কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন, ধৈর্য প্রদান করুন

লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম ২৫ মে, ২০১৭, ১১:২৫:৫০ সকাল

কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন, ধৈর্য প্রদান করুন

কৃতজ্ঞতা জানাতেই হবে

কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে তথা ব্যক্তিক পরিচয়ে। কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই ১৬ কোটি বাংলাদেশীর একজন হয়ে। পবিত্র কুরআনে ৫৫ নম্বর সূরার নাম, সূরা আর রাহমান। এই সূরায় মোট আয়াত ৭৮টি। একটি আয়াত বা একই আয়াত তথা একই কথা বা বক্তব্য ৩১ বার উপস্থাপিত হয়েছে। সেই আয়াতটি, প্রথমে আরবি ভাষায় ও পরে বাংলা অর্থ উদ্ধৃত করছি। ‘ফাবি আইয়্যে আলাই রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান।’ অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার (তথা তোমাদের রবের) কোন কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে?

প্রথম কারণ আমার মায়ের হায়াত

আমার পিতা সাত বছর আগে ইন্তেকাল করেছেন। পঁচাশি বছর বয়সে আমি তথা আমার ভাইবোনদের মা এখনো যে হায়াতে আছেন, তাতে তিনি চলাফেরা করেন, সব নামাজ না হলেও কিছু নামাজ হলেও দাঁড়িয়ে পড়তে পারেন, আত্মীয়স্বজন এলে ভালো-মন্দ খোঁজখবর নিতে পারেন। ৯ জন ভাইবোনের প্রত্যেকের চিন্তা-চেতনা আনন্দ-বেদনার কেন্দ্রীয় আকর্ষণ মা। সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে যেমন নিজ নিজ কক্ষপথে ভ্রাম্যমাণ গ্রহগুলো স্থির আছে, তেমনি মায়ের আকর্ষণে, মায়ের দোয়ায় আমরা ৯ ভাইবোন এখনো শিকড়কে আঁকড়ে ধরে আছি। এটা হলো আমার পক্ষ থেকে মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রথম মৌলিক কারণ।

দ্বিতীয় কারণ : ঈমান

দ্বিতীয় কারণটি হলো এই যে, মহান সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক মনোনীত দ্বীনের মধ্যে এখনো আছি, কলিজার মধ্যে, হৃদয়ের মধ্যে, মননের মধ্যে, মানসপটে, কলেমায়ে তৈয়বাকে ধারণ করি। মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি যে, নাজিলকৃত পবিত্রগ্রন্থ আল কুরআন পড়তে পারি, চেষ্টা করলে বুঝতে পারি এবং অন্যকে আহ্বান জানাতে পারি। মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতার এই কারণটিকে আদি থেকে বিস্তৃত করলে এটা বলা যাবে যে, তিনি আমাকে মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করে প্রাথমিকভাবেই কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছেন। কারণ, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আল্লাহ তায়ালা যদি আমাকে মানুষ না বানিয়ে যেকোনো পশু-পাখি বা বৃক্ষ বানাতেন তাহলে, ‘আমি সৃষ্টির সেরা জীবের একজন’ এই গৌরবে গৌরবান্বিত হতে পারতাম না। সৃষ্টির সেরা জীবকেই মহান আল্লাহ তায়ালা, এই পৃথিবীর বুকে তাঁর খলিফা নিযুক্ত করেছেন। এবং তিনি এও বলে দিয়েছেন যে, মানুষ এবং জিন জাতিকে তিনি সৃষ্টি করেছেন একমাত্র এই কারণে যে, মানুষ এবং জিন জাতি আল্লাহর ইবাদতই করবে। তাহলে আমার গৌরবান্বিত হওয়ার আরো কারণ আছে এবং তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার আরো কারণ আছে যেগুলো প্রথম মৌলিক কারণের অন্তর্ভুক্ত শাখা-প্রশাখা। সেই শাখা-প্রশাখাগুলো হলো- মহান আল্লাহ তায়ালা আমাকে তাঁর খলিফা সম্প্রদায়ের একজন বানিয়েছেন এবং যারা তাঁর ইবাদত করার জন্য মনোনীত হয়েছেন, আমি সেই সম্প্রদায়ের একজন, কারণ আমি মানুষ।

তৃতীয় কারণ : আমার হায়াত, সুস্থতা এবং মনের তারুণ্য

চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে, স্বর্ণগর্ভা হালদার তীরে, নিজ গ্রাম উত্তর বুড়িশ্চরে যারা আমার দাদা-দাদীর বয়সী ছিলেন, তারা ইন্তেকাল করেছেন বহু আগেই; যারা আমার বাবা-চাচার বয়সী ছিলেন, তারাও প্রায় সবাই ইন্তেকাল করেছেন। প্রায় সময়েই যেহেতু নিজ গ্রামে যাই এবং অনেক সময় যেহেতু জুমার নামাজ বা ওয়াক্তের নামাজ পড়ি, মুরব্বিদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ওখানেই হয়ে যায়। কিছু দিন আগে পাড়ার একটি সামাজিক বিষয় নিয়ে বাদ আসর কথা উঠেছিল মসজিদের উঠোনে। আমাকে বলার পর আমি বললাম, মাগরিবের পরে মুরব্বিদের নিয়ে বসেন; কথা বলেন, তাদের পরামর্শ নিয়ে কাজ করেন। আমার বলাটা ছিল বহু বছরের অভ্যাসের প্রতিফলন। কিন্তু উপস্থিত ব্যক্তিদের প্রতিক্রিয়াটি আমাকে একটু চমকে দেয়। একসঙ্গেই দুই-তিনজন বলে ফেললেন, যেই মুরব্বিদের কথা আপনার মনে এখনো দাগ কেটে আছে, তারা সবাই মসজিদের দক্ষিণ পাশে (মানে হলো কবরস্থানে)। আপনি নিজের বয়স কি চিন্তা করেছেন? আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। আমার বয়স ৬৮ চলছে; পাড়ায় চার-পাঁচজন মাত্র আছেন যাদের বয়স আমার থেকে দু’চার বছর মাত্র বেশি। অনেকের তুলনায় আমি মনে করি, আমি এখনো শরীরে উপযুক্ত আছি, শতভাগ চলনযোগ্য আছি, মনে এবং চিন্তায় এখনো তরুণ আছি, হৃদয়ে এখনো সাহস আছে; এবং এটাই হলো মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য আমার তৃতীয় মৌলিক কারণ; আমি শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।

চতুর্থ কারণ : জীবনের সাফল্য

মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা এই মর্মে যে, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি আমাকে সমকালীন সর্বোত্তম বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। আমি কৃতজ্ঞ যে, জ্ঞান অর্জনে, আনুষ্ঠানিক পরীক্ষায় সর্বত্র তিনি আমাকে সাফল্য এবং সম্মান দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞ এই জন্য যে, লেখাপড়ার প্রতি বা জ্ঞান অর্জনের প্রতি আমার মনের অভ্যন্তরে নিষ্ঠা ও আগ্রহ তিনি সর্বদাই জীবিত রেখেছেন, এখনো জীবিত রেখেছেন। চাকরি জীবনের শুরুতেই মহান আল্লাহ তায়ালার দয়ায় অভূতপূর্ব অকল্পনীয় অসাধারণ সম্মান ও সাফল্য দিয়েছেন। রিজিকের মালিক মহান আল্লাহ তায়ালা। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে আমার রিজিক স্থির হয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় ব্যাটালিয়নের আবাস ও কর্মস্থল গাজীপুরে (তখনকার নাম জয়দেবপুর)। এই ২০১৭ সালের মে মাস পর্যন্ত মহান আল্লাহ তায়ালা সর্বদাই সম্মানজনক স্বাস্থ্যকর রিজিক দান করেছেন, এর জন্য কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত ভাষা আমার জানা নেই। তারপরও পরিচিত ভাষায় বলব শোকর আলহামদুলিল্লাহ।

পঞ্চম কারণ : মুক্তিযুদ্ধ

এবার ১৯৭১ সালের কথায় আসি। ওই আমলে জনসংখ্যায় শিশু-আধিক্য ছিল। এখন বাংলাদেশী মানুষের গড় আয়ু ৭১ হলেও তখন ৩৫-এর নিচে ছিল। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মধ্যে অর্ধেকসংখ্যক নারীকে শুধু গণনার খাতিরে কিন্তু সম্মানের সঙ্গে বাদ দিচ্ছি; বাকি থাকে পৌনে চার কোটি পুরুষ। তার মধ্যে ১৯৭১ সালে আনুমানিক পঞ্চাশ ভাগের বয়স ছিল পনেরো থেকে চল্লিশের মধ্যে; বাকি পঞ্চাশ ভাগের বয়স ছিল পনেরোর নিচে চল্লিশের উপরে। পনেরো থেকে চল্লিশ মানে কৈশোর বা যৌবন। কবির কথা ধার করি : কবি হেলাল হাফিজ রচিত অন্যতম জনপ্রিয় কবিতার নাম ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’; এই কবিতার দু’টি পঙ্ক্তি নিমবসরূপ : ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ ১৯৭১ সালে কবি হেলাল হাফিজ এই দু’টি লাইন তখনো লেখেননি। কিন্তু যৌবন তো ছিল, মিছিল তো ছিল, যুদ্ধ তো ছিল। যুদ্ধে গিয়েছি, যুদ্ধ করেছি, বন্ধু ও সহযোদ্ধাদের শহীদ হওয়া প্রত্যক্ষ করেছি, রণাঙ্গনের শত্রু সৈন্যের পতন প্রত্যক্ষ করেছি, পতিত লাশ গণনা করেছি, বন্ধুর লাশ দাফন করেছি। রাষ্ট্র সম্মান দিয়েছে বীর প্রতীক উপাধি দিয়ে। আমি কৃতজ্ঞ না হওয়ার কোনো কারণ আছে কি? ওই যে হিসাব করলাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মধ্যে পুরুষ কতজন, ওই পুরুষদের মধ্যে যৌবন কতজনের ছিল, ওই যুবকদের মধ্য ২০-৩০ বছর বয়স কতজনের ছিল এবং তাদের মধ্য থেকে যে অল্প কয়জনই অস্ত্র হাতে নিতে পেরেছিলেন তাদের মধ্যে তো আমি একজন ছিলাম। তাদের একজন হওয়া প্রচণ্ড গৌরবের বিষয়, এর জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার দয়াই একমাত্র কারণ, অতএব আমি কৃতজ্ঞ। আমি আরো কৃতজ্ঞ, আমি ১৯৭১ সালের রণাঙ্গনকে আমার অনুভূতিতে এবং চিন্তা জগতে চিরভাস্বর রেখেছি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে হৃদয়ে ধারণ করে রেখেছি, ১৯ মার্চ তারিখে জয়দেবপুরে সৈনিক জনতার প্রথম বিদ্রোহকে স্মরণ ও ধারণ করে রেখেছি, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের ঘোষণাকে হৃদয়ে ধারণ করে রেখেছি, ৪ এপ্রিল তারিখে তেলিয়াপাড়ায় অনুষ্ঠিত প্রথম অপারেশনাল সমন্বয় সভার কথা মনে রেখেছি। প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীসহ (পরে জেনারেল ওসমানী) রণাঙ্গনে আমার উপরের জ্যেষ্ঠদের মনে রেখেছি, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে মনে রেখেছি, মেহেরপুরের সীমান্তে আমবাগানকে মনে রেখেছি। সবকিছুই যুগপৎ মনে রেখেছি, একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটিকে নয়। যে যা-ই বলুক না কেন, মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় ঐক্যের উসিলা বানাতে চাই, যেমনটি ছিল। মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় অঙ্গনে বিভাজনের উসিলা বানাতে চাই না, যেমনটি অনেকেই করে।

সাফল্যময় জীবন : সেনাবাহিনী

যুদ্ধের কথা শেষ করে পরবর্তী জীবনে আসছি। স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীতে যে অল্প কয়দিন চাকরি করেছি, একান্তই নিষ্ঠা ও ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে চাকরি করেছি, গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে চাকরি করেছি, উজ্জ্বল সহকর্মীদের সঙ্গে চাকরি করেছি, অবসরজীবনে স্মৃতিচারণের সময় স্বস্তি ও আনন্দ দেবে এমন দায়িত্বগুলো পালন করেছি। মহান আল্লাহ তায়ালা চাকরিজীবনে অভিজ্ঞতা, সাফল্য, সম্মান ও শান্তি প্রচুর দিয়েছেন, অসীম দিয়েছেন, অসামান্য দিয়েছেন। এর কৃতজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। ভালো ভালো ব্যাটালিয়নে, গুরুত্বপূর্ণ ব্যস্ত ব্রিগেডে, স্বাভাবিক ডিভিশনে, তাৎপর্যপূর্ণ স্টাফ অফিসারের চেয়ারে, অতি সম্মানযোগ্য প্রশিক্ষকের চেয়ারে চাকরি করেছি। আমাদের আমলে সর্বোচ্চ র‌্যাংক হতো সেনাবাহিনী প্রধানের জন্য নির্ধারিত লেফটেন্যান্ট জেনারেল একজন মাত্র; দ্বিতীয় সর্বোচ্চ র‌্যাংক ছিল মেজর জেনারেল, সেই র‌্যাংক পর্যন্ত উন্নীত হয়েছি। সপরিবারে এক বছর ইংল্যান্ড এবং এক বছর আমেরিকায় উচ্চতর লেখাপড়া করেছি। এমনকি বাধ্যতামূলকভাবে চাকরি যাওয়ার সময়েও, সম্মানজনক পরিবেশেও সম্মানের সঙ্গে চাকরি গিয়েছে। ১৯৯৬ সালের জুন মাসের কথা; জেদ্দা বিমানবন্দরে নেমেছিলাম, ওমরাহ করতে যাবো পবিত্র মক্কা নগরীতে। বিমানবন্দরেই খবর পেলাম, আমি চাকরিচ্যুত। ঠিক পাঁচ ঘণ্টা সময় পরই, পবিত্র কাবা শরিফ তওয়াফ করেছি এবং সেখানেই শুকরিয়া জানিয়েছি চাকরিজীবনের সব প্রাপ্তির জন্য এবং সম্মানজনক অবসরের জন্য। ১০ ঘণ্টা পর পবিত্র মদিনা শরিফে রহমাতুল্লিল আলামিন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজাপাক জিয়ারতের পর পুনরায় শুকরিয়া জ্ঞাপন করেছি। ১৯৯২সালে মহান আল্লাহর দয়ায় সস্ত্রীক হজ সম্পন্ন হয়েছে; এর পরে অনেকবার আল্লাহ তায়ালা ওমরাহ করার জন্য সুযোগ দিয়েছেন একা, সস্ত্রীক এবং সন্তানাদিসহ। মহান আল্লাহর প্রিয়তম ও শ্রেষ্ঠতম বন্ধু নবীজী (সা.)-এর বন্ধুকুল তথা আল্লাহর আউলিয়াগণের সমাধিস্থলে জিয়ারতের উদ্দেশ্যে নিয়ে গিয়েছেন ইরাকব্যাপী, ভারতব্যাপী এবং বাংলাদেশব্যাপী। কৃতজ্ঞতা জানানো শেষ তো হবার নয় কোনো দিনই।

কল্যাণ পার্টি ও রাজনীতি

অবসরজীবনে মহান আল্লাহ তায়ালা পরীক্ষামূলক পরিস্থিতি এবং পরিবেশে রেখেছেন কিন্তু এখনো সম্মানের মধ্যেই রেখেছেন। সব মানুষ কোনো দিনই পছন্দ করবে না; কিন্তু গালিও দেবে না। অনেক মানসিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব পার করে, রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছিলাম একজন কর্মী হিসেবে। সাহস করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। পরাজিত হয়েছিলাম, কিন্তু অভিজ্ঞতা পেয়েছিলাম। তার জন্য কি কৃতজ্ঞতা জানাব না? আমাদের রাজনৈতিক দলের নাম বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি। নতুন দল। এখনো অনেক বড় কিছু করে দেখাতে পারিনি; তাই বলে বড় স্বপ্ন দেখি না এমন তো নয়। আমাদের দলকেও আল্লাহ তায়ালা সম্মান দিয়েছেন। সবাই বলে তোমাদের দলের নামটি সুন্দর; সবাই বলে আশা করি তোমরা দেশের কল্যাণ করতে পারবা, মানুষের কল্যাণ করতে পারবা; চেষ্টা করো। দলের নামটি এমনই সুন্দর যে, এটা মনে রাখার জন্য পরিশ্রম করতে হয় না; কঠিন কোনো বাংলা শব্দ নেই, কঠিন কোনো ইংরেজি শব্দ নেই। শব্দটি এমনই যেটি সবার মনের আকুতির সঙ্গে, চিন্তার স্রোতের সঙ্গে মিলে যায়। রাজনীতির মূল উদ্দেশ্যই কল্যাণ। চারদলীয় জোট যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, তারা সম্প্রসারিত হবে তখন, বিএনপির মহাসচিব নিজে এসে আমাদেরকে দাওয়াত দিয়েছিলেন জোটে যোগদান করার জন্য; এর জন্য বিএনপি এবং বিএনপির মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানব। কিন্তু কৃতজ্ঞতা জানাব মহান আল্লাহ তায়ালাকে যিনি এই সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। অর্থাৎ রাজনীতির বৃহত্তর পরিসরে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন। সমালোচনাও আছে; সেটাও সম্মানের সঙ্গে; সেটার জন্যও সমালোচকগণের প্রতি ধন্যবাদ এবং যুগপত মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা। সমালোচনা না থাকলে শুদ্ধতা নিশ্চিত হয় না, স্বচ্ছতা প্রবাহিত হয় না। অবসরে আসার পর থেকে পত্রিকায় লিখছি; ছয়টি মৌলিক বই লিখেছি। ২০০২ সাল থেকে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে যাচ্ছি। মহান আল্লাহ তায়ালা তৌফিক দিয়েছেন লেখার এবং বলার জন্য, তার জন্য কৃতজ্ঞ তো বটেই। এখন বাংলাদেশের কথা বলি।

বাংলাদেশ : আলোকিত এবং অন্ধকার পৃষ্ঠা

বাংলাদেশ অনেক কিছু পার করেছে। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ পার করেছে, ১৯৭৫ এর আগস্ট-নভেম্বর পার করেছে, ১৯৮১ সালের মে মাস পার করেছে, ১৯৮২ সালের মার্চ দেখেছে। রাষ্ট্রপতি শাসন দেখেছে, প্রধানমন্ত্রীর শাসন দেখেছে। বড় বড় বন্যা দেখেছে, বড় বড় ঘূর্ণিঝড় দেখেছে। প্রমত্তা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা দেখেছে। পদ্মায় যমুনায় ধু ধু বালুচর এখন দেখছে। চট্টগ্রামের লালদীঘির পাড়ে, আগ্রাবাদে নিক্সন মার্কেটের পুরনো কাপড় দেখেছে, রানা প্লাজা দেখেছে, সাড়ে চার হাজার গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিও দেখছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জারকে দেখেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনকে দেখেছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী গুজরাল-মনমোহন-মোদিকে দেখেছে, চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিংকে দেখেছে। আমি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গিয়েছি চারটি বড়-ছোট ফেরি পার হয়ে। ফজরের নামাজ থেকে মাগরিবের নামাজ পর্যন্ত পথ চলে। এখন ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে নিশ্চিতভাবেই চার লেন, ভাগ্য খারাপ হলে দশ ঘণ্টা, সচরাচর ছয়-সাত-আট ঘণ্টার মধ্যেই যাতায়াত সম্ভব। প্রাইভেট সেক্টরে বিলাসবহুল বাস সার্ভিস ও এয়ারলাইন আছে। যতগুলো সামলানো যায় তার থেকে বেশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছে। লেখাপড়ার মান নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে কিন্তু ছেলেমেয়েরা পড়ছে তো। যতগুলো দরকার তার থেকে বেশি প্রাইভেট ব্যাংক আছে। দুর্নীতির যত রিপোর্ট, ব্যাংক থেকে টাকা আত্মসাতের যেসব রিপোর্ট পত্রপত্রিকায় আসে, তার থেকে বহুগুণ বেশি বাস্তবে ঘটছে। বাংলাদেশে নোবেল বিজয়ী আছে, হিমালয়ের এভারেস্ট চূড়া বিজয়ী বাংলাদেশের তরুণ এবং তরুণী আছে। বিশ্বকে চমক লাগিয়ে দিচ্ছে এমন বাংলাদেশী বিজ্ঞানী আছে। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের উপস্থিতি বহু দেশের জন্যই ঈর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমন হয়েছে নরম হয়েছে। অন্যের জন্য কোনো আশ্রয়-প্রশ্রয় আমার দেশের মাটি থেকে বিতাড়িত হয়েছে। যমুনা ব্রিজ অনেক আগেই হয়েছে, পদ্মা ব্রিজ অনেক দূর এগিয়েছে। সুন্দরবন বিপদে পড়েছে, পায়রাবন্দর জন্ম নিয়েছে। রিজার্ভের অঙ্ক কত, সস্তা দামের ক্যালকুলেটারে হিসাব করা যাবে না। দুর্নীতির মাধ্যমে কত টাকা আত্মসাৎ হচ্ছে বা কত টাকা পাচার হচ্ছে সেটা দামি ক্যালকুলেটারেও হিসাব করা যাবে না! জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিতে চায় এটা যেমন সত্য, জঙ্গি গন্ধ পেলেই দমিত হচ্ছে সেটাও সত্য। জঙ্গি উপাখ্যান নিয়ে মুখরোচক কাহিনী আছে এটা যেমন সত্য, বাংলার মানুষ জঙ্গিবাদ চায় না এটাও সত্য। পার্লামেন্ট আছে, সুপ্রিম কোর্ট আছে, সুপ্রিম কোর্টের সামনে দেবীর মূর্তি আছে- এসবই সত্য। দ্ইু নম্বর আর চার নম্বর বাদানুবাদ করছেন এটা যেমন সত্য, এর মাধ্যমে পদ্ধতি স্থির হবে এটাও সত্য। টেলিভিশন আছে, কথা বলার লোক আছে, কথা শোনার লোক আছে- এসবগুলোই যেমন সত্য, তেমনি সত্য যে, আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি মানুষের মূল্যবোধ ধ্বংসকারী টেলিভিশনও বাংলার আকাশের পরতে পরতে আছে। সুন্দর সুন্দর আবাসিক এলাকা আছে, সুন্দর সুন্দর রাস্তাঘাট আছে, তেমনি আছে ভদ্রলোকদের ভদ্রতার ছদ্মবেশে অশ্লীলতার বন্যা। দুষ্টু লোকেরা বলে, অর্থনীতির হিসাবে আমরা নিম্œমধ্যম আয়ের দেশ; কিন্তু নৈতিকতার বিচারে আমরা উচ্চনিম্নমানের দেশ। এই সব মিলিয়েই আমরা, এই নিয়ে আমাদের দেশ, আমাদের সমাজ। তাহলে কী করণীয়?

কী করণীয়? কার দায়িত্ব কী?

অশ্লীল অশোভন অমঙ্গল থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। মূল্যবোধকে উজ্জ্বল করতে হবে। সৃষ্টিশীলতাকে পৃৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। অশ্লীল অশোভন অন্যায় দুর্নীতিকে সাহসের সঙ্গে না বলতে হবে। চোরকে চোর বলতে হবে, সাধুকে সাধু বলতে হবে। দৃষ্টিশক্তি যার প্রখর আছে তিনি কালার ব্লাইন্ড হলে চলবে না। কালো রং চিনতে হবে, সাদা রঙ চিনতে হবে এবং সেরকম বলতে হবে। ভদ্রদের ঐক্য চাই। সাহসীদের ঐক্য চাই। প্রতিবাদীদের ঐক্য চাই। শোভনদের ঐক্য চাই। গরিবের বন্ধুদের ঐক্য চাই। ঐক্যের মাধ্যমে প্রচেষ্টা চাই। প্রচেষ্টার মাধ্যমে সাফল্য চাই। এর জন্য সময় লাগবে। সময়কে সহ্য করতে হলে ধৈর্য লাগবে। ধৈর্য চাই, ব্যক্তিপর্যায়ে, সমষ্টিগত পর্যায়ে। চেষ্টা করে যাচ্ছি, একা পারব না। গতানুগতিকভাবে, আমি রাজনীতির বন্যায় নিজের গা ভাসাইনি। পরিবর্তন চাই। পরিবর্তন করতে হলে বেঁচে থাকতে হবে। যারা চিন্তা করতে পারেন তাদেরকে আহ্বান জানাব, শুধু চিন্তা করবেন না। রাজনীতির অনেক অঙ্গন আছে। রাজপথ একটি অঙ্গন, বুদ্ধিবৃত্তি একটি অঙ্গন, সাংগঠনিক তৎপরতা একটি অঙ্গন, সম্মিলিত আলোচনা-সমালোচনা একটি অঙ্গন, আর্থিক অনুদান প্রণোদনা আরেকটি অঙ্গন। টাকা ছাড়া রাজনীতি হয় না। টাকা ছাড়া লিফলেট ছাপানো যায় না। টাকা ছাড়া সম্মেলন করা যায় না। তাহলে সেই টাকা কে দেবে? ‘দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ’- এই কথা বুদ্ধি আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সাহস আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, আর্থিক সঙ্গতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বুদ্ধিমান মেধাবী লোক যদি প্রফেসর হতে না চান, তাহলে নিশ্চিতই কম বুদ্ধিমান ও কম মেধাবী লোক প্রফেসর হবেন। বাংলদেশী টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার যদি বাংলাদেশী টেক্সটাইল মিলে চাকরি করতে না চান, তাহলে অবশ্যই বিদেশ থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার আসবেন এবং চাকরি করবেন। অনুরূপ সাহসী ও মেধাবী ব্যক্তিগণ যদি রাজনীতি করতে না চান, তাহলে অবশ্যই কম সাহসী কম মেধাবী ব্যক্তিগণ রাজনীতি করবেন। প্রকৃতির নিয়ম হচ্ছে কোনো স্থান শূন্য থাকে না। যারা নিজেদেরকে ভালো মেধাবী ও সাহসী বলে দাবি করেন, তারা মেহেরবানি করে নিজেদের অবস্থান চিন্তা করুন। রাজপথে না গিয়েও রাজনীতি করা যায়, মেহেরবানি করে চিন্তা করুন। আজকের কলামের শেষ বাক্য আমরা কেউই ধৈর্যহারা হবো না, সাহসহারা হবো না, লক্ষ্যচ্যুত হবো না।

বিষয়: বিবিধ

৮৮১ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

383123
২৫ মে ২০১৭ দুপুর ০২:২১
চাটিগাঁ থেকে বাহার লিখেছেন :
চোরকে চোর বলতে হবে, সাধুকে সাধু বলতে হবে। দৃষ্টিশক্তি যার প্রখর আছে তিনি কালার ব্লাইন্ড হলে চলবে না। কালো রং চিনতে হবে, সাদা রঙ চিনতে হবে এবং সেরকম বলতে হবে। ভদ্রদের ঐক্য চাই। সাহসীদের ঐক্য চাই। প্রতিবাদীদের ঐক্য চাই। শোভনদের ঐক্য চাই। গরিবের বন্ধুদের ঐক্য চাই। ঐক্যের মাধ্যমে প্রচেষ্টা চাই। প্রচেষ্টার মাধ্যমে সাফল্য চাই।

অনেক সুন্দর বলেছেন স্যার। আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। Rose
383124
২৫ মে ২০১৭ বিকাল ০৫:৪৪
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চমৎকার শিক্ষনিয় লিখাটির জন্য ধন্যবাদ।
383128
২৬ মে ২০১৭ সকাল ০৫:৪০
আকবার১ লিখেছেন : চমৎকার

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File