একজন রুহুল সাহেবের গল্প

লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মাদ ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৪:৩২:৩১ বিকাল

বিছানায় গড়াগড়ি করছিলেন রুহুল সাহেব, হাতের ব্যথাটা অনেক বেড়েছে । এমনিতেই মোটা শরীর তার উপর ফুলে যাওয়ায় হাতটা মোটা হয়ে পায়ের আকার ধারণ করেছে অনেকটা।

ডাক্তার বলেছিলেন হাতটা ব্যান্ডিজ করে নিতে কিন্তু রুহুল সাহেব তা না করে ব্যথার ঔষধ খেয়ে দিন পার করছেন।

ছুটি কাটাতে দেশে গিয়েছিলেন রুহুল সাহেব , ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফেরত এসেছেন কিছুদিন হোল।

এলাকায় রুহুল সাহেবের বেশ নামডাক, গাজি সাহেব নামে এক ডাকে সবাই চিনেন । এবার বাড়ি গিয়ে নিজ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছন মহা ধূমধামে ।

বাড়ি থেকে আসার পর নিজ কুম্পানিতে কাজ মিলেনি রুহুল সাহেবের । নতুন কাজের পরিচিত জনদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন কয়েকদিন যাবত। তেমনই একজনের বাসায় গিয়েছিলেন সেদিন, আছরের নামাজের অযু করতে গিয়ে অযুখানায় পড়ে গিয়েছিলেন, আর তাতেই ডান হাতটায় বেশ আঘাত পেয়েছেন ।

ডাক্তারের কাছে না গিয়ে বাছতে চেয়েছিলেন, কিন্তু হাতটা ফুলে কলাগাছ হয়েছে, আগত্য না গিয়ে পারলেন না । ডাক্তার দেখে দুটো এক্সরে দিয়েছেন , দুটো এক্সরের বিল বানাতেই রুহুল সাহেবের পকেট খালি হয়েছে ।

এক্সরের রিপোর্ট দেখে ডাক্তার জানালেন যে হাড়ে আঘাত লেগেছে, হাত প্লাসটার করতে হবে । কিন্তু যে পরিমাণ খরচের কথা বললেন তা পকেটে না থাকায় রুহুল সাহেব প্লাসটার না করেই ব্যথার ট্যাবলেট নিয়ে বাসায় ফিরেছেন।

কিন্তু কয়েকদিনেও হাতের ব্যাথাটা কমছেনা , ব্যথার প্রচণ্ডতায় ঘুম না আসায় বিচানায় গড়াগড়ি করছেন তিনি।

নিস্তব্ধ রাত মাঝে মাঝে গাড়ির হর্নের আওয়াজ ভেসে আসছে , আশেপাশের পরিশ্রান্ত মানুষগুলো ঘুমে অচেতন, রুহুল সাহেব একাই জেগে আছেন ।

অতীতটা আজ খুব মনে পড়ছে , সেই দুরন্ত শৈশব , উড়ন্ত কৈশোর , কত ভাবনা আর কত স্বপ্ন কোথায় যেন সব হারিয়ে ।

নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান রুহুল সাহেব , অল্প বয়সেই অনেক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন। তাই তো কৈশোর না পেরুতেই ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় পাড়ি জমিয়েছলেন প্রবাসে।

এক সময়ে ভাবতেন প্রবাস জীবনের ইতি না টেনে নিজের জীবনের সাথে কাউকে জড়াবেন না , তাই তো খুব ছোট ছোত স্বপ্ন দেখতেন তিনি । ভাবতেন ছোট একটি ঘর আর নগদ কিছু টাকা হলেই প্রবাস জীবনের ইতি টানবেন ।

কিন্তু সে ভাবনা আর বাস্তবতার মুখ দেখেনি , যাই যাই করে ছাব্বিশটি বছর কাটিয়ে দিলেন , কিন্তু কারো চাওয়াই পূরণ করতে পারেননি ।

ভাবতে ভাবতেই রুহুল সাহেব ঘুমিয়ে পড়েছলেন, মোবাইলটা বেজে উঠতেই লাপ উঠলেন।

মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখেন স্ত্রী রোশনারা বেগম ফোন করেছেন । কুশলাদি জিগ্যেস করেই বললেন ...

• আর তো কিছু জানালা না ! কোন ব্যাবস্থা কি হোল ?

o কি করব বল, চাকরী থাকলে মানুষের কাছে ধার পাওয়া যায় কিন্তু চাকরী না থাকায় ধারও পাওয়া যাচ্ছেন না ।

• কিন্তু একটা কিছু তো করতে হবে, মেয়েটার যে মুখ ছোট হয়ে থাকবে, ওর বিয়ের পর এটাই প্রথম ঈদ পড়ে যাই’ই এই ঈদে তো অবশ্যই একটা খাসী ঈদ উপহার হিসাবে পাঠাতে হবে, আমাদের সালমার কয়দিন পরেই সাফিয়ার বিয়ে হয়েছে, সাফিয়ার বাপ তার শ্বশুর বাড়িতে দুইটা খাসী উপহার পাঠিয়েছে । আমরা অনন্ত একটাও না দিলে সমাজের মানুষ আমাদের কি বলবে , আর মেয়েটাকে খোঁটা শুনতে হবে ।

আর শোন ! কালাম চাচার ফার্নিচার দোকানে যে সোফাটা বানানর বাকি ছিল সেটা বানানো শেষ হয়েছে , কালাম চাচাকে বলে একটা ভ্যানগাড়িতে করে সালমার শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি।

কালাম চাচা তার বাকি টাকাটা চেয়েছে ।

o আচ্ছা দেখি কি করা যায়, তুমি ভেব না । সোহেলের ঈদের ছুটি কয়দিন, সে বাড়ি এসেছে নাকি।

• একত্রিশ তারিখ পর্যন্ত ছুটি আছ সোহেলের, তাকেও তো যাওয়ার সময়ে কিছু টাকা দিতে হবে। সে বলেছে সামনে তার ফাইনাল পরীক্ষা , প্রাইভেট পড়তে হবে তাই এবার দুই হাজার টাকা বেশি দিতে হবে ।

o আচ্ছা, আমি চেষ্টা করছি, দোয়া রাখবা , এখন রাখছি ।

ফোন রেখে ঘড়ির দিকে তাকালেন রুহুল সাহেব , রাত সাড়ে তিনটা বাজে। কিছুক্ষণ পরই ফজরের আযান হবে । রাজ্যের চিন্তা মাথায় এসে ভর করেছে , ভেবেছিলেন মেয়েটা দিয়ে বুঝি ভারমুক্ত হবেন, ছেলেটার পড়াশুনাও শেষ পর্যায়ে , এইবার হয়ত প্রবাস জীবনের ইতি টানতে পারবেন ।

কিন্তু শেষ হয়েও যে হয় না ! সেই যৌবনের পারম্বে প্রবাস নামক যে মহাসাগরে ঝাঁপ দিয়েছেন তা বুঝি শেষ হবারই নয় ? । জীবনের কত স্বপ্নকেই ও কবর দিলেন মা-বাপ স্ত্রী-সন্তানের কথা ভেবে কিন্তু কাউকেই তো সন্তুষ্ট করতে পারলেন না । যৌবনের আগুন ঝরা দিনগুলোতে যখন আরামের বিছানায় শান্তিতে ঘুমানর কথা ছিল, তখন তিনি একাকী রাত্রিযাপন করেছেন ছোট্ট একটি শক্ত বিছানায়, ভেবেছেন এইত আর কয়টা দিন । সারাদিন পরিশ্রমের পর যখন বাসায় এসে তৈরি করা খাবার সামনে পাবার কথা ছিল, তখন রান্না করে খেতে হয়েছে, ভেবেছেন এইত আর কয়টাদিন।

রুহুল সাহেব আজ যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন, এখন আর তার জীবনের কোন স্বপ্ন নাই , কোন স্বাদ আহ্লাদও নাই .........।

ফজরের আযান হয়েছে, শোয়া থেকে উঠতে গিয়ে বুঝলেন ডান হাতটার অবস্থা অবনতি হয়েছে, বাম হাতের ওপর ভর দিয়ে উঠতেই বুখে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলেন, তারপরও উঠতে চেষ্টা করতেই ... পারলেন না , ভারী শরীরটা বিছানায় এলিয়ে পড়েছে প্রচণ্ড ধাক্কায়, মুখ দিয়ে ক্ষীণ একটা আওয়াজ বেরিয়ে এসেছে শুধু ...... ।

বিষয়: বিবিধ

১০১৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File