন একটি সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছিল ঐশী। এই যে সামাজিক প্রেক্ষাপটের ভয়ংকর নেশা সংস্কৃতি। যেখানে প্রতিনিয়ত জড়িয়ে পড়ছে আজকের নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরীসহ নানা বয়েসীরা। অসৎ সঙ্গদোষ, অসামাজিক সংস্কৃতির কবলে জড়িয়ে পড়ার কারণে সন্তানের হাতে প্রাণ দিতে হচ্ছে পিতা-মাতাসহ নানা সম্পর্কের মানুষদের। এ পরিস্থিতি রোধ করতে না পারলে, ধর্মীয় শুদ্ধ সংস্কৃতি লালনে আকৃষ্ট না করতে পারলে ঐশীর মত ঘটনা বাড়তেই থাকবে। অবশ্যই ঐশীর মা-বাবার হত্যাকাণ্ড আমাদের জন্য বিশাল একটি ‘‘অ্যালার্ম’’। এ ক্ষেত্রে সন্তানের মা-বাবা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ একটি শিশুর বেড়ে ওঠার পেছনে যতগুলো প্রতিষ্ঠান জড়িত, তারা সবাই সচেতন হবেন। তবে ঐশীর জন্য যে রায়ই নির্ধারণ হোক না কেন, হোক তা মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন দুটোই বড় শাস্তি। অবশ্যই শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে সমাজে সন্তানের মাধ্যমে অভিভাবকদের হত্যার ঘটনা আরও বৃদ্ধি পাবে।’ উচ্চ আদালতে যেহেতু এর আপীলের সুযোগ রয়েছে, সেক্ষেত্রে উচ্চ আদালত ঐশীর পারিবারিক, সামাজিকভাবে বেড়ে উঠা বিষয়টি অবশ্যই লক্ষ্য করবেন। সংশোধনের একটা পথ তৈরি হবে আশা করি, মৃত্যুদন্ড দিয়ে জীবনের শেষ পরিণতি দেখা যায় সত্য কিন্তু জীবন সংশোধনের মধ্য সুন্দর অনুকরণীয় একটা অধ্যায়ও রচনা করা যেতে পারে।
বিষয়: বিবিধ
১০৯৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন