লাশের রাজনীতি
লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ সাদিক হুসাইন ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৭:০৮:৪৮ সন্ধ্যা
২৪ সেপ্টেম্বর ঘটে যাওয়া সৌদি আরবের মিনার মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে সৌদি ও সৌদি বিরোধী শিবিরের মধ্যে শুরু হয়েছে ‘লাশের রাজনীতি’। যা খুবই দুঃখজনক। পক্ষে-বিপক্ষে অনেক খবর ফলাও করে প্রচারিত হচ্ছে বিশ্ব মিডিয়ায়। এর কারণ নিয়ে একেকজন একেক কথা বলছেন। কেউ বলছেন, কতিপয় আফ্রিকান হাজিদের উচ্ছৃঙ্খলতার কারণে এমনটা ঘটেছে। কেউ বলছেন, সৌদি যুবরাজের গাড়িবহরের পথ সুগম করতে পুলিশ হাজিদের চলাচলের একটা পথ বন্ধ করে দিলে পদপৃষ্ঠের এ দুর্ঘটনা ঘটে। হজ্ব থেকে ফিরত কোনো কোনো বাংলাদেশী হাজি বলেন, পথে তাপদাহের তীব্রতা কমানোর জন্য উপর থেকে ছিটানো পানিতে পথ পিচ্ছিল হয়ে যায়। পরে ওই পিচ্ছিল পথে হাজিদের মাত্রারিক্ত ছাপ বাড়ে এবং ঘটনাক্রমে ওই পথে একসময় বৈদ্যুতিক তার পড়লে বিদ্যুৎ স্পৃশ্য হয়েই এতগুলো মানুষের প্রাণহানি ঘটে। কেউ বলছেন, যেহেতু আইএসের পক্ষ থেকে অনেকে অনুমতি চেয়ে হজ্বের আসার সুযোগ পায়নি এ বছর, তাদের হয়েই কোনো সংঘবদ্ধ গ্রুপ মিনা থেকে জামারাতে যাওয়ার পথে সাধারণ হাজিদের জন¯্রােতে প্যানিক সৃষ্টি করে। আর তাতেই হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে পদদলিত হয়ে এ বিয়োগান্তক হতাহতের ঘটনা ঘটে। আবার কেউ কেউ বলছেন, মুযদালিফা থেকে জামারাতে যাবার পথগুলো তুলনামূলক সরু। ওই সরু পথ দিয়ে পার্শবর্তী তাবুতে আগুন লাগার রিউমার ছড়িয়ে পড়লে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। পরক্ষণেই শুরু হয় প্রচন্ড ধাক্কাধাক্কি ও হুড়–হুড়ি। এতেই ঘটে যায় স্মরণকালের এ হৃদয়বিদারক ঘটনা।
বিশ্লেষকদের মতে, মূলত: একটি একমুখী রাস্তায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় দুই বিপরীত দিক থেকে আসেন হাজিরা, যাঁদের অনেকেরই কাঁধে ভারী ব্যাগ এবং অনেকেই দ্রুত প্রতীকী শয়তানের দিকে পাথর ছুড়তে জামারাত এলাকায় যেতে অত্যুৎসাহী, তাঁরা মুখোমুখি হওয়ার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে বলে প্রতীয়মান হয়। এদিকে মিনায় পদপৃষ্ঠ হয়ে নিহতের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার বলে দাবি করেছে নাইজেরিয়া, পাকিস্তান ও ইরান। আর এ দুর্ঘটনার জন্য তারা দায়ী করেছে সৌদি সরকারের অব্যবস্থাপনাকে।
সৌদি আরবের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী, বিশেষ করে ইরান সরাসরি সৌদি আরবকে এই দুর্ঘটনার জন্য অভিযুক্ত করেছে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, উভয় দেশের গণমাধ্যমও নিজ নিজ সরকারের ভাষ্য বড় আকারে তুলে ধরা অব্যাহত রেখেছে। সৌদি গেজেট ও আরব নিউজ জোর দিয়ে লিখেছে যে, ৩০০ ইরানি হাজি নিয়ম ভেঙে চলাচল করতে গিয়েই এই দুর্ঘটনার জন্ম দিয়েছেন। ইরানি দূতাবাসের সুত্রের বরাতে প্রদত্ত ওই তথ্যের পক্ষে অনেকে নিহতদের মধ্যে প্রায় ১৩৪ জন ইরানি হাজির সংখ্যাকে যুক্তি হিসেবে দেখান। সরেজমিন থেকে ঘুরে আসা কেউ কেউ এটাও বলছেন, পুরো ঘটনাই ইরানিরা ঘটিয়েছে। নিজেদের লোকদের প্রাণ দিয়ে হলেও তারা এই দুর্ঘটনাটি ঘটিয়েছে বর্তমান সৌদি বাদশাহকে ব্যর্থ করার জন্য। অনেকটা নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করার মতো। কারণ, ইয়েমেনে চলছে সৌদি বনাম ইরান প্রক্সি যুদ্ধ। সৌদি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই এই উদ্যোগ নিয়েছে ইরান। এছাড়া প্রয়াত বাদশাহ আবদুল্লাহ ইরানি শিয়াদের ব্যাপারে কিছুটা উদার থাকলেও বর্তমান বাদশাহ সালমান শিয়াদের ব্যাপারে কঠোর। তবে সৌদি মিডিয়ার অভিযোগ সত্য ধরে নিলেও অনেকের মতে তা যথাযথ নিরাপত্তার প্রশ্নটিকেই সামনে আনতে পারে। কারণ, কথিত ইরানি ৩০০ হাজির মতো অন্য অনেক দেশের হাজিদের দল এভাবে ‘ভুলক্রমে’ নিয়ম ভঙ্গ করতে পারে। আর তা যদি এত বড় মানব বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তা প্রকারান্তরে নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতাকেই নির্দেশ করে। ব্যবস্থাপনার দিকটি যে নাজুক, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। এপির একজন সাংবাদিক দুর্ঘটনার ১০ ঘণ্টার বেশি সময় পরেও মরদেহ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেছেন। অনেকে বলেন, সৌদি আরব হজ ব্যবস্থাপনার জন্য গৌরবান্বিত ছিল। সৌদি বাদশাহর একটি আনুষ্ঠানিক খেতাব হলো, খাদেমুল হারামাইন আল শরিফাইন তথা ‘কাস্টডিয়ান অব দ্য টু হলি মস্কস’। কিন্ত এই গৌরব ম্লান হয়ে গেছে এই অব্যবস্থাপনায়।
সাধারণ হাজিদের কথা হলো, ঘটনা যেভাবেই ঘটুক। ঘটেছে। নিতান্ত মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। এটাই সত্য। এটা নিয়ে যেন কেউ রাজনীতিচর্চা না করে। এতগুলো হাজির বিয়োগান্তক বিদায় যেন নোংরা রাজনীতির শিকার না হয়। কোনো একটি সুনির্দিষ্ট কারণেই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে নিশ্চয়ই। যারাই ঘটিয়েছে, আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। তদন্তে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে, যথাযথ ক্ষতিপূরণ দাবি করছি। এখানে কার কতটুকু দায়িত্ব, দায়ভার, অবহেলায়, কিংবা ষড়যন্ত্র.. যাই থাকুক। সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এর একটা সুরাহা হওয়া দরকার। এবং আগামিতে এমন মর্মান্তিক ঘটনা যেন আর না ঘটে সেজন্য বিহিত ব্যবস্থা নেয়া একান্ত প্রয়োজন। অন্যথায়, হজ্বে যাওয়াটা মানুষের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়াবে।
বিষয়: বিবিধ
১০৯২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন