১০ই মহররমের গুরুত্ব
লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম ১২ অক্টোবর, ২০১৬, ১০:৪৪:০৭ সকাল
১০ই মহররমের গুরুত্ব
বুধবার ১০ মহররম; তথা ১২ অক্টোবর ২০১৬ এবং ২৭ আশ্বিন ১৪২৩
মহররম মাসের ১০ তারিখ দ্বীন ইসলামের ইতিহাসের আঙ্গিকে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, আমাদের আবেগে চিন্তায় চেতনায় কারবালার ময়দানের ঘটনাটি সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল। তাই আমার আবেগ কারবালার ময়দানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার ঘটনাটি উল্লেখ করেই পরবর্তী আলোচনায় যাচ্ছি।
আমার কারবালা সফর
আমার চাকরি জীবনে এবং অবসর জীবন শুরু হওয়ার পরে ২০০১ পর্যন্ত সময়ে, অনেক দেশে গিয়েছি, সরকারি কাজে, সেমিনার সিম্পোজিয়ামে অংশ নিতে, অথবা বেড়াতে। কিন্তু তখন পর্যন্ত ঐতিহাসিক দেশ ইরাকে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। ২০০২ সালেই মে মাসে একবার এবং অক্টোবর মাসে আরেকবার, আমার সুযোগ হয়েছিল ইরাক সফর করার। মনের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন যাবত লালিত ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো জিয়ারত করা এবং ইতিহাসের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশকে মুল্যায়ন করার। উভয়বারই আমাদের দলে আমিসহ মোট ৩জন ছিলাম। প্রথমবার গিয়েছিলাম, ১২ রবিউল আউয়াল তথা ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষ্যে বাগদাদ নগরীতে সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে। দ্বিতীয়বার গিয়েছিলাম সাদ্দাম হোসেনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোটের দিন নির্বাচনী পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে।
উভয়বারই হযরত ইউনুস (আ.) এর সমাধি ক্ষেত্র, হযরত আলী (রা.) এর সমাধি ক্ষেত্র, কারবালা নগরীসহ অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থানগুলো পরিদর্শন করার জন্য যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিলাম। মহান আল্লাহর নিকট, অফুরন্ত শুকরিয়া।
শুধুমাত্র পাঠকের মনের ভেতরে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা সরল ও স্মরণ রাখার জন্য মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, আমাদের সফরের ছয় মাস পরে, ২০০৩ সালের শুরুর দিকেই আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করেছিল।
ইমাম হুসাইন (রা.)
কারবালার যুদ্ধে যিনি নিষ্ঠুর পরিস্থিতির শিকার হয়ে শাহাদত বরণ করেছিলেন, তিনি ছিলেন আমাদের প্রিয় নবী, রাহমাতাল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর অতি প্রিয় ও স্নেহের কনিষ্ট নাতি—হযরত ইমাম হুসাইন বা বানান ভেদে হোসেন (রা.)। তিনি চতুর্থ হিজরীর ৫ শাবান মোতাবেক ৬২৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুন তারিখে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন মহানবী (সা.) এর আপন চাচাতো ভাই এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.)। তাঁর মা ছিলেন রাসুল (সা.) এর কন্যা হযরত ফাতেমা (রা.)।
হযরত আলী, এবং হযরত মু’আবিয়া
