বাংলাদেশের নিরাপত্তা সমস্যা : বচনে ও কর্মে - সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম
লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম ১৪ অক্টোবর, ২০১৫, ০২:৫১:১১ দুপুর
বাংলাদেশের নিরাপত্তা সমস্যা : বচনে ও কর্মে
মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক
রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক : প্রার্থক্য
ঢাকা মহানগর থেকে প্র্রকাশিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক পত্রিকা থাকলেও নিয়মিত কলাম লিখতে পারি শুধু দু’টিতে : যুগান্তর ও নয়া দিগন্তে। প্রত্যেক বুধবার নয়া দিগন্তের সৌজন্যে পাঠক সম্প্রদায়ের সাথে একটি যোগাযোগ হয় কলাম লেখার মাধ্যমে। যদিও নিজে প্র্রত্যভাবে একজন রাজনৈতিক কর্মী, তথাপি সব সময় রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কলাম লিখি না। লেখালেখির বিষয়ের মধ্যে একটি বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করি। তবে আজকের কলামটি রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার তাগাদা থেকে লেখা। অতীতের কোনো একজন মনীষীর কথা থেকে একটি ইংরেজি বাক্য উদ্ধৃত করছি। ‘এ পলিটিশিয়ান থিংকস অব দি নেক্সট ইলেকশন; এ স্টেইটসম্যান থিংকস অব দি নেক্সট জেনারেশন।’ বাংলা মানে করলে দাঁড়াবে : একজন রাজনীতিবিদ আগামী নির্বাচন নিয়ে চিন্তা করেন; একজন রাষ্ট্রনায়ক আগামী প্রজন্মকে নিয়ে চিন্তা করেন।’ প্রশ্ন হলো, এই দুই পরিচয়ের (অর্থাৎ পলিটিশিয়ান এবং স্টেইটসম্যান) কি মধ্যবর্তী কোনো অবস্থান নেই? আমার উত্তর হলো, আছে। কোনো একজন রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্র পরিচালনার সময় আগামী প্রজন্মের কথা একটু চিন্তা করতেও পারেন। আবার যিনি রাষ্ট্রনায়ক, তাকে অবশ্যই আগামী নির্বাচন নিয়ে চিন্তা করতেই হবে। কারণ, নির্বাচনের মাধ্যমে মতায় যেতে হয়। মতায় যাওয়ার পর দৈনন্দিন কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে, দৈনন্দিন কথাবার্তার মাধ্যমে, কর্ম পরিকল্পনা হাতে নেয়ার মাধ্যমেই মাত্র মতাসীন ব্যক্তি বা মতাসীন রাজনীতিবিদ চলমান প্রজন্ম ও আগামী প্রজন্মের জন্য পদপে নিতে পারেন। যিনি বর্তমান প্রজন্মের জন্য বেশি করবেন, তার পরিচয় বেশি হবে রাজনীতিবিদ হিসেবে। যিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বেশি করবেন, তার পরিচয় হবে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। যে ইংরেজি বাক্যটি উদ্ধৃত করেছি এতে যেমনভাবে ভাগ করা হয়েছে রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কের চিন্তাপরিধি, বাস্তব জীবনে সেটি অত সুনির্দিষ্ট নয় এবং ওই রূপ স্পষ্টভাবে ভাগ করা যায় না। প্রত্যেক রাজনীতিবিদই একটু হলেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করেন; কেউ কম কেউ বেশি। অনেক রাজনীতিবিদই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নেতিবাচক চিন্তা করেন; তবে নেতিবাচক হলেও চিন্তা তো বটে!
দেশের কল্যাণে চেষ্টা : সর্বাবস্থায়
মতায় না গেলে রাষ্ট্র পরিচালনার অংশীদার হওয়া যায় না, এটি সত্য। অংশীদার হতে পারলে চিন্তা, মেধা ও দতার স্বার রাখা যায়। মতার বাইরে থাকলেও অবশ্যই এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের স্বার রাখা যায়; কিন্তু সেগুলো প্রায় সময় অবহেলিত থাকে। এ জন্য রাষ্ট্রের বা জনগণের কল্যাণ করার জন্য মতায় যাওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মতায় না থাকলেও কল্যাণ করার কিছু পদপে নেয়া যায়। মতাসীন রাজনৈতিক দল বা মতাসীন ব্যক্তিবর্গের ভুলত্রুটিগুলোকে মতার বাইরের ব্যক্তিবর্গ অবশ্যই চিহ্নিত এবং উপস্থাপন করতে পারেন। এরূপ চিহ্নিত ও উপস্থাপন করার মাধ্যমে মতার বাইরের মানুষেরাও জনগণের কল্যাণ করতে পারেন। যেহেতু রাজনৈতিক ব্যাকরণে সরকারি দল এবং বিরোধী দল বলে দু’টি অঙ্গ আছে, উভয় অঙ্গই যেন জনগণের কল্যাণে কাজ করতে পারে, সেই চেষ্টা করা উচিত। যেকোনো দেশে, যে মতাসীন রাজনৈতিক দল যত বেশি বেশি রাজনীতির অঙ্গের বিরোধী অংশকে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জড়িত করতে পারবে, তারা তত বেশি দেশপ্রেম ও সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বিশেষত কোনো দেশ বা সমাজ যখন কোনো বড় বিপদে পড়ে, তখন সেই বিপদ মোকাবেলা করার জন্য সম্মিলিত বা একতাবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাতে হয়। বহু দেশেই, ওইসব দেশের বিপদের দিনে এরূপ সম্মিলিত বা একতাবদ্ধ প্রয়াসের উদাহরণ আছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের েেত্র এটি নেই। কেন নেই, সেটি ব্যাখ্যা করতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে; আজকে সে দিকে যাবো না। বরং আবার একতাবদ্ধ বা সম্মিলিত প্রয়াসে গুরুত্ব আরোপ করে কয়েকটি কথা সংেেপ বলব।
নিরাপত্তা সঙ্কটের শুরু
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ একটি নিরাপত্তা সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ‘সাম্প্রতিক’ শব্দের ব্যাখ্যা দিতে গেলে আমি ১৯৯৯ বা ২০০০ সাল থেকে যে সময়, সেটিকে গণনা করব। বিভিন্ন নামের উগ্রবাদী বা কট্টরবাদী বা চরমপন্থী কয়েকটি সংগঠন তখন প্রকাশ পেতে থাকে। প্রথমে তাদের ‘অস্তিত্ব নেই’ বলেই কর্তৃপ সবাইকে আশ্বস্ত করতেন। পরবর্তী সময়ে কর্তৃপ তাদের অস্তিত্ব স্বীকার করেছিলেন এবং যথাসাধ্য চেষ্টা করে তাদের দমন করেছিলেন। তবে দমন করা এক জিনিস এবং নির্মূল করা আরেক জিনিস। আমার মতে নির্মূূল করা অসম্ভব। কারণ, উগ্রবাদী বা কট্টরবাদী বা চরমপন্থী সংগঠন উগ্র বা কট্টর বা চরম চিন্তা থেকেই জন্ম নেয়। চিন্তার স্থান হচ্ছে মাথা। অতএব মাথার মধ্যে চিন্তা বন্ধ করার কোনো প্রকার অস্ত্র এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, এখন সমষ্টিগত অথবা ব্যক্তিগতপর্যায়ে মানুষে মানুষে দৃশ্যমান বা অদৃশ্য যোগাযোগ, অথবা মানুষের চিন্তার মধ্যে দৃশ্যমান বা অদৃশ্য যোগাযোগ অথবা মানুষের সংগঠনগুলোর মধ্যে দৃশ্যমান বা অদৃশ্য যোগাযোগ অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি সহজ ও বিস্তৃত। উদাহরণস্বরূপ, হিমালয় অঞ্চলের উগ্রবাদী চিন্তা অথবা ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরের উগ্রবাদী চিন্তা বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলে পৌঁছতে বিশেষ সময় নেয় না।
অতি সাম্প্রতিক সঙ্কট ও বিভিন্ন বক্তব্য
উপরের অনুচ্ছেদে ‘সাম্প্রতিক’ সময়ের কথা বলেছি। এ অনুচ্ছেদে ‘অতি সাম্প্রতিক’ সময়ের কথা বলছি। অতি সাম্প্রতিক বলতে বিগত পনেরো-বিশ দিন। ইংরেজিতে বললে, বলতাম মোস্ট রিসেন্ট ঘটনাবলি। অতি সাম্প্রতিক ঘটনাবলি শুরু হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট টিম বাংলাদেশে সফরসূচি বাতিল করা থেকে। অস্ট্রেলিয়ানরা অজুহাত দিয়েছিলেন, বাংলাদেশে নিরাপত্তার অভাব। সেই সফর বাতিলের পর থেকে গত পনেরো-বিশ দিন যা হয়েছে সেটি পত্রপত্রিকার ও টেলিভিশনের বদৌলতে সব সচেতন বাংলাদেশী অবগত আছেন। সারমর্ম পরবর্তী ছোট ছোট বাক্যগুলোতে দিলাম। একজন ইতালিয়ান ও একজন জাপানি নিহত হয়েছেন। ১১ তারিখ সন্ধ্যায় যখন এই কলাম লিখছি তখন পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হয়নি। সব টেলিভিশন চ্যানেল এবং সব পত্রিকায় বিশ্লেষণমূলক বক্তব্য ও কলাম উপস্থাপিত হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রথম থেকেই বিএনপি, বিএনপি ও জামায়াত জোট এবং বিএনপি চেয়ারপারসনকে সরাসরি দোষী করে বক্তব্য দিয়ে আসছেন। বিএনপি সমস্যা মোকাবেলায় গভীর আলোচনার এবং জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির জন্য দাবি জানাচ্ছে। যখন ঘটনাটি ঘটছিল তখন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমেরিকার ভূখণ্ডে জাতিসঙ্ঘের সাথে ব্যস্ত ছিলেন এবং মাননীয় বেগম খালেদা জিয়া লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। যেখানেই থাকুন না কেন, সেখান থেকেই প্রধানমন্ত্রী দেশ চালানোর দায়িত্ব পালন করে যান, এটিই স্বাভাবিক। যেখানেই থাকুন না কেন মাননীয় খালেদা জিয়াও দেশ নিয়ে চিন্তাভাবনা এবং মতামত ব্যক্ত করবেন, এটিও স্বাভাবিক।
আমরা কোন দিকে যাবো?
আজ বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশীরা সত্য সত্যই কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন। আমরা কি (কথার কথা) আগামী বারো মাস পর বা চব্বিশ মাস পর বা তিরিশ মাস পর বা ২০১৯ সালের শেষ মাথায় পার্লামেন্ট নির্বাচনের কথা চিন্তা করেই এখন কথাবার্তা বলব? নাকি, দুই বছর বা দশ বছর বা বিশ বছর পর বিশ্বের জাতিগুলোর পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে, সেটি চিন্তা করে কথা বলব? আগামী নির্বাচন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ চাচ্ছে যেকোনো নিয়মেই হোক, যেকোনো কিছুর মূল্যেই হোক রাষ্ট্রীয় মতা অব্যাহতভাবে দখলে রাখতে। ২০ দলীয় জোট বা বিএনপি চাইবে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, জনগণ যদি ভোটের মাধ্যমে রায় দেয়, তাহলে মতায় যেতে। যে-ই মতায় যাক, দেশ যদি না থাকে, জনগোষ্ঠী যদি না থাকে তাহলে কাকে, কে শাসন করবে? সম্মানিত পাঠক, আমার প্রশ্নটিকে আরিক অর্থে গ্রহণ করবেন না; বরং প্রতীকী অর্থে গ্রহণ করুন। এমনিতেই রাজধানী ঢাকা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বসবাসের প্রায় অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। ভীষণ বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প যেমন গৃহীত হচ্ছে, তেমনই ভীষণ বড় বড় দুর্নীতিও সাধিত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সংবাদ প্রচারে যেরূপ মনোযোগ ও সময় ব্যয় করা হচ্ছে, একই প্রকারে সময় ও মনোযোগ ব্যয় করা হচ্ছে দুর্নীতির খবর ধামাচাপা দিতে। পাশ্চাত্যের শুভঙ্করীয় ফাঁকিমূলক অঙ্কের মানদণ্ডে দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক উন্নতি করছে কিন্তু সরেজমিন দেশের অর্থনীতি অবনতির দিকে। মানুষের মনে স্বস্তি নেই। মানুষ শান্তি চায়। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ধর্মকর্ম, পড়ালেখা, চাকরিবাকরি, ব্যবসাবাণিজ্য ইত্যাদি করতে চায়। কিন্তু সেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বাংলাদেশে নেই। যদি আমরা চেষ্টা না করি, তাহলে আগামী দিনে যে দলই মতায় আসুক না কেন, তারা আজকে (অক্টোবর ২০১৫) যত অশান্তিপূর্ণ দেশ দেখছেন, তার থেকেও বেশি অশান্তিপূর্ণ দেশ শাসনের দায়িত্ব নেবেন। যদি বর্তমান মতাসীন দল, আগামীতে মতায় না থাকে, উনারা দেশের ভেতরে বসবাস অব্যাহত রাখতে পারেন অথবা উনারা দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে যেতেও পারেন। মতার চেয়ারে আসীন রাজনৈতিক দল যাবে, দল আসবে। কিন্তু দেশ ও সমাজ তো থাকবেই। তাই মতাসীন কোনো নেতা বা মতাসীন কোনো দল যদি শুধু নিজেদের মতায় থাকা নিশ্চিত করার জন্য দেশের প্রতি অবান্ধব নীতি অনুসরণ করেন, তাহলে তারা এক অর্থে দেশদ্রোহিতার মতো কাজ করেন বলেই জনগণ মনে করে।
মাননীয় শেখ হাসিনার উচ্চারণগুলো
বৃহস্পতিবার ১ অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলোর ঢাকা মহানগর সংস্করণ-এর দশ নম্বর পৃষ্ঠায় বড় একটি প্রতিবেদন আছে। ফিচারটির নাম এরূপ ‘ব্রিটিশ জিহাদিরা কট্টরপন্থীদের ইন্ধন দিচ্ছে : ঢাকা’। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রদত্ত সাাৎকারের আলোকে ওই প্রতিবেদনটি প্রস্তুত হয়েছিল ব্রিটিশ পত্রিকা ‘গার্ডিয়ান’ কর্তৃক; ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে। এর বাংলা অনুবাদ প্রথম আলো প্রকাশ করেছে। এর প্রথম সাতটি বাক্য আমি উদ্ধৃত করছি। ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনকে সতর্ক করেছেন, কট্টরপন্থীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাকে আরো তৎপর হতে হবে। কারণ, ব্রিটিশ জিহাদিরা বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ ছড়াতে সহায়তা করছে। ঢাকার নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞরা বলেন, ব্রিটিশ জিহাদিরা বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের পুনর্জাগরণে ইন্ধন জোগাচ্ছে। তারা সিরিয়া ও ইরাকে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট-এর (আইএস) প্রতি আকৃষ্ট ধার্মিক তরুণদের একটি প্রজন্মকে প্রশিতি করছে। ব্রিটেনের বাঙালি সম্প্রদায়ের মানুষেরা আন্তর্জাতিক জিহাদি কর্মকাণ্ডে যোগ দেয়ার জন্য বাংলাদেশের স্থানীয় লোকজনকে প্ররোচনা দিচ্ছে। এসব কাজের তহবিলও আসছে ব্রিটেন থেকে। সালাফি সংগঠনগুলোর সাথে জড়িত বাংলাদেশীর সংখ্যা বাড়ছে।’ উদ্ধৃতি শেষ। সম্মানিত পাঠক, বর্তমানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় যত দেশের রাষ্ট্রদূত আছেন, তাদের তথা ডিপ্লোমেটিক কোরের ডিন বা আধা আনুষ্ঠানিক নেতা বা মুখপাত্র হচ্ছেন বাংলাদেশে বর্তমান ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত। এক মাস আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রিটেনকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন অনেক কিছুতেই; এক মাস পর ব্রিটেন ও পশ্চিম ইউরোপ শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করবে এটিই স্বাভাবিক। বেশ কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সম্মানিত সাধারণ সম্পাদক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিমন্ত্রী নিশা দেসাই এবং ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার পদবি ও নাম নিয়ে ব্যঙ্গ করে কথা বলেছিলেন। তিনি নিশাকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, চার আনার মন্ত্রী এবং রাষ্ট্রদূতকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, কাজের মেয়ে মর্জিনা। সম্মানিত পাঠক, আমাদের জিহ্বা বা আমাদের বচন আমাদের শত্রু হতেই পারে। পশ্চিম ইউরোপ এবং আমেরিকার প থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বা কোনো মন্ত্রীকে কোনো অশোভন ভাষায় গালি দেয়া হয়নি, কিন্তু তার চেয়েও বেশি মারাত্মক কিছু করার মতা বা সুযোগ ওইসব দেশের অবশ্যই আছে। যদি মারাত্মক কিছু করে এর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার সম্মানিত মন্ত্রীর বচনকে দায়ী করা কি অযৌক্তিক হবে? পুরোপুরি দায়ী না হলেও আংশিকভাবে দায়ী হতেও পারেন।
সহযোগিতা নেয়ার পরিবেশ আছে কি?
বাংলাদেশের কষ্ট যা-ই হোক, আমাদের কষ্ট আমাদেরই সহ্য করে মোকাবেলা করতে হবে। বিশ্বায়নের যুগে একটি দেশ আরেকটি দেশকে সাহায্য বা সহযোগিতা করাটাই স্বাভাবিক। প্রথম আলোর যে নিবন্ধের কথা একটু উপরে বলেছি এর মাঝামাঝি অংশ থেকে ছয়টি বাক্য উদ্ধৃত করছি। ‘শেখ হাসিনা জোর দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন : মৌলবাদীরা চেষ্টা করছে, এতে সন্দেহ নেই; আর কিছু মানুষ তাদের উৎসাহ দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছি। বাংলাদেশে কট্টরপন্থার বিস্তার ঠেকাতে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে আরো ঘনিষ্ঠ আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন : আমরা অবশ্যই অন্য সব দেশের কাছ থেকে সহযোগিতা চাই, যাতে তারা সতর্ক হয়ে যায়, অবৈধ অর্থ, অস্ত্রশস্ত্র বা সন্ত্রাসীরা অন্য কোনো দেশে সমস্যা তৈরি করার সুযোগ না পায়।’ সম্মানিত পাঠক, বিগত কয়েক দিনের সংবাদ, সরকারি নেতা ও মন্ত্রীদের কথাবার্তা ইত্যাদি কি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পাওয়ার ল্েয উচ্চারিত হচ্ছে, নাকি সহযোগিতা না পাওয়ার ল্েয উচ্চারিত হচ্ছে, এটি আপনারাই বিবেচনা করুন। সম্মানিত পাঠক, আমি আন্তর্জাতিক শব্দটি ব্যবহার করেছি, দণি এশীয় সহযোগিতা বা ভারতীয় সহযোগিতা ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করিনি। আমি মনে করি দেশের ভেতরে এবং দেশের বাইরে থেকে একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন উগ্রপন্থা বা কট্টরবাদ মোকাবেলা করার জন্য। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান বা ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এমনই যে, অনেক দেশই আমাদের দিকে গভীর মনোযোগ দেবে। তবে বাংলাদেশের জনগণকে অর্থাৎ তাদের প্রতিনিধিগণকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কোন দেশের সাথে কতটুকু সুসম্পর্ক বা খাতির রাখবেন। এই ভারসাম্য সৃষ্টিতে ব্যর্থ হলে, শুধু মতাসীন সরকারের মতায় থাকাটাই হুমকির মুখে পড়বে না, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নতিও হুমকির মুখে পড়বে।
তরুণ ও ছাত্রদের প্রসঙ্গ
আজকের কলাম লেখা শুরু করেছিলাম রাজনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রনায়ক, এই দুটো শব্দের কর্মপরিধি বা চিন্তা পরিধির আলোচনা দিয়ে। কট্টরপন্থা বা উগ্রবাদ ইত্যাদি মোকাবেলা করা যেমন অতি সাম্প্রতিক সময়ের একটি চাহিদা, তেমনই আগামী দিনের বাংলাদেশের পরিচালক যারা হবে তাদের প্রস্তুত করাও, আজকের দিনের একটি জরুরি চাহিদা। আমি তরুণ সম্প্রদায়ের কথা বলছি। মেডিক্যাল ভর্তি ইচ্ছুক ছাত্রদের কথা বলছি। আনুমানিক চার সপ্তাহ আগে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যখন ভ্যাট আরোপের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিল, তাদের প্রতি নৈতিক সমর্থন জানিয়েছিলাম। সরেজমিন ছাত্রদের কাছে যেতে পারিনি, কিন্তু ফেইসবুকে এবং পত্রিকার কলামে বলিষ্ঠভাবে তাদের পে অবস্থান নিয়েছি। আমি মেডিক্যাল ভর্তি ইচ্ছুক ছাত্রদের বর্তমান দাবির প।ে পরীা বাতিল করে আবার পরীা নেয়া, বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। এখন থেকে আট-নয় বছর আগে বিসিএস লিখিত পরীার রেজাল্ট প্রকাশ করার পরেও সেই পরীার ফলাফল বাতিল করা হয়েছিল। বিসিএস প্ররীা আবার নেয়া হয়েছিল। আমার ছেলে ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। এরপর সে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ এবং মিরপুর সেনানিবাসে অবস্থিত মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি (এমআইএসটি) থেকে এমবিএ পাস করেছে। অতঃপর আমার ছেলে আন্তরিক প্রস্তুতি নিয়ে বিসিএস পরীা দিয়েছিল। কোনো প্রকার অসততার সাথে সে বা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা জড়িত হয়নি। ছেলে প্রথমবার পাস করেছিল। কিন্তু সেই বিসিএস লিখিত পরীার ফলাফল যখন বাতিল করে দেয়া হয়েছিল, তখন রাগ করে আমার ছেলেকে বললাম, আর বিসিএস দিতে হবে না। বললাম, ব্যাংকে চাকরি খোঁজ। ছেলে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসার হিসেবে প্রাইভেট সেক্টরে একটি ব্যাংকে ঢুকল।
অসততার তাৎপর
অসৎভাবে বিসিএস পাস করা এবং অসৎভাবে মেডিক্যাল ভর্তি পরীা পাস করা, দুটোই মারাত্মক অন্যায়। কিন্তু নেতিবাচক তাৎপর্য বা সমাজের ওপরে প্রভাব বিশ্লেষণ করলে মেডিক্যালের েেত্র সেটি বেশি বিস্তৃত। মেধাবিহীন প্রশ্ন-চোর একজন যুবক মেডিক্যালে ঢোকার পর অসৎভাবেই ভবিষ্যতেও পাস করবে, এরূপ প্রবণতা থাকাই স্বাভাবিক। মেধাবিহীন মেডিক্যাল ছাত্রের মাথায় মেডিক্যালের পড়ালেখা কি ঢুকবে? যদি না ঢোকে, তাহলে সে অবশ্যই অসৎভাবে বিভিন্ন পরীায় পাস করার চেষ্টা করবে। সার্টিফিকেট পাবে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করে সরকারি চাকরিতেও ঢুকবে অথবা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করবে। ওই মেধাহীন এবং অসৎভাবে পাস করা কোনো ডাক্তারের হাতে যদি কোনো রোগী পড়ে, তাহলে ওই রোগী কি নিরাপদ? আমার মতে, মোটেই নিরাপদ নয়। বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একরোখা নীতির কারণে, রাজনৈতিক গোঁ ধরার কারণে, অতি মন্দ একটি উদাহরণ বাংলাদেশের অ্যাকাডেমিক জগতে সৃষ্টি হতে চলেছে। হাজার হাজার মেডিক্যাল ভর্তি ইচ্ছুক ছাত্র আবার পরীা নেয়ার জন্য আন্দোলন করছে। সেসব ছাত্র সবাই আবার পরীা দিলেও ভর্তির সুযোগ পাবেন এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। কারণ, মেডিক্যাল কলেজে সিট সংখ্যা সীমিত। কিন্তু সৎ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অসফল হলেও সেটিই সম্মানের এবং গৌরবের বিষয়।
উপসংহার
আমি বাংলাদেশের তারুণ্যের প,ে আমি বাংলাদেশের তরুণদের সৎ ও স্বচ্ছ আশা-আকাক্সার প্রতি সম্মান রাখি, আগামী দিনের বাংলাদেশের কাণ্ডারি তরুণদের চিন্তা-চেতনায় ও কর্মে সম্মান ও গৌরব যেন প্রতিষ্ঠিত হয়, সেটি কামনা করছি। আমি একা নই, আমার মতো হাজার হাজার, লাখ লাখ সচেতন নাগরিক এরূপ কামনা করছেন বলে আমার বিশ্বাস। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টিতে আমার সহকর্মীরাও একই কামনা করছেন।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
বিষয়: বিবিধ
৯১৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন