ভূমিকম্প: একজন আস্তিকের সরল বিশ্লেষণ

লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ সাদিক হুসাইন ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৬:১৬:৪১ সন্ধ্যা

বিজ্ঞানীরা বলেন, ভূমিকম্প এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা মুহূর্তকালের মধ্যে কোনো রকম পূর্বাভাস ছাড়াই বদলে দিতে পারে একটি দেশ বা ভূখন্ডের পুরো মানচিত্র। এ দুর্যোগ প্রতিরোধের উপায় আজ পর্যন্ত মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি। ফলে দুর্যোগপূর্ব প্রস্তুতিই এক্ষেত্রে একমাত্র ভরসা। ভূমিকম্পের মতো একটি পূর্বাভাসবিহীন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার মতো মজবুত অর্থনীতি আমাদের না থাকায় কিভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত থাকা যায়, সেটাই ভাবতে হবে আমাদের।

সুতরাং অবিশ্বাসী নাস্তিকরা যাই বলুক, এক্ষেত্রে যে মানুষমাত্রই অসহায় এ কথা তারাও বিলক্ষণ জানে। আর আমরা যারা আস্তিক, ঈমানদার, সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর নবী-রসূল এবং যুগে যুগে অবতীর্ণ ঐশি গ্রন্থসমূহে বিশ্বাসী তাদের জন্যে তো ভাবনার অনেক কিছুই রয়েছে এ ক্ষেত্রে। পৃথিবীর বিশুদ্ধতম গ্রন্থ, সর্বশেষ আসমানি কিতাব পবিত্র কুরআনে উপরোক্ত প্রশ্নসমূহের সুন্দরতম উত্তর রয়েছে, রয়েছে আগামী দিনের দিকনির্দেশনা। আসুন শুনি, আসমান-জমিনের মালিক মহান আল্লাহ কি বলেন এ বিষয়ে। ইরশাদ হয়েছে:

- ‘স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সূরা আর-রূম: ৪১)

- তোমাদের উপর যে সব বিপদ-আপদ পতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি (আল্লাহ) তোমাদের অনেক গোনাহ ক্ষমা করে দেন। তোমরা পৃথিবীতে পলায়ন করে আল্লাহকে অক্ষম করতে পারবে না এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোন কার্যনির্বাহী নেই, সাহায্যকারী নেই।’(সূরা আশ-শূরা:৩০-৩১)

- আল্লাহর নির্দেশ ব্যতিরেকে কোন বিপদ আসে না এবং যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে, তিনি তার অন্তরকে সৎপথ প্রদর্শন করেন। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সম্যক পরিজ্ঞাত।’ (সূরা তাগাবুন: ১১)

- ‘প্রত্যেককেই তার অপরাধের কারণে পাকড়াও করেছি। তাদের কারও প্রতি প্রেরণ করেছি প্রস্তরসহ প্রচন্ড বাতাস। কাউকে পেয়েছে বজ্রপাত, কাউকে আমি বিলীন করেছি ভূগর্ভে এবং কাউকে করেছি নিমজ্জিত। আল্লাহ তাদের প্রতি যুলুম করার ছিলেন না। কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি যুলুম করেছে।’ (সুরা আনকাবূত:৪০)

- ‘আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। আল্লাহ যখন কোন জাতির উপর বিপদ চান, তখন তা রদ হওয়ার নয় এবং তিনি ব্যতীত তাদের কোন সাহায্যকারী নেই। তিনিই তোমাদেরকে বিদ্যুৎ দেখান ভয় ও আশার জন্যে এবং উত্থিত করেন মেঘমালা। তাঁর প্রশংসা পাঠ করে বজ্র এবং সব ফেরেশতা সভয়ে। তিনি বজ্রপাত করেন, অত:পর যাকে ইচ্ছা তাকে তা দ্বারা আঘাত করেন; তথাপি তারা আল্লাহ সম্পর্কে বিতন্ডা করে। অথচ তিনি মহা শক্তিশালী।’(সূরা রাদ:১১-১৩)

-. ‘গুরু শাস্তির পূর্বে আমি অবশ্যই তাদেরকে লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে। যে ব্যক্তিকে তার পালনকর্তান আয়াতসমূহ দ্বারা উপদেশ দান করা হয়, অত:পর সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার চেয়ে যালেম আর কে? আমি অপরাধীদেরকে শাস্তি দেব।’ (সূরা সিজদা:২১-২২) অর্থাৎ আল্লাহ পাক কখনও মানুষকে তাদের কৃত পাপের জন্য সাবধান করে দেয়ার উদ্দেশে ইহকালে তাদের উপর নানাবিধ দুঃখ-যন্ত্রণা, দুর্যোগ, রোগ-ব্যাধি চাপিয়ে দেন, যেন তারা সতর্ক হয়ে পাপ থেকে ফিরে আসে এবং পরকালের কঠিনতম শাস্তি থেকে অব্যাহতি পেতে পারে।

অবশ্য যেসব লোক এরূপ দুর্যোগ-দুর্বিপাক সত্ত্বেও আল্লাহর প্রতি ধাবিত না হয়- তাদের পক্ষে এটা দ্বিগুণ শাস্তি, (একটা) দুনিয়ায় নগদ, (দ্বিতীয়টা) পরকালের কঠিনতম শাস্তি। কিন্তু পুত: পবিত্র ও নেক্কার লোকের উপর যে বিপদাপদ আসে, তাঁদের ব্যাপার এদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। এগুলো তাঁদের পক্ষে পরীক্ষা স্বরূপ- যার মাধ্যমে তাঁদের মর্যাদা উন্নত হতে থাকে। যার লক্ষণ ও পরিচয় এই যে, এরূপ বিপদ-আপদ ও রোগ-ব্যাধির সময়ও তাঁরা আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে এক প্রকারের আত্মিক শান্তি ও স্বস্তি লাভ করে থাকেন।

প্রসিদ্ধ সাহাবি হযরত আনাস ইবন মালিক রা. বলেন, একদা তিনি ও জনৈক ব্যক্তি মা আয়েশা রা.এর দরবারে প্রবেশ করেন। লোকটি বলল, হে উম্মুল মু’মিনিন, আমাদের ভূমিকম্প সম্পর্কে একটু বলুন। মা আয়েশা রা. বললেন, লোকেরা যখন যিনা-ব্যভিচারকে বৈধ করে নেয়, মদ পান করে, গান-বাজনায় লিপ্ত হয়। তখন আসমানে আল্লাহর গায়রত জেগে উঠে। তখন তিনি জমিনকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘হে জমিন, প্রকম্পিত হও। এতে মানুষ যদি তাওবা করে এবং পাপাচার থেকে ফিরে আসে তো ভাল। অন্যথায় তাদের উপর ধ্বসে পড়ো।’ লোকটি প্রশ্ন করে, হে উম্মুল মু’মিনিন, এটা কি তাদের জন্য আযাবস্বরূপ? জবাব দিলেন, বরং মু’মিনদের জন্য উপদেশ ও রহমত আর কাফিরদের বেলায় এটা আল্লাহর অসন্তুষ্টি, আযাব ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।’ (আল-মুস্তাদরাক আলাস সাহীহাইন)

ইমাম তিরমিযি রহ. হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। আবু হুরায়রা রা. রাসূলুল্লাহ সা. এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘যখন কোনো জাতির মধ্যে যুদ্ধলব্ধ সম্পদকে পুঞ্জীভূত করা হবে, আমানতকে মালে গণিমত মনে করা হবে, যাকাতকে অর্থদন্ড জ্ঞান করা হবে, জ্ঞানার্জন করা হবে দীন নেই এমন লক্ষ্যে, পুরুষ আপন মায়ের নাফরমানি করে স্ত্রীর আনুগত্য করবে, বন্ধুকে কাছে টেনে নিবে আর জন্মদাতা পিতাকে দূরে সরিয়ে দিবে, মসজিদে উচ্চস্বরে আওয়াজ করা হবে, গোত্রের নেতৃত্ব দিবে পাপীষ্ট লোক, জাতির নেতা হবে জাতির নিকৃষ্ট ব্যক্তি, মানুষকে সম্মান করা হবে তার অনিষ্ট্যের ভয়ে, গায়িকা-নর্তকীরা প্রকাশ পাবে, গান-বাজনার প্রচলন ঘটবে, মদপান করা হবে, এই উম্মতের শেষের লোকেরা পূর্ববর্তী লোকদের অভিশাপ দিবে, তখন তারা যেন অপেক্ষা করে লালবায়ু, ভূমিকম্প, ভূমিধ্বস, ..ইত্যাদি আল্লাহর নিদর্শনসমূহের। তা একের পর এক এমন ধারাবাহিকভাবে দেখা দিবে যেমন তসবিহর সূতা ছিড়ে গেলে দানাগুলো একের পর গড়িয়ে পড়তে থাকে।’ (সুনান তিরমিযি)

চলতি বছরের এপ্রিলে স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটে গেল প্রতিবেশী দেশ নেপালে। এতে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা রয়েছে। আমরা জানি, মনভুলানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ নেপাল। তবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দুর্বল অর্থনীতিরও দেশ। তাদের আয়ের একটি বড় অংশই আসে পর্যটন খাত থেকে। মুসলিম বিশ্লেষকরা বলেন, আল্লাহই ভালো জানেন, তবে সাধারণত যেসব দেশ পর্যটনশিল্পের উপর ভিত্তি করে অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে অভ্যস্ত সেখানে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে উল্লেখিত ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সবগুলো কারণই বিদ্যমান থাকে। আনন্দ-বিনোদনের নামে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, মদ্যপান, ওপেন কনসার্ট, উম্মুক্ত সী বিচে নারী-পুরুষের উদম দেহে সূর্যস্নান ইত্যাদি সব। মোটকথা, আল্লাহর নাফরমানির সব আয়োজন থাকে সেখানে। ২০০৪ সালে ইন্দোনেশিয়ায় ভয়াবহ সুনামিসহ যে ভূমিকম্প হয়েছিল তার পিছনেও একই কারণ ছিল বলে মনে করেন তারা। ওই সুনামিতে ২ লক্ষ ৩০ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল। কিন্তু আত্মভোলা মানুষ জানে না, যার উপর ভর করে স্রষ্টাকে ভুলে যায়, ভয়াবহ ভুমিকম্পে মুহূর্তেই তার সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়। যা আবার ঘটে উঠতে সময় লাগে বছরের পর বছর। ভয়াবহ ভুমিকম্পে বিপর্যন্ত নেপালেরও এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন নেপালের সাবেক অর্থমন্ত্রী।

বাস্তবত গত ১৫ বছরে যে কয়টি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে ২৫ এপ্রিল শনিবারেরটি তার অন্যতম । এ পর্যন্ত বড় ধরনের যেসব ভূমিকম্প হয়েছে তার আংশিক হলেও বাংলাদেশে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। তাই সময় থাকতেই সতর্ক হওয়া উত্তম। একটি মুসলিমপ্রধান দেশ হয়েও বাংলাদেশের মাটিতে সম্প্রতি পাপের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। হাদিসে বর্ণিত এমন কোনো অপরাধ নেই যা এই মাতৃভূমিতে আজকাল সংঘটিত হয় না। আসুন, কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে সবধরনের পাপ থেকে ইস্তিগফার করি, তাওবা করি। দুর্যোগের বাহ্যিক নিয়ম-কানুন মেনে সবাই মিলে সমাজটাকে পরিশুদ্ধ করি। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য গড়ে তুলি এক সুন্দর নিরাপদ আবাসভূমি। আল্লাহ সবার সহায় হোন।

বিষয়: বিবিধ

১২৮৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

340434
০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত ০৮:০৪
শেখের পোলা লিখেছেন : ভাল লাগল৷ ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File