বাংলাদেশীদের সৌদি বিদ্বেষর নেপথ্যে কারণ কি?

লিখেছেন লিখেছেন আলিম হায়দার চৌধুরী অনিক ০১ নভেম্বর, ২০১৮, ০৭:৩৯:১৯ সন্ধ্যা

বিসমিল্লাহর রাহমানির রাহীম। শান্তি বর্ষিত হোক হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর উপর, আরো শান্তি বর্ষিত হোক অন্যান্য নবী রাসূল, সাহাবা সহ সকল হক পথে চলা আলেম ও সাধারণ জনগণের উপর। সৌদি আরব সারা বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিমদের প্রাণের স্থান, এর কারণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য হলো -ইসলাম এসেছে ঐ স্থান হতে, আমাদের প্রিয় এবং শেষ নবী হহযরত মুহাম্মাদ সঃ সহ অনেক সাহাবার দেশ সৌদি আরব, এবং ইসলামের অধিকাংশ স্থাপনাগুলো সৌদি আরবে যার মধ্যে মসজিদে হারামাইন শরীফাইন এবং মসজিদে নববী অন্যতম। বাংলাদেশের সাথে সৌদি আরবের সাথে সুসম্পর্ক বিদ্যমান, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, ইসলামিক, রাজনৈতিক অনেক ক্ষেত্রেই সৌদি আরব দেশটির প্রভাব রয়েছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের একটি অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সৌদি আরবে অবস্থান করা প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো অর্থ, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবিলায় সৌদি আরবের সহোযোগিতার কথা সবার জানা। তারপরেও বাংগালীদের দেখবেন সৌদি আরব এর বিরুদ্ধে সব সময় কথা বলে, আমাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায় না বাদশাহ পরিবার,আলেম ওলামাসহ আম জনতা কেউই। কেনো এই বিদ্বেষ? যদিও কি না আমাদের দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে সুসম্পর্ক বিদ্যমান, তাদের সাহায্য সহোযোগিতা বিদ্যমান? ছোট বেলা থেকেই আরবের দূর্নাম শুনে শুনে আমরা বড় হয়েছি,, এর কারণ হিসেবে ধারাবাহিক পর্ব লেখার জন্য চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি সাইদুর রহমান ভাই এর নিকট।

মধ্যযুগে ক্রুসেডার এবং খারেজীরা মুসলিম কাফেলাতে ডাকাতি করে সেখান থেকে ছোট ছোট বাচ্চাদের অপহরণ করে নিয়ে যেত৷ পরবর্তীতে এদেরকেই মুসলমানদের বিরূদ্ধে ব্যবহার করত৷ এতে তাদের সন্তানরা নিরাপদ থাকত৷ যুদ্ধটা হত মুসলমানে মুসলমানে৷

যেসব মুসলমানরা অমুসলিম এবং খারেজীদের পক্ষ নিয়ে মুসলমানদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করত তারা জানতই না তারাও মুসলমান৷ নেশা এবং রাজকীয় জীবনে অভ্যস্ত করে ধীরে ধীরে এদের নিজস্ব চিন্তা শক্তি বিলুপ্ত করে অতীত মুছে দেওয়া হত৷

এধরনের অপহরণের ঘটনা বর্তমানে নেই, কিন্তু মুসলমানদের পরষ্পরের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ এবং মিথ্যা অপবাদ দেওয়া কিন্তু থেমে নেই মুসলমানদের মাঝে৷ পরষ্পরের প্রতি দোষারোপের দিক দিয়ে উপমহাদেশের মুসলমানরা সবার চেয়ে এগিয়ে থাকবে৷ এদের মাঝে বাঙ্গালীরা প্রথম স্থান দখল করবে৷ কেন এমনটা হচ্ছে?

আমরা আসলে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ভুল শিক্ষা ব্যবস্থা এবং মিডিয়া সন্ত্রাসের শিকার৷ ছোটবেলা থেকেই মুখস্ত বিদ্যা, মিডিয়ার ভুল তথ্য এবং মিথ্যা ইতিহাসের মাধ্যমে আমাদের বড় করা হয়৷ চাকুরীর মোহে বিলাসি জীবন-যাপনের লোভে আমরাও অভ্যস্ত হয়ে পড়ি এসব মুখস্ত বিদ্যাতে৷ নেশায় আসক্ত রোগীর মত আমাদের নিজস্ব চিন্তা শক্তি লোপ পেতে থাকে এবং ভুলে যাই অতীত ইতিহাসকে৷

বৃটিশরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন ভাবেই প্রণয়ন করেছে, যেন আমরা সংশয়বাদী হয়ে উঠি৷ নিজেদের পরিচয় ভুলে অন্য মুসলমান ভাইয়ের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করি এবং ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে একে অপরকে আক্রমণ করে বসি৷ সেই বৃটিশ আমল থেকে বাঙ্গালী মুসলমানদের সবচেয়ে বেশী বিদ্বেষের শিকার সৌদী আরব এবং সেখানকার আলেমগণ

সৌদীর প্রতি ইসলাম প্রিয় তৌহিদী বাঙ্গালী মুসলমানগণের বিদ্বেষের প্রধাণ কারন হলো "রাজতন্ত্র"৷ রাজতন্ত্রে সাধারণত একজন রাজা তার মৃত্যুর পূর্বে উত্তরাধিকারী নিয়োগ করে যান৷ আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই খোলাফায়ে রাশেদীনের পর উমাইয়া, আব্বাসীয়, ফাতেমী, উসমানীয় খিলাফত, সেলজুক, আইয়্যূবীয়, মামলুক সালতানাতের প্রায় সবাই উত্তরাধিকার সূত্রে সিংহাসন আরোহণ করেছেন৷

যারা "রাজতন্ত্র হারাম" বলে ফতোয়া দেন তারা কি দয়া করে বলবেন, রাজতন্ত্রে উত্তরাধিকার নিয়োগ করা হারাম হলে খিলাফত এবং সালতানাতে উত্তরাধিকার নিয়োগ হালাল হয় কি করে? আর যদি খিলাফত, সালতানাত, রাজতন্ত্রে উত্তরাধিকার নিয়োগ হারাম হয়, তাহলে এত বছর ধরে মুসলিম শাসন ব্যবস্থা টিকে ছিলো কিসের ভিত্তিতে?

সৌদী আরবের প্রতি বাঙ্গালী মুসলমানদের বিদ্বেষের আরেকটা অন্যতম কারন হলো, সৌদী আরবের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ বিন সৌদ উসমানীয় খিলাফতকে ধ্বংস করে সৌদী আরব প্রতিষ্ঠা করেছেন৷ কিন্তু ইতিহাস কি বলে?

নূর উদ্দীন জঙ্গী (রহঃ) ছিলেন সেলজুক সুলতান৷ সেলজুক সালতানাতের পতন হয়েছিলো তাঁরই শিষ্য এবং বন্ধু সুলতান আইয়্যুবী (রহঃ) এর হাতে৷ আইয়্যুবী সালতানাতের পতন হয়েছিলো আরেক বীর মামলুক সুলতান রোকন উদ্দীন বাইবার্স (রহঃ) এর হাতে৷

অযোগ্য শাসকের দূর্বল অবস্থানের কারনে সিংহাসনের যখন নড়বড়ে হয়ে যায়, তখন রাজ্যের ছোট ছোট রাজারা নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে আর না হয় অন্য কেউ সে সিংহাসন দখল করে৷ উসমানীয় খেলাফতও ছিলো তখন অযোগ্য শাসকদের দখলে৷

মুহাম্মদ বিন সৌদ এবং খিলাফতের যুদ্ধকে অনেকে ধর্মীয় যুদ্ধ হিসেবে উপস্থাপন করে বিকৃত করে থাকেন৷ ইতিহাসে মুসলমানে মুসলমানে যুদ্ধ নতুন নয়৷ সালাহউদ্দীন আইয়্যূবী কে তাঁর চাচাত ভাইয়ের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে৷ বাদশাহ হূমায়নের সাথে শের শাহের যুদ্ধ হয়েছে৷ সম্রাট আলমগীরকে তাঁর আপন ভাইদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছে৷

কে কিভাবে সিংহাসনে বসলো তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সিংহাসনে বসে তিনি কি করেছেন? মুহাম্মদ বিন সৌদ কি করেছেন, সেটা দেখার আগে আমরা দেখি খোদ খিলাফতের কেন্দ্রস্থল তুরষ্কে কি হয়েছে?

ক্ষয়িষ্ণু খিলাফাতের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে মোস্তফা কামাল পাশা৷ সে এসে মসজিদ, মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয়৷ কোরআন পাঠ, আযান, দাড়ি, টুপি, হিজাব নিষিদ্ধ করে৷ ইসলামকে বিলুপ্ত করার জন্য এমন কোন হীন কাজ নেই যা সে করে নি৷ অথচ ইতিহাস একেই আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে কামাল আতাতুর্ক বা তুরষ্কের পিতা নামে৷

যখন খিলাফতের শাসকরা খোদ নিজের দেশেই খিলাফত ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নি, তখন প্রায় ২৫০০ কিঃ মিঃ দূরের জাযিরাতুল আরবকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখত?

মুহাম্মদ বিন সৌদ সৌদী আরবের রাষ্ট্র ক্ষমতায় না এসে যদি বৃটিশরা আসত এবং ধর্মের নামে শিরক-বিদআত ইত্যাদি কুসংস্কার চালু করত; কিংবা কামাল পাশার মত সেক্যুলাররা ক্ষমতা দখল করত, তখন সেটা কি আমাদের জন্য খুব ভালো হত?

মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেছিলেন, "পশ্চিমের শুয়োর সাদা হইতে পারে, পূর্বের শুয়োর কালো হইতে পারে কিন্তু সব শুয়োরই হারাম। শোষণ করা ছাড়া শাসকের কোন জাত নাই, ধর্ম নাই৷" শাসকের কাছে ধার্মিকতা আশা করা বৃথা৷ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বেশির ভাগ মধ্যযুগে ক্রুসেডার এবং খারেজীরা মুসলিম কাফেলাতে ডাকাতি করে সেখান থেকে ছোট ছোট বাচ্চাদের অপহরণ করে নিয়ে যেত৷ পরবর্তীতে এদেরকেই মুসলমানদের বিরূদ্ধে ব্যবহার করত৷ এতে তাদের সন্তানরা নিরাপদ থাকত৷ যুদ্ধটা হত মুসলমানে মুসলমানে৷

যেসব মুসলমানরা অমুসলিম এবং খারেজীদের পক্ষ নিয়ে মুসলমানদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করত তারা জানতই না তারাও মুসলমান৷ নেশা এবং রাজকীয় জীবনে অভ্যস্ত করে ধীরে ধীরে এদের নিজস্ব চিন্তা শক্তি বিলুপ্ত করে অতীত মুছে দেওয়া হত৷

এধরনের অপহরণের ঘটনা বর্তমানে নেই, কিন্তু মুসলমানদের পরষ্পরের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ এবং মিথ্যা অপবাদ দেওয়া কিন্তু থেমে নেই মুসলমানদের মাঝে৷ পরষ্পরের প্রতি দোষারোপের দিক দিয়ে উপমহাদেশের মুসলমানরা সবার চেয়ে এগিয়ে থাকবে৷ এদের মাঝে বাঙ্গালীরা প্রথম স্থান দখল করবে৷ কেন এমনটা হচ্ছে?

আমরা আসলে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ভুল শিক্ষা ব্যবস্থা এবং মিডিয়া সন্ত্রাসের শিকার৷ ছোটবেলা থেকেই মুখস্ত বিদ্যা, মিডিয়ার ভুল তথ্য এবং মিথ্যা ইতিহাসের মাধ্যমে আমাদের বড় করা হয়৷ চাকুরীর মোহে বিলাসি জীবন-যাপনের লোভে আমরাও অভ্যস্ত হয়ে পড়ি এসব মুখস্ত বিদ্যাতে৷ নেশায় আসক্ত রোগীর মত আমাদের নিজস্ব চিন্তা শক্তি লোপ পেতে থাকে এবং ভুলে যাই অতীত ইতিহাসকে৷

বৃটিশরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন ভাবেই প্রণয়ন করেছে, যেন আমরা সংশয়বাদী হয়ে উঠি৷ নিজেদের পরিচয় ভুলে অন্য মুসলমান ভাইয়ের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করি এবং ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে একে অপরকে আক্রমণ করে বসি৷ সেই বৃটিশ আমল থেকে বাঙ্গালী মুসলমানদের সবচেয়ে বেশী বিদ্বেষের শিকার সৌদী আরব এবং সেখানকার আলেমগণ৷

সৌদীর প্রতি ইসলাম প্রিয় তৌহিদী বাঙ্গালী মুসলমানগণের বিদ্বেষের প্রধাণ কারন হলো "রাজতন্ত্র"৷ রাজতন্ত্রে সাধারণত একজন রাজা তার মৃত্যুর পূর্বে উত্তরাধিকারী নিয়োগ করে যান৷ আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই খোলাফায়ে রাশেদীনের পর উমাইয়া, আব্বাসীয়, ফাতেমী, উসমানীয় খিলাফত, সেলজুক, আইয়্যূবীয়, মামলুক সালতানাতের প্রায় সবাই উত্তরাধিকার সূত্রে সিংহাসন আরোহণ করেছেন৷

যারা "রাজতন্ত্র হারাম" বলে ফতোয়া দেন তারা কি দয়া করে বলবেন, রাজতন্ত্রে উত্তরাধিকার নিয়োগ করা হারাম হলে খিলাফত এবং সালতানাতে উত্তরাধিকার নিয়োগ হালাল হয় কি করে? আর যদি খিলাফত, সালতানাত, রাজতন্ত্রে উত্তরাধিকার নিয়োগ হারাম হয়, তাহলে এত বছর ধরে মুসলিম শাসন ব্যবস্থা টিকে ছিলো কিসের ভিত্তিতে?

সৌদী আরবের প্রতি বাঙ্গালী মুসলমানদের বিদ্বেষের আরেকটা অন্যতম কারন হলো, সৌদী আরবের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ বিন সৌদ উসমানীয় খিলাফতকে ধ্বংস করে সৌদী আরব প্রতিষ্ঠা করেছেন৷ কিন্তু ইতিহাস কি বলে?

নূর উদ্দীন জঙ্গী (রহঃ) ছিলেন সেলজুক সুলতান৷ সেলজুক সালতানাতের পতন হয়েছিলো তাঁরই শিষ্য এবং বন্ধু সুলতান আইয়্যুবী (রহঃ) এর হাতে৷ আইয়্যুবী সালতানাতের পতন হয়েছিলো আরেক বীর মামলুক সুলতান রোকন উদ্দীন বাইবার্স (রহঃ) এর হাতে৷

অযোগ্য শাসকের দূর্বল অবস্থানের কারনে সিংহাসনের যখন নড়বড়ে হয়ে যায়, তখন রাজ্যের ছোট ছোট রাজারা নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে আর না হয় অন্য কেউ সে সিংহাসন দখল করে৷ উসমানীয় খেলাফতও ছিলো তখন অযোগ্য শাসকদের দখলে৷

মুহাম্মদ বিন সৌদ এবং খিলাফতের যুদ্ধকে অনেকে ধর্মীয় যুদ্ধ হিসেবে উপস্থাপন করে বিকৃত করে থাকেন৷ ইতিহাসে মুসলমানে মুসলমানে যুদ্ধ নতুন নয়৷ সালাহউদ্দীন আইয়্যূবী কে তাঁর চাচাত ভাইয়ের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে৷ বাদশাহ হূমায়নের সাথে শের শাহের যুদ্ধ হয়েছে৷ সম্রাট আলমগীরকে তাঁর আপন ভাইদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছে৷

কে কিভাবে সিংহাসনে বসলো তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সিংহাসনে বসে তিনি কি করেছেন? মুহাম্মদ বিন সৌদ কি করেছেন, সেটা দেখার আগে আমরা দেখি খোদ খিলাফতের কেন্দ্রস্থল তুরষ্কে কি হয়েছে?

ক্ষয়িষ্ণু খিলাফাতের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে মোস্তফা কামাল পাশা৷ সে এসে মসজিদ, মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয়৷ কোরআন পাঠ, আযান, দাড়ি, টুপি, হিজাব নিষিদ্ধ করে৷ ইসলামকে বিলুপ্ত করার জন্য এমন কোন হীন কাজ নেই যা সে করে নি৷ অথচ ইতিহাস একেই আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে কামাল আতাতুর্ক বা তুরষ্কের পিতা নামে৷

যখন খিলাফতের শাসকরা খোদ নিজের দেশেই খিলাফত ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নি, তখন প্রায় ২৫০০ কিঃ মিঃ দূরের জাযিরাতুল আরবকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখত?

মুহাম্মদ বিন সৌদ সৌদী আরবের রাষ্ট্র ক্ষমতায় না এসে যদি বৃটিশরা আসত এবং ধর্মের নামে শিরক-বিদআত ইত্যাদি কুসংস্কার চালু করত; কিংবা কামাল পাশার মত সেক্যুলাররা ক্ষমতা দখল করত, তখন সেটা কি আমাদের জন্য খুব ভালো হত?

মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেছিলেন, "পশ্চিমের শুয়োর সাদা হইতে পারে, পূর্বের শুয়োর কালো হইতে পারে কিন্তু সব শুয়োরই হারাম। শোষণ করা ছাড়া শাসকের কোন জাত নাই, ধর্ম নাই৷" শাসকের কাছে ধার্মিকতা আশা করা বৃথা৷ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বেশির ভাগ শাসকই ধর্ম-কর্মের তেমন একটা ধার ধারেন না, বিলাসী জীবন-যাপন করেছেন৷

প্রশ্ন হলো, শাসক কি ধর্ম-কর্ম পালনে জনগণকে কোন বাধা প্রদান করছে কি না? জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে কি না? রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটছে কি না? অপরাধীর বিচার হচ্ছে কি না?

সৌদী রাজ পরিবার আমাদের আদর্শ নয়, শাসক ও নয়, আমাদের পররাষ্ট্র নীতি ভারত এবং আমেরিকামুখী৷ শিক্ষা ব্যবস্থা সেক্যুলার এবং কমিউনিস্ট মুখী৷ সৌদী আরবের কারনে বাংলাদেশের কি এমন ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে?

যেহেতু সব কিছুর সমালোচনা আমাদের মুদ্রাদোষ, আমরা সমালোচনা করবোই৷ কিন্তু সে সমালোচনা রাজ পরিবার থেকে নামতে নামতে গ্র্যান্ড মুফতি থেকে শুরু করে বাইতুল্লাহ, মসজিদে নববীর সব আলেম ওলামাকে দরবারী আলেম গালাগালি করতে করতে অনেকে চলে যান মক্কা-মদীনাকে দাজ্জালের কবল থেকে মুক্ত করতে জিহাদের ময়দানে৷

আগেই বলছি, শাসককে আপনি সারাদিন গালি দেন আপত্তি নেই৷ আপত্তিটা আসে তখন, যখন দেখি জ্ঞাত বা অজ্ঞাত সারে অনেকে সীমা অতিক্রম করে নিচের দিকে নামতে থাকে,

চেঙ্গিস খান ছিলো সাধারণ গোত্র প্রধানের পুত্র৷ এক সময় তিনি বিশাল মোঙ্গল সম্রাজ্য গঠন করেন৷ রোকনউদ্দিন বাইবার্স ছিলো একজন মামলুক মানে দাস৷ তাঁর হাত ধরেই মিশরে মামলুক সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়৷ আব্রাহাম লিংকন ছিলেন উইগ পার্টির সদস্য৷ এক সময় তিনি রিপাবলিকান পার্টি গঠন করেন এবং এই পার্টির জনপ্রিয়তায় উইগ পার্টি বিলুপ্ত হয়ে যায়৷

ইতিহাসটাই এমন যে কোন সম্রাজ্য বা দলের শুরু হয় সাধারণ কারো হাত ধরে৷ এসব সাধারণ লোকেরা তাদের আশেপাশের রাজ্যগুলো দখল করে বিশাল সম্রাজ্য গঠন করে, না হয় কোন প্রতিষ্ঠিত সম্রাটকে পরাজিত করে সে সম্রাজ্য দখল করে, অথবা তাদের প্রভাবে অন্যরা বিলুপ্ত হয়ে যায়৷ কালের পরিক্রমায় সেসব শাসককে শুভাকাংখীরা নায়ক এবং বিরোধীরা খলনায়ক হিসেবে দেখতে পছন্দ করে৷ বাদশাহ মুহাম্মদ বিন সৌদ ও মুক্ত নয় এ থেকে৷

মুহাম্মদ বিন সৌদের