ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে দিবস -মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক
লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম ১৫ অক্টোবর, ২০১৫, ১১:২১:০৩ সকাল
অনেক প্রকারের দিবস থাকে। বছরে ৩৬৫ দিন; এখন মনে হয় ৩৫০টির বেশি দিনে, কোনো-না-কোনো উপলে আন্তর্জাতিকভাবে অথবা জাতীয়ভাবে বিভিন্ন নামের দিবস পালিত হয়। ব্যক্তির জন্মদিন থাকে, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের প্রতিষ্ঠাদিবস থাকে এবং দেশের স্বাধীনতা দিবস থাকে। একেকটি দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য একেক রকম। যথা: আন্তর্জাতিক পরিবেশ দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস ইত্যাদি সমান মাপের নয়। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশীদের কাছে স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবস সম্পূর্ণ নতুন উচ্চমাত্রার তাৎপর্য বহন করে। এ রকম ব্যক্তিজীবনেও কিছু দিবস অন্য দিনগুলোর তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যথা: জন্মদিবস, বিবাহদিবস, চাকরিপ্রাপ্তির দিবস, পিতা-মাতার মৃত্যুদিবস ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে। কিছু দিবসে ব্যক্তির আনন্দ ও উপলব্ধি কম, অন্যদের বেশি। কিছু দিবসে অন্যদের কম, ব্যক্তির বেশি। কিছু দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যক্তিকে যেমন স্পর্শ করে, তেমনই সমষ্টিকেও স্পর্শ করে।
কয়েকটি দিবসের উদাহরণ
ওপরের অনুচ্ছেদে কথাগুলো বললাম এ জন্য যে, অক্টোবরের ৪ তারিখ হলো আমার জন্মদিবস, নভেম্বরের ৫ তারিখ হলো আমার বিবাহদিবস, সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ হলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আমার কমিশন দিবস, ১৫ জুন হলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে আমার বাধ্যতামূলক অবসর দিবস, ৭ আগস্ট হলো আমার বড় নাতির জন্মদিবস এবং যুগপৎ আধ্যাত্মিক মুরব্বির ওফাত দিবস। আমি ব্যক্তি ইবরাহিম। আমার জন্মদিবস এবং অন্যান্য দিন আমার কাছে যেমনভাবে গুরুত্বপূর্ণ তেমনই তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দিবস। কারণ স্বাধীনতা দিবসে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সাথে আমিও একজন জড়িত ছিলাম; কয়েক হাজার প্রথম দিনের বিদ্রোহীর মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। আমার জীবনের ২১তম বছরের শেষাংশ এবং ২২তম বছরের বৃহদাংশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল। রণাঙ্গনে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ করেছি। বিজয় দিবসের দিন, বিজয়ীর বেশে, দেশের রাজধানী ঢাকা মহানগরে প্রবেশ করেছি। অতএব শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকায়, শরীরের অস্থিমজ্জার প্রতিটি কোষে, হৃদয়ে ও ফুসফুসের প্রতিটি স্পন্দনে, বাংলাদেশের গন্ধ ও অনুভূতি বিদ্যমান। অতএব দেশ নিয়ে চিন্তা করব এবং করতে হবে এটা আমার দৃষ্টিতে অতি স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া।
মানুষের দৃষ্টিতে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদ
সব পেশা ও কর্মযজ্ঞই দেশ গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সরকার পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ, মানুষের সেবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। কিন্তু যেই পেশা বা যেই কর্মযজ্ঞ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ সেটা হলো, রাজনীতি। রাজনীতি শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে এখানে গবেষণামূলক বক্তব্য দেবো না। তবে ন্যূনতম এইটুকু না বললেই নয় যে, অনেকের মতে রাজার নীতি থেকে রাজনীতি শব্দের উৎপত্তি, আবার অনেকের মতে সব নীতির রাজা হিসেবে রাজনীতি নামক শব্দের উৎপত্তি। রাজনীতিবিদেরা মানুষের খেদমতের নিমিত্তেই রাজনীতি নামক পেশা বা কর্মযজ্ঞে জড়িত হন। রাজনীতিবিদেরা দেশ পরিচালনার নীতিমালা প্রণয়ন করেন, নীতিমালা অনুযায়ী দেশ পরিচালিত হচ্ছে কি না সেটা তদারকি করেন, সময়ে সময়ে ওই নীতিমালাগুলোকেই পর্যালোচনা করেন। এই কর্মগুলো যদি সঠিকভাবে পালিত না হয় তখন সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে রাজনীতিবিদেরা এবং রাজনীতি নামক পেশা বা কর্মযজ্ঞ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। এই মুহূর্তে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে রাজনীতি একটি অসম্মানিত পেশা। সচেতন নাগরিকদের ভীষণ বড় একটি অংশ রাজনীতি নামক পেশাকে ঘৃণা না করলেও অপছন্দ করে, রাজনীতিবিদ নামক মানুষগুলোকে গালি দেয়। মানুষের মনে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদ প্রসঙ্গে এরূপ ভাব সৃষ্টির জন্য দায়ী কারা? আমার মতে, রাজনীতিবিদেরাই সর্বাধিক দায়ী। উদাহরণস্বরূপ রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য, বেকারত্বের জন্য, দুর্নীতির প্রকোপ বৃদ্ধির জন্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য এবং বাংলাদেশের সাথে ভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের েেত্র নেতিবাচক ঘটনার জন্য মানুষ রাজনীতিবিদের দায়ী করে। রাজনীতিবিদেরা নিজেরাও নিজেদের মানহানির জন্য দায়ী বলে আমি মনে করি। অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে, অথবা রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে আমরা পরস্পরকে শ্রদ্ধাহীনতার অনেক গভীরতায় নিয়ে যাই, যেখান থেকে ওপরে উঠে আসা খুব কষ্ট হয়।
রাজনীতিতে অসৌজন্যের উদাহরণ
রোববার ৪ অক্টোবর দুপুরবেলা বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্সের কথা উল্লেখ করা যায়। সেই প্রেস কনফারেন্সে একজন প্রশ্নকর্তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন বা একটি পরিস্থিতি বা প্রোপট ব্যাখ্যা করে মন্তব্য চাইলেন। ব্যাখ্যাকৃত পরিস্থিতি বা প্রোপট হলো এই, বিএনপি চেয়ারপারসন বলেছেন যে, (অনেকটা এ রকম) ভবিষ্যতে তিনি আরো অনেক ব্যক্তিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এবং দেশ পরিচালনায় সাথে রাখবেন; যথা আওয়ামী লীগেও অনেক ভালো ও দেশপ্রেমিক মানুষ আছে, তিনি তাদেরকে সাথে রাখবেন। প্রশ্নকর্তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য জানতে চান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে, রহস্যজনক হাসি দিয়ে বললেন, আওয়ামী লীগাররা যদি উনার প্রেমিক হয়, তাহলে অমুকের কী হবে? অমুক মানে একজন ভদ্রলোকের নাম, তিনি বিএনপি রাজনীতির সাথে জড়িত, তিনি একটি মিডিয়া হাউজের মালিক অংশের একজন, তিনি একজন সাবেক সংসদ সদস্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রহস্যময় হাসি দিয়ে যে নামটি নিয়েছেন আমি সেটা নিতে পারব না। কারণ আমার ভব্যতা জ্ঞান, আমার সামাজিক জ্ঞান, আমার ভদ্রতা জ্ঞান কোনোটাই আমাকে অনুমতি দিচ্ছে না প্রকাশ্যে এরূপ নাম নিতে। মাননীয় শেখ হাসিনা তারই মতো আরেকজন ব্যক্তিকে দেশবাসী ও বিশ্বের টেলিভিশন শ্রোতা-দর্শকদের সামনে অবলীলাক্রমে অপমান করলেন অশোভন ইঙ্গিতের মাধ্যমে। প্রশ্ন তো উঠতেই পারে একজন প্রধানমন্ত্রী যদি আরেকজন প্রধানমন্ত্রীকে সম্মান না দেন, তাহলে অন্য হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের এমন কী ঠেকা পড়েছে প্রধানমন্ত্রীকে বা সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে সম্মান দিতে হবে? শেখ হাসিনা এখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। মাঝখানে পাঁচ বছর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আগামীতে তথা ভবিষ্যতে আবারো যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সম্বোধিত হবেন না তার কোনো নিশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারবে? যা হোক, রাজনীতির অতি উচ্চস্তরের এরূপ নেতিবাচক স্পর্শকাতরতার পরিবর্তন প্রয়োজন। পরিবর্তন শব্দটা যখন আনলামই, তখন আমি এই পরিবর্তনের রাজনীতির কথা একটু বলব। কারণ রাজনীতি আমার জীবনের অংশ। অনেকগুলো তারিখের কথা ওপরের একটি অনুচ্ছেদে উদাহরণ দিয়েছি। সেই তালিকা সম্পূর্ণ হবে যদি ৪ ডিসেম্বর নামক তারিখটিকে সেই তালিকায় যোগ করি। কারণ ৪ ডিসেম্বর ২০০৭ তারিখে আমি প্রত্যভাবে রাজনীতিতে নাম লেখাই। প্রথমে এর প্রোপট বর্ণনা করি।
বাংলাভিশনে ইন্টারভিউ
২৪ সেপ্টেম্বর ২০০৬ তারিখে ‘বাংলাভিশন’ নামক জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেলে আমার একটি ইন্টারভিউ প্রচারিত হয়েছিল। ইন্টারভিউ গ্রহণকারী ছিলেন ওই আমলের এবং বর্তমানেরও প্রখ্যাত নাট্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জনাব মামুনুর রশীদ। ওই ইন্টারভিউ থেকে একটি অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করছি। মামুনুর রশীদ : ‘আমি মনে করি আপনি একজন কনশাস মানুষ। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সঙ্কটে আপনি উদ্বিগ্ন হন। আপনি কি মনে করেন না যে, আপনি রাজনীতি করলে ভালো করতে পারতেন?’ ইবরাহিম : ‘আপনার এই প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ। আমি বর্তমানে এই কাঠামোতে রাজনীতি করতে পারব না। তবে আমার নিজস্ব দর্শনে আমি অনুভব করি যে, আমার সৃষ্টিকর্তার কাছে যখন ফেরত যাবো তখন উনি যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, তোমার মেধা, তোমার মতা, তোমার দক্ষতা , জ্ঞান তুমি কোন্ কাজে ব্যবহার করেছো নাকি সব কিছু নিজের জন্যই করলা? আমি সেটার উত্তর দেয়ার জন্যই বলি, আমার কলম দ্বারা, আমার চিন্তা দ্বারা, আমার মুখ দ্বারা যত দূর সম্ভব আমি চেষ্টা করেছি। এই মহূর্তে এই রাজনীতিতে আসা সম্ভব নয়।’
মামুনুর রশীদ : ‘কিন্তু কাউকে-না-কাউকে তো এখানে আসতে হবে।’
ইবরাহিম : ‘আপনি যদি বনসাই করা বৃক্ষ চেনেন, তাহলে আপনার কাছে পরিষ্কার হবে। এখন রাজনীতির মধ্যে মেধা, দক্ষতা , সততা বনসাই বৃক্ষ হয়ে আছে। তাহলে কে আসবে? তবে সেই পরিবেশ যদি কখনো তৈরি হয় তাহলে আসবো।’ ইন্টারভিউ থেকে উদ্ধৃতি শেষ।
যুগান্তরের ইন্টারভিউ
ঢাকা মহানগরের বড় বড় দৈনিক পত্রিকার মধ্যে একটি হচ্ছে যুগান্তর। যুগান্তর পত্রিকার জন্মলগ্ন থেকেই, এই পত্রিকায় লেখালেখি করি। ১৫-১৬ বছর আগে পত্রিকাটি যখন প্রথম বাজারে আসে, তার ১৫-২০ দিন পরেই আমি ধারাবাহিকভাবে কলাম লেখা শুরু করি। আমার একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক রচনা ৩৬ কিস্তিতে, তথা পরপর ৩৬ দিন প্রকাশ হয়েছিল যুগান্তর পত্রিকায়। ওই পত্রিকার ৬ জুলাই ২০০৭ তারিখের একটি ইন্টারভিউ প্রসঙ্গ এখানে আনছি। সেই ইন্টারভিউতে, প্রশ্নকর্তা আমাকে ১২টি প্রশ্ন করেছিলেন। ১১ নম্বর প্রশ্ন ছিল ‘আপনার জীবনদর্শন কী? সংেেপ বলুন।’ আমার উত্তর ছিল নি¤œরূপ, ‘বর্তমানে আমার বয়স ৫৮ বছর শেষ হতে যাচ্ছে প্রায় এবং এই মুহূর্তে আমার জীবনদর্শন হচ্ছে আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন। সে জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা। আমার জীবনের চাওয়া-পাওয়ার যে দর্শন সেটি হচ্ছে আমরা যা পেয়েছি তা বিলিয়ে দিতে হবে।’ আমার মনের এই আন্তরিক অভিব্যক্তিকে বাস্তবায়ন করতে হলে আমাকে সক্রিয় হতে হবে। সক্রিয় হওয়ার জন্য বিভিন্ন পন্থা সামনে খোলা ছিল। আমি বেছে নিয়েছিলাম রাজনীতি।
কল্যাণ পার্টির প্রতিষ্ঠা
বাংলাভিশনে প্রদত্ত ও প্রচারিত আমার ওই ইন্টারভিউয়ের সোয়া বছর পর, যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত ইন্টারভিউয়ের পাঁচ মাস পর ২০০৭ সালের ৪ ডিসেম্বর তারিখে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি আত্মপ্রকাশ করেছিল। কল্যাণ পার্টি প্রতিষ্ঠার পেছনে রাজনৈতিক ও নৈতিক ভিত্তি, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রোপট ইত্যাদি প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করা বাস্তবসম্মত। আমার নিজের লেখা এবং ফেব্রুয়ারি ২০১১-তে প্রকাশিত ১১তম বইয়ের নাম ‘মিশ্রকথন’। এই বইটিতে মোট ১৩টি অধ্যায় আছে। ১১ নম্বর অধ্যায়ের শিরোনাম হচ্ছে ‘রাজনৈতিক মত ছিল; কিন্তু পথ কোনটি?’ ১২ নম্বর অধ্যায়ের শিরোনাম হচ্ছে ‘রাজনীতির পথে হাঁটবো কি হাঁটবো না?’ শেষ তথা ১৩ নম্বর অধ্যায়ের শিরোনাম হচ্ছে ‘রাজনীতিতে আমার পথ : নতুন দল।’ অর্থাৎ মিশ্রকথন নামক বইটির ৩৮৩ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে ৪৯৫ নম্বর পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিধৃত তিনটি অধ্যায়ে আমি রাজনীতিতে আমার আগমন ও নতুন দলের উন্মেষ প্রসঙ্গে লিখেছি। সবার পে বই সংগ্রহ করে বিস্তারিত পড়া অনেক সময় বাস্তবসম্মত নয়, কিন্তু আমার প থেকে ব্যাখ্যা দিয়ে রাখা প্রয়োজন। কারণ প্রোপট জানা না থাকলে, চিন্তাশীল মানুষ সম্পৃক্ত হবেন না। আজকের এই কলামে আমি এই কথাটা আনলাম এ জন্য যে, ৪ অক্টোবর ২০১৫ আমার জন্মদিবসে কথা প্রসঙ্গে আমি উপস্থিত সুধীমণ্ডলী ও রাজনৈতিক কর্মীবৃন্দের সামনে এই কথাগুলো বলেছি। উপস্থিত সুধীমণ্ডলী ও রাজনৈতিক কর্মীবৃন্দ বললেন, এই কথাগুলো বিস্তারিতভাবে বা সংপ্তি আকারে আমি যেন বারবার বলতে থাকি এবং বারবার উপস্থাপন করতে থাকি। কারণ শত ব্যস্ততার মধ্যে মানুষকে স্বচ্ছ রাজনীতির দিকে আকর্ষণ করতে হলে এরূপ বারবার বলার কোনো বিকল্প নেই।
পরিবর্তনের দাবি
সংপ্তিভাবে বললে প্রেক্ষাপট ছিল নিম্নরূপ : ক. ১৯৭১-এর মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশ, যতটুকু উন্নতি করতে পারত তা থেকে অনেক কম হয়েছে। যতটুকুই উন্নতি বা অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তার জন্য বিগত ৪৪ বছরের নেতৃত্ব ও অংশীদারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েই প্রত্যয় হচ্ছে যে, উন্নতি ও অগ্রগতি দ্রুততর করতে হবে। উন্নতি ও অগ্রগতিতে পিছিয়ে থাকার জন্য অনেকগুলো কারণ দায়ী। যথা: অব্যাহত গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব, হানাহানি ও সঙ্ঘাতের রাজনীতি, দুর্নীতির প্রসার, নেতৃত্বের দুর্বলতা ইত্যাদি। তাই কল্যাণ পার্টির স্লোগান হচ্ছে, ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’ অর্থাৎ নেতৃত্বে ও দেশ পরিচালনার নীতিতে গুণগত পরিবর্তন প্রয়োজন, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। এ লক্ষ্যেই ৪ ডিসেম্বর ২০০৭ তারিখে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির আত্মপ্রকাশ।
দাবি অর্জনের জন্য তারুণ্য এবং বিনিয়োগ
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য, অব্যাহত পরিশ্রম করতে হবে, ধৈর্য, সাহস ও কৌশলের সাথে। সাংগঠনিকভাবে পরিশ্রম করতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সময়, শ্রম, মেধা ও অর্থ ব্যয় করতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তরুণ সম্প্রদায়কে রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ করতে হবে। রাজনীতিতে স্বচ্ছভাবে সম্ভব, অথবা রাজনীতিতে স্বচ্ছতা সম্ভব এর প্রমাণ তরুণদের সামনে রাখতে হবে। রাজনীতি যে একটি সম্মানজনক পেশা এই বিষয়টি তরুণদের বোঝাতে হবে। রাজনীতি যে তাদের প্রত্যেকের জীবনকে স্পর্শ করে এই কথাটি তরুণদের বোঝাতে হবে। তরুণদেরকে এ-ও বোঝাতে হবে যে, তারা দলীয় রাজনীতি করতেও পারে না-ও করতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সচেতন হওয়া আবশ্যক। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ গ্রেশাম বলেছিলেন, ‘গুড মানি ড্রাইভস ব্যাড মানি আউট অব সার্কুলেশন।’
মানে হলো, পুরনো টাকা ছেঁড়া টাকা ইত্যাদি নতুন ও সুন্দর টাকাকে বাজার থেকে বহিষ্কার করে দেয়। বাজারে যখনই নতুন ধাতবমুদ্রা আসে অথবা নতুন নোট আসে, সেই নতুনগুলোকে বাজার থেকে বহিষ্কার করে দেয় পুরনো মুদ্রা এবং পুরনো ছেঁড়া নোট। কারণ, সবাই নতুনটিকে জমাতে চায়, কম ব্যবহার করতে চায়। অনুরূপ রাজনীতির অঙ্গনে সৎ মেধাবী তরুণেরা আগমন করলেও, অসৎ মেধাশূন্য ব্যক্তিরা তাদেরকে বহিষ্কার করার জন্য তৎপর থাকে। সে জন্য সৎ মেধাবী তরুণদের অধিক মাত্রায় পরিশ্রম করতে হবে রাজনীতির অঙ্গনে টিকে থাকার জন্য।সুধী পাঠক, খেয়াল করুন যে, আমি দলীয় রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ করছি না, আমি রাজনীতি নামক পেশা বা কর্মযজ্ঞের প্রতি সচেতন হওয়ার জন্য আহ্বান করছি। আমি মনে করি মানুষের কল্যাণের জন্যই রাজনীতি। আমরা যারা মুসলমান, আমরা আমাদের প্রিয়নবী সা:কে অবশ্যই ভালোবাসি এবং অবশ্যই মান্য করতে চাই। সে জন্য নবীজীর প্রসঙ্গটি এনে কলামের এই অংশ শেষ করতে চাই। বিশ্বনবী তথা মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:কে মহান আল্লাহ তায়ালা মনোনীত করেছেন সমস্ত সৃষ্টিকুলের জন্য রহমত তথা কল্যাণস্বরূপ। অতএব নবীজীর উম্মত হিসেবে তথা দ্বীন ইসলামের অনুসারী হিসেবে আমরা সবাই অপরের কল্যাণ কামনা করি এবং কল্যাণ স্থাপনে সচেষ্ট থাকতেই হবে।
সারমর্ম
আমার তথা কল্যাণমুখী রাজনীতির আবেদন
১. বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন চাই।
২. সমাজ ও দেশ গঠনে ধনী-গরিব সবার অংশগ্রহণ চাই।
৩. ধর্মীয় মূল্যবোধের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমন্বিত প্রকাশ চাই।
৪. রাজনীতিতে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমঝোতা চাই।
৫. জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা চাই।
৬. রাজনীতির প্রতি সৎ, মেধাবী সাহসী মানুষকে আকৃষ্ট করতে চাই, বিশেষত তরুণ সম্প্রদায়কে। আজ বুধবার ৭ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে, রাজনৈতিক জীবনের পৌনে আট বছরের মাথায়, ৬৭ বছর বয়সে পদার্পণের চতুর্থ দিবসে, আমার অভিব্যক্তিকে, আমার আবেদনগুলোকে, আমার কামনাগুলোকে, শুভাকাক্সীদের সামনে পুনরায় উপস্থাপন করলাম; নয়া দিগন্ত পত্রিকার সৌজন্যে। নয়া দিগন্তকে ধন্যবাদ।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
[লেখাটি ৭ অক্টোবর নয়া দিগন্ত ও আমার ফেসবুকে প্রকাশ হয়েছিল ।]
বিষয়: বিবিধ
১১৬৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন