মহররমের তাগাদা : পড়ুন, জ্ঞান অর্জন করুন
লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম ২৯ অক্টোবর, ২০১৫, ১১:৩৮:৫৬ সকাল
পত্রিকার কলামগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাম্প্রতিক বা সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে হয়। উদাহরণ দিই। খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারের ২৪ অক্টোবর শুরু হওয়ার পর মধ্যরাত রাত ১টার দিকে ঢাকা মহানগরের হোসেনি দালান এলাকায় বোমা হামলায় একজন নিহত হন এবং ২০-৩০ জন বা আরো বেশি আহত হন। তা হলে আজকে এই কলামটি এই বিষয়টি নিয়ে যদি লিখি, তাহলে সেটা হবে সমসাময়িক প্রসঙ্গ। অথবা গত শুক্রবার ২৩ অক্টোবর ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বড় উৎসব দুর্গাপূজার শেষ দিন। এই দিন বিজয়া দশমী হিসেবে পরিচিত; এই দিন প্রতীমা বিসর্জন দিবস হিসেবেও পরিচিত; এই দিন আনন্দ ও বেদনা উভয়-মিশ্রিত অনুভূতির দিন। এই বিজয়া দশমী নিয়ে বা দুর্গাপূজা নিয়ে যদি লিখি তাহলে সেটাও সমসাময়িক বিষয় বলে বিবেচিত হবে। সাম্প্রতিক বা সমসাময়িক বলতে কত দিনের ঘটনা বোঝায় সেটা কোথাও নির্দিষ্ট করে দেয়া নেই, অর্থাৎ সাত দিন না ১৫ দিন না ২১ দিন- এইরূপ ব্যাপ্তি নির্ভর করে ঘটনার গভীরতা, ঘটনার উত্তাপ, ঘটনা সম্বন্ধে মানুষের আগ্রহ ইত্যাদির ওপর। যেহেতু পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এলাকায় আশুরার রাতেই বোমা হামলার ঘটনাটি ঘটেছে এবং এরূপ ঘটনা প্রথমবার ঘটেছে, সেহেতু বিষয়টি নিয়ে মানুষের আগ্রহ অব্যাহত থাকবে। অর্থাৎ তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি সমাবেশে হামলার বিষয়টি আগামী দুই-চার মাস সাম্প্রতিক বা সমসাময়িক হিসেবে বিবেচিত হতেই থাকবে। এ প্রসঙ্গে ভিন্ন প্রকৃতির আরো উদাহরণ নিচের অনুচ্ছেদে দিই।
দু’টি আন্তর্জাতিক উদাহরণ
মাত্র পাঁচ-সাত দিন আগে একটি ইন্টারভিউতে টনি ব্লেয়ার বলেছেন, ইরাক যুদ্ধ প্রসঙ্গে তিনি দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। অর্থাৎ এখন থেকে ১২-১৩ বছর আগে, যখন জর্জ বুশ ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এবং টনি ব্লেয়ার ছিলেন যুক্তরাজ্য বা বিলাতের প্রধানমন্ত্রী, তখন তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ইরাক আক্রমণ করার, ইরাকে যুদ্ধ পরিচালনা করার এবং ইরাককে ধ্বংস করার। আজ ১২-১৩ বছর পর এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সাবেক হয়ে যাওয়ার ছয়-সাত বছর পর টনি ব্লেয়ার বলছেন, ইরাক যুদ্ধটি ভুল যুদ্ধ ছিল। টনি ব্লেয়ারের বক্তব্যের সূত্র ধরে ইরাক যুদ্ধের আলোচনাটিও সাম্প্রতিকতার বা সমসাময়িকতার রূপ ধারণ করে; যদিও যুদ্ধটি ১২-১৩ বছর আগের। পৃথিবীতে ইংরেজি ভাষায় যেক’টি বিখ্যাত সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন আছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘টাইম’। আমরা সবাই কথা বলতে গেলে বা গল্প করতে গেলে এটাকে বলি টাইম ম্যাগাজিন। মূলত এটি আমেরিকানদের উদ্যোগের ম্যাগাজিন এবং বয়সের হিসাবে অনেক পুরনো। তবে এর বিভিন্ন সংস্করণ আছে। আমরা যেই মুদ্রিত সংস্করণটি হাতে পাই সেটি হলো মূলত দক্ষিণ-এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দূরপ্রাচ্যের জন্য প্রস্তুত করা সংস্করণ। ২৬ অক্টোবর ২০১৫ যে সংখ্যা, তার ৩২ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে তিন পৃষ্ঠা দীর্ঘ একটি প্রতিবেদন আছে বাংলাদেশ নিয়ে। ওই প্রতিবেদনের মূল প্রতিপাদ্য বাংলাদেশে বর্তমানকালের ব্লগার বা নাস্তিকদের ওপর পরিচালিত খুন-খারাবি। প্রতিবেদক নিখিল কুমার, বিস্তারিতভাবে অনেক কিছুই লিখেছেন। লিখতে গিয়ে গত দুই মাস আগের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তিনি লেখা সীমিত রাখেননি। লেখায় তিনি প্রায় দুই-আড়াই দশক আগের তসলিমা নাসরিনের ঘটনাসহ অন্যান্য প্রেক্ষাপটকে ২০১৫ সালের আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন। যারাই টাইম ম্যাগাজিনের এই প্রতিবেদনটি পড়েছেন, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে, সবাই মনে করবেন বাংলাদেশে প্রচুর খুন-খারাবি হচ্ছে। লেখার স্টাইলটি এমন যে, প্রতিবেদনটির বিষয়বস্তু সাম্প্রতিক বা সমসাময়িক হিসেবেই উপস্থাপিত। লেখাটিতে নব্বই ভাগ অংশেই ব্লগার ও নাস্তিকদের ওপর আক্রমণের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে। উদারপন্থী সুফিবাদী আলেম-ওলামা ও বুজুর্গ ব্যক্তিদের ওপর আক্রমণের কোনো উল্লেখ বিন্দুমাত্র নেই। অর্থাৎ আলোচক সাম্প্রতিক আলোচনাকেও একপক্ষীয় বা একপেশে করতে পারেন।
ইসলামের যুদ্ধগুলো
গত ২১ অক্টোবর নয়া দিগন্ত পত্রিকায় আমার সাপ্তাহিক কলামে আমি কারবালা যুদ্ধের প্রসঙ্গে লিখেছি। কারবালা যুদ্ধ হয়েছিল মহররম মাসের প্রথম অংশে। কারবালা যুদ্ধের শেষ দিন, চূড়ান্ত বিয়োগান্ত, চূড়ান্ত শোকাবহ দিন ছিল ১০ মহররম তারিখ। বছরটি ছিল ৬১ হিজরি; বর্তমানে চলছে ১৪৩৭ হিজরির প্রথম মাস। বাংলাদেশে এবারের ১০ মহররম ছিল শনিবার ২৪ অক্টোবর। অতএব ২৪ অক্টোবরের আগে নিকটতম বুধবারে আমি মহররম সম্বন্ধে লিখেছি। আমার লেখার বিষয় ছিল পৌনে চৌদ্দশত বছর আগের সংঘটিত ঘটনা। কিন্তু যেহেতু ঘটনাটি আর রিপিট বা পুনরায় হয়নি এবং প্রতি বছর এই ঘটনার স্মৃতি আমাদের সামনে ঘুরে ঘুরে আসে, তাই এই আলোচনাটি সর্বদাই সাম্প্রতিক বা সমসাময়িক। ২১ অক্টোবরের পত্রিকার কলামে আমি আমার লেখা বই ‘ব্যাটলস অব ইসলাম’-এর কথা উল্লেখ করেছি। বাংলায় নামকরণ করলে এটি হবে ‘ইসলামের যুদ্ধগুলো’। উদ্দেশ্য, বইয়ে আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যেন পাঠকের দরজায় পৌঁছতে পারে। প্রকাশক ওই পুস্তকটির সরবরাহ নিশ্চিত করেছেন বলে শুনেছি। তার পরও পুনরায় বলে রাখি, চট্টগ্রাম মহানগরের প্রেস ক্লাবের নিচতলায় বাতিঘর নামে দোকানে, ঢাকা মহানগরের নাটক সরণি খ্যাত বেইলি রোডে সাগর পাবলিশার্সে এবং ঢাকা মহানগরের পুরাতন বিমানবন্দরের কাছে বুক ওয়ার্মে এটি অবশ্যই পাবেন।
মহানবী সা: এবং যুদ্ধ
আমি ব্যাটেলস অব ইসলাম নামের বইয়ের কথাটি আবারো তুললাম এই কারণে যে, বইটির বিষয়বস্তু আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আলোচ্য পুস্তকে আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনকালের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ আলোচনা করতে। ২০০৮ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে ইসলামিক টিভি যেমন চেয়েছিল তাদের দর্শক-শ্রোতার কাছে বিষয়টি উপস্থাপিত হোক; তেমনি আমিও মনে করেছিলাম বা এখনো মনে করি যে, এই আমলে তথা সমসাময়িক কালে, যেসব মানুষ ইংরেজি ভাষার তুলনায়, বাংলায় কথা বলা ও বাংলায় বই পড়ায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, এমন পাঠকের কাছে বিষয়টি উপস্থাপিত হোক। আমরা একই সাথে একটি জিজ্ঞাসা উপস্থাপন করি। যে মুসলমান মহানবী সা:-কে ভালোবাসেন, তিনি কি একবারও জানতে চাইবেন না, কেন তিনি মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য কল্যাণ ও শান্তির দূত, ধারক, বাহক, প্রতিভূ হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধে গেলেন? কী পরিস্থিতি বা কী পরিবেশ তাঁকে যুদ্ধে যেতে বাধ্য করেছিল? সাধারণভাবে মানুষ মনে করে যুদ্ধ মানে অকল্যাণ, যুদ্ধ মানে অশান্তি, যুদ্ধ মানে ধ্বংস, যুদ্ধ মানে রক্ত। তাহলে এরূপ প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে, প্রিয় বিশ্বনবী সা: কেন যুদ্ধে গিয়েছিলেন সেটা জানা খুবই প্রয়োজন। মুসলমানদের মধ্যে বা পাঠকদের মধ্যে যারা অধিকতর সচেতন, তারা জানতে চাইতেও পারেন, মহানবী সা: যুদ্ধের নেতৃত্ব কিভাবে দিতেন? অথবা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার সময় তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো কী ছিল? এই অনুচ্ছেদে যেই প্রশ্নটির অবতারণা করলাম, সেই প্রশ্নটিকে আরেকটু বিস্তৃত করছি পরের অনুচ্ছেদে।
মহানবী সা:-এর জীবনী ও কুরআন
যে মুসলমান মহানবী সা:-কে ভালোবাসেন, তিনি কি একবারও চাইবেন না তাঁর জীবনী পড়তে? তিনি কি একবারও জানতে চাইবেন না কেন তিনি একাধিকবার শত্রুর আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছিলেন? কেন তিনি মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় গিয়েছিলেন? কেন তিনি মদিনায় ইহুদিদের সাথে সমঝোতামূলক বা সমন্বয়মূলক চুক্তি করেছিলেন? কেন নামাজের মধ্যে আমরা আত্তাহিয়াতু এবং দরুদ শরিফ পাঠ করি? পাঠকদের মধ্যে অনেকেই একটি প্রসিদ্ধ হাদিস সম্বন্ধে জানেন। সাদামাটা ভাষায় হাদিসটি এরূপ। একবার সাহাবিরা রাসূলুল্লাহ সা:-এর অন্যতম সম্মানিতা স্ত্রী বিবি আয়েশা রা:কে জিজ্ঞাসা করলেন এইরকম- ‘আপনি রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনপদ্ধতি সম্বন্ধে আমাদের কিছু বলুন।’ বিবি আয়েশা রা: অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন। উত্তরটি ছিল- ‘আপনারা কি কুরআন পড়েন না; আপনারা কি কুরআনের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে অবহিত নন? তাঁর জীবনপদ্ধতি কুরআনেরই ছবি।’ আমার দৃঢ়বিশ্বাসসচেতন মুসলমানেরা মহানবী সা:-এর জীবনের খুঁটিনাটি জানতে চাইবেন। জানতে চাইলে, তার মনের খোরাক মিটানোর জন্য উপযুক্ত বই খুঁজবেন। আমার নিজের লেখা ব্যাটেলস অব ইসলাম নামক বইটি থেকেও সহস্রগুণ বেশি মূল্যবান আরো দু’টি বইয়ের কথা আমি বলব। সহস্রগুণ কথাটি বলেছি রূপক অর্থে, প্রতীকী অর্থে। কারণ, বিষয়বস্তুর তুলনায়, এরূপ সহস্র গুণ বা লাখো গুণ মাপার ক্ষমতা আমার নেই এবং মাপাটাও আমার পক্ষ থেকে অশোভন বলে আমি মনে করি। যে দু’টি নতুন বইয়ের নাম নিচ্ছি, সেখানে একটি বইয়ের নাম হচ্ছে ‘মুহাম্মদের নাম’। অপর বইয়ের নাম হচ্ছে ‘স্পষ্ট জ্যোতি : আল কুরআন সমসাময়িক অনুবাদ’।
প্রসঙ্গ আব্বাসউদ্দীন ও সন্তানেরা
বাংলাদেশের সঙ্গীতজগতের অন্যতম মহাপুরুষ, প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন আব্বাসউদ্দীন। আব্বাসউদ্দীন ছিলেন ধর্মীয় চেতনারও একজন সাধক। মূল বাড়ি বা পৈতৃক ভিটা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের অপর পাড়ে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহারে। তবে ১৯৪৭-এর পর থেকে তাঁরা সীমান্তের এই পাড়ের অধিবাসী। আব্বাসউদ্দীনের সন্তানেরা জ্ঞানী ও গুণী। আব্বাস উদ্দীনের সন্তানেরা আমাদের সমাজের জন্য মূল্যবান অলঙ্কার। একজন সন্তানের নাম, বর্তমানে মরহুম, আমাদের দেশের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি মুস্তাফা কামাল। আরেকজন সন্তানের নাম সঙ্গীতজগতের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, পিতার মতোই বিখ্যাত, ফেরদৌসী রহমান। আরেকজনের নাম মুস্তাফা জামান আব্বাসী। তিনি ভাবগম্ভীর গানের গায়ক, তিনি সুবক্তা, তিনি জাতীয় কবি নজরুলের ওপর গবেষণাকারী ও সাধনাকারী। মুস্তাফা জামান আব্বাসী সুফিবাদ বা আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করেন, সুফিবাদ বা আধ্যাত্মিকতা চর্চা করেন, সুফিবাদ বা আধ্যাত্মিকতার সুগন্ধ বিতরণে সচেষ্ট থাকেন। মুস্তাফা জামান আব্বাসীর সর্বশেষ পরিচয় তিনি রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনীকার এবং পবিত্র কুরআনের অন্যতম অনুবাদক।
গ্রন্থের নাম : মুহাম্মদের নাম
বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা ‘অনন্যা’ ফেব্রুয়ারি ২০০১ সালে প্রথমবার প্রকাশ করেছিল ‘মুহাম্মদের নাম’ নামক গ্রন্থটি। এই গ্রন্থেরই প্রথম প্রচ্ছদের ভেতর অংশে বইয়ের পরিচয়টি এরকম দেয়া। ‘নবীকে ভালোবেসে তাঁর পথে বিলীন হয়ে যাওয়া ভক্ত হৃদয় এই গ্রন্থে পাবেন এক অনুপম দৃষ্টিভঙ্গি। নতুন আঙ্গিকে নব প্রেরণার সুধারসে নবীকে দর্শন করেছেন তিনি (লেখক)। ব্যবহার করেছেন সুখপাঠ্য ভাষা। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে বিশ্লেষণধর্মী তার উপলব্ধি একজন আধুনিক মানুষের দৃষ্টিতে বিশ্বনবীর কালজয়ী রূপটি তুষার আবৃত গিরি শিখরে সূর্য কিরণের অনবদ্য আলোকছটার মতোই ঝলমল করে উঠেছে।’ এই গ্রন্থটি একই মলাটে তিন খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে আছে নবী-জীবনী। দ্বিতীয় খণ্ডে আছে মহানবী সা: সম্বন্ধে আঠারোটি বিষয়ভিত্তিক আলোচনা। তৃতীয় খণ্ডে আছে লেখক আব্বাসী কর্তৃক অনুবাদ করা ৪৫১টি রাসূলের হাদিস, কাসিদা-এ-বোরদার অনুবাদ এবং এ যাবৎকাল বাংলা ভাষায় প্রকাশিত মহানবী সা:-এর জীবনীভিত্তিক রচনাগ্রন্থের তালিকা।
আল কুরআন-সমসাময়িক অনুবাদ
একই প্রকাশনা সংস্থা ‘অনন্যা’ অক্টোবর ২০১৫ সালে প্রকাশ করেছে একটি বই, যার নাম দেয়া হয়েছে ‘স্পষ্ট জ্যোতি : আল কুরআন-সমসাময়িক অনুবাদ’। ফেসবুকে মুস্তাফা জামান আব্বাসী একটি পোস্ট বা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, যেদিন তিনি এই গ্রন্থের প্রথম কপিটি হাতে পেয়েছিলেন। তখন থেকেই আমি বা আমার মতো অনেকেই অপেক্ষা করছিলেন এই গ্রন্থটি হাতে পাওয়ার জন্য। অনন্যার স্বত্বাধিকারী মনিরুল হক ২৫ অক্টোবর আমাকে এই গ্রন্থটির একটি কপি উপহারস্বরূপ পাঠিয়েছেন। স্পষ্ট জ্যোতি আল কুরআনের এই কপিটি পেয়ে আমি অনন্যার প্রতি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করা একাধিক পবিত্র কুরআন আছে। বাংলা ভাষায় অন্যান্য অনুবাদক কর্তৃক অনুবাদ করা পবিত্র কুরআনের বাংলা ভাষ্য, অনেক ব্যতিক্রমধর্মী ভাষ্য, আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে। যখন প্রয়োজন হয় তখন সেগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করি। মুস্তাফা জামান আব্বাসী কর্তৃক উপস্থাপন করা অনুবাদটির একটি বিশেষণ তিনি দিয়েছেন। বিশেষণটি হচ্ছে ‘সমসাময়িক অনুবাদ’। কেন তিনি সমসাময়িক শব্দটি ব্যবহার করেছেন, তার সপক্ষে তিনি ১৮ নম্বর পৃষ্ঠায় একটি অনুচ্ছেদ লিখেছেন। অনুচ্ছেদটির প্রথম অংশ আমি এখানে উদ্ধৃত করছি। উদ্ধৃতি শুরু। সেমিটিক আরবিতে ‘ইযাজ’, অননুকরণীয় উহ্যতা। এটি অনেকে বন্ধনীর মধ্যে সংযুক্ত করেছেন, আমিও। কুরআনের ভাষা অপরিবর্তনীয়, অথচ সমসাময়িক আরবির রূপান্তর ঘটেছে। যা সমসাময়িক পাঁচশত বছর পর তেমনটি থাকবে না। অনুবাদ কর্মটি ‘সমসাময়িক’, আজকের জন্য। আধুনিকতার স্পর্শ কুরআনে। মিডিয়ার যুগ, প্রিন্ট মিডিয়া, টেলিভিশন, কম্পিউটারে সংবাদের জয়জয়কার, চার দিকে খবরের পর খবর। আল্লাহ্ বলছেন পনের শ’ বছর আগে সুরা সা’দে : ‘আজকের সর্বোত্তম সংবাদ [নাবাউল আজম] কী? তা হচ্ছে কুরআন, যার থেকে তোমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছ [৩৮:৬৭]’। আংশিক উদ্ধৃতি শেষ।
তবুও পড়ুন
পাঠক, মুস্তাফা জামান আব্বাসী কর্তৃক উপস্থাপন করা মহানবী সা:-এর জীবনীগ্রন্থ অথবা পবিত্র কুরআনের অনুবাদ গ্রন্থ, আপনি ইচ্ছা করলে পড়তে পারেন। কিন্তু আপনি যদি মুস্তাফা জামান আব্বাসীর উপস্থাপনাগুলো পড়তে না চান, তাতে কোনো প্রকারের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। এই কলামের একদম শুরুতে প্রথম দু’একটি অনুচ্ছেদ সাম্প্রতিক কাল এবং সমসাময়িক শব্দের ব্যাখ্যা বা উদাহরণ দিয়ে আলোচনা করেছিলাম। মুস্তাফা জামান আব্বাসীর উপস্থাপনাগুলোও সাম্প্রতিক বা সমসাময়িক কালের বিধায় উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করলাম। আলোচনার খাতিরে মুস্তাফা জামান আব্বাসীর নাম এলেও, আলোচনাটি তাকে কেন্দ্র করে নয়। আলোচনার কেন্দ্র হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনী এবং পবিত্র কোরআনের অনুবাদ পড়ার বিষয়টি। রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনী বাংলা ভাষায় অনেক আছে; ইংরেজি ভাষায় তো প্রচুর আছে। পবিত্র কুরআনের বাংলা অনুবাদও প্রচুর আছে। বাংলাদেশের ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক করা পবিত্র কুরআনের অনুবাদ গ্রন্থটিও অতি সুপরিচিত। আগ্রহী পাঠকদের জন্য, প্রচুর সংখ্যক তাফসির গ্রন্থও আছে। আমার পক্ষ থেকে নিবেদন যে, জীবনী এবং পবিত্র কুরআন পড়াটা একান্ত জরুরি। পবিত্র কুরআনে অনুবাদের উপস্থাপনা দুই প্রকার। এক প্রকার অনুবাদে, আরবি এবং বাংলা পাশাপাশি থাকে। আরেক প্রকারের অনুবাদে, শুধু বাংলা ভাষ্য আছে। আমার ব্যক্তিগত মতে, যেখানে আরবি এবং বাংলা উভয়টি আছে সেটা তুলনামূলকভাবে বেশি উপকারী। অনুবাদ গ্রন্থে, বাক্যের নিচে অথবা পৃষ্ঠার নিচে টিকা (নোট) দেয়া থাকে। কোনো অনুবাদে বেশি, কোনো অনুবাদে কম। আমার ব্যক্তিগত মতে, টিকা বেশি থাকলে ভালো। তবে যিনি পাঠক, তার কাছে কতটুকু সময় আছে অথবা তার কতটুকু ধৈর্য আছে এগুলোর ওপর নির্ভর করবে কোন ধরনের অনুবাদ তিনি পড়তে চান। আমার নিবেদন, সম্মানিত পাঠক যদি কোনো অনুবাদ না পড়ে থাকেন, অবশ্যই একটি সংগ্রহ করে পড়ুন। একই সাথে মহানবী সা:-এর জীবনীও পড়তে হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন, তোমরা যদি আমাকে ভালোবাসো, তবে আমার নবীকেও ভালোবাসো। মহানবী সা: নিজেও তাগাদা দিয়েছেন, তাঁকে এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিবারের সদস্যদের (আহলে বাইত বা আহলুল বাইত) ভালোবাসতে। যাঁকে আমরা ভালোবাসতে চাই, যাঁর ভালোবাসা অন্তরে থাকলে সীমাহীন উপকারের নিশ্চিত ইশারা আল্লাহ তায়ালা নিজেই দিয়েছেন, তাঁর জীবনী আমরা কেন পড়ব না?
চন্দ্র সূর্য এবং ইবাদত
নতুন হিজরি বছর শুরু হয়েছে। পবিত্র কুরআনে চন্দ্র এবং সূর্য প্রসঙ্গে আলোচনা আছে। সম্মানিত পাঠক খেয়াল করুন যে, দ্বীন ইসলামের ইবাদতগুলো সূর্য এবং চন্দ্র উভয়ের চলাচলের সাথে সম্পর্কিত। ইবাদতের জন্য মাসের হিসাব হয় চন্দ্রের ক্যালেন্ডার মোতাবেক; দিনটি নির্ধারিত হয় চন্দ্র ক্যালেন্ডারের তারিখ মোতাবেক। ইবাদতের জন্য দিনের সময়সূচি হিসাব হয় সূর্যের উদয় ও অস্ত মোতাবেক। উদাহরণ দিই, রোজার মাস কখন; নির্ভর করে চন্দ্রের উদয়ের ওপর। মাগরিবের নামাজ কখন নির্ভর করে সূর্যের অস্তের ওপর। এরূপ কথাগুলো অথবা রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনীর কোনো-না-কোনো অংশ, সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশের ছাত্রদের সিলেবাস থেকে ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাইমারি স্কুলে অথবা ক্লাস এইট পর্যন্ত হাইস্কুলেও যেসব পুস্তক পড়ানো হয় সিলেবাস মোতাবেক, সেখানে কত জায়গায় কতটুকু পরিমাণে আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনী বা কারবালার যুদ্ধ ইত্যাদির কথা উল্লেখ আছে সেটা সম্মানিত পাঠক কষ্ট করে গবেষণা করে আবিষ্কার করতে পারেন।
জ্ঞান অর্জনের বিকল্প নেই
কোনো-না-কোনো পাঠক এরূপ প্রশ্ন করতে পারেন যে, সিলেবাসে না থাকলে ক্ষতি কী? আমার উত্তর হলো, ধর্মীয় মূল্যবোধের চেতনা, মানবতার প্রতি মমত্বের চেতনা, সৃষ্টির প্রতি উদারতা ও মমত্বের চেতনা, মানুষে মানুষে এবং সৃষ্টির প্রতি সহমর্মিতার চেতনা, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে সংগ্রামের চেতনা ইত্যাদি সমুজ্জ্বল রাখতে হলে এগুলো পড়তেই হবে। এগুলো না পড়লে একজন শিশু বা একজন কিশোরের মানসিক গঠন ও উন্নয়নে ঘাটতি থাকে। কথাটি সব ধর্মাবলম্বীর জন্য প্রযোজ্য। আরো বেশি প্রযোজ্য এ কারণে যে, বিশ্বব্যাপী কিছু ব্যক্তি বা কিছু সংগঠন, ধর্মের নামে উগ্রবাদ বা চরমপন্থা ছড়াচ্ছে এবং ধর্ম প্রচারের জন্য ধ্বংসাত্মক শক্তি ব্যবহার করছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিকার চাইলে আমাদের সচেতন হতে হবে। সচেতন হতে হলে, পড়তে হবে। কারণ, জ্ঞান অর্জনের বিকল্প নেই।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক
(২৮ অক্টোবর ২০১৫ নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত)
বিষয়: বিবিধ
১২৩৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন