পাক-ভারত-বাংলাদেশের ধর্ম ও জাতিস্বত্তার আদি কথা এবং বর্তমান প্রেক্ষিত : ধর্মীয় উম্মাদনা নয়, সত্যি আবিষ্কারের বাসনা থেকে আমার এই প্রয়াশ, ধৈর্য ধরে পড়লে কৃতার্থ হবো।
লিখেছেন লিখেছেন জাহাঙ্গীর ফারুক ০৭ অক্টোবর, ২০১৫, ০১:৪৩:৫০ দুপুর
প্রথম কিস্তি ঃ
ভারতে বিভিন্ন স্থানে গরু জবাই নিষিদ্ধ করেছে সরকার। গরু জবাই বা গরুর মাংস খাবার অপরাধে ইদানিং মুসলিম সম্প্রদায়ের বেশ কিছু মানুষকে পিটিয়ে মারার খবর মিডিয়ায় আসছে। এই একবিংশ শতকে গরুর মাংস খাবার অপরাধে মানুষ হত্যার মত জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হতে পারে এই সভ্য দুনিয়ার মানুষ ! এটা ভাবতেই ভীষণ অসহায় বোধ করছি, মানুষ হিসেবে খুবই লজ্জিত বোধ করছি। বজরং দল, আরএসএস, শিবসেনার মত সাম্প্রদায়িক দল ও গোষ্ঠীগুলো সাম্প্রদায়িক বিজেপি সরকারের কাঁধে ভর করে হিন্দুত্তের ধুয়া তুলে ভিন্নধর্মী মানুষের ন্যুনতম ধর্মীয় ও মানবাধিকার হরণ করে নিষ্পেষিত করে চলছে প্রতিনিয়ত । আমি সাম্প্রদায়িক ভেদ বুদ্ধি জনিত কারনে এটা নিয়ে লিখছিনে। আমি ইতিহাসের ঐ জায়গায় আলো ফেলতে চাইছি যেখানে আলো ফেললেই অন্ধকারের প্রেতাত্মারা চেঁচামেচি শুরু করে।
প্রাচীন-মধ্য ও আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমি হিন্দু তথা সনাতন ধর্মের উৎপত্তি, আদর্শ আর বিকাশের যেটুকু তথ্য উপাত্ত জানি, সেখান থেকে আমার অর্জিত উপলব্দিতে কুলায় না এমন তুচ্ছ বিষয়ে কেন হিন্দু ধর্মের এইসব ধ্বজাধারী দের এতো অমানবিক আস্ফালন? গরু হিন্দু ধর্মের অবতার শ্রীকৃষ্ণের বাহন হিসেবে সম্মানিত এবং শিশুকালে গাভির দুগ্ধ পান করা হয় বলে মাতৃ রুপে কল্পনা করা হয়। এটা ধর্মের মৌলিক কোন বিষয় নয়। গোমাংস ভক্ষন করা যাবে না এমন কোন মৌলিক ধর্মীয় নির্দেশনাও হিন্দুধর্মে নেই। এটা সনাতন ধর্মী মানুষদের সংস্কার মাত্র। সংস্কার আর ধর্ম এক বিষয় নয়। তাহলে প্রশ্ন আসে এমন তুচ্চ বিষয় নিয়ে এই আধুনিক যুগে এমন বাড়াবাড়ি,এমন অমানবিক ঘটনা কেন ঘটানো হচ্ছে ? এটা কিন্তু মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।
আমি যদি এটাকে গোঁড়া হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের হাজার বছরের পরাজিতের মানসিকতা থেকে উৎসারিত প্রতিশোধ পরায়নতা বলে ধরে নেই খুব ভুল হবে কি ? ঘটনা পরস্পরায় আমার ভাবনা সে দিকেই ধাবিত হয়।
আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে হিন্দু ধর্মের বিকাশ ঘটেছিল ভূখণ্ডে। তার পূর্বে এখানে দ্রাবিড়ীয় জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বসবাস করতেন।এই দ্রাবিড়ীয় জনগোষ্ঠীর মানুষেরা লোকজ সংস্কৃতি নির্ভর ধর্ম পালন করতেন সেই সময় এখানে, যার মুল ছিল প্রকৃতিপুজা তথা বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির পুজা বা আরাধনা। উর্বর ভুমির সহজ জীবন যাত্রার এই ভূখণ্ডের মানুষেরা ছিল সহজাত কারনেই আরামপ্রিয়, কল্পনা বিলাসী এবং ভোগে লিপ্ত । এধরনের মানুষেরা স্বভাবতই ছিলেন শারীরিকভাবে দুর্বল, হীনবুদ্ধি ও রণকৌশলে কাঁচা। মধ্য এশিয়ার শক্তিশালী বুদ্ধিমান আর্যগন আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে অপেক্ষাকৃত দুর্বল এই দ্রাবিড়ীয় জনগোষ্ঠীর উপর হামলা চালিয়ে দখল করে নেয় এই জনপদ। চালু করে তাদের নিজেস্ব ধর্মমত বৈদিক ধর্ম । দখলকৃত ভূখণ্ডের পরাজিত বন্দি স্থানীয় দ্রাবিড়ীয় জনগোষ্ঠীর মানুষেরাই কালক্রমে বৈশ্য এবং শুদ্র বা দাস শ্রেণীর মানুষে রূপান্তরিত হয় বলে অনুমান করা হয়। আক্রমণকারী বহিঃশক্তি দখলদার আর্যগন ব্রাহ্মন ও ক্ষত্রীয় রুপে উচ্চবর্ণ ও কুলীন শ্রেণীরুপে প্রতিষ্ঠিত হন । তারা মুলত রাষ্ট্র ও সমাজে পুরোহিত ও রাজপুরুষ রুপে চিহ্নিত ছিলেন । সেই থেকেই জাতপাতের উৎপত্তি বলেই আমার উপলব্দি ।
আমার অনুমান এই যে, দ্রাবিড়ীয় জনগোষ্ঠীর মানুষেরাই এই বৈশ্য ও শুদ্র শ্রেণীর মানুষদের পূর্বপুরুষ, যারা মুলত ভারতীয় উপমহাদেশের আদি বাসিন্দা । বৈদেশিক দখলদার আর্যগন ব্রাহ্মন ও ক্ষত্রীয় । আচার্য, ভট্টাচার্য, চক্রবর্তী পদবীর মানুষেরা হলেন ব্রাহ্মণ যারা মুলত ধর্মগুরু বা পুরোহিত শ্রেণীর। চট্টোপধ্যায়, বন্দোপধ্যায়, রায়, বোস, গোস্বামি, লোদ এরকম পদবীর মানুষেরা ক্ষত্রীয় শ্রেণীর। উহারা সেই প্রাচীনকালে মধ্য এশিয়া হতে মাইগ্রেটেড হয়ে এসেছিলেন এই ভূখণ্ডে। সেই বিবেচনায় ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রীয় শ্রেণীর মানুষেরা এই উপমহাদেশের আদি বাসিন্দা নন। বরং বৈশ্য ও শুদ্র নামক দাস শ্রেণীর মানুষেরাই এই ভূখণ্ডের আদি বাসিন্দা, যাদের একটা বিশাল অংশ পরবর্তীকালে শ্রেণী শোষণের যাতাকলে লিপ্ত হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। আর ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা বিদেশী দখলদারদের উত্তর পুরুষ বলে মনে হয় সংগত কারনেই।
মহান ধর্ম গ্রন্থ বেদের উৎপত্তি ও বিকাশ এই সময় হয় । ঋকবেদ কেন্দ্রিক এই ধর্ম একসময় বৈদিক ধর্ম নামেই প্রচলিত ছিল, যার মুল ভিত্তি ছিল একেশ্বরবাদ। কালক্রমে বেদের নুতন সংস্করণ যজুর্বেদ, অথর্ব বেদ এবং বেদ-বেদান্ত । পরবর্তীতে বৈদিক ধর্মের উত্তর পুরুষেরা স্থানীয় লোকজ ধর্মের বিভিন্ন আচার গ্রহন করে এক শঙ্কর ধর্মের প্রচলন করেন। আর্যদের একেশ্বরবাদের সাথে হরপ্পার আদি দেবদেবীর সংমিশ্রণে পৌরাণিক কাহিনীর সৃষ্টি হয়। হরপ্পা ও মাহেঞ্জদাড়ো সভ্যতার মাঝেই আর্য, দ্রাবিড়, মঙ্গোল এবং সুমেরিয়দের মিলিত সৃষ্টি বিবর্তনের মাধ্যমে হাজার হাজার বছরের পরিক্রমায় আজকের হিন্দু ধর্ম, যার বর্তমান ধর্মীয় পুস্তক ভগবত গীতা। অন্যান্য সহায়ক গ্রন্থ যেমন উপনিষদ বেদ নির্ভর । মহাভারত ও রামায়ণ এই ধর্মের পৌরাণিক কাহিনী রুপেই বিবেচিত।
আমি হিন্দু ধর্ম বিশারদ কেউ এ দাবি করছিনা ।এ ধর্মের প্রতি বিরাগ বা অনুরাগ আমার সংগত কারনে নেই। আমি এই ধর্মটাকে জানার ও বুঝার চেষ্টা করেছি মাত্র। আমি মোটা দাগে বিষয়টা উপস্থাপন করছি, চুলচেরা নয়। একথা বলা অমুলক নয় যে, হিন্দু বা সনাতন ধর্ম এভুমি থেকে উৎসারিত কোন ধর্ম নয়। উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা প্রাচীন ভারতবর্ষের আদি বাসিন্দা নয়, বরং বিদেশী দখলদার শক্তির উত্তর পুরুষ। হিন্দু এবং ইসলাম ধর্ম দুটি ধর্মই প্রাচীন ভারতবর্ষের বাহির থেকে আগত। যদিও এখানকার অধিকাংশ মানুষ প্রথমে হিন্দু তথা সনাতন ধর্ম ও পরবর্তীতে অনেক মানুষ ইসলাম ধর্মকে বরন করে নিয়েছিল ধর্মদর্শন হিসেবে।
প্রাক মধ্যযুগে ইসলাম ধর্ম এই ভূখণ্ডে আসে প্রথমত পীর আউলিয়াদের মাধ্যমে । পরবর্তীকালে মুসলিম নৃপতিরা আক্রমন করে বাহুবলে দখল করে নেয় ভারতের বিশাল অঞ্চল। কায়েম করে মুসলিম শাসন। সময়ের হিসাবে প্রায় হাজার বছর সেটি। ইসলাম ধর্মের সাম্য, উদারতা, শ্রেণীহীন জীবন ব্যবস্থা এখানকার মানুষের কাছে গ্রহন যোগ্য হয়েছিলো বলে এই ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠীর বিশাল একটা অংশ ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিল। তরবারি বা শক্তির জোরে ইসলাম এখানে পয়দা হয়নি। যদি তাই হতো তাহলে দেখার জন্যও আজ কোন হিন্দু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীকে এখানে পাওয়া যাওয়ার কথা নয়, এটা বুঝার জন্য খুব বেশি পণ্ডিত হতে হয় না।হাজার বছর ধরে যদি শাসনের সাথে শক্তির জোরে ধর্মান্তর প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকতো তাহলে কেবল একমাত্র মুসলমানেরাই এই ভূখণ্ডে থাকতেন, অন্যরা হারিয়ে যেতেন বহু আগেই। ইসলামের এই উদারতা যারা অনুধাবন করেছেন তারাই মুসলমান হয়েছেন। এরপরও হিন্দুরাই এই ভারতীয় উপমহাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী।
এই হাজার বছরের মুসলিম সংখ্যালগু শাসন থেকে মুক্তি পাবার জন্য সঙ্গত কারনেই বহুবার চেষ্টা করেছে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠী হয়েছে । কিছু কিছু ক্ষুদ্র সাফল্য থাকলেও দীর্ঘকাল ধরে বৃহত্তর কোন সাফল্য কখনোই অর্জিত হয়নি এই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠীর। তাই ভিতরে ভিতরে এই শাসিত জনগোষ্ঠীর মাঝে তৈরি হতে থাকে তীব্র মুসলিম বিদ্বেষ, যা প্রথমে ছিল মুলত রাজশক্তির প্রতি বিদ্বেষ । বারবার অসফল হয়ে হতাশ এই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠীর সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য সাফল্যের সুচনা হয় বাংলা বিহার উড়িষ্যায়। ১৭৫৭ সালে জগতশেট, রায়দুর্লভ আর উমিচাঁদেরা মীরজাফরের কাঁধে ভর করে ইংরেজদের হাত ধরে পলাশীর রণপ্রান্তরে নবাব সিরাজুদউলার পরাজয়ের মাধ্যমে উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের অবসানের সুচনা হয়। যদিও পলাশী রণ-প্রান্তরের এই বিজয়ের চূড়ান্ত ফল হিন্দুগন পেতে আরও দুইশত বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিলো । পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজ উদ-দোলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ভারতে হাজার বছর ব্যাপী মুসলিম শাসনের অবসান। তাই পলাশীর যুদ্ধই সবচাইতে যুগান্তকারী এই ভূখণ্ডের হিন্দু ও মুসলিম উভয় জনগোষ্ঠীর জীবনে।মুসলমানেরা রাজ্য হারিয়ে মুষড়ে পড়ে, আর হিন্দুরা নব লব্দ শাসন ও শাসকগোষ্ঠীর তল্পিবাহকে পরিনত হয়ে রাজ শক্তির আনুকূল্য লাভ তথা দালালিতে লিপ্ত হয়। আর মুসলমানেরা আতঙ্কিত হয়ে সমাজ ও রাজনীতির উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত হয় মুসলিম সমাজ। পক্ষান্তরে মুসলিম শাসনের হাত থেকে মুক্তি পাবার আনন্দে উদ্বেলিত হিন্দুগন নুতন অর্জনের আনন্দে বিভোর থাকে বহুকাল। ০৩.১০.২০১৫ খৃস্টাব্দ। চলবেঃ
বিষয়: বিবিধ
২০০৯ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমার উপরের মন্তব্যটি নজরুল ইসলাম টিপু ভাইয়ের পোস্টকৃত একটি ব্লগে করেছিলাম। । হাতে সময় ও সুযোগ থাকলে সেখানে ভিজিট করে আসতে পারেন। ওখানে আরো অনেকেই কমেন্ট করেছেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন