পরিবর্তন নিয়ে চিন্তা * তুরস্ক-মায়ানমার-বিহার*----এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ

লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম ১৮ নভেম্বর, ২০১৫, ১২:৪৯:২৫ দুপুর

গত বুধবার ১১ নভেম্বর ২০১৫, নয়া দিগন্ত পত্রিকায় আমার সাপ্তাহিক কলামটিতে আমি ১৯৭৫ সালের আগস্ট ও নভেম্বরের ঘটনাবলীর বিষয় আলোচনা করেছিলাম। ৪০ বছর আগের আগস্ট বা নভেম্বরের পরিস্থিতির সঙ্গে, বর্তমান ২০১৫ সালের আগস্ট বা নভেম্বরের পরিস্থিতির মিল বা অমিল আলোচনা করেছিলাম। বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে বিদ্যমান অসহনশীলতা, অশালীনতা, অসহিষ্ণুতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বৈরিতার কথার কিঞ্চিত উল্লেখ করেছিলাম। এইরূপ অসহনশীল-অশালীন-অসহিষ্ণু-বৈরি পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কে বা কারা বেশি দায়ী সেটা আলোচনা করিনি। কলামে বলেছিলাম, পরিবর্তন প্রয়োজন। তাই, গত সপ্তাহের কলামের সঙ্গে আজকের কলামটির যোগসূত্র স্থাপনের নিমিত্তে, গত সপ্তাহের কলামের শেষ অনুচ্ছেদটির উপরে যে শিরোনাম ছিল, সেই শিরোনামসহ পরবর্তী অনুচ্ছেদটিতে উদ্বৃত করছি। উদ্বৃতি শুরু।

পরিবর্তন অবশ্যই প্রয়োজন

এইরূপ প্রেক্ষাপটে আমরা কী করতে পারি? গত সপ্তাহের কলামের শিরোনাম ছিল সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। সম্মানিত পাঠক, প্রিয় দেশবাসী, সবাই মিলে চিন্তা করতে হবে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী? আমি একজন রণাঙ্গণের সৈনিক যেমন ছিলাম, অবসর জীবনে কলম সৈনিকও বটে। মাথার চিন্তা, বুকের সাহস, পায়ে হাঁটার শক্তি, সাধারণ মানুষকে বুকে টেনে নেয়ার সহজাত অভ্যাস আমাকে শক্তি যোগাচ্ছে রাজনীতির অঙ্গনে। আমি রাজনৈতিক কর্মী। আমি মনে করি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের কর্মীদেরকেই এ দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের রাজনীতিতে বহু আঙ্গিকে গুণগত পরিবর্তন অতি প্রয়োজনীয়। যদি এই পরিবর্তন আনতে আমরা চেষ্টা না করি, দেশের ক্ষতি হবে অপূরণীয়; রাজনীতি নামক শব্দটির সংজ্ঞা অভিধান বা ডিকশনারীতে নতুন করে লিখতে হবে। পরিবর্তন নিয়ে কিছু কথা আগামী সপ্তাহে ইনশাআল্লাহ। উদ্বৃতি শেষ। সেই কথাই আজকের তথা বুধবার ১৮ নভেম্বর তারিখের কলামে লিখছি, আগামী সপ্তাহের কলামেও ইনশাআল্লাহ লিখবো।

গত এক মাসের তিনটি বড় খবর

গত এক মাসের মধ্যে, বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে কিন্তু মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ তুরস্কে ঘটনা ঘটেছে। গত সাত-আট দিনের মধ্যে, বাংলাদেশের ভৌগলিক নৈকট্যে, আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক অংগনে অন্য দুটো নির্বাচন সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ঘটনা সচেতন বাংলাদেশিগণের মনে দাগ কেটেছে। একটি ঘটনা হলো, বাংলাদেশের পূর্বে বা দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত মিয়ানমার নামক দেশে পার্লামেন্ট নির্বাচন ও তার ফলাফল। দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো, বাংলাদেশের প্রতিবেশি বিশাল রাষ্ট্র ভারতের অন্যতম প্রদেশ বা রাজ্য বিহারে অনুষ্ঠিত রাজ্য-পার্লামেন্ট বা বিধান সভা নির্বাচন ও তার ফলাফল। নিচের অনুচ্ছেদগুলোতে প্রথমে তুরস্কের কথা বলবো, তারপর মায়ানমারের কথা বলবো এবং সর্বশেষে বিহারের কথা বলবো।

তুরস্ক এবং এরদোগান

গত তিন-চার সপ্তাহ আগে, তুরষ্কে বড় রাজনৈতিক-খবর সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট এর নাম এরদোগান। তার পার্টির নাম একে পার্টি (সংক্ষেপে একেপি)। তার এই দলটি প্রায় এক দশক ধরে ক্ষমতায় আছেন। ক্ষমতায় আসার আগে আরও এক দশক ধরে, তুরস্কের প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সাংবাধিক ও কৌশলগত যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ক্রমান্বয়ে জনগণের আস্থা পেতে পেতে, একেপি তুরস্কের রাজধানী আংকারায় ক্ষমতায় বসে। যথেষ্ঠ মেজরিটি ছিল। তুরস্কের সংবিধান মোতাবেক, তুরস্কের সামরিক বাহিনীই ছিল সংবিধানের রক্ষক। কোন রাজনৈতিক কর্মটি সাংবিধানেকভাবে বৈধ অথবা অবৈধ এই মর্মে চূড়ান্ত রায় প্রদানের ক্ষমতা ছিল তুরস্কের সামরিক বাহিনীর হাতে। েএরকম আরও কিছু স্পর্শকাতর বৈশিষ্ট্য ছিল ঐ সংবিধান। ঐ সবিধান রাচনা করেছিল সামরিক বাহিনীর আশীর্বাদপ্রাপ্ত পার্লামেন্ট। ঐ পার্লামেন্টের অধিকাংশ সদস্য ছিলেন কামাল আতাতুর্কপন্থী, সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী। কামাল আতাকুর্কের রাজনৈতিক দশনের সারমর্ম এখানে উল্লেখ করছি না। আট-দশ বছর আগে, সুসংহতভাবে ক্ষমতায় বসার পর এরদোগানের একেপি, তুরস্কের সংবিধানকে সংশোধন করে। এরদোগান ধীরে ধীরে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে, কখনও ক্যারোট (গাজর বা মুলা) ঝুলিয়ে কখনও স্টিক (লাঠি বা দণ্ড) দেখিয়ে, এরদোগান তুরস্কের সামরিক বাহিনীর উচ্চ পদস্থ নেতৃত্বকে বশীভূত করেন (বাংলায় দুষ্টামি করে বলা যায়, সাইজ করে ফেলেন)। এখনকার নভেম্বর মাস থেকে মাস ছয়েক-সাতেক আগে, তুরস্কে পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়েছিল। ঐ নির্বাচনের ফলাফলে একেপি একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পায়নি। অতএব, একেপি অন্যান্য কয়েকটি ছোট দলের সঙ্গে সমঝোতা করে সরকার গঠন করতে চেয়েছিল; কিন্তু ছোট দলগুলো রাজি হয়নি। তখন এরদোগান জুয়া খেলার মতো একটা চান্স নিলেন। সংবিধানে দেওয়া বিধান মোতাবেকই, তিনি পুনরায় পার্লামেন্ট নির্বাচন ঘোষণা করলেন। দেশবাসীকে বললেন, হয় যথেষ্ট ভোট দিয়ে আমাকে শক্তিশালী করুন অথবা আমাকে ভোট না দিয়ে, ছোট দলগুলোকে বিক্ষিপ্তভাবে ভোট দিয়ে, কাউকেই যথেষ্ট ক্ষমতা না দিয়ে, দেশে নৈরাজ্য বেছে নিন। এই আহ্বানের পর, নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়ে, তুরস্কের জনগণ নৈরাজ্যের বদলে, এরদোগানকে বেছে নেয়। এরদোগান তিন-চতুর্থাংশ মেজরিটি না পেলেও, ছয় মাস আগের ফলাফলের তুলনায় যথেষ্ট শক্তিশালী ও সন্তোষজনক মেজরিটি পেয়েছে। তুরস্কের নেতা এরদোগানের কৌশল থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাগণের জন্য নিশ্চয় কোনো বার্তা আছে। তুরস্কের ভোটার তথা জনগণের মেধা ও ইচ্ছা শক্তির থেকে, বাংলাদেশের জনগণের মেধা ও ইচ্ছাশক্তির জন্যও নিশ্চয় কোনো বার্তা আছে। এখন আমি মায়ানমারের কথা বলবো।

মায়ানমার এবং সুচি

বর্তমানের মায়ানমার, অর্থাৎ অতীতের বার্মা, বৃটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমান পাকিস্তান-ভারত ও বাংলাদেশকে যদি আমরা উপমহাদেশ বলি, তার পাশেই ছিল তৎকালীন বার্মা। সেই বার্মার রাজধানী ছিল রেঙ্গুন। বার্মা প্রসঙ্গে বলতে গেলে অবশ্যই বলতে হবে যে, বাংলাদেশের সবচেয়ে দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত কক্সাবাজার জেলার পরেই, বার্মার প্রদেশ যার নাম রাখাইন প্রদেশ, শুরু হয়। রাখাইন প্রদেশের পূর্বেকার নাম: আরাকান, যেখানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন নামক নৃগোষ্ঠীর প্রাধান্য। কিন্তু ঐ আরাকান বা রাখাইন প্রদেশেই রোহিঙ্গা নামক আরও একটি নৃগোষ্ঠী আছে যারা দেখতে-শুনতে কক্সবাজার বা বৃহত্তর চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের মতো; ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান। বার্মায় প্রায় অর্ধ শতাধিক বিভিন্ন প্রকারের নৃগোষ্ঠী আছে, তাদেরই মধ্যে ১৮/২০টি নৃগোষ্ঠী, গত বিশ-তিরিশ বছরে বিভিন্ন মেয়াদে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ পরিচালনা করেছে। এইসব কারণ এবং আরও অন্যান্য কারণে, বার্মায় ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পরে এতগুলো দশকেও, কোনো দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্র স্থায়িত্ব পায়নি। বার্মার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে সুখকর কোনো সময় নয়। কেন নয়, সেটা জানতে চেয়েছিলাম। প্রতিবেশি বার্মার সঙ্গে আমাদের বাংলাদেশের বাণিজ্য কেন কম, সেটাও জানতে চেয়েছিলাম। ২০০২-০৩ সালের কথা। আমার মনের মধ্যে রেঙ্গুন-ঢাকার বা রেঙ্গুন-চট্টগ্রামের সম্পর্ক উন্নয়নের একটা আবেগ স্বাভাবিকভাবেই কাজ করছিল। অতএব আমি আমার নিজের উদ্যোগে, নিজের খরচে, কোনো সময় একা, কোনো সময় একাধিক সঙ্গীসহ, বার্মা বেড়াতে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশ ও বার্মার মধ্যে বন্ধুত্ব বৃদ্ধির জন্য নাগরিক উদ্যোগ। মোট ৪ বার রেঙ্গুন সফর করেছিলাম ২০০২-০৩ সালে। তখনকার আমলে চাকরিরত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এডুকেশন কোর-এর সদস্য চট্টগ্রামের সন্তান, আমার সাবেক সংগ্রামী বুদ্ধিদীপ্ত সহকর্মী মেজর এমদাদুল ইসলাম আমাকে দারুন সহযোগিতা করেছিলেন। এমদাদ তখন বার্মায় সরকারিভাবে নিযুক্ত ছিলেন। ২০০৩ সালে ঢাকায় একটি সংগঠন সৃষ্টি করেছিলাম যার নাম ছিল বাংলাদেশ মায়ানমার ফ্রেন্ডশীপ সোসাইটি। বছর দু’য়েক এই সংগঠনটি কাজ করতে পেরেছিল। পরবর্তীতে বিবিধ গঠনমূলক খরচ মিটানোর জন্য তহবিল না থাকায়, সংগঠনটি স্তিমিত হয়ে পড়ে। মায়ানমারে বহু বছর, বিভিন্ন মেয়াদে বলতে গেলে প্রায় ৫৪ বছর, বিভিন্ন নিয়মে ও কৌশলে, সামরিক বাহিনী শাসন ক্ষমতা নিজেদের আয়ত্বে রেখেছিল। প্রায় ২৬ বছর আগে একবার পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়েছিল। জনগণের বিখ্যত নেতা অং সাং সূচী-র দল জিতেছিল। কিন্তু তখনকার আমলের সামরিক বাহিনীর ক্ষমতালিপ্সু নেতৃবৃন্দ, নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে দেয়, সূচিকে বন্দী করে এবং রাজনীতি কুক্ষীগত করে। ক্রমান্বয়ে সামরিক বাহিনী নিজেদের বুদ্ধি খরচ করে, নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আজ থেকে এক দশক আগে সামরিক বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় এমনভাবে সংবিধান রচনা করা হয়েছিল যে, যে কোনো নিয়মেই হোক, সামিরক বাহিনীর সহযোগিতা ব্যতিত কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হবে না। নভেম্বর ২০১৫ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য, জনগণের বিখ্যাত নেতা অং সাং সূচি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। জনগণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অনেকের মনে গভীর আশংকা ছিল যে, সামরিক বাহিনী নির্বাচনকে কলুষিত করবে এবং ফলাফলকে কুক্ষিগত করবে। এই আশংকা মনে থাকতে থাকেতেই, সুচি নির্বাচনে যান। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অং সাং সূচির দল অনেক বড় ব্যবধানে জয়ী হয়েছে। শেষ মূল্যায়নে বলতে হবে, সূচির ধৈর্য্যর জয় হয়েছে, সূচির বিনয়ের জয় হয়েছে, সূচির দলের সাংগঠনিক আনুগত্যের জয় হয়েছে। আজকের মায়ানমারের মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিল; তাদের জন্য পরিবর্তনের দরজা উন্মুক্ত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে সময় লগবে। পরিবর্তনের জন্য সকল মহলের মধ্যে সমঝোতা লাগবে; ন্যূনতম ঐক্যমত লাগবে। গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে সুচি পথরেখা চিহ্নিত করেছেন। তিনি সমঝোতার ডাক দিয়েছেন। সামরিক বাহিনী ও তাদের আশীর্বাদপ্রাপ্ত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল সমঝোতার ডাকে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। প্রায় এরকমই একটি ঘটনা ঘটেছিল আনুমানিক ২৫ বা ২৭ বছর আগে; দক্ষিণ আফ্রিকায়। প্রায় তিন দশক জেলখানায় থাকার পর, মুক্ত হওয়ার পর প্রথম নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিজয় লাভ করার পরও, কৃষ্ণাঙ্গদের নেতা নেলসন মেন্ডেলা, শত বছরের অত্যাচারী শাসক শ্বেতাঙ্গ গোষ্ঠীর প্রতি সমঝোতার আহ্বান রেখেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার কথা এখন আর বলছি না, মায়ানমার প্রসঙ্গে সীমিত থাকি। আমাদের বাংলাদেশের জনগণের জন্য বা আমাদের দেশের রাজনীতিবিদগণের জন্য এখানে নিশ্চয় কোনো বার্তা আছে। এরপর বলবো বিহারের কথা।

বিহার এবং লালু-নিতিশ

বাংলাদেশের মানুষের কাছে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার নাম অতি পরিচিত। আজকে যেটাকে আমরা ভারতের বিহার প্রদেশ বলছি, এবং যেটিকে আমরা ভারতের উড়িষ্যা প্রদেশ বলছি, এগুলোসহ বাংলা বিহার উড়িষ্যা ছিল নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার নবাবী বা রাজত্ব। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয় ঘটে। এর আগে কোনো সময় দিল্লীর মোঘল সম্রাটদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে, কোনো সময় ঢিলা নিয়ন্ত্রণে, কোনো সময় নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা শাসিত হয়েছিল। আমি কথাগুলো উল্লেখ করছি এইজন্য যে, আমাদের বাংলাদেশের আবেগ অনুভূতি শ্বাস-প্রশ্বাস ইত্যাদির সঙ্গে, বিহার নামটি বা বিহারী শব্দটি, মিশ্রিত। সেই বিহার রাজ্যটি ভারতের অনুন্নত রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। অনুন্নত থাকার জন্য, অন্যতম কারণ হচ্ছে বিহারের রাজনৈতিক নেতৃত্বের চারিত্রিক দুর্বলতা, নেতৃত্বের সক্ষমতার অভাব, বিভাজিত সমাজ ব্যবস্থা, বিভাজিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং রাজনীতি ও দুর্নীতির মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব। বিহারে গত মাস দেড় মাস যাবত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ফলাফল ঘোষিত হয়েছে গত সপ্তাহে। বিজেপি হেরে গিয়েছে। বিজেপি হেরে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণ আছে। অন্যতম কারণ, বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দলগুলোর মনের মধ্যে উপলব্ধি। বিহারের অন্যতম একজন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রাসাদ যাদবের দল, আরেকজন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী নিতিশ কুমারের দল এবং সর্বভারতীয় কংগ্রেস দলের বিহার অংশ, নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলে। লালু প্রসাদ যাদব ব্যক্তিগতভাবে, আইন মোতাবেক, নির্বাচনের অযোগ্য। নিতিশ কুমার একজন সুনামধারী সফল মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। কংগ্রেস চাচ্ছে নিজে ক্ষমতায় না থাকলেও, বিজেপি যেন আসতে না পারে। ১৮ মাস আগে বিজেপি নেতা অমিত শাহ এবং নরেন্দ্র মোদি যেই রাজনৈতিক কৌশল ও কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে দিল্লীতে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন, সেটা চাঞ্চল্যকর ছিল। সেই দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি একইসাথে এবার বিহারেও দীর্ঘদিন বা দীর্ঘ সময় নির্বাচনী প্রচারণায় যুক্ত ছিলেন। কিন্তু বিজেপি হেরে গিয়েছে। বিজেপির অভ্যন্তরে অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা যারা একটু কোনঠাসা অবস্থায় ছিলেন, তারা বিদ্রোহী মনোভাব প্রকাশ করতে শুরু করেছেন; তাঁদের মতে, মোদী ও অমিত শাহ জুটি জ্যেষ্ঠ নেতাদেরকে মাইনাস করে যেই দলীয় রাজনীতি করছেন সেটা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। বছর খানেক আগে, ভারতের কেন্দ্রীয় রাজধানী দিল্লী মহানগরীতে বা দিল্লী উপ-প্রদেশে বিধানসভা বা স্টেইট এসেম্বলী নির্বাচনে, বিজেপি মারাত্মকভাবে হেরে গিয়েছিল, নতুন রাজনৈতিক দল আমজনতা পার্টির নিকট। এবার বিজেপি বিহারে হারলো। বিজেপি কেন হারলো, সে বিষয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। তার থেকে বেশি প্রয়োজন, বিজেপির প্রতিপক্ষ কী নিয়মে কী কৌশলে জিতলো সেটা আবিষ্কার করা। ছোট্ট একটা কথা বলি। মোদী এবং অমিত শাহ, উন্নয়নের কথা বলেছেন, লালু-নিতিশ ও কংগ্রেস-এর নেতৃবৃন্দ সম্বন্ধে বা তাদের নীতিমালা সম্বন্ধে অশালীন সমালোচনা করেছেন। অপরপক্ষে, লালু নিতিশ প্রচারণা করেছে যে, বিহারের উন্নয়ন বাইরের লোক দিয়ে হবে না, বাইরেরে থিউরি দিয়ে হবে না। তাদের ছন্দময় শ্লোগান ছিল “বিহারী পছন্দ, বাহারী নেহি”—অর্থাৎ বাইরের লোক বিহার নিয়ন্ত্রণ করবে না; বিহারীরাই বিহার নিয়ন্ত্রণ করবে। মনে রাখতে হবে, লালুর দল এবং নিতিশের দল উভয়টির শিকড় ও ডালাপালা, সর্বভারতীয় নয় বরং বিহারেই ছড়ানো ছিটানো ও গভীরে যাওয়া। এই অনুচ্ছেদের সারমর্ম গবেষণা করলে, বাংলাদেশের রাজনীতি সচেতন মানুষের জন্য কোনো না কোনো বার্তা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

বাংলাদেশের সংকট

বাংলাদেশে সাংবিধানিক সংকট বিরাজ করছে বলে আমি মনে করি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন, আইনগতভাবে বৈধ সাংবিধানিকভাবে প্রয়োজনীয়—এটা সত্য। কিন্তু এই নির্বাচন, ক্ষমতাসীনদেরকে নৈতিক শক্তি দেয়নি। বাংলাদেশের সংবিধান ও নির্বাচনী পদ্ধতিতে দুর্বলতা আছে। বর্তমান পার্লামেন্টে ১৫৩ বা ১৫৪ জন সদস্য আছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। আমাদের সংবিধান এবং নির্বাচনী পদ্ধতি এমনই যে, যদি ৩০০ জনের মধ্যে ৩০০ জনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হয়, তাহলে কিছুই করার থাকবে না। অতএব সংবিধানের এই সকল বক্তব্য, জনস্বার্থেই সংশোধনযোগ্য। গত দুই বা সোয়া দুই বছর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন সহিংসতা দেখেছে। এই সহিংসতা সর্বঅবস্থায় পরিত্যয্য। সাম্প্রতিক দুই-তিন মাস ভিন্ন প্রকারের সহিংসতা দেখছে; এটাও প্রতিরোধযোগ্য ও পরিত্যয্য। ক্ষমতাসীনগণ কর্তৃক সাংবিধানিক দুষ্টু কৌশল, সহিংসতা দিয়ে মোকাবিলা করার কোনো বৈধতা নেই। পৃথিবীর বুকে বাংলাদের উজ্জ্বল ভাবমূর্তিকে সমুন্নত রাখার জন্য আরেকটি সুষ্ঠু পার্লামেন্ট নির্বাচন প্রয়োজন। ঐ পার্লামেন্টে যারা নির্বাচিত হবেন তাদের মধ্যেও কিছু গুণগত বৈশিষ্ট্য প্রয়োজন।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে

১৯৭২ সাল থেকে শুরু করে, ধীরে ধীরে, একটু একটু করে, রাজনীতি দুষিত হয়েছে, কলুষিত হয়েছে এবং দুর্নীতিগ্রস্থ হয়েছে। হেন শাসন আমল নেই যেটাকে দুর্নীতিমুক্ত বলা যায়। বাড়তে বাড়তে, ক্রমান্বয়ে এটা এখন বটবৃক্ষ হয়েছে। বাংলাদেশের অন্যতম বিখ্যাত তথা জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এর তিনটি তারিখের তিনটি শিরোনাম আমি এখানে উল্লেখ করছি। (১) ৩১ আগস্ট ২০১৫-তে প্রকাশিত, “টাকা মারো পালিয়ে যাও” (২) ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫-তে প্রকাশিত, “যা পারো কামাই করো” (৩) ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫-তে প্রকাশিত, “তদবির করো টাকা বানাও”। এই সীমিত শব্দের শিরোনামগুলোকে বিশ্লেষণ করলে বা মূল্যায়ন করলে, এই মুহূর্তের বাংলাদেশ বা বর্তমান সরকারের অধীন বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনের বৈশিষ্ট্য পাঠকের সামনে পরিষ্কার হবে। রাজনীতিকে ব্যবসা মনে করে, অর্থনৈতিকভাবে লাভ-লোকসানের কর্মকাণ্ডে পরিণত করা হয়েছে। রাজনীতি নামক বিষয়টিকে, রাজনীতি নামক কর্মযজ্ঞকে তরুণ সমাজের নিকট, সৎ ব্যক্তিদের নিকট, মেধাবী ব্যক্তিদের নিকট অপাংক্তেয় করা হয়েছে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য আগামী নির্বাচনেই পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ মেধাবী সাহসী সৎ ব্যক্তিদেরকে রাজনীতিতে আকর্ষণ করে, পার্লামেন্ট নির্বাচনে যাওয়ার জন্য প্রেরণা দেয়া যেতে পারে। যদি আগামী নির্বাচনে, বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে, তাহলে নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সবাই এবং পৃথিবীর সবাই বলবে যে, এটা একটি সর্বদলীয় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছিল। বিশ্ব আমাদেরকে বাহবা দেবে। কিন্তু নির্বাচনের মাধ্যমে যদি দেশপ্রেমিক গঠনমূলক চিন্তার মানুষ পার্লামেন্টে না আসে তাহলে বাংলাদেশের ভাগ্য পরিবর্তনে সুযোগ আসবে না। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সামনে কয়েকটি মারাত্মক সমস্যা আছে। উদাহরণস্বরূপ মাত্র কয়েকটা উল্লেখ করছি। সামাজিক অঙ্গনে মাদক সমস্যা, ব্যবসার অঙ্গনে ভেজাল (ফরমালিন) সমস্যা, শিক্ষার অঙ্গনে নকল ও সার্টিফিকেট বাণিজ্য সমস্যা, রাজনীতির অঙ্গনে শক্তি প্রদর্শনের সমস্যা। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে ও রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে কেন্দ্রীকরণ (ইংরেজি পরিভাষায় সেন্ট্রালাইজেশন) সমস্যা। জাতি গঠনের আঙ্গিকেও একাধিক সমস্যা আছে। যেই সমস্যাটি জাতীয় রাজনৈতিক-সামাজিক-ব্যবসায়িক-পারিবারিক সকল অঙ্গনে বিস্তৃত সেই সমস্যাটি হলো দুর্নীতি। বাংলাদেশে বর্তমানে, বিস্তৃতভাবেই, চিন্তা দুর্নীতিগ্রস্থ, চিন্তার প্রকাশ দুর্নীতিগ্রস্থ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ দুর্নীতিগ্রস্থ, লেনদেন ‍দুর্নীতিগ্রস্থ, ব্যবসা-বাণিজ্য দুর্নীতিগ্রস্থ, ভোট চাওয়া ভোট পাওয়া দুর্নীতিগ্রস্থ অর্থাৎ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন মানুষের সঙ্গে যা কিছু সম্পর্কিত ও সম্পৃক্ত তার সবকিছুই দুর্নীতিগ্রস্থ। এই মারাত্মক দুর্নীতির অঙ্গন থেকে এই দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে হবেই হবে। কিন্তু এটা সময়ের ব্যাপার। প্রক্রিয়া শুরু করতেই হবে।

পরিবর্তনের কথা বলাটাও বিপদসংকুল

বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেই পরিবর্তনের কথা আমি বা আমরা বলে আসছি, সেটা হলো রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন। সেই গুণগত পরিবর্তন আনতে হলে, বিদ্যমান পদ্ধতির মধ্য দিয়েই, প্রথমে এই পদ্ধতির ভেতরে ঢুকতে হবে অতঃপর এই পদ্ধতিতে সংশোধন করতে হবে। কথাটা এরকম বলা যায় যে, পুকুরের পানি দুষিত। ঐ পানিতে প্রথমে নামতে হবে। শরীরে এমন একটা ওয়টার প্রুফ কাপড় বা পলিথিন পরতে হবে যেন ঐ দুষিত পানি চামড়ায় না লাগে; কারণ চামড়ায় লাগলে, খস-পাচড়া বা ঘা হবে। অতঃপর এক বাল্টি এক বাল্টি করে পুকুরের পানি সিঞ্চন করে বাইরে ফেলতে হবে। এক বালটি পানি বাইরে যাবে, আরেক বালটি ভালো পানি পুকুরে ঢোকানো হবে। ক্রমান্বয়ে, ভালো পানির পরিমাণ যখন বেশি হবে, তখন পুকুরটিকে আর কেউ দুষিত বলবে না। এইরূপ একটি উদ্যোগ গ্রহণ, খুব রিস্কি বা বিপদসংকুল। সেই রিস্ক বা বিপদ নিয়ে আগামী সপ্তাহে ইনশাআল্লাহ আলাপ করবো।

শোক প্রকাশ

ইতোমধ্যে ১৪ নভেম্বর তারিখে প্যারিসে নিহতদের জন্য শোক প্রকাশ করছি। প্যারিসের আগে প্যালেস্টাইনে ও জেরুজালেমে নিহতদের জন্যও শোক প্রকাশ করছি

( ১৮-১১-২০১৫ বুধবার নয়াদিগন্ত-এ প্রকাশিত কলাম)

বিষয়: বিবিধ

১৫০৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File