দর্শনের ইতিহাসকে কেন আবার নতুন করে লেখা প্রয়োজন?

লিখেছেন লিখেছেন খালিদ ইমদাদ ১৪ অক্টোবর, ২০১৮, ০৯:০৯:০১ রাত



বর্তমান সময়ে বিশেষ করে মুসলিম সমাজে দর্শন শাস্রের চর্চা নেই বললেই চলে। যতটুকুই বা আছে সেটা সম্পূর্ণ পাশ্চাত্যের দর্শন। ফলশ্রুতিতে যারা দর্শন নিয়ে চিন্তা করেন তারা দর্শনকে মুক্তির পথ বলে বিবেচনা করে থাকেন। তবে দর্শন শাস্রের বিভিন্ন পরিভাষা, দার্শনিকদের মধ্যকার বিভিন্ন বিতর্ককে বাদ দিয়ে যেটা আগে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন তা হল, শিক্ষার্থীদেরকে সঠিক চিন্তা এবং হিকমাহ শিক্ষা দেওয়া। আমাদের মুসলিম দেশ সমূহে দর্শনের নামে যা পড়ানো হয় এক কথায় বলতে গেলে পুরোপুরি ভাবে পাশ্চাত্য দর্শন এবং তাদের ইতিহাস। পাশ্চাত্যের দর্শনকে এত মূল্যবান মনে করে যুগ যুগ ধরে পড়ানোর ফলেও কেন পাশ্চাত্যের দার্শনিকদের মত আমাদের দেশে বা মুসলিম দেশ সমূহে কেন এখনো একজন বড় মাপের দার্শনিক উঠে আসেনি সেটার উত্তর আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে।

আজ আমরা যে পাশ্চাত্যের দর্শনের নামে পাশ্চাত্যের চিন্তার ইতিহাস ও তার বিকাশকে আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে গুলে খাওয়াচ্ছি এর পরিনতি কি হচ্ছে তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? এই জন্য আমার কাছে মনে হয় আজ সময় এসেছে তুলনামূলক দর্শন পাঠ করার।

আজকে আমাদের দেশ বা মুসলিম দেশ সমূহের সিলেবাস সমূহ রয়েছে তা ব্রিটেন বা অ্যামেরিকা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। তারা অনুমতি দেওয়ার আগে কারোর পক্ষেই কোন সিলেবাস তৈরি করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে একটি কাহিনী না বললেই নয়, গত বছর বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দলের অনুবাদক হিসেবে তুরস্কের সবচেয়ে বড় শিক্ষক ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তো তিনি আলোচনার একপর্যায়ে তুরস্কের শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি সমূহ এক এক করে তুলে ধরছিলেন। আর প্রতিটি শ্রেণীতে কোন কোন বইয়ে কি কি সমস্যা আছে এই সংক্রান্ত রিপোর্ট বই প্রস্তুত করেছেন।

এই রিপোর্ট সমূহকে সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাসহ অনেকের কাছে তারা পাঠিয়েছেন। তিনি বলেন যেন, হটাৎ করে এক দিন তুরস্কে নিযুক্ত অ্যামেরিকান রাষ্ট্রদূত আমার দেখা করতে চান। আমি তাকে অফিসে আসতে বললে। তিনি আমার অফিসে আসেন। এসে কয়েক মিনিট কথা বলার পর সরাসরি আমাকে বলেন, “কেন এই সকল রিপোর্ট তৈরি করেছেন? আমরা যেভাবে বলব তুরস্কের শিক্ষা ব্যবস্থা সে আলোকেই হবে!”

এই ঘটনা ছাড়াও তিনি আরো ঘটনা বলেন। কিভাবে ইউরোপের শিক্ষা কমিশন সারা পৃথিবীর শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রন করছে এগুলাও তিনি তুলে ধরেন। এবার চিন্তা করুন তুরস্কের ক্ষেত্রেই যদি এই অবস্থা হয়, অন্য দেশ সমূহের ক্ষেত্রে তাহলে কি অবস্থা! এক কথায় বলতে গেলে আজ সারা পৃথিবীর শিক্ষা ব্যবস্থা সাম্রাজ্যবাদীদের তৈরি কৃত শিক্ষা ব্যবস্থা। তারা আধুনিক গোলাম বানানোর এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রনয়ণ করেছে এবং এর বাহিরে কোন শিক্ষা ব্যবস্থাকেই তারা স্বীকৃতি দেয় না। তাদের প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ থেকে ডিগ্রী না দিয়ে একজন মানুষ যতবড় পণ্ডিতই হোক না কেন তার কোন দাম নেই।

এই জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটা সম্পূর্ণ ত্রুটি পূর্ণ। মাদরাসা সমূহের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এত মাদরাসা, এত আলেম উলামা কেন তাহলে বাংলাদেশ আজও সবচেয়ে অপরিষ্কার? কেন আজও বাংলাদেশে এত বস্তি এত পতিতালয়? এই পেছনে কারণ কি আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে।

যেমন আমাদের দেশে দর্শনকে ভুলভাবে পড়ানো হয়ে থাকে। তার চেয়েও বড় সত্য কথা হল, পাশ্চাত্য যেভাবে করেছে আমরাও সেভাবেই করব, এই জন্য তাদের বইগুলোকে হুবুহু অনুবাদ করে পড়ানো হয়। দর্শনের বিভিন্ন স্কুলের কথা উল্লেখ করা হয়ে থাকে আর এই সকল স্কুলের সবগুলার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পাশ্চাত্যের দার্শনিকদের দেখানো হয়ে থাকে। অথচ ভালোভাবে খুজলে দেখা যায় যে এই সকল বিখ্যাত স্কুল সমূহের কিছু আছে যেগুলোর প্রতিষ্ঠাতা মুসলিম দার্শনিকগণ! অথবা কিছু স্কুল আছে যেগুলো মুসলিম দার্শনিকদের দ্বারা প্রভাবিত! আমাদের দেশে বা মুসলিম দেশের কোথাও পড়ানোর সময় এসব বিষয়কে উল্লেখ করা হয় না। অথচ পড়ানোর সময় আমাদের উচিত ছিল এই সব বিষয়কে তুলে ধরা এবং পাশ্চাত্যের কোন কোন দার্শনিক কোন কোন মুসলিম দার্শনিক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে সেগুলোকেউ উল্লখ করা।

দর্শনের কথা আসলেই শুধুমাত্র পাশ্চাত্যের দার্শনিকরা আমাদের সামনে আসে। যেন আমাদের কোন দার্শনিক নেই। আমাদের ইসলামী সভ্যতায় যে সকল মহান দার্শনিকগণ রয়েছেন তাদেরকে আমাদের তুলে ধরা প্রয়োজন। ইমাম আযম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ী, মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবী, সোহরাওয়ার্দী, ইমাম গাজালীর মত ব্যক্তিগন সময়ের প্রখ্যাত আলেম এবং একই সাথে মহান দার্শনিক। অর্থাৎ দর্শনকে যদি আমরা চিন্তার ইতিহাস হিসেবে পড়ি তাহলে এই কাতারে তাদের সকলকেই সম্পৃক্ত হবে যারা চিন্তার জগতকে বিস্তৃত করেছেন এবং এই ক্ষেত্রে ইতিহাস গড়েছেন। একজন ইউরোপের সমাজ নিয়ে চিন্তা করেছেন বলে তিনি সমাজবিজ্ঞানী হতে পারলে বাংলাদেশের সমাজকে নিয়ে চিন্তাকারী একজন ব্যক্তি কেন সমাজ বিজ্ঞানী হতে পারবেন না! ইউরোপের বড় বড় দার্শনিকগণ আমাদের মুসলিম দার্শনিকদের দ্বারা প্রভাবিত যেমন, রেনে দেকার্ত ইমাম গাজালীর দ্বারা প্রভাবিত, বেকন সোহরাওয়ার্দীর চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত, কান্ট মুসলিম দার্শনিকদের দ্বারা প্রভাবিত, হেগেল কাজী আব্দুল জাব্বার সহ মুতাযিলা দার্শনিকদের দ্বারা প্রভাবিত, সারত্রে আলী শরীয়তী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বলেছিলেন, আমি যদি কোন মানুষের ধর্ম গ্রহণ করতাম তাহলে আলী শরীয়তীর ধর্মকে গ্রহণ করতাম! এই সকল বিষয়কেও আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। চার মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমামগণ শুধুমাত্র ফিকাহ এবং ইসলামী শিক্ষা শাস্রেই নয় সমাজ বিজ্ঞান, রাজনীতি এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রেও তাদেরকে তুলে ধরা প্রয়োজন। কারণ তারা ফিকাহকে যুগপোযুগী করার জন্য সমাজকে বিশ্লেষণ করেছেন অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে। ইমাম শাফেয়ী আইনের ক্ষেত্রে এক নবদিগন্ত উম্মোচন করেছিলেন, ইমাম আবু হানিফা সমাজ বিজ্ঞান এবং আইন দর্শনকে অত্যাধুনিকভাবে তুলে ধরেছিলেন, মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবী শুধুমাত্র একজন সুফি নন একজন মহান দার্শনিকও বটে।

এই সকল বিখ্যাত ব্যক্তিগণ ছাড়াও ইসলামী সভ্যতায় এত বেশী পরিমাণে চিন্তাবিদ রয়েছেন তাদেরকে দর্শন শাস্রবিদরা চিনেনা। অথচ তাদের চিন্তা অনেক উন্নত চিন্তা ও দর্শন রয়েছে। তাদের চিন্তা এবং দর্শনকে আমাদের তুলে ধরা উচিত। যেমন স্থপতি সিনান। তাকে আমরা কয়জনে চিনি চিনলেই বা কতটুকু? অথচ তাকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা স্থপতি বলা হয়। তিনি শুধুমাত্র একজন স্থপতি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন গনিতবিদ, একজন ভূগোলবিদ, একজন পদার্থবিদ একজন শব্দবিদ, একজন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ এবং একজন মুজাহিদ। তিনি ১৭ টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ইতালির একজন প্রখ্যাত স্থপতি তার অমর কীর্তি সুলেয়মানিয়া মসজিদ দেখে বলেছিলেন, যদি এটা আমাদের দেশে থাকত তাহলে আমরা বলতাম এটা স্রস্টার সৃষ্টি। কোন মানুষের পক্ষে এটা নির্মাণ করা সম্ভব নয়।আমাদের উচিত এই সকল মহান মানুষকে আমাদের যুব সমাজের সামনে তুলে ধরা।

কারণ অতীতকে জানা ছাড়া ভবিষ্যৎকে নির্মাণ করা সম্ভব নয়। কারণ যে অতীতকে বুঝতে পারে না সে ভবিষ্যৎকেও বুঝতে পারবে না।

এখন যদি এথিক্স (আখলাক) দর্শনের কথা কাউকে জিজ্ঞাসা করা হয় তাহলে সে চোখ বন্ধ করে পাশ্চাত্যের দার্শনিকদের নাম বলে দিতে। তাসাউউফের বড় বড় শায়েখদের কথা কেউ ভুলেও উচ্চারন করবে না। অথচ এই বিষয়ে সর্বপ্রথম কাজ শুরু করেন সুফিগণ। এই ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ করে বলা যায়, আখলাক দর্শন বা ফিলোসফি ও এথিক্সের ক্ষেত্রে মুসলমানগণ যে উন্নতি করেছে, সমগ্র পাশ্চাত্য কিয়ামত পর্যন্ত চেষ্টা করেও এই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবে না। যার কারণেই ব্রিটিশ দার্শনিকদের মধ্যে মেটাফিজিক্সের প্রতি অনিহা দেখা যায়। সাইকোলজি বা মনস্তত্ত্বের কথা আসলেই সকলের সামনে যার নাম সর্ব প্রথম ভেসে উঠে তিনি হলেন ইয়াহুদী মনস্তত্ত্ববিদ ফ্রয়েড। অথচ ‘রূহ’ এবং ‘নফস’ কে মুসলমানদের চেয়ে ভালো ব্যাখা আজ পর্যন্ত অন্য কেউ কি করতে পেরেছে?

এখন যদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই ভাবে গণনা করে দেখি তাহলে দেখতে পাব আমাদের চিন্তার ধারা কত উন্নত এবং কত বিস্তৃত। কিন্তু এই বিষয়সমূহ বুঝার মত ব্যক্তি আমাদের নেই। কারণ আমাদের বর্তমান দর্শন শাস্রবিদগণ ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস সম্পর্কে জানেন না।

আমাদের মাজহহাবের ইমামগণ শুধুমাত্র ফকিহ নন। তারা একই সাথে আইন দর্শনের জনক। বড় বড় মুজতাহিদ আলেমগণও একই রকম। কিন্তু আমরা তাদেরকে সেই দৃষ্টিতে না দেখে ইখতিলাফি দৃষ্টিকোন থেকে দেখার কারণে তাদের মর্যাদাকে আমরা বুঝতে পারি না। এই সকল মুজতাহিদ আলেমগণ একই সাথে রাজনৈতিক দার্শনিক। ইবনুল মুকাফফার উসূলল সিয়াসাহ পড়লেই বুঝা যায় তিনি কত বড় রাজনৈতিক দার্শনিক ছিলেন। আল ফারাবির মাদিনাতুল ফাদিলা পড়লেও বুঝা যায় তিনি কত বড় সমাজ বিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক দার্শনিক ছিলেন।

অর্থাৎ দর্শনের নাম শুনলেই যেন গ্রীক দর্শন না বুঝি, ইসলামী সভ্যতাসহ অন্যান্য সভ্যতার চিন্তাকেও আমাদের পড়া দরকার। ফিকহ একই সাথে মুসলমানদের সমাজবিজ্ঞান। যখন সমাজবিদ্যা ছিল না তখন ফিকহ সমাজবিজ্ঞানের কাজ করত। এই জন্য তুরস্কের প্রখ্যাত দার্শনিক জেমিল মেরিচ বলেছেন, যে সমাজের মানুষ জামায়াতের সাথে নামাজ আদায় করে তাদের জন্য মনোবিদ্যা (Psychology) এবং যে সমাজের মানুষ যাকাত আদায় করে সে সমাজের জন্য সমাজবিজ্ঞান ( Sociology) র কোন দরকার নেই।

ইলমুল কালামও একই সাথে তত্ত্ববিদ্যা (Ontology)। কিন্তু তত্ত্ববিদ্যা (Ontology) নিয়ে আলোচনা করার সময়ে কেউ আমাদের কালামবিদগণের ( আশইয়ারী, মাতুরিদি, মুতাযিলা, জাবরিয়া, কাদরিয়া) কথা কেউ বলেন না। এক অর্থে বলতে গেলে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামী সভ্যতা ও মুসলমানদের অবদানকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা হয়। স্বীকার করা হলেই বড় বড় ৫ থেকে ৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়।

আর এটা তারা করতে পারে আমাদের অজ্ঞতার কারণেই তাই আমাদের উচিত আমাদের ইতিহাসকে আমাদের নিজেদের লেখা। আর এটা শুধুমাত্র অতীতকে জানার জন্য নয় আমাদের ভবিষ্যৎকে নির্মাণ করার জন্যও খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ

মুল লেখক:

Burhan Uddin Azad

বিষয়: বিবিধ

৬১৯ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

386003
১৫ অক্টোবর ২০১৮ দুপুর ১২:১৮
আমি আল বদর বলছি লিখেছেন : বারাকাল্লাহ ভাই জান
386009
১৫ অক্টোবর ২০১৮ দুপুর ০২:২৫
কুয়েত থেকে লিখেছেন : আজ মুসলমানদের পতনের কারনই হলো কুরানের গবেষনা না করা। কুরান হলো যুগের ব্যাখ্যদানকারি। আল্লাহ বলেন তোমাদের কি হলো! তোমরা কেন কুরান গবেষনা করছোনা তোমাদের অন্তরেকি আমি তালা লাগিয়েছি। সুরা মুহাম্মদ ২৪ আয়াত। কুরআন উফাচ্ছিরুজ জামান কুরান হলো যুগের ব্যাখ্যদান কারী। আমরা শিক্ষা অর্জন করার পরে ফতোয়া বাজিকরছি পোষাকনিয়ে লেবাস নিয়ে এই জাতির উন্নতি হবে কি করে--? লেখাটি ভালো লাগলো আপনাকে ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File