কুরানের প্রতি ভালবাসা
লিখেছেন লিখেছেন তট রেখা ০৬ মার্চ, ২০১৬, ১১:১২:৪৩ সকাল
কিছু দিন আগে আমার এক বোন আমার কাছে টেলিফোন করে বললেন যে তার হাত থেকে এক কপি কুরান (শরীফ) দুর্ঘটনা বশত মাটিতে পড়ে গিয়েছে, সে খুবই উদ্বিগ্ন এবং এটার কাফফারা স্বরূপ কি করতে পারে? আমার স্বল্প জ্ঞানের নিরীখে আমি যা জানি তা হলো এটা কোনো সমস্যা নয়, তাই তাকে দুশ্চিন্তা গ্রস্থ হতে নিষেধ করলাম এবং ভবিষ্যতে কুরান মজিদ হাতে নেয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে বললাম।
আমার এই বোনের মত লক্ষ কোটি মা- বোন এবং ভায়েরা আছেন আমাদের দেশে যারা কুরান কে ভালোবাসেন, যারা কুরানকে যত্ন করে বুকশেলফের সব চেয়ে উঁচু তাকে গিলাফে জড়িয়ে তুলে রাখে্ন, কুরান তেলাওয়াত করেন, কিন্তু কুরান মজিদের প্রকৃত হক সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন।
প্রসঙ্গক্রমে একটি কথা মনে পড়ে গেল, আমার ছেলেবেলায় আমাকে ও আমার বোনকে আমপাড়া ও কুরান পড়াতে আসতেন একজন বিহারী মহিলা, ওনার একটি অদ্ভুত নিয়ম ছিল, কেউ যদি আমপাড়া পড়ার সময় সুরা আলাক শিখতে শুরু করে তাহলে বুট সিদ্ধ করে খেতে হবে বা সদকা করতে হবে। সে সময় দুর্ঘটনা বশত কুরান মজীদের কপি হাত থেকে পড়ে গেলে, ওনার নির্দেশ মত কুরান মজীদের ওজনের সমান চাল সদকা করতে হয়েছিল। তার এই ফতোয়াতে কুরানের প্রতি ভালোবাসা বা সম্মান হয়ত ছিল। কিন্তু সত্যতা একেবারেই ছিলোনা। আমার সেই ছেলেবেলায় বা এখনো বাংলাদেশের আনাচে- কানাচে হয়ত এরকম আরো অনেক কু-সংস্কার ছড়িয়ে ছিল বা আছে। আল্লাহর অপরিসীম রহমতে বাল্যের সেই কু-সংস্কার গুলোকে কু হিসাবেই চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছি।
কিন্তু এই সংস্কার গুলোর হেতু কি ? উত্তর হলো এক কথায় অজ্ঞতা। আমরা কুরানকে ভালোবাসি / সম্মান করি, কুরান তেলাওয়াত করি কিন্তু কুরান শিখিনা, জানিনা। কুরান মজীদের নাম যে কুরান শরীফ নয়, সেটাই আমরা অনেকে জানিনা। আল্লাহ সুবহানুতা’আলা কুরান কে আল-কুরানুল মজিদ, আল-কুরানুল হাকিম, আল-কুরানুল কারীম, আল-ফুরকান, কিতাবুল মুবীন ইত্যাদী নানা নামে অভিহিত করেছেন, কিন্তু কখনোই কুরান শরীফ নামে অভিহিত করেন নি, কিংবা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম থেকেও এমন কিছু বর্ণিত আছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু আপামর জন-সাধারণের এই ভুলটি খুব কমই ভুল হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে কুরান শরীফ নামটির কোনো প্রচলন নেই।
আমরা কুরান তেলাওয়াত করি কিন্তু এর অর্থ বুঝিনা। আমরা পার্থিব লাভের জন্য সারা জীবন ধরে ইংরেজি ভাষা শিখি, কেতাদুরস্থ ভঙ্গীতে ইংরেজীতে কথা বলে নিজেকে জাতে তোলার চেষ্টা করি, কিন্তু আল্লাহ যে ভাষায় মানুষের সাথে কথা বলেছেন, সেই ভাষা শেখার প্রতি অনীহা প্রদর্শন করি।
আমরা জানি কুরান পাঠ করলে প্রতি হরফের জন্য ১০ টি করে নেকি পাওয়া যাবে, কিন্তু কুরানে বর্ণিত আল্লাহর আদেশ- নিষেধ সম্মন্ধে আমরা জানিনা। কুরান হাতে থেকে পড়ে গেল আমাদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে, কিন্তু কুরানে বর্ণিত পর্দার ফরজ বিধান সম্পর্কে অনেক বোন উদাসীন। তাদের কাছে মনে পর্দাই তখন বড় পর্দা হয়ে উঠে। আমরা নিজেদের মুমিন-মুসলমান দাবী করি এবং মসজিদ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি , কিন্তু আমরা জানিনা আল্লাহ তার পবিত্র গ্রন্থে ঈমান এবং সালাত কে একই অর্থে ব্যাবহার করেছেন। আমরা কুরানকে ভালোবাসি আর ইহুদী, খ্রিস্টান, মুশরিকদের কে বন্ধু হিসাবে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠি। কিন্তু আল্লাহ কুরানুল কারীমে ইহুদী- মুশরিকদের মুসলমানের শত্রু হিসাবে গণ্য করেছেন এবং ইহুদী- নাসারা দের বন্ধু হিসাবে গ্রহন করতে নিষেধ করেছেন, সে ব্যাপারে আমরা বিন্দু মাত্র জ্ঞান রাখিনা। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে, যাতে শুধু এই নিবন্ধের কলেবরই বৃদ্ধি হবে। যা আমার উদ্দেশ্য নয়।
কুরানকে জানতে হলে বুঝতে হলে আরবী ভাষা শেখা বা জানার কোনো বিকল্প নেই। এখন অনেকেই বলবেন, আরবীর মত বিদেশী ভাষা শেখা সোজা নয়। আমি জানি এটা আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থার গলদ, ৯০% মুসলমানের দেশে এটা দাবী করাও এখন এক রকম ধৃষ্টতা। কিন্তু আমরা কুরানের ভালো অনুবাদ ও তফসির পড়তে পারি। তবে আমাদের সমাজে অনেকেই আছেন যারা কুরানের অনুবাদ বা তফসির পড়তে নিরুৎসাহিত করেন, এর অন্যতম কারণ হলো এতে অনেকেরই ব্যাবসাতে ধ্বস নামবে, অবশ্য অনেকেই অজ্ঞতা বশত এ রকম কথা বলে থাকেন।
আর আরবী ভাষা শেখার ব্যাপারে আমাদের ব্যাক্তিগত বা সম্মিলিত উদ্দ্যোগ নিতে হবে, যে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরবী ভাষা শেখানো হয়, সে সব জায়গাতে আমাদের সন্তানদের ভর্তি করার উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই হয়ত আমরা কুরানের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা বা শ্রদ্ধা দেখাতে পারব এবং এর হক আদায় করতে পারব এবং কু-সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।
বিষয়: বিবিধ
১০১৫ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক সুন্দর করে অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরেছেন। জাযাকাল্লাহু খাইর
মন্তব্য করতে লগইন করুন