সাম্প্রদায়িক ভারত ও গো-মাতার ইতিবৃত্ত
লিখেছেন লিখেছেন শামছুল হক ০৭ নভেম্বর, ২০১৫, ০৮:৫৯:৪০ রাত
প্রসঙ্গক্রমে এক প্রশ্নের জবাবে মহাত্মা গান্ধী (মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী) বলেছিলেন, ‘ভারত স্বাধীনের পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গো-হত্যা নিবারণ করা হবে’। গান্ধীজির এই ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক মন্তব্য অখন্ড ভারতের স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দেয়। মুসলমানরা তাহজিব, তমদ্দুন-সংস্কৃতি ও নিজেদের স্বতন্ত্রতা রক্ষায় পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান দাবি করে বসে এবং ক্রমেই তা জোরালো ভিত্তি পায় এবং দ্বিজাতিতত্ত্ব দানা বেঁধে ওঠে। ফলে বিশ্বমানচিত্রে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। তাই সাম্প্রতিক ভারতে যে গো-রক্ষার নামে সাম্প্রদায়িক মাতম চলছে এবং কথিত গো-হত্যা ও গোমাংস ভক্ষণের অজুহাতে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে নরহত্যা করা হচ্ছে তা সর্বসাম্প্রতিক কোনো ঘটনা নয়, বরং এর শেকড় আরও অনেক গভীরে বলেই গবেষণায় উঠে এসেছে। আর মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধীকে যে অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হিসেবে আখ্যা দিয়ে ‘মহাত্মা’ খেতাব দেয়া হয়েছিল তা শুধু আষাঢ়ে গল্প বলেই প্রতীয়মান।
বিদগ্ধজনেরা বলছেন, এক সময় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাই গরু জবাই করতেন (বলি দিতেন) এবং মাংস খেতেন। এমনকি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদ ও উপনিষদেও গো-বলির সমর্থন পাওয়া যায়। কিন্তু উপমহাদেশীয় অপরাজনীতির প্রেক্ষাপটে গরু আস্তে আস্তে হয়ে ওঠে রাজনীতি সংখ্যালঘু নির্যাতনের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ। ফলে কথিত গো-হত্যাকে এখন ধর্মবিরোধী বলে আখ্যা দিয়ে পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং এটিকে অজুহাত বানিয়ে বিশেষ ধর্মের সাথে পরিকল্পিতভাবে সঙ্ঘাত সৃষ্টি করা হচ্ছে, যা গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধানোর নামান্তর।
ঐতিহাসিকদের বিবেচনায় ব্রাহ্মণদের গো-হত্যাবিরোধী অবস্থানের ধারাবাহিকতায় গরু জবাই নিষিদ্ধের দাবি করা হচ্ছে। দাবিটি ভারতের দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল বিজেপি ও সাম্প্রদায়িক আরএসএস-এর বলে দাবি করা হলেও ইতিহাস বলে অন্য কথা। কারণ যখন বিজেপি ও আরএসএস নামে সংগঠনের জন্মই হয়নি, তার অনেক আগে থেকেই এটিকে সাম্প্রদায়িক ইস্যু বানানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে গো-হত্যা নিবারণ যতটা না ধর্মীয় তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। এ কথার প্রমাণ মেলে সাম্প্রতিক প্রকাশিত খবর থেকে। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, ভারতের শাসকদল বিজেপির কট্টরপন্থী, মুজাফ্ফরনগর দাঙ্গার মূল পরিকল্পক ও শীর্ষ গরু হত্যাবিরোধী নেতা সঙ্গীত সিং সোম নিজেই একটি গরুর গোশত প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার মালিক ছিলেন। সেখান থেকে বিভিন্ন হালাল গরুর গোশত রফতানি করা হতো। প্রথমে অস্বীকার করলেও তীব্র চাপের মুখে তা স্বীকারও করেছেন সঙ্গীত সিং সোম নামে বিজেপির সাংসদ।
সঙ্গীত সিং সোম বিভিন্ন উগ্রবাদী মন্তব্য করার জন্য ভারতজুড়ে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন। এ নেতা নিজের সামাজিক যোগাযোগেমাধ্যমের আইডিতে ভুয়া গরু জবাই করার গুজব ছড়িয়ে দাঙ্গা বাধান মুজাফফরনগরে। এসব দাঙ্গায় বহু মানুষ হতাহত হন এবং দাঙ্গা বাধানোর অভিযোগে তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন। অবশ্য এখন তিনি জামিনে মুক্ত হয়েছেন। কয়েক দিন আগে মোহাম্মদ আখলাক নামে ৫০ বছর বয়সী এক মুসলিমকে গরু জবাইয়ের গুজব ছড়িয়ে হিন্দুত্ববাদীরা হত্যা করলে সেখানে গিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষাবলম্বন করেন গো-হত্যাকারী এই বিজেপি নেতা।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, আল-দুয়া ফুড প্রসেসিং প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি গরুর গোশত প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার অন্যতম মালিক ছিলেন সঙ্গীত সিং। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ওই প্রতিষ্ঠানটির সব পণ্যই গরুর গোশত ও গরু থেকে উৎপাদিত পণ্য। তিনি এ প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। আল-দুয়ার ওয়েবসাইট অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ভারত থেকে হালাল গরুর গোশতের অন্যতম শীর্ষ উৎপাদনকারী ও রফতানিকারক। এ প্রতিষ্ঠানটির সাথে সঙ্গীত সোমের জড়িত থাকাটা তার রাজনৈতিক দলের অবস্থান ও তার নিজের কট্টর রাজনৈতিক অবস্থানের সাথে স্ববিরোধী ও শঠতাপূর্ণ। তাদের দলের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও নিজেই গরুর গোশত রফতানি ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। মোদি ও অন্য শীর্ষ নেতারাই বলেছিলেন, ‘গরুর গোশত রফতানি প্রকারান্তরে গরু হত্যারই নামান্তর’।
শুধু আল-দুয়াই নয়, আল-আনাম অ্যাগ্রো ফুড প্রাইভেট লিমিটেড নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন সঙ্গীত সোম ও মঈনুদ্দীন কুরেশি। সঙ্গীত দাবি করেন, তিনি গো-হত্যা ও গোশত রফতানিতে কোনোভাবেই জড়িত ছিলেন না বরং শুধু একটি প্লট কিনতে জড়িত ছিলেন, এর বেশি কিছু নয়। পরে তিনি স্বীকার করেন, তিনি আল-দুয়ার পরিচালক ছিলেন দুই বছর। কারণ, ওই প্রতিষ্ঠানে তিনি ৯ লাখ রুপি বিনিয়োগ করেছিলেন। এ সিদ্ধান্তকে ভুল স্বীকার করলেও তার দাবি তিনি জানতেন না আল-দুয়া একটি গরুর গোশত রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান। আবার তিনি এ-ও জানান, এসব কিছুই ছিল তার রাজনীতিতে যোগদানের আগে। কিন্তু আল-দুয়ার ওয়েবসাইটে দেখা যায় প্রতিষ্ঠানটি হালাল গরু, মহিষ ও ছাগলের গোশত বিদেশে, বিশেষ করে আরব দেশগুলোতে রফতানি করে। এ ছাড়াও মঈনুদ্দীন কুরেশী নিজেই ভারতের অন্যতম শীর্ষ মাংস রফতানিকারক। সঙ্গীত সোম লুকোচুরি করলেও তার বক্তব্য থেকে এ কথা পরিষ্কার হয় যে, গো-হত্যা নিবারণের বিষয়টি মোটেই ধর্মীয় কোন বিষয় নয় বরং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অনুষঙ্গ মাত্র।
ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। যদিও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সকল মানুষের নিজ নিজ ধর্মপালনের স্বাধীনতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়, কিন্তু একটি ভাঁওতাবাজি ছাড়া কিছুই নয়। মূলত ধর্মে কোনো নিরপেক্ষতা নেই। আসলে ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে ধর্মহীনতা। এ কথার প্রমাণ মেলে ইংলিশ সেকুলারিজম এবং প্রিন্সিপালস অব সেকুলারিজম-এর ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা থেকে-
Secularism is that which seeks the development of the physical, moral and intellectual nature of man to the highest possible point, as the immediate duty of life, which inculcates the practical sufficiency of natural morality apart from Atheism, Theism or the Bible-which selects as its methods of procedure the promotion of human improvement by material means and proposes these positive agreements as the common bond of nation, to all who would regulate life by reason and enable it by service. ( Principles of Secularism, 17 )
Secularism is a code of duly pertaining to this life founded on considerations purely human and intended mainly for those who find theology indefinite or inadequate, unreliable or unbelievable. Its essential principles are three: The improvement on this life by materials means. That science is the available providence of man. That is good or not, the good of present life is good, and it is good of present life is good, and it is good to seek that good.’ (English Secularism, 35 )
এ ব্যাপারেOxford dictionaryর সংজ্ঞা খুবই প্রাণবন্ত ও সুস্পষ্ট-
Secularism means the doctrine morality should be based solely on in the present life to exclusion of all consideration drawn from belief in God or in future state.
ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞায় ধর্মহীনতা খুবই সুষ্পষ্ট। কিন্তু ভারত ধর্মহীন রাষ্ট্রও নয়। তারা মূলত ধর্মনিরপেক্ষতার ছদ্মাবরণে সাম্প্রদায়িক, উগ্রবাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতিসত্তার ধারক ও বাহক। আসলে তারা ধর্মান্ধ। সাম্প্রদায়িক ও উগ্রবাদিতার জন্য শুধুমাত্র দক্ষিণপন্থী বিজেপি ও উগ্রবাদী আরএসএসকে দায়ী করা হলেও ভারতীয় ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সাম্প্রদায়িক ও উগ্রবাদী ভারতেরই পরিচয় পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক সময়ের ‘গো-হত্যা নিবারণ’ আন্দোলনের জন্য বিজিপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে দায়ী করা হলেও ১৯৯০ সালে ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ ধ্বংসের সময় কিন্তু তারা ক্ষমতায় ছিল না বরং কথিত ধর্মনিরপেক্ষতাদাবী কংগ্রেসই ক্ষমতায় ছিল। সেদিন রাষ্ট্রশক্তি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ধ্বংসলীলা থামাতে পারেনি আর এটি কোন গ্রহণযোগ্য কথা নয়। ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শেকড় আরও গভীরে। আসলে ভারত এই উপমহাদেশে হিন্দুত্ব ছাড়া আর কোনো ধর্ম ও আদর্শের অস্তিÍত্বকেই স্বীকার করে না। তাদের মতে, কোন এক ঘূর্ণাবর্তে ভারত মাতা বিভাজিত হয়েছে। তাই হিন্দুত্ববাদ ছাড়া ভারতে অন্য কিছু চলতে পারে না। ১৯২৮ সালে হিন্দু মহাসভার জন্ম হলে জন্মক্ষণ থেকেই সংগঠনটি প্রচার করতে থাকে যে, ÔAll India is Hindustan, the land of the Hindus, at once their fatherland and holy land, and the only land with which Hindus, unlike moslems are concerned, that there is only one nation of India, the Hindu nation and that the moslems are any minority community, and as such must take their place in a single Indian state,’-K K Aziz, 1979, Delhi : 46.
.
অর্থাৎ ভারতবর্ষ হিন্দুদের জন্য। তাদের পিতৃভূমি ও পবিত্র স্থান এটি এবং এটি এমন দেশ, যেখানে শুধু হিন্দুদের স্বার্থ সংরক্ষিত থাকবে। ভারতে শুধুমাত্র একটি জাতি রয়েছে এবং তা হলো হিন্দু জাতি। মুসলমানরা একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং অখন্ড ভারতে ঐভাবেই তাদের অবস্থান চিহ্নিত হবে।
১৯৩৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর কানপুরে অনুষ্ঠিত মহাসম্মেলনে সভাপতির ভাষণে সাভারকার (ট উ ঝধাধৎশধৎ ) বলেন, (U D Savarkar ) , The land which extends from the Indus to the southern sea is Hindustan, the land of the Hindus are the nation that own it. To us Hindus, Hindustan and India mean one and the same thing.’
