হে মানবতা! তুমি কার?
লিখেছেন লিখেছেন শরীফুল ইসলাম শরীফ ১৮ নভেম্বর, ২০১৫, ১০:২৫:৫৬ রাত
চারদিকে সুনসান নিরবতা। গোটা পৃথিবী যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। পাখিরাও মজেছে মনোরম তন্দ্রায়! শিয়ালগুলো আর ডাকছে না! ঢাকার যানজটপূর্ণ গাড়ি-ঘোড়ার পে-পু শব্দ আর কানে আসছে না। তবে কাগজের চালার উপর দিয়ে ফুরুৎ করে মাঝে মধ্যে দুই-একটি বিমান যাচ্ছে! মা ডাকছে, এই নুরু, এই নুরু, উঠ উঠ। হঠাৎ জেগে উঠল নুরু। একমাত্র মা ছাড়া সবাই তাকে নুরা নামে ডাকে। সেটা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যাথা নেই! কর্মেই পরিচয় নামে নয়! একলাফে উঠেই নুরা ডুবার পানিতে হাতমুখ ধুয়ে নিল। পান্তা ভাতের সাথে একটি শুকনো মরিচ মিশিয়ে গদ গদ করে গিলে ফেললো মায়ের রাখা ভাতের প্লেট।
রাতের আঁধার তখনো জেগে আছে। কামরাঙ্গীরচর বস্তির গাছের পাতা আর কাগজ মোড়ানো এক তাবু থেকে বেড়িয়ে পড়ল নুরা। ভোরের আলো ফোটার আগেই তাকে সদরঘাটে পৌছতে হবে। নয়তো কাজের বারোটা বেজে যাবে। ওদিকে মালিকের মেজাজ তো সবসময় একশো ডিগ্রিতে থাকে! হন্য হয়ে ছুটছে নুরা। হাটার গতি প্রায় আশি কিলোমিটার পার ঘন্টা। হঠাৎ নুরার কানে পড়াশোনার আওয়াজ ভেসে আসলো। মাদ্রাসার পিচ্ছি পোলাপানরা হেলে দুলে কুরআন পড়ছে। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো নুরা। কখন যে সে মাদ্রাসা অতিক্রম করে চলে এসেছে সেটা নুরা টেরই পায়নি। রাস্তার মোড় ঘেষে হাটছে সে। আবারও পোলাপানের পড়ার আওয়াজ! সে ভাবলো। স্কুল, কলেজের ছেলেমেয়েরা হয়ত পরীক্ষার চাপে রাতজেগে পড়াশোনা করছে। তবে এবার মনটা খারাপ হয়ে নুরার! অজানা কিছু একটি তার অন্তর স্পর্শ করে গেল। সেও তো এক সময় স্কুলে যেত। আহারে! সে কথা মনে পড়ায় নুরার চোখের কোনা অশ্রুতে ভিজে গেল। টাকার অভাব না থাকলে সেও এখন রাস্তায় রাস্তায় না ঘুরে পড়ার টেবিলে পড়ে থাকত।
কি আর করার। নিয়তিকে তো আর অস্বীকার করার যায় না। নিজেকে সামলে নিল নোরা। হাটতে হাটতে নুরা সোয়াপুর ঘাটে চলে এসেছে। এই তো আর একটু হাটলে বুঝি পথ শেষ! একটু ঝিরিয়ে নিল নুরা। ততক্ষণে রাতের আধার অনেকটা কেটে গেছে। মসজিদ থেকে মুসল্লিরা নামায শেষে বের হচ্ছে। আবার হাটা শুরু করল নুরা। হঠাৎ রাস্তার পাশের একটি ভাগাড়ে চোখ পড়তেই নুরা স্তব্ধ হয়ে গেল। ছোট্ট একটি মেয়ে ও বয়স্ক এক ব্যক্তির সাথে কুকুরটি প্রতিযোগিতায় নেমেছে কেন? পুরুষটি মেয়েটির বাবা হবে হয়ত ভাবছে, নুরা! কিন্তু কুকুরটি এমন আচরণ করছে কেন? কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল নুরা। দেখছে তারা কি করে। একবার কুকুরটি ঐ ব্যক্তিকে ধাওয়া করছে আবার লাঠি হাতে ব্যক্তিটি কুকুরটিকে তাড়িয়ে দিচ্ছে! আর মেয়েটি ভাগাড় থেকে কুড়িয়ে কিছু একটা মুখে দিচ্ছে। হাতে থাকা পলিথিনেও তুলছে। নুরা ফেল ফেল করে তাকিয়ে দেখছে। তার বুঝতে বাকি নেই! কেন এমন করছে তারা।
মনের অজান্তেই ধনকুবেরদের অভিশাপ দিতে ইচ্ছে করলো নুরার। ঢাকার বড় বড় লাট সাহেবরা দামি দামি খাবার নষ্ট করে রাতে এইসব ভাগাড়ে ফেলে গেছে। তাই অন্য কেউ আসার আগেই ঐ বাবা-মেয়েটি ডাস্টবিনে খাবার খুজতে এসেছে। কিন্তু ক্ষুধার্ত কুকুরও ভাগ ছাড়তে চাচ্ছে না। সেই জন্য তাদের মাঝে ধাওয়া-পাল্টা হচ্ছে। শোকে বাকরুদ্ধ নুরা আর আগাতে পারছে না। ছোট্ট শরীরটি যেন ভারি হয়ে আসছে। সে ভাবতো এই পৃথিবীতে সেই-ই সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে! কিন্তু তার ধারনা আজ ভেঙ্গে গেল। মনে মনে ভাবল বিশাল পৃথিবীতে কত মানুষই না জানি একবেলা খেলে আরেকবেলা উপোস থাকে। অন্যদিকে ধনবানরা কোটি কোটি টাকা নষ্ট করছে। তাদের ছেলেমেয়েরা টাকাকে তুলার মতো উড়াচ্ছে! পাঁচ তারা, দশ তারা হোটেলে খাবার খেয়ে বিলাসবহুল বাড়িতে আরামচে ঘুমাচ্ছে! এমন বৈষম্য কেন? টাকাওয়ালারা এতো স্বার্থপর কেন? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছে নুরা। কোটিপতিরা যদি তাদের ভাণ্ডার থেকে সুতিভাগ টাকাও গরিবদের বিলি করে দিত, তাহলে তো বই-খাতায় ছেড়ে তার মতো ছন্নহারা ছেলেমেয়েরা রাস্তায় রাস্তায় কাগজ ফেরি করতে হতো না। হায়রে! আদম সন্তান। তোরা এতো নির্দয় ও নিষ্ঠুর কেন? স্বপ্নের সাগরে ডুব দিল সে। ভাবতে ভাবতে সদরঘাটের উপচে মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেল বস্তির টোকাই নুরা……..
বিষয়: সাহিত্য
১২৩৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন