মুসলিম জীবনে আগন্তুক
লিখেছেন লিখেছেন মুসলিম৫৫ ১৬ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০৫:২৯ রাত
নীচের লেখাটি একজন নাম না জানা বিদেশী লেখকের লেখা থেকে আপনাদের জন্য অনূদিত:
—————–
আমার জন্মের কয়েক মাস আগে, আমার বাবার সাথে একজন আগন্তুকের দেখা হয়েছিল, যে আমাদের ছোট্ট শহরে তখন নতুন এসেছিল। শুরু থেকেই আমাদের বাবা, ঐ মুখর আগন্তুকের প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট বোধ করেন এবং শীঘ্রই তাকে আমাদের সাথে এসে বসবাস করতে আমন্ত্রণ জানান। তার চেহারা, বাইরে থেকে দেখতে খুব আকর্ষণীয় মনে না হলেও, সবাই তাকে খুব তাড়াতাড়িই আপন করে নিল এবং কয়েক মাস পর পৃথিবীতে যখন আমার আগমন ঘটলো, তখন আর সবার সাথে সেও আমাকে স্বাগত জানালো। আমি যখন বড় হচ্ছিলাম, তখন, কখনো বাড়ীতে এই আগন্তুকের অবস্থান নিয়ে মনে কোন প্রশ্ন জাগেনি।
আমার কচি মনে পরিবারের সকল সদস্যের জন্য একেকটা আসন ছিল। আমার ৫ বছরের বড় ভাই ইউসুফ ছিল আমার জন্য অনুসরণীয় উদাহরণ। আমার ছোট বোন সাদিয়া, আমার খেলার সাথী ছিল – সে আমাকে বড় ভাই হবার যোগ্যতা দান করে এবং মানুষকে ”ক্ষ্যাপানোর” বিদ্যা অর্জনে সহায়তা করে। আমার বাবা-মা ছিলেন সম্পূরক ও পরিপূরক শিক্ষক – মা আমাকে আল্লাহকে ভালোবাসতে শেখান, আর বাবা শেখান কি করে আল্লাহর আনুগত্য করতে হয়। কিন্তু ঐ আগন্তুক আমাদের গল্প শোনাতো। সে অদ্ভুত সুন্দর সব হৃদয়গ্রাহী গল্প বানাতে ও শোনাতে পারতো। এডভেঞ্চার, রহস্য, কমেডি – আরো কত কি! এসবই ছিল তার দৈনন্দিন সংলাপ। প্রতিদিন বিকালে সে আমাদের গোটা পরিবারকে ঘন্টার পর ঘন্টা তার শ্রোতা হিসেবে ধরে রাখতে পারতো আর সপ্তাহান্তে, আমাদের জেগে থাকা সময়ের প্রায় সবটুকু সেই নিয়ে নিতো। আমি যদি রাজনীতি, ইতিহাস অথবা বিজ্ঞান সম্বন্ধে কিছু জানতে চাইতাম, সে তা জানতো। সে অতীত সম্বন্ধে জানতো এবং মনে হতো যে, বর্তমান সম্বন্ধেও তার সম্যক জ্ঞান রয়েছে। সে এমন সব ”জীবন্ত” ছবি আঁকতে পারতো যে, আমি প্রায়ই সেগুলো দেখে কাঁদতাম অথবা হাসতাম। সে আমাদের গোটা পরিবারের একজন বন্ধুর মত ছিল। সে আমার বাবাকে, ইউসুফকে এবং আমাকে, আমাদের জীবনের প্রথম-দেখা আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট ম্যাচে নিয়ে যায়। সে আমাদের সব সময় সিনেমা দেখতে উৎসাহ দিত এবং এমনকি, বহু নামী-দামী মানুষের সাথে যাতে আমরা পরিচিত হতে পারি, সে তারও ব্যবস্থা করে দিত।
সে অনর্গল কথা বলতে পারতো। আমার বাবা মনে হয় তাতে কিছু মনে করতেন না বা বিরক্ত হতেন না। কিন্তু, আমরা বাকীরা যখন হাঁ করে, তার বলা পৃথিবীর প্রত্যন্ত কোন অঞ্চলের গল্প শুনতাম, মা তখন মাঝে মাঝেই তার সভা থেকে উঠে যেতেন – নিজের ঘরে গিয়ে তিনি কুর’আন পড়তেন। কখনো তিনি সন্তর্পণে আমাদের বলতেন যে, নবী (সা.) বলেছেন, “কারো ঈমানের সুন্দর দিক হচ্ছে, সকল নিস্ফল কাজ-কর্ম এড়িয়ে চলা।”
এখন আমি মাঝে মাঝে ভাবি, মা কি কখনো এমন দোয়া করতেন যে, ঐ আগন্তুক যেন চলে যায়! আমার বাবা আমাদের পরিবারকে কিছু নৈতিক নিয়ম কানুনের ভিত্তিতে পরিচালনা করতেন। কিন্তু এই আগন্তুক সেগুলোকে সম্মান করার কোন প্রয়োজন বোধ করতো না। এমনিতে, আল্লাহবিরুদ্ধ কোন আচরণ আমাদের বাড়ীতে বরদাস্ত করা হতো না – আমাদের তরফ থেকে তো নয়ই, আমাদের বন্ধুদের বা বড়দের তরফ থেকেও ঐ ধরনের কোন আচরণ বরদাস্ত করা হতো না। কিন্তু আমাদের অনেকদিনের অতিথি কখনো কখনো এমন ”চার অক্ষরের” শব্দ ব্যবহার করতো, যাতে আমার কানে শীসা ঢালার অনুভূতি হতো এবং আমার বাবা তখন অস্বস্তিতে গজ গজ করতেন। তবে আমার জানা মতে, ঐ আগন্তুককে কখনো চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। আমার বাবা কখনোই মদ স্পর্শ করেননি এবং কখনো বাড়ীতে এলকোহল অনুমোদন করেননি – এমনকি রান্নার জন্যও নয়। কিন্তু ঐ আগন্তুক যেন মনে করতো যে, আমাদের, অন্য ধারার জীবন সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করা আবশ্যক। সে আমাদের প্রায়ই, বিয়ার এবং অন্যান্য মদ জাতীয় পানীয় সাধতো। সে আমাদেরকে বোঝাতো যে, সিগারেট বেশ মজার একটা জিনিস, চুরুট বেশ পুরুষালী আর পাইপ হচ্ছে ব্যক্তিত্বের প্রকাশ। সে খোলামেলাভাবে যৌনতা নিয়ে কথা বলতো। তার মতামতগুলো ছিল কখনো চাঁছা-ছোলা, কখনো ইঙ্গিতবহ, আর প্রায়শই বিব্রতকর। কিভাবে রসিয়ে রসিয়ে মেয়েদের সাথে আলাপ জমানো যায়, তাও সে আমাদের শিখিয়ে দিতো।
আমি এখন বেশ বুঝতে পারি যে, নারী-পুরুষের সম্পর্কের ব্যাপারে আমার মনে প্রোথিত প্রাথমিক ধারণাগুলো, তার দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
এখন যখন আমি পিছনে ফিরে তাকাই, তখন আমার মনে হয় যে, এটা আমাদের জন্য আল্লাহর একটা বিশেষ রহমত ও করুণার ব্যাপার ছিল যে, ঐ আগন্তুক আমাদের আরো বেশী প্রভাবিত করতে পারেনি। বার বার সে আমার বাবা-মার নৈতিক মূল্যবোধের বিরোধিতা করতো। তথাপি তাকে কদাচিৎ শাসন করা হতো বা প্রস্থান করতে বলা হতো। যখন থেকে সে আমাদের পরিবারের সাথে বসবাস শুরু করেছিল, তারপর প্রায় ৩০ বছর পেরিয়ে গেছে। এখন অবশ্য আমার বাবার কাছে সে, তার আগমনের পরের প্রথম দিককার দিনগুলোর মত প্রিয় নয়। কিন্তু তবু, এখনো, আমি যদি কখনো আমার বাবা-মায়ের শোবার ঘরে প্রবেশ করি, তবে দেখি সে এক কোণায় বসে রয়েছে – কখন কেউ তার কথা শুনবে এবং তার আঁকা ছবি দেখবে এবং সে তার যাদু দিয়ে তার শ্রোতা-দর্শককে বিমোহিত করবে, সেই অপেক্ষায়। আপনারা হয়তো তার নাম জানতে চাইবেন। আমরা তাকে টিভি বলে ডাকি।
বিষয়: বিবিধ
১২৩৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন