কুরআনের আলো Radio Tehran Bangla
লিখেছেন লিখেছেন মুন্সী কুতুবুদ্দীন ০৯ নভেম্বর, ২০২১, ০৬:০৩:৫০ সন্ধ্যা
সূরা আল আহযাব: আয়াত ৬৩-৬৮ (পর্ব-১৬)
কুরআনের আলো অনুষ্ঠানের আজকের পর্বে সূরা আল আহযাবের ৬৩ থেকে ৬৮ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৬৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
يَسْأَلُكَ النَّاسُ عَنِ السَّاعَةِ قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ اللَّهِ وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّ السَّاعَةَ تَكُونُ قَرِيبًا (63)
“(হে রাসূল!) লোকেরা আপনাকে কেয়ামত (সংঘটিত হওয়ার সময়) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, এর জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছেই রয়েছে। আপনি কি করে জানবেন? হয়ত কেয়ামত নিকটেই থেকে থাকবে।” (৩৩:৬৩)
আরবের কাফির ও মুনাফিকরা যখন দেখল কিয়ামত অস্বীকার করার মতো কোনো যুক্তি তাদের কাছে নেই তখন তারা নও মুসলিমদের ঈমান দুর্বল করার জন্য আল্লাহর রাসূলের কাছে এই প্রশ্ন তোলে, তিনি যদি সত্যি বলে থাকেন তাহলে যেন বলে দেন, কিয়ামত কবে সংঘটিত হবে?
এখানে বলে রাখা ভালো যে, কোনো ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সময় জানা না থাকার অর্থ এই নয় যে, ওই ঘটনা ঘটবে না। আমরা সবাই জানি যে, একদিন আমাদের মৃত্যু হবে। কিন্তু কেউ জানে না সে কখন মারা যাবে। এখন আমরা আমাদের মৃত্যুর সময় জানি না বলে কি একথা বলা যাবে যে আমাদের মৃত্যু হবে না?
আবার আল্লাহর রাসূল যদি বলতেন যে, এক হাজার বছর পর কিয়ামত সংঘটিত হবে তাহলে কি প্রশ্নকারীরা তার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য এক হাজার বছর বেঁচে থাকত?
আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হচ্ছে, কিয়ামত কবে সংঘটিত হবে সে জ্ঞান একমাত্র আল্লাহই রাখেন। আল্লাহর রাসূল এ বিষয়টি জানেন না। তাঁকে আল্লাহ এ খবর জানাননি। মুমিন ব্যক্তিদের কর্তব্য হচ্ছে, শিগগিরিই কিয়ামত সংঘটিত হবে বলে ধরে নিয়ে নিজেকে সেই ভয়াবহ দিনের জন্য প্রস্তুত করা।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দু’টি বিষয় হচ্ছে:
১. কিয়ামতের সময় সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান না থাকলেও কিয়ামত যে একদিন সংঘটিত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
২. আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর পর আল্লাহর বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। মৃত্যুর সময় জানা জরুরি নয় বরং মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা বেশি জরুরি।
সূরার ৬৪ থেকে ৬৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
إِنَّ اللَّهَ لَعَنَ الْكَافِرِينَ وَأَعَدَّ لَهُمْ سَعِيرًا (64) خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا لَا يَجِدُونَ وَلِيًّا وَلَا نَصِيرًا (65) يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُولُونَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللَّهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولَا (66)
“নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তাদের জন্যে জ্বলন্ত আগুন প্রস্তুত রেখেছেন।” (৩৩:৬৪)
“সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে এবং (নিজেদের রক্ষা করার জন্য) কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না।” (৩৩:৬৫)
“যেদিন আগুনে তাদের মুখমণ্ডল ওলট পালট করা হবে; সেদিন তারা (অনুতাপ প্রকাশ করে) বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করতাম।” (৩৩:৬৬)
এর আগের আয়াতের কাফেরদের সংশয় সৃষ্টিকারী প্রশ্ন সম্পর্কে আলোচনার পর এই তিন আয়াতে বলা হচ্ছে: যারা মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস দুর্বল করার কাজে লিপ্ত এবং যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে হাল্কা করে দিতে চায় তারা পার্থিব জীবনে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে এবং পরকালে কঠিন আজাবের মধ্যে পতিত হবে। সেখানে তারা এতটা আজাবের সম্মুখীন হবে যে, একথা বলে উঠবে- যদি ধর্ম, আল্লাহ ও রাসূলের সঙ্গে এ ধরনের জঘন্য আচরণ না করতাম তাহলে আমাদেরকে এই কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হতো না। কিন্তু সেদিনের অনুতাপ কোনো কাজে আসবে না। কারণ, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তওবা করার পথ বন্ধ হয়ে গেছে এবং পৃথিবীর জীবনে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। এ ছাড়া, কিয়ামতের ভয়াবহ বিপদের দিনে তাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করার জন্য কোনো সাহায্যকারীও থাকবে না।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:
১. আল্লাহর প্রতি গোঁয়ার্তুমি ও বিদ্বেষ থেকে যে কুফর বা অবিশ্বাস তৈরি হয় তার ফলে দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহর চরম অভিশাপের শিকার হতে হয়।
২. দুনিয়ার জীবনে পরস্পরকে সাহায্য করা সম্ভব হলেও কিয়ামতের দিন কেউ কাউকে সাহায্য করতে বা আজাব থেকে মুক্তি দিতে পারবে না।
৩. দুনিয়া ও আখেরাতে মুক্তি ও সৌভাগ্য অর্জনের একমাত্র উপায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা। এর অন্যথায় কিয়ামতের দিন অনুতপ্ত হতে হবে।
সূরা আহযাবের ৬৭ ও ৬৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلَا (67) رَبَّنَا آَتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا (68)
“তারা আরও বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা আমাদের নেতা ও বড়দের আনুগত্য করেছিলাম, অতঃপর তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল।”(৩৩:৬৭)
“হে আমাদের পালনকর্তা! তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং তাদেরকে মহা অভিসম্পাত করুন।”(৩৩:৬৮)
জাহান্নামের দুঃসহনীয় শাস্তি দেখার পর পাপী ব্যক্তিরা তাদের পথভ্রষ্ট হওয়ার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অভিশাপ দিতে থাকবে; যদিও এ বক্তব্য তাদের কোনো উপকারে আসবে না। কারণ, পার্থিব জীবনে তারা তাদের নেতাদের আনুগত্য না করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করতে পারত। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এসব অপরাধী ব্যক্তি কিয়ামতের দিন তাদের নেতাদের জন্য দ্বিগুণ শাস্তি ও মহা অভিসম্পাত কামনা করবে। অথচ সে আবেদন মঞ্জুর হলেও তাদের দুই দলকেই দ্বিগুণ শাস্তি দেয়া হবে। কারণ, যারা কিয়ামতের দিন নেতাদের জন্য দ্বিগুণ শাস্তি কামনা করবে তাদের উদ্দেশ করে আল্লাহ তায়ালা সূরা আরাফের ৩৮ নম্বর আয়াতে বলেছেন: এই দুই ধরনের ব্যক্তিদের জন্যই শাস্তি হবে দ্বিগুণ। কাফের ও জালিম নেতাদের শাস্তি দেয়া হবে সাধারণ মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ শাস্তি পাবে এ ধরনের নেতাদের আনুগত্য করার জন্য; কারণ, তারা আনুগত্য না করলে এসব নেতা কুফর ও জুলুম করার অবকাশ পেত না।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. কিয়ামতের দিন পাপী ব্যক্তিরা তাদের অপরাধের ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর এবং অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হবে না।
২. নেতাদের অন্ধ অনুসরণ করা শরিয়ত এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে গ্রহণযোগ্য নয়। এর ফলে অনুতাপ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না।
৩. যারা ভুল ও অন্যায় সংস্কৃতি তৈরি করে মানুষকে পথভ্রষ্ট করে তাদের ওপর এই ভুল ও অন্যায়ের ফলাফলের গোনাহ চাপিয়ে দেয়া হয়। মৃত্যুর পরও এই ধারা চলতে থাকে। #
বিষয়: বিবিধ
৫১৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন