নবী-জীবনের সোনালী অধ্যায়-২ তুমি চলে এসো, একশত উট পাবে
লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ সাদিক হুসাইন ৩১ অক্টোবর, ২০১৬, ০১:১৪:০০ রাত
মালেক ইবন অউফ আন নাসরি। হাওয়াযিন বংশের অত্যন্ত সাহসী ও নির্ভীক এক কমান্ডার। হুনায়নের যুদ্ধে মুশরিক বাহিনীর সর্দার ছিল সে। বনি সাক্বিফের সহায়তায় পঁচিশ হাজার সৈন্য সমেত হুনায়নের ময়দানে উপস্থিত হয়েছিলো।
তৎকালিন কাফির-মুশরিকদের মাঝে তার সম্মান এমন পর্যায়ের ছিল যে, সে যখন এ মর্মে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে, সম্প্রদায়ের সবাই নিজেদের সাথে নিজ নিজ সম্পদ, গৃহপালিত প্রাণী , নারী ও শিশুদেরও নিয়ে রণাঙ্গনে উপস্থিত হবে- সবাই একবাক্যে মেনে নিল তার এ কথাকে। কেউ কেউ বিরোধিতা করেছে। কিন্তু সে তার কথার উপর অটল ছিল।
অনুসারীদের উদ্দেশ্যে মালেক ইবন অউফ বলল, আমাদের বাহিনীকে মনে রাখতে হবে, এই ময়দানেই অটল থাকতে হবে আমাদেরকে। পলায়ন করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ পালিয়ে যাদের কাছে যাবো তারা তো আমাদের সঙ্গেই আছে। তার এ যুদ্ধকৌশল বলতে গেলে খুবই সফল ছিল। এ কারণেই যুদ্ধের শুরুর দিকে মুসলমানরা পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছিলো। যুদ্ধের ভয়াবহতায় পালাতে থাকে তারা।
আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ দয়া ও অনুগ্রহই বলা যায়, রাসূলুল্লাহ সা. এর বীরত্ব ও সাহসিকতার ফলে পলায়নরত মুসলমানরা ফিরে আসেন। এমন দৃঢ়তার সঙ্গে লড়াই করেন যে, একসময় আল্লাহ তা‘আলা মুসলমানদেরকে বিজয় দান করেন। বনি সাক্বিফ ও বনি হাওয়াযিন অবস্থা বেগতিক দেখে জান নিয়ে পালিয়ে গেল। সেই পালিয়ে যাওয়াদের মধ্যে ওই বাহিনীর কমান্ডার মালেক ইবন অউফও ছিল।
পালিয়ে সে তায়েফের বনি সাক্বিফের দুর্গে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এরই মধ্যে তার গোত্র বনি হাওয়াযিন ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে ইতিবাচক চিন্তা নিয়ে রাসূলুল্লাহ সা. এর দরবারে উপস্থিত হয়। আল্লাহর রাসূল সা. তাদের নারী ও শিশুদের ফিরিয়ে দিলেন।
সম্মানিত পাঠক! একটু চিন্তা করুন। একজন কমান্ডার যে যুদ্ধের ময়দানে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেছে, তার কী অবস্থা হয় ? সে তো লোকজনকে মুখ দেখাবার যোগ্য থাকে না। মালেক ইবন অউফের অবস্থা এমন হয়ে গেল যে, সে নিজ গোত্র থেকে পৃথক হয়ে বনি সাক্বিফের দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর বেঁচে রইল। তার নিকট যেমন কোনো সম্পদ ছিলো না,
ছিলো না গোত্রের কোনো লোকজন। তার তো বনি সাক্বিফের পক্ষ থেকেও আশংকা ছিলো, হুনায়নের যুদ্ধে পরাজয়ের জন্য দায়ী সাব্যস্ত করে তাকে আবার হত্যা করে কিনা।
সুপ্রিয় পাঠক! এই সেই মালেক ইবন অউফ। একজন পরাজিত কমান্ডার। কাউকে মুখ দেখাবার যোগ্যতাও নেই তার। তার কারণেই পরাজয় ঘটেছে- এমন কথা বলে বলে মানুষ তাকে ঘৃণা করছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে তার, যেন কোথাও কেউ নেই।
কিন্তু নাহ্। এমন এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন সেখানে যিনি তার ব্যাপারে কল্যাণকর ধারণা পোষণ করেন। তার সাথে সহমর্মিতা ও উত্তম আচরণের জযবা রাখেন। এই ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন দয়ালু নবী হযরত মুহাম্মদ সা.। তিনি সা. মালেক ইবন অউফের গোত্রের লোকজনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মালেক ইবন অউফ কোথায়?’ তারা উত্তর দিল, সে তো তায়েফের দুর্গে। লোকজনের কাছ থেকে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে। বর্তমানে সে নিজের ভবিষ্যত নিয়েই পেরেশান।
রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, (أخبروا مالكا أنه إن أتاني مسلما) ‘মালেককে জানিয়ে দাও, সে যদি মুসলমান হয়ে আমার কাছে আসে, (رددت عليه أهله وماله) ‘আমি তার পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ ফিরিয়ে দেব।’
(وأعطيته مائة من الإبل) ‘এবং তাকে একশত উটও প্রদান করব।’
সম্মানিত পাঠক! কেউ কি নিজের প্রাণের শত্রুর সাথে এমন ব্যবহারের কথা চিন্তাও করতে পারে? এমন এক বাহিনীর কমান্ডার যিনি সম্প্রতি বিজয় অর্জন করেছে, নিজের দুশমন সম্পর্কে এরকম ইতিবাচক ভাবনা পোষণ করতে পারে? নাহ। পারে না।
এটাই তো আমাদের প্রিয় রাসূল সা.এর চরিত্র, যিনি দুশমনকেও বুকের সাথে মিলাচ্ছেন।
মালেক ইবন অউফের নিকট রাসূলুল্লাহ সা. এর পয়গাম পৌঁছে যায় একসময়। তার মনে হলো, পয়গামটা যেন তার হৃদয়েরই প্রতিধ্বনি। যে ধরনের বিপদ ও অস্থিরতার মধ্যে সে নিমজ্জিত ছিল তার সমাধানও ছিল ইসলাম গ্রহণের মধ্যে। সে কাল বিলম্ব না করে দ্রুত তায়েফ থেকে ছুটে যায় রাসূলুল্লাহ সা.এর দরবারে। উপস্থিত হয়ে ইসলাম কবুল করে ধন্য হয়।
আল্লাহর রাসূল সা. এর চরিত্র দেখুন, তিনি মালেক ইবন অউফের উপর কোনো ধরনের শর্ত আরোপ করেন নি। তাকে তিরস্কার, ভালো-মন্দ কিংবা কোনো ধরনের জিজ্ঞাসাবাদও করেন নি। বরং তিনি (সা.) কল্পনার চাইতেও ভালো আচরণ করেছেন তার সাথে। পরবর্তীতে মালেক ইবন অউফকে দ্বিতীয়বার বনি হাওয়াযিনের সর্দার নিযুক্ত করা হয় এবং তায়েফ জয়ের দায়িত্বও সোপর্দ করা হয় তাকে।
(আস সীরাতুন নববিয়্যা, ইবন হিশাম: ৪/১৩৪। আল ইসাবা: ৫/৫৫০, ৫৫১। উসদুল গা’বা:৫/৩৮। আস সীরাতুন নববিয়্যাহ, মাহদি রিযকুল্লাহ: ৬০০। আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ: ৪/৬৩২, ৬৩৩।)
(সংকলিত ও অনুদিত)
বিষয়: বিবিধ
১১৬১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন