দেশ বিভাগ, স্বপ্ন-ভঙ্গ ও বাংলাদেশ
লিখেছেন লিখেছেন তট রেখা ২৬ মার্চ, ২০১৬, ০৫:৫৬:০৫ বিকাল
ছেলে বেলায় স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস বা একুশে ফেব্রুয়ারী এলে তা উদযাপনে নানা ভাবে ব্যাস্ত থাকতাম, দেয়াল পত্রিকা বের করা, কবিতা লিখা, কবিতা আবৃত্তি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদী ছিল আনন্দ ও অনুপ্রেরণার উৎস্য। পরবর্তীতে পরিণত বয়সে স্বাধীনতা নিয়ে কিছু লিখা বা বলা তেমন কিছুই হয়নি, তার একটি কারন পেশাগত ব্যাস্ততা। তবে বড় কারণ সার্বজনীন স্বাধীনতা কারো কারো ব্যাবসায়িক পণ্যে পরিণত হওয়া, এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক মেরুকরণ। রাজনীতির সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, তাই এই বিষয়ে নির্মোহ বিশ্লেষণ কোনো পক্ষকেই সন্তষ্ট করতে পারবেনা।
তবে আজ ব্লগার গাজী সালাহ উদ্দীন ভাই এর অনুরোধে এই ক্ষুদ্র প্রয়াস, যা ক্ষুদ্র পরিসরেই সংক্ষিপ্ত করার তাগাদা আছে। আমি যেহেতু মুসলমান, তাই ইসলামই হবে আমার আলোচনার মান দন্ড।
পাকিস্তানের স্বপ্ন দ্রষ্টা আল্লামা ইকবালের প্রস্তাবনায় এই বাংলার কোনো অস্তিত্ব ছিলোনা। পাঞ্জাব, আফগানিস্তান ( উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ), কাশ্মীর ও বেলুচিস্তান এই নিয়ে তিনি পাকিস্তান নাম করণ করেন। ইকবালের আক্বীদাগত বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তিনি “Reconstruction of religious thought of Islam” নামে বই লিখেছিলেন। ইসলামের নির্মাণ ও তার পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে আল্লাহর ওহীর আলোকে, রসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর হাতে। এই ইসলামের ধ্যান-ধারণা কে ভেঙ্গে পুণর্নির্মান করার অধিকার কারো নেই।
মুসলিম লীগের জন্ম পূর্ব বঙ্গের মানুষের হাতে হলেও, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেতৃত্ব চলে আসে পরবর্তীতে কংগ্রেস থেকে আগত ইসমাইলিয়া শিয়া ধর্মালম্বী মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর হাতে। যিনি বিয়ে করেছিলেন একজন অগ্নি উপাসক পার্সী মহিলাকে এবং তাদের সন্তান সন্ততি পরবর্তীতে পার্সী ধর্মের অনুসারী হয়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ছিল এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর প্রাণের দাবী। কারণ তারা উচ্চ-বর্ণের হিন্দুদের দ্বারা সামাজিক ভাবে এমন ভাবে নির্যাতিত বা নিষ্পেষিত ছিলেন যে, একটি পৃথক মুসলমান রাস্ট্র প্রতিষ্ঠা খুবই জরুরী হয়ে পড়েছিল। তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন তাদের আশান্বিত করেছিল, তারা ইসলামের সাম্য ও ন্যায় বিচারের নীতির ভিত্তিতে সমাজ ও রাস্ট্র কায়েমের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই প্রকৃতির অসংখ্য মানুষের মধ্যে ছিলেন অনেক তরুন, যুবা, প্রৌঢ় ও বৃদ্ধ, এদেরই একজন ছিলেন হুমায়ুন আহমেদের নানা।
বিলেতি ধ্যান-ধারণায় লালিত নেতৃ বৃন্দের হাতে যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, তা তারা কিছুদিনের মধ্যেই উপলব্ধি করেন। বিশেষ করে পাকিস্তানের হুইস্কি পায়ী জেনারেলদের হাতে ব্যপারটি আরো খারাপ রূপ পরিগ্রহ করে।
প্রকৃত পক্ষে ইতিহাসের কোথাও শিয়া-সুন্নী মিলিত ভাবে ইসলামী শাসন ব্যবস্থার নজীর নেই। আর এটা সম্ভবও নয়, কারণ উভয়ে বিশাসের দুই মেরুতে অবস্থান করেন। আর এর মধ্যে শুরু হয় নতুন ধরণের জুলুম নির্যাতন আর শোষন।
মানুষের স্বপ্ন ভঙ্গ হতে সময় লাগেনি। কিন্তু এর মধ্যে অনেক প্রৌঢ় ও বৃদ্ধ রয়েছে যারা তখনো পাকিস্তান কাঠামোর মধ্য থেকেই পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতেন।
এরই মধ্যে ১৯৭০ সালের সাধারন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ, সময়ের পরিক্রমায় ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। যা এ জাতিকে এমন একটা অবস্থানের দিকে ঠেলে দেয়, যেখান থেকে আর ফিরে আসার আর কোন উপায় ছিলনা (Point of no return)।
আপামর জনসাধারণ অস্ত্র হাতে তুলে নেয় প্রতিরোধ সংগ্রামে, যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ বলি। জনসাধারণের এই প্রতিরোধে সেদিন ইসলাম বিরোধী চেতনা কাজ করেনি। চেতনা ছিল নিজেদের আত্মরক্ষা ও পাকিস্তানের ভন্ড শাসক গোষ্ঠীর হাত হতে নিস্কৃতি লাভ করে, নিজেদের স্বাধীন আবাসভুমি গঠন করা।
প্রকৃত পক্ষে ভারতের দুই প্রান্ত অবস্থিত দুই পাকিস্তানের এক থাকা কখনোই সম্ভব ছিলোনা।
জাতির এই ক্রান্তি লগ্নে, ইসলাম পন্থী রাজনীতিবিদ দের একটি বড় অংশ এমন একটি ভুল করে বসেন, যার প্রভাব সুদুর প্রসারী।
প্রথমত ইসলামে যখন দুই গ্রুপ মুসলমানের মধ্যে বিবাদ হবে, তখন তাদের একত্রিত করে ন্যায় ভিত্তিক মিমাংসা করে দেয়া অপর মুসলমানের জন্য কর্তব্য। যদি তাদের একটি পক্ষ মিমাংসার পরো সীমা লংঘন করেন, তাহলে সকল মুসলমান এক্ত্রিত হয়ে সীমা লঙ্ঘন কারীকে প্রতিহত করবে।
দ্বিতীয়ত মজলুমের অধিকার আছে, নিজের জান-মালের রক্ষার, এক্ষেত্রে একজন মুসলমান মজলুমের পাশে দাঁড়াবে, এবং জালিমকে জুলুম থেকে নিবৃত্ত করবে।
উভয় ক্ষেত্রেই ইসলাম পন্থী নেতৃত্ব স্বঠিক অবস্থান গ্রহণে ব্যার্থ হন। তবে এটা ইসলামের ব্যার্থতা নয়।
পাকিস্তান রাস্ট্র প্রতিষ্ঠা ব্যার্থ হওয়ার জন্য কখনো ইসলাম দায়ী ছিলোনা। কিন্তু ইসলাম বিদ্বেষী একটি শ্রেণী এইটাকেই পুঁজি করেন। ১৯৭২ সালে ভারত ও রাশিয়ার প্রভাবে ধর্ম-নিরপেক্ষতাকে সংবিধানের মুলনীতি হিসাবে গ্রহণ করা হয়। বাম পন্থি, নাস্তিক ও ইসলাম বিদ্বেষী চক্রটি এখনো ইসলামে বিরূদ্ধে তৎপর।
হুমায়ুন আহমেদের নানা ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটির মেম্বার ছিলেন। হুমায়ুন আহমেদ তার এক বই এ লিখেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর মিশ্র অনুভুতি রয়েছে। তার বাবা মুক্তিযুদ্ধে নিহত হয়েছেন, অপরদিকে তার প্রিয় নানা শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি তার নানার পক্ষে এই বলে যুক্তি উপস্থাপন করেন যে, তারা ব্রিটিশ আমলে বর্ণ হিন্দুদের নিপীড়নে মসজিদের আজানও অনেক সময় দিতে পারতেননা। তাই তারা পাকিস্তান চেয়েছিলেন। কিন্তু যখন নিজেদের চোখের সামনে তাদের হাতে গড়া পাকিস্তান ভেঙ্গে যাচ্ছে, সেটা তারা সহ্য করতে পারেননি, তাই তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছেন।
যে নেতৃত্ব এই উভয় পক্ষের আবেগকে বুঝতে পারবেন এবং ইসলামকে আলোকবর্তিকা হিসাবে সাথে নেবেন, তারাই সফলকাম হবেন এবং সম্মুখে এগিয়ে যাবেন।
পরিশেষে স্বাধীনতা যুদ্ধের অগণিত নারী-পুরুষ যারা আত্নাহুতি দিয়েছেন, তাদের রূহের মাগফিরাত কামণা করছি।
RELATED READING:
জাতির মনস্তত্ব ও পরিণতি
বিষয়: বিবিধ
১২৪৫ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমাদের চোখে সিদ্ধান্তটি ভুল বলে এখনও মনে হয়, আমার বিশ্বাস বাঙ্গালী যেদিন এটাকেই সঠিক বলে মেনে নেবে তখুই তাদের শাস্তি যা হচ্ছে এটা শেষ হবে৷
" কিন্তু যখন নিজেদের চোখের সামনে তাদের হাতে গড়া পাকিস্তান ভেঙ্গে যাচ্ছে, সেটা তারা সহ্য করতে পারেননি, তাই তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছেন।"
পাকিস্তান ভেঙ্গে যাচ্ছে নয় বরং পুনরায় ভারতীয় হিংসুক হিন্দুদের সাহায্য নিয়ে তাদের অধীনস্থ হতে চলেছে এটা তারা পছন্দ করেননি৷ অন্ততঃ আমার ভিতর এটাই ছিল৷ কারণ আমি ওদের কবল থেকে নিঃস্য হয়েই বার হয়ে এসেছিলাম৷ ধন্যবাদ৷
আপনার দ্বিতীয় মন্তব্যের সাথে আমি পরিপূর্ণ ভাবে একমত। আমি এ কথাটি লিখতে ভুলে গিয়েছি।
আপনার এই কথাটা আমারই মনের কথা। ইসলামকে আধুনিক রুপদানে যাচ্ছেতাই অবস্থা করে ফেলা কখনোই মানতে পারিনি।
জনসাধারণের এই প্রতিরোধে সেদিন ইসলাম বিরোধী চেতনা কাজ করেনি।
যথার্থ বলেছেন, যুদ্ধটা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বিরুদ্ধে, সেদেশের ইসলামের বিরুদ্ধে নয়।
দারুণ লিখেছেন। আমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
মন্তব্য করতে লগইন করুন