৬৫৬ খিস্টাব্দে ৮২ বছর বয়সে, ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমান (রা.) বিদ্রোহী আততায়ীগণের হাতে শহীদ হওয়ার পর হযরত আলী (রা.) তৎকালীন ইসলামী রাষ্ট্রের খেলাফতের দায়িত্ব নিতে, প্রথমে, বিনীতভাবে অস্বীকার করলেও, কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবীর অনুরোধে পরে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, কিছু সংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাঁর এই দায়িত্ব গ্রহণ স্বতস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেননি। উদাহরণস্বরূপ ঐরূপ ৩জন ব্যক্তির নাম:
এক. মিশরের তৎকালীন শাসনকর্তা আব্দুল্লাহ বিন সা’দ বিন সবুর,
দুই. সিরিয়ার তৎকালীন শাসনকর্তা ও বিশিষ্ট সাহাবী হযরত মু’আবিয়া বিন আবু সুফিয়ান এবং
তিন. তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা.) এর মন্ত্রণা সচিব হযরত মু’আবিয়ার দূরের চাচাতো ভাই মারওয়ান বিন হাকাম। হযরত আলী (রা.) ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুন তথা ৩৫তম হিজরী বছরের জিলহজ্ব মাসের ২৫ তারিখে মদীনার মসজিদে উপস্থিত মুসলমানগণের আনুগত্য গ্রহণ করত: খলিফার দায়িত্ব পালন শুরু করেন। দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক মাসের মধ্যেই একটি বিদ্রোহ বা যুদ্ধ মোকাবিলা করতে হয় ইতিহাসে যাকে বলা হয় উটের যুদ্ধ। অতঃপর তিনি চেলডিয়া ও মেসোপটেমিয়ায় বিদ্রোহ দমন করেন। এগুলো শেষ হতে না হতেই সিরিয়ার শাসনকর্তা হযরত মু’আবিয়া বিদ্রোহ শুরু করেন। এইরূপ প্রেক্ষাপটে তিনি প্রশাসনিক রাজধানী মদীনা থেকে কুফা নামক স্থানে স্থানান্তর করেন। মু’আবিয়া কর্তৃক উস্কিয়ে দেয়া যুদ্ধের এক পর্যায়ে, একটি সন্ধি হয় মু’আবিয়ার পক্ষের সঙ্গে। ৬৬১ খ্রিস্টাব্দ তথা ৪০তম হিজরী বছরের ১৭ রমজান তারিখে রাজধানী শহর কুফায় হযরত আলী (রা.) আততায়ীর আক্রমণে শাহাদত বরণ করেন। কুফা শহরের পাশ দিয়ে ফোরাত নদী বহমান ছিল। ঐ নদীর প্লাবন থেকে কুফা শহরকে বাঁচানোর জন্য একটি শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। ঐ বাঁধের পাশেই হযরত আলী (রা.)কে সমাহিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে, ক্রমান্বয়ে ঐ স্থানে ‘নাজাফ’ শহর প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে নাজাফ মুসলিম বিশ্বের একটি বড় অংশের নিকট অতি পবিত্র শহর।
হযরত হাসান এবং হুসাইন (রা.)
হযরত আলী (রা.) শাহাদত বরণের পর, তাঁর বড় ছেলে অর্থাৎ হুসাইন (রা.) এর বড় ভাই, ৩৬ বছর বয়সে ৪০ হিজরীতে ইরাক প্রদেশে খলিফা নির্বাচিত হন এবং সেখান থেকেই হিজাজ এবং খোরাসান প্রদেশও শাসন করতেন। তাঁর শাসনকালের চার মাসের মাথায়, তৎকালীন অপর শাসনকর্তা মু’আবিয়া কর্তৃক পুনরায় যুদ্ধ উষ্কিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি হয়। সন্ধির অন্যতম শর্ত মোতাবেক হযরত হাসান (রা.) মু’আবিয়ার অনুকূলে খেলাফত ত্যাগ করে, ক্ষমতা পরিত্যাগ করে, মদীনায় চলে যান। সন্ধির অপর শর্ত ছিল, মু’আবিয়ার মৃত্যুর পর হযরত হাসান (রা.) এর ছোট ভাই ইমাম হুসাইন (রা.) খলিফা নির্বাচিত হবেন। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে মু’আবিয়ার মৃত্যু হলে তার পুত্র ইয়াজিদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং পিতা কর্তৃক সম্পাদিত চুক্তি মান্য করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। এর ফলে তৎকালীন মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের মতে, উম্মাহর ধর্মীয় নেতা ও ইসলামী রাজ্যের শাসনকর্তা তথা খলিফা হওয়ার কোনো প্রকার চারিত্রিক, নৈতিক, শিক্ষাগত যোগ্যতায় ইয়াজিদের মধ্যে ছিল না। এই কারণে, হযরত আলী (রা.) এবং ইমাম হাসান (রা.) এর ইরাকি সমর্থকগণ ইয়াজিদ কর্তৃক বে-আইনী ও অনিয়মিত বা প্রথা বহির্ভুত পদ্ধতিতে ক্ষমতার চেয়ারে আরোহণ করায়, ইয়াজিদের প্রতি বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন।
হুসাইন ( রা. ) দায়িত্ব নেয়ার প্রেক্ষাপট
এইরূপ ঘটনাবলীর সময় ইমাম হুসাইন (রা.) অস্থায়ীভাবে পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থান করছিলেন। সংকটপূর্ণ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে কুফা বাসীদের উপর্যুপরি নিমন্ত্রণ ও আনুগত্যের আশ্বাসে ইমাম হুসাইন (রা.) মুসলমানদের পক্ষে নেতৃত্ব গ্রহণ করতে সম্মত হন। ঐ সময়, কোনো কর্মপন্থা সুনিশ্চিতভাবে অবলম্বন করার আগে ইমাম হুসাইন (রা.) তাঁর একজন জ্ঞাতি ভাই (যার নাম মুসলিম ইবনে আকিল)কে পরিস্থিতি যাচাই করার জন্য ইরাকের কুফা নগরীতে প্রেরণ করেন। সেখানে হাজার হাজার মুসলমান, মুসলমি ইবনে আকিলকে স্বাক্ষী রেখে ইমাম হুসাইন (রা.) এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। সেই হাজার হাজার মুসলমানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতিই, জ্ঞাতি ভাই মুসলিম ইবনে আকিল ইমাম হুসাইন (রা.)কে পত্র লেখেন যে, তিনি যেন মক্কা ত্যাগ করে ইরাক চলে আসেন। ইতোমধ্যে ইয়াজিদের খ্রিস্টান উপদেষ্টাগণের পরামর্শ মোতাবেক, ইয়াজিদ, ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদকে কুফার শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। দায়িত্ব নিয়েই, ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ তাৎক্ষণিকভাবে মুসলিম ইবনে আকিলকে বন্দি করে ও হত্যা করে। এই বন্দি করা ও হত্যা করার বিষয়টি ইমাম হুসাইন (রা.) জানতে পারেননি। কুফাবাসীর আমন্ত্রণেই খলিফা হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার লক্ষ্যে, ইমাম হুসাইন (রা.) রাজধানী কুফা শহরের উদ্দেশ্যে, ৬০ হিজরী সালের জিলহজ্ব মাসের ৩ তারিখে মক্কা ত্যাগ করে রওনা হয়ে পড়েছিলেন। কারণ, উমাইয়া স্বেচ্ছাচারি শাসনের অভিশাপ থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য যে সকল মুসলমান ইমাম হুসাইন (রা.) এর কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন, তাদেরকে সাহায্য করা তিনি কর্তব্য বলে মনে করলেন। কুফার উদ্দেশ্যে অগ্রসরমান, ইমাম হুসাইন (রা.) এর দলটি ছিল অতি ক্ষুদ্র তথা পরিবার-পরিজন ও পরিবারের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দল। কোনো অবস্থাতেই, কোনো যুদ্ধ-দল বা যুদ্ধের কন্টিনজেন্ট নয়।
কারবালার প্রান্তরে বাধ্যতামূলক অবস্থান
কুফা আসার পথেই এই দলটি ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ এর অশ্বারোহী বাহিনীর নজরদারিতে পড়েন। এই অশ্বারোহী বাহিনী ইমাম হুসাইন (রা.) এর দলকে অগ্রযাত্রা বন্ধ করতে আহ্বান জানায় এবং ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করতে দাবি জানায়। কিন্তু ইমাম হুসাইন (রা.) এই দাবি মানতে অস্বীকার করেন। কারণ, এই দাবি মেনে নেয়ার অর্থই ছিল অন্যায় ও অসত্যের সাথে, স্বেচ্ছাচারিতার সাথে আপোষ করা তথা নতিস্বীকার করা। শেষ পর্যন্ত ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে হুসাইন (রা.)-এর দল অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। ফোরাত নদীর ইংরেজি নাম ইউফ্রেটিস। এই ফোরাত নদীর তীরে তখনকার আমলের কারবালা প্রান্তর ছিল ধূ-ধূ মরুভূমি। এখানে শত্রুপক্ষ ইমাম হুসাইন (রা.) এর দলকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করার নিমিত্তে, ফোরাত নদীর পানি ব্যবহার করার সব পথ বন্ধ করে দেয়। পরবর্তী কয়েকটি দিন শ্বাসরুদ্ধকর এবং একতরফা শক্তি প্রদর্শনের চূড়ান্ত নমুনা ছিল। অবরুদ্ধ অবস্থায় ইমাম হুসাইন (রা.)-এর দল, কুফা থেকে সাহায্যকারী বা সমমনা দল আশা করেছিলেন। কিন্তু কুফা থেকে অনুগত মুসলমান বাহিনীও বিভিন্ন কারণে তথা কুফাতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, ইমাম হুসাইন (রা.)কে সাহায্য করার জন্য কারবালার উদ্দেশ্যে রওনা হতে পারেনি। এইরূপ পরিস্থিতিতেই, ১০ মহররম ৬১ হিজরী সকালে জনৈক উমার ইবনে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ৪০০০ উমাইয়া সৈন্যের সেনাপতি হিসেবে ইমাম হুসাইন (রা.)-এর মাত্র ৭০ বা ৭২ সদস্য সংবলিত দলের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দণ্ডায়মান হয়। আত্মসমর্পনে আবারও অস্বীকৃতি জানানোর পর, উমাইয়া বাহিনী ইমাম হুসাইন (রা.)-এর ক্ষুদ্র দলকে আক্রমণ করে। ইমাম হুসাইন (রা.) বাহিনীর সকলেই শাহাদত বরণ করেন।
কারবালার আত্মত্যাগের মূল্যায়ন
কলামের এই স্থানে পুনরায় উল্লেখ করছি যে,
ভীষন বড় ও বিস্তৃত একটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে মাত্র তিন-চারটি অনুচ্ছেদে, সারমর্ম করে প্রকাশ করা দুঃসাহসী ও কঠিন কাজ। অতএব আমার ভুলভ্রান্তি মার্জনীয়।অনুরূপভাবে মূল্যায়নও বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করতে পারছি না। কারবালার ময়দানে ইমাম হুসাইন (রা.) এর শাহাদতের ঘটনার মূল্যায়ন করতে গিয়ে ইতিবাচক যেই প্রসঙ্গটি সবার আগে বলতে হবে সেটি হলো, বেদনার পাশাপাশি একটি মহিমান্বিত আঙ্গিক আছে। কারণ, সত্য ও ন্যায়, সাম্য ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য স্বৈরাচারী ইয়াজিদের বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইন (রা.) যেভাবে বীর বিক্রমে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সেই ত্যাগ চিরকাল দেশে দেশে যুগে যুগে এই ধরনের সংকট ও সমস্যা ও উত্তরণের ব্যাপারে অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করবে। কারবালার ময়দানের ঘটনার পরই, ইয়াজিদের ক্ষমতার ভীত নড়ে উঠেছিল। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মুসলিম জাতি পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল। মুসলমানরা আবার ঘুরে দাঁড়ায়। এই ঘটনা মুসলিম জাতিকে তাদের ভেতরের শত্রু কারা সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে সাহায্য করে।
পরবর্তীতেও ইতিহাস স্বাক্ষী, মুসলমানরা যখনই শত্রু আর মিত্র চিনতে ভুল করেছে তখনই তারা বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। কারবালার ঘটনাটির বড় প্রভাব হলো, খেলাফতের পর, গত প্রায় সাড়ে তেরোশো বছরের মুসলিম উম্মাহর ভেতর, দ্বীন ইসলাম রক্ষার যেই চেতনা ও শৌর্য-বীর্য আপন মহিমায় ভাস্বর রয়েছে, তার পেছনে কোরআন ও সুন্নাহর পরে ইসলামের ইতিহাসের যেই ঘটনাগুলো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে সক্রিয় হয়েছে, কারবালার ঘটনা তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য।কারবালার ঘটনায় যুদ্ধ হয়েছিল মুসলমানগণের মধ্যেই। একপক্ষে তথা শক্তিশালী পক্ষে ছিল মুসলমান নামধারী মুনাফেক, স্বার্থপর, ভোগবিলাসী এবং রাজতন্ত্র অনুরাগী মানুষ। কারবালার ঘটনার মাধ্যমে শাসকরা বিজয়ী হয়েছিল, কিন্তু নন্দিত হতে পারেনি। অন্যায় করে বিজয় অর্জন করলেও যে নন্দিত হওয়া যায় না, ধিকৃত হতে হয়, কারবালার ঘটনা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কারবালা সম্বন্ধে অনেক বড় বড় পুস্তক রচিত হয়েছে, ঘটনাভিত্তিক উপন্যাস রচিত হয়েছে এবং কবিতা রচিত হয়েছে। যেই কবিতাটির নাম সবার আগে আমার মনে আসে সেটি হলো বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘মহররম’ কবিতা। পূর্ণ কবিতাটি ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়, রাসুল (সা.) এর পরিবারের প্রতি ভালোবাসা শাণিত করে এবং পাঠককে ঈমানী বলে বলীয়ান করে। এই কলামে স্থান অভাবে, আমি ঐ বিখ্যাত কবিতাটির তিনটি স্থান থেকে মাত্র কয়েকটি লাইন এখানে উদ্বৃত করছি।
মহররম কবিতা থেকে প্রথম উদ্বৃতি
নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া //
আম্মা লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া, //
কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে? //
সে কাঁদনে আসু আনে সিমারের ও ছোরাতে। //
... ... গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা, //
“আম্মা গো পানি দাও ফেটে গেল ছাতি মা!” //
নিয়ে তৃষা সাহারার,দুনিয়ার হাহাকার, //
কারবালা-প্রান্তরে কাঁদে বাছা আহা কার ! //
দুই হাত কাটা তবু শের-নর আব্বাস, //
পানি আনে মুখে, হাঁকে দুশ্ মনও ‘সাব্বাস্’ ! //
দ্রিম্ দ্রিম্ বাজে ঘন দুন্দুভি দামামা, //
হাঁকে বীর “শির দেগা,নেহি দেগা আমামা ! //
মহররম কবিতা থেকে দ্বিতীয় উদ্বৃতি
...‘আস্ মান’ ভ’রে গেল গোধূলিতে দুপুরে, //
লাল নীল খুন ঝরে কুফরের উপরে ! //
বেটাদের লোহু-রাঙা পিরাহান-হাতে,আহ্- //
‘আরশের’ পায়া ধরে,কাঁদে মাতা ফাতেমা, //
“এয়্ খোদা বদ্ লাতে বেটাদের রক্তের //
মার্জ্জনা কর গোনাহ পাপী কম্ বখতের ।” //
কত মোহর্ রম এলো,গেল চ’লে বহু কাল- //
ভুলিনি গো আজো সেই শহীদের লোহু লাল ! //
মহররম কবিতা থেকে তৃতীয় উদ্বৃতি
ফিরে এল আজ সেই মহরম মাহিনা //
ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা। //
উষ্ণীষ কোরআনের হাতে তেগ আরবীর //
দুনিয়াতে নত নয় মুসলিম কারো শীর। //
তবে শোন ঐ শোন বাজে কোথা দামামা //
শমশের হাতে নাও বাধ শিরে আমামা //
বেজেছে নাকাড়া হাঁকে নাকিবের তুর্য //
হুঁশিয়ার ইসলাম ডুবে তব সূর্য ... ...।
ইসলামের যুদ্ধগুলো প্রসঙ্গে রচনা
মহানবী (সা.) এর আমলে, খোলাফায়ে রাশেদার আমলে এবং তৎপরবর্তী চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের ইসলামের রাজনৈতিক ও সামারিক ইতিহাস আজকের প্রজন্মের নিকট প্রায়ই অজানা। ইসলামের ইতিহাস বা ইসলামিক হিস্ট্রি নামক বিষয় যদি কেউ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়েন, তাহলেই মাত্র কিছুটা সংবাদ ঐ ছা্ত্র পাঠ্যপুস্তক থেকে পাবেন। সাধারণ মানুষের নিকট এই বিষয়টি একেবারেই অপরিচিত, অপরিবেশিত। এ কথা খেয়াল রেখে, ২০০৮ সালে তৎকালীন ইসলামিক টিভি (অধুনা বিলুপ্ত) কর্তৃপক্ষ আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, অন্তত সামরিক ইতিহাস যেন টেলিভিশনে তুলে ধরি বাংলা-ভাষী টিভি দর্শকের জন্য। এই পরিপ্রেক্ষিতে, পরপর ১৩ সপ্তাহে, ১৩টি ভিন্ন পর্বে, ইসলামের ১৩টি যুদ্ধের বর্ণনা বাংলাভাষী টেলিভিশন দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করার দুর্লভ সুযোগ আমার হয়েছিল। সময়টা ছিল মার্চ-এপ্রিল ২০০৮। আমি মনে করি এটি মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে একটি বিশেষ দয়া ছিল। কারণ, মহানবী (সা.) এর আমলের যুদ্ধগুলো বর্ণনা করতে গিয়ে, আমাকে সবিশেষভাবে জানতে হয়েছে এবং আমার সেই ক্ষুদ্র অর্জিত জ্ঞান দেশবাসীর সঙ্গে শেয়ার করতে পেরেছি। কয়জনের সৌভাগ্য হয় মহানবী (সা.) এর যুদ্ধের নেতৃত্ব অন্যের সামনে উপস্থাপন করার।
শতভাগ আদবের সঙ্গে, শতভাগ রাসুল-প্রেমের সঙ্গে নাও হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটি সমূহের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী; নিশ্চিতভাবেই মহান আল্লাহতায়ালা ক্ষমা করতে পারেন।
একটি ব্যতিক্রমী বই
টেলিভিশনের সেই ১৩টি মৌখিক উপস্থাপনা, পরবর্তীতে, লিখিতভাবে বইয়ে প্রকাশ করার মতো করে সাজানো হয়েছিল। ঢাকা মহানগরের বিখ্যাত প্রকাশক “অনন্যা” ঐ বইটি প্রকাশ করেছিলেন।
বইটির নাম ‘দি ব্যাটেলস অফ ইসলাম” (বা ইসলামের যুদ্ধগুলো)। সেই বইয়ে ১২তম অধ্যায় হচ্ছে কারবালার ময়দানের যুদ্ধ। আমি বিশদভাবে প্রেক্ষাপটসহ বইটির পরিচয় দিলাম একটি উদ্দেশ্য নিয়ে। উদ্দেশ্য হচ্ছে সম্মানিত পাঠককূল, বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায়, ইসলামের অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস যেন জানতে চেষ্টা করে। যে সকল ছাত্র-ছাত্রী স্কুলের পাঠ্যসূচীতে ইসলামের ইতিহাস পড়েন, বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের স্টাডিজ পড়েন, বা মাদ্রাসায় পড়েন, শুধু তারা জানলে হবে না। ইতিহাসের উত্তরাধিকারী আমরা সবাই। বইটি নিশ্চিতভাবেই বাজারে অনেক জায়গায় পাওয়া যাবে, কিন্তু অবশ্যই অবশই প্রেসক্লাবের নিচে বাতিঘর নামক দোকানে, ঢাকা মহানগরের নাটক সরনিখ্যাত বেইলী রোডে সাগর পাবলিশার্সে অবশ্যই পাবেন।
#
#
বিষয়: বিবিধ
১২৬৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
চমৎকার লিখা
মন্তব্য করতে লগইন করুন