অর্থাৎ যে ভূমি সিন্ধু থেকে দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত তাহলো হিন্দুস্থান। হিন্দুদের নিজস্ব ভূমি। হিন্দুরা যে জাতি গঠন করেছে তারাই এর মালিক। আমাদের নিকট হিন্দুস্থান ও ভারত সমার্থক। আমরা ভারতীয়, কেননা আমরা হিন্দু।
এ থেকে প্রমাণ হয় ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সর্ব সাম্প্রতিক কোন দল বা গোষ্ঠীর নয় বরং এর পেছনে অনেক বড় ইতিহাসে রয়েছে।
কথিত গো-হত্যা নিবারণ বিষয়ে এখন গোটা ভারতই উত্তাল। উগ্রবাদীরা প্রচার করছে গরু হচ্ছে তাদের গো- দেবতা। তাই হিন্দু ভারতে গো-হত্যা কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না। আর এ গো-হত্যাকেই অজুহাত বানিয়ে তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও ভারতের সচেতন হিন্দুরা উগ্রবাদীদের এ ধারণার সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন এবং প্রকাশ্যে গরুর গোশত ভক্ষণ করার ঘোষণা দিয়েছেন। গরুর গোশত খাওয়ার মহোৎসবও হয়ে গেছে ভারতে। কিন্তু উগ্রবাদীরা এ জন্য কোন হিন্দুকে আক্রমণ করছে না বরং বোরকা পরে মুসলিম মহিলা সেজে মন্দিরে গো-মাংস নিক্ষেপ করে দাঙ্গা বাধানোর মত ঘটনাও বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে। ফলে প্রমাণিত হয়েছে যে, গো-রক্ষার নামে উগ্রবাদীরা ভারত থেকে মুসলিম নিধন করার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে।
ভারতীয় এসব উগ্রবাদীর মোকাবেলায় সে দেশের সচেতন মানুষকে সোচ্চার হতে দেখা গেছে। গরু নিষিদ্ধের এই রাজনীতির ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বিচার করতে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে মতামতভিত্তিক ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ডেইলিও। ভারতীয় উপমহাদেশের ওপর গ্রন্থ রচনার জন্য ইতিহাসবিদ দ্বিজেন্দ্র নারায়ন ঝাঁ (ডিএন ঝাঁ) এর সাথে ডেইলি ও এর প্রতিবেদক উর্সিলা আলীর কথোপকথনের ভিত্তিতে প্রকাশিত হয়েছে নিবন্ধটি। প্রকাশিত নিবন্ধটিতে ইতিহাসকে সাক্ষী মেনে ডি এন ঝাঁ বলেছেন, বৈদিক আর্যরা গরু বলি দিতেন এবং তার মাংস খেতেন। গরু বলি দেয়ার এ রকম অনেক উদাহরণ আছে বেদেও। সেখানেও গরু জবাই ও তার মাংস খাওয়ার কথা রয়েছে।
মূলত গো-মাংস ভক্ষণের চর্চাটি আর্য পরবর্তীদের সময় থেকে শুরু হয়ে মৌর্য শাসনের পূর্ব পর্যন্ত চলে এসেছে। ইতিহাসে যে তথ্য পাওয়া যায় তা অনুযায়ী মৌর্য সময়কালে কমতে থাকে গরু জবাইয়ের সংখ্যা। যে সকল ব্রাহ্মণ গরু জবাইয়ের মূলে ছিলেন তারাই এখন গরু জবাইকে নিরুৎসাহিত করছেন এবং একে ক্ষমাহীন অপরাধও বলছেন। গো-হত্যা নিবারণের প্রক্রিয়া শুরু হয় কলি কালের ধারণা থেকে। যে ধারণা প্রথমে মহাভারতে দেয়া হয় মৌর্য শাসনের পরবর্তী সময় থেকে গুপ্ত শাসনামলের সময়। ডি এন ঝাঁ বলেছেন, ধর্মীয় বিষয়ে মতামত দেয়া ব্রাহ্মণরা এখন যুক্তি দেখাতে শুরু করেছেন যে, কলি কালে পুরনো কিছু চর্চা বাদ দিতে হবে, যার মধ্যে গরু জবাই অন্যতম। তবে তাদের এ নিরুৎসাহিত করার সাথে ধর্মশাস্ত্রের নির্দেশ (গরু জবাইকারীকে ছোঁয়া যাবে না) কোন মিল নেই। বস্তুত বিষয়টি কথিত ব্রাহ্মণদের মন গড়া ও মুসলিমবিদ্বেষের ফল ছাড়া কিছু নয়।
যেহেতু মুসলমানরা গরুর গোশত খান, তাই গো-রক্ষা ইস্যুকে সামনে এনে সাম্প্রদায়িক সমস্যা সৃষ্টি করার জন্য গরু জবাই বন্ধ করার মনগড়া ধর্মীয় বিধান প্রচার করা হয় এবং গরুর মাংস খাওয়াকে ক্রমে ক্রমে ব্রাহ্মণদের খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। এখন খাবারটি এমন বর্ণের খাবার হয়ে দাঁড়িয়েছে যাদের ছোঁয়া যাবে না। মধ্যযুগে ইসলামী জাগরণের সময় ব্রাহ্মণদের এ নির্দেশের সাথে মুসলমানদের মধ্যে একটি ধর্মীয় অমিল দেখা যায় এবং ১৭ থেকে ১৮ শতকে এ বিষয় নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধেরও প্রমাণাদি রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। মারাঠি শাসনামলে এবং শিবাজির সময়ে তা আরও প্রবল হয়। গরু এবং ব্রাহ্মণদের রক্ষাকর্তা হিসেবে পরিচিত শিবাজি। তার সময়েই হিন্দু ধর্মের সাথে গরুর সম্পর্কের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
পাঞ্জাবে গরু জবাইকে বৈধতা দেয়ার কারণে ১৯ শতকে হিন্দু এবং শিখদের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে একত্রিত করে গরু ইস্যু। তবে ১৮৮২ সালে দয়ানন্দ সরস্বতী গরু রক্ষার সমাজ গঠন করেন এবং এর সাথে বহু মানুষকে একত্রিত করতে সক্ষম হন যা সরাসরি মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হতো। এর পর থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে গরু হয়ে ওঠে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঝাঁ বলেছেন, আর্যদের গরু জবাইয়ের অনেক তথ্য থাকলেও এটি সময়ের সাথে তার আকর্ষণ হারিয়েছে। মৌর্য এবং গুপ্ত আমলের পরবর্তী সময়ে ব্রাহ্মণরা সরাসরি গরু জবাইকে নিরুৎসাহিত করেন। মধ্যযুগ পরবর্তী সময়ে এটি ধর্মীয় প্রতিকৃতি ধারণ করে এবং ১৯ শতকে হিন্দু ধর্মের পরিচায়ক হয়ে দাঁড়ায়, যা ধর্মের নামে উগ্র সাম্প্রদায়িকদের অসহিষ্ণুতা ও দেউলিয়াত্ব ছাড়া কিছু নয়।
মূলত উগ্র সাম্প্রদায়িক ভারতে গরুর জীবনের মূল্য একজন মুসলিমের জীবনের চেয়েও বেশি। ঘটনার ধারাবাহিকতা তাই প্রমাণ করে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকেই ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করলেই এর স্বপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যাবে। গত সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ভারতের উত্তর প্রদেশের দাদরি শহরে লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের শিকার ৫০ বছর বয়সী মোহাম্মদ আখলাকের অপরাধ ছিল গরুর গোশত খাওয়া ও সংরক্ষণ করা। ২০১৪ সালের আগস্টে উত্তর ভারতে একজন মুসলিম যুবককে উগ্রবাদী হিন্দুরা নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। তার অপরাধ সে গরু জবাই করেছিল।
চলতি বছরের মার্চে প্রচারিত এক ভিডিওতে দেখা যায় একজন মুসলিম যুবক গরু কেনাবেচার অপরাধে দড়িতে ঝুলিয়ে পিটিয়ে হিন্দু রামগীতি বলতে বাধ্য করা হয়েছে। উল্লিখিত ঘটনার মধ্যে আখলাকের হত্যাকান্ডটি সবচেয়ে হৃদয়বিদারক। ক্ষমতাসীন বিজেপির ইউনিয়ন মন্ত্রী প্রভাবশালী মহেশ শর্মা এ হত্যাকান্ডকে ‘দুর্ঘটনা’ বলেছেন। আসলে এটি ছিল একটি নির্মম ও নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড, যা বিশ্ববিবেককে মর্মাহত করেছে।
এই হত্যায় অংশ নেয়া উগ্রপন্থী হিন্দুরা আখলাকের বাড়িতে হামলা করে এবং পরিবারের সবার সামনেই তার স্ত্রীর সেলাই মিশিন দিয়ে মাথা থেঁতলে তাকে হত্যা করে। এ ঘটনায় জড়িত ‘গরু রক্ষা করি’ নামক সংগঠনটির এক সদস্য ও স্থানীয় বিজেটি নেতা ইন্দার নাগার বলেন, ‘আমরা গরুকে আমাদের সন্তানের চেয়ে বেশি ভালবাসি’।
হিন্দুদের কাছে গরু দেবতা। তাই ভারতে গরু হত্যা ও মাংস ভক্ষণ দুটোই নিষিদ্ধ। সম্প্রতি এক বক্তৃতায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘গরু নিধন সর্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে’। কিন্তু ২০১৪ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে তিনি কখনোই মুসলিম হত্যার ব্যাপারে মুখ খোলেননি। মোদির রাজনৈতিক আনুগত্য পরিষ্কারভাবে বোধগম্য। তিনি এক দশকের বেশি সময় ধরে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএস-এর সাথে জড়িত, যাদের প্রধান এজেন্ডাই হলো ১২৫ কোটি মানুষের দেশকে, যাদের ১৪ শতাংশের বেশি মুসলিম, তা পুরোপুরি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা।
১৯৮৫ সালে মোদি হিন্দু মৌলবাদী গ্রুপের রাজনৈতিক শাখা বিজেপিতে যোগদান করেন। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর মোদির কার্যক্রমে বিশেষজ্ঞরা মনে করেছিলেন তিনি রাজনৈতিক আদর্শের ঊর্ধ্বে ওঠে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী, ধর্মনিরপেক্ষ ভারত গঠনে বেশি আগ্রহী হবেন। কিন্তু ভারতবাসীর সে আশা পূরণ হয়নি বরং তারা আশাহত হয়েছেন।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে সংঘটিত এ যাবৎকালের সবচেয়ে প্রাণঘাতী গুজরাট দাঙ্গায় নিহত কমপক্ষে এক হাজার মুসলিমের রক্তে যার হাত রঞ্জিত সেই নরেন্দ্র মোদি তার সারা জীবনের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা থেকে একটুও বিচ্যুত হননি। ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানো সম্ভবত তার ও তার দলের প্রধান লক্ষ্য। সে লক্ষ্য অর্জনে তারা যে এখন পর্যন্ত সফল সে ব্যাপারে মোদির ঘোর শত্রুও দ্বিমত করবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। অনেক ভারতীয়ই বলছেন, মোদি আখলাকের মৃত্যুতে সমবেদনাও জানাননি। এতে প্রমাণ হয় প্রধানমন্ত্রী উগ্রবাদীদের প্রতিভূ। যদিও তিনি কয়েক দিন আগে এক নির্বাচনী জনসভায় দাদরি হত্যাকান্ডের ব্যাপারে কৌশলে মুখ খুলেছেন এবং এই হত্যাকান্ডকে অগ্রহণযোগ্য বলছেন। কিন্তু কথার মারপ্যাঁচে তিনি প্রকারান্তরে হত্যাকারীদেরই আনুকূল্য দিয়ে গেছেন।
উল্লেখ্য, ২০০৩ সালে মোদি বলেছিলেন, ‘গুজরাটের প্রধান শক্তিই এর নিরামিষভোজী হিন্দুরা। মাংসাশীরা হলো ভিন্নধর্মী’। যদিও গরুর মাংস সস্তা ও গরিবদের (প্রধানত মুসলিম) প্রোটিনের অন্যতম উৎস। তারপরও মোদি সরকার ভারতে গরু জবাই নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে। বিশ্ববাসীর উদ্দেশে পরিষ্কার বার্তা, মোদির ভারতে একটি গরুর জীবন একজন মুসলিমের জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যবান।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে গো-রক্ষা আন্দোলন ও উগ্রবাদী উন্মাদনা বিশেষ গোষ্ঠী বা শ্রেণীর সৃষ্ট নয় বরং ভারতে অলিখিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতি। তারা ‘গরু রক্ষা করি’ ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানো ও সে দেশ থেকে মুসলিম উৎখাত করতে চায়। তাদের আরও একটি অলিখিত মূলনীতি হচ্ছে ‘হিন্দু হও, নইলে ভারত ছাড়’। মূলত ভারতীয় রাজনীতি সে ঘূর্ণাবর্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু তাদের সে চন্ডনীতি ভারতকে কোন ভয়ঙ্কর গন্তব্যে নিয়ে তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে।
বিষয়: বিবিধ
১২৫০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন