আবেগ নিয়ন্ত্রণে ৫ টি পরামর্শ
লিখেছেন লিখেছেন তট রেখা ১৫ জুলাই, ২০১৬, ০৭:২৯:৩৯ সন্ধ্যা
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
কিছুদিন আগে সদ্য প্রয়াত শ্রদ্ধেয় ডঃ আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহঃ) সাহেবের একটি প্রশ্নোত্তরের ভিডিও ক্লিপ দেখছিলাম ইউ টিউবে। সেখানে এক ব্যাক্তি প্রশ্ন করেছেন, তরুনরা কেন ‘আই এস’ এর মত চরম পন্থী সংগঠনে যোগ দেয়। তিনি উত্তরে যা বলেছিলেন, তার ভাবার্থ হলো, এই সব তরুনদের ইসলামের প্রতি চরম আবেগ রয়েছে, কিন্তু প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা নেই, যার ফলে চরমপন্থী সংগঠন গুলোর চটকদার প্রচারণায় প্রলুব্ধ হয়ে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে অসমর্থ হয় এবং ভ্রান্ত পথে পা বাড়ায়।
আরো একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল, আমাদের ছাত্র-জীবনে জুনিয়র ক্লাসের একটি ছেলে আত্ম-হত্যা করেছিল। আত্ম-হত্যার কারণ সম্পর্কে যতটুকু জানতে পারি ছেলেটির মা সকালের নাশ্তা তৈরীতে ব্যাস্ত ছিল ( গ্রামের মহিলা), কোনো কারণে তার মেজাজ বিক্ষুব্ধ ছিল। ছেলেটি তার মায়ের কাছে গিয়ে নাশ্তা চাইলে তার মা উত্তর দেয়, “আমি তোকে নাশ্তা দেবনা, সারাক্ষণ খাওয়া আর খাওয়া, কেন ট্রেনের তলে গিয়ে মরতে পারিসনা” । ছেলেটি তার কথায় এতটাই আহত বোধ করে যে, তৎক্ষণাৎ তার বাড়ীর পাশে রেল লাইনের উপর গিয়ে চলন্ত টেনের নীচে আত্মা-হুতি দেয়।
এখানে একটি কথা স্পষ্ট যে, এখানে মা এবং সন্তান উভয়ই আবেগ নিয়ন্ত্রণে অসমর্থ হয়, মা তার সন্তানের প্রতি অনিয়ন্ত্রিত কথার দ্বারা নিজের অজান্তেই হয়ত আত্ম-হত্যার জন্য প্ররোচিত করে আর কিশোর বয়সের সেই ছেলেটি আত্ম-হত্যার মত একটি চরম সিদ্ধান্তে উপনীত হয়।
শুধু এই উদাহরণ গুলিই নয়, এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, যেখানে আবেগী আচরণ মানুষের ব্যাক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এমনকি রাস্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসে।
মূলতঃ আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানাবিধ সমস্যায় নিপতিত হই। আমাদের জীবনের অধিকাংশ বাঁধা- বিপত্তি মাঝে মাঝে আমাদের আবেগাপ্লুত করে তোলে, যার সাথে অনেক সময় আমরা মানিয়ে নিতে পারিনা। একজন মুসলমান হিসাবে আমরা জানি যে, এই জীবন একটি পরীক্ষা ক্ষেত্র, এবং আমরা সবরের জন্য পুরস্কৃত হব।
আল্লাহ সুবহানুতা’আলা আল-কুরানুল কারীমে বলেন,
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوفْ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الأَمَوَالِ وَالأنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ
অর্থঃ এবং অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।
(সুরা বাকারাঃ আয়াত নং-১৫৫)
আবেগ নিয়ন্ত্রনের সবচেয়ে বড় উপায় হলো কুরান-সুন্নাহর আলোকে নিজেকে প্রকৃত ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। জীবনের কোন ক্ষেত্রে কি করণীয় কুরান-সুন্নাহ থেকে সে ব্যাপারে সম্যক জ্ঞানার্জন করা। আর যতটুকু সম্ভব প্রকৃত আলেমদের সাহচর্যে থাকার চেষ্টা করা।
একটি ইংরেজী ব্লগে তাসনীম নাযীর আবেগ নিয়ন্ত্রণের উপায় গুলি নিয়ে আলোচনা করেছেন, তার অনুসরণে নিম্নে ৫ টি পরামর্শ আলোচিত হলোঃ
১। আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করুনঃ
প্রত্যেক সময় যখন আপনি দুশ্চিন্তা, কঠিন পরিস্থিতি, চ্যালেঞ্জ অথবা সংগ্রামের সম্মুখীন হন, তখন আল্লাহর দিকে ফিরে আসুন। সালাতে দোয়া করুন, আল্লাহর কাছে আপনার সমস্যা থেকে পরিত্রানের জন্য সাহায্য কামণা করুন। একমাত্র আল্লাহই কঠিন পরিস্থিতি দুর করতে পারেন, সুতরাং শুধু তাঁরই দিকে মুখ ফিরান, তাঁরই কাছে সাহায্য চান। আল্লাহ মুখাপেক্ষিতা আপনার হৃদয়ে প্রশান্তি আনয়ন করবে এবং আপনাকে সমস্যা থেকে উত্তরণের অনুভুতি জাগ্রত করবে ইন শা আল্লাহ। আল্লাহ সুবহানুতাআ’লা ওয়াদা করেছেন যে, পরিস্থিতি বদলাবে, যদি আমরা তার অসীম নির্দেশনার প্রতি আবিচল আস্থা রাখি। আল-কুরানুল কারীমে তিনি বলেনঃ
فَإِذَا بَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَأَمْسِكُوهُنَّ بِمَعْرُوفٍ أَوْ فَارِقُوهُنَّ بِمَعْرُوفٍ وَأَشْهِدُوا ذَوَيْ عَدْلٍ مِّنكُمْ وَأَقِيمُوا الشَّهَادَةَ لِلَّهِ ذَلِكُمْ يُوعَظُ بِهِ مَن كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَل لَّهُ مَخْرَجًا
অর্থঃ ---- এতদ্দ্বারা যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তাকে উপদেশ দেয়া হচ্ছে। আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্যে নিস্কৃতির পথ করে দেবেন।
وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ وَمَن يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا
অর্থঃ এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিযিক দেবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন। আল্লাহ সবকিছুর জন্যে একটি পরিমাণ স্থির করে রেখেছেন।
(সুরা তালাকঃ আয়াত নং ২-৩)
২। কোনো কিছু হারানোর চিন্তাকে কৃতজ্ঞতার অনুভুতি দিয়ে প্রতিস্থাপন করুনঃ
যখন আপনি কোনো কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যান, এটা অনেক ক্ষেত্রেই কোনো ব্যাক্তি বা বস্তুকে হারানোর কারণে হয়ে থাকে। প্রিয় কাউকে হারানোর বেদনা বা পরিস্থিতি আমাদের জন্য সামলানো খুব কঠিন ব্যাপার হয়ে থাকে অথবা সেটি আমাদের জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে থাকে। এই সময়, আমরা যা হারিয়েছি তার জন্য বিলাপ না করে, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে কল্যাণ/করুনা আমাদের জীবনে রয়েছে, তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিৎ। যখন বিপর্যয় নেমে আসে, তখন আমরা স্বভাবতই আমাদের কি আছে তা ভুলে যায়, কিন্তু কি নেই তা নিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হই। অন্তরের অবস্থার পরিবর্তন করুন, তখন আপনি আপনার চার পার্শ্বে কল্যাণকর জিনিস গুলো দেখে হারানোর ব্যাথা কমাতে পারেন এবং এটা আপনার অন্তরের ক্ষতকে দ্রুত নিরাময় করতে সাহায্য করবে।
এ প্রসঙ্গে সেই পুরনো গল্পটি এখানে প্রণিধান যোগ্য, এক ব্যাক্তি তার পায়ে কোনো জুতা ছিলোনা দেখে হতাশায় নিমজ্জিত ছিল, কিন্তু যখন সে এমন এক ব্যাক্তির সন্ধান পেল যার একটি পা নেই। এ ব্যাপারটি দেখে সে নিজের দুটি পা থাকার কারণে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল।
৩। ধৈর্য দিয়ে মোকাবেলা করুনঃ
নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন, “ একজন মুমিনের জন্য ব্যাপারটি কতই না চমৎকার, তার জন্য সব কিছুর মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে , আর এটা শুধু মুমিনের বেলাতেই প্রযোজ্য। তার যখন সমৃদ্ধি আসে, তখন সে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, আর এটাই তার জন্য মঙ্গলজনক; যদি তার উপর কোনো বিপদ পতিত হয়, সে ধৈর্যের সাথে তার মোকাবেলা করে, আর এটাই তার জন্য মঙ্গলজনক। ( সহীহ মুসলিম)
এখানে এটা নির্দেশ করে, বিপদ আসলে আমাদের কি ভাবে মোকাবেলা করা উচিৎ ; এখান থেকে আরো শিক্ষণীয় যে, দুনিয়ার জীবন যেহেতু ক্ষণস্থায়ী, সেহেতু আমাদের আল্লাহর উপর ভরসা করে সবর করা উচিৎ।
আল-কুরানুল কারীমে আল্লাহ বলেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اسْتَعِينُواْ بِالصَّبْرِ وَالصَّلاَةِ إِنَّ اللّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ
অর্থঃ হে মুমিন গন! তোমরা ধৈর্য্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চিতই আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন।
(সুরা বাকারাঃ আয়াত নং-১৫৩)
৪। সালাতে অবিচল থাকুনঃ
অনেক মানুষ যখন আবেগ নিয়ে সংগ্রামে নিয়ে লিপ্ত হয়, তখন অনেক সময় সালাতকে অবহেলা করতে চায়। আপনাকে সর্বদা সালাত কায়েম করা উচিৎ, এবং মনে রাখা উচিৎ যে, এই সালাতের মাধ্যমেই আপনি পরিত্রান পেতে পারেন। আল্লাহ আপনার সমস্যা সমাধানের জন্য একটি রাস্তা দেখিয়ে দেবেন, কিন্তু এটা নিষ্ঠা ও বিনয়ের সাথে সালাত আদায় ছাড়া সম্ভব নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আমাদের সতর্ক করেছেন যে, মুমিন এবং মুনাফিকের মাঝে পার্থক্যকারী ব্যাপার হলো সালাত। যে সালাতকে পরিত্যাগ করলো, সে কুফরী করলো। ( সুনানে তিরমিযী- সহীহ)
সে কারণে একেবারে বিপন্ন অবস্থাতেও সালাত পরিত্যাগ করবেননা। কুরান মজীদে সুরা বাকারার উপরোক্ত অনুচ্ছেদে বর্ণিত ১৫২ নং আয়াত ছাড়াও নিম্নোক্ত আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ
وَاسْتَعِينُواْ بِالصَّبْرِ وَالصَّلاَةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلاَّ عَلَى الْخَاشِعِينَ
অর্থঃ ধৈর্য্যর সাথে সাহায্য প্রার্থনা কর নামাযের মাধ্যমে। অবশ্য তা যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু সে সমস্ত বিনয়ী লোকদের পক্ষেই তা সম্ভব।
(সুরা বাকারাঃ আয়াত নং-৪৫)
৫। কুরান থেকে নির্দেশিকা গ্রহণ করুনঃ
অন্তরের প্রশান্তির জন্য আল্লাহ সুবহানুতাআ’লা আমাদের অনেক পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে দোয়া, সালাত এবং তার বাণী আল-কুরানের আলো ও হেদায়েত। কুরান থেকে আপনার সমস্যার উত্তর বের করার চেষ্টা করুন। আল্লাহর সকল নবীকে তাদের সারা জীবন নানা ভাবে পরীক্ষা করেছেন । তারা এ ধরনের চ্যালেঞ্জ কিভাবে মোকাবেলা করেছেন? কুরানের অমূল্য রত্ন আবিস্কার করুন এবং নিজেকে জ্ঞানের সাগরে অবগাহন করান যে জ্ঞান আপনার আবেগীয় সমস্যার সহজ সমাধান প্রদান করবে।
এ ছাড়াও আমরা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর সিরাত অধ্যয়ন করব, কারণ আল্লাহ সুবহানুতাআ’লা আমাদের বলেছেন যে, রসুলের চরিত্রেই আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে। রসুলের সাহাবীদের জীবনী পড়ব এবং সেখান থেকে শিক্ষা নেব, কেননা তারাই আমাদের জন্য অনুসরনীয়।
কৃতজ্ঞতাঃ তাসনিম নাযীর
বিষয়: বিবিধ
১৫২৫ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সময়োপযোগী একটি গুরুত্বপূর্ণ লিখা মাশাআল্লাহ।
আলহামদুলিল্লাহ। আপনার মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। জাজাকাল্লাহ খায়রান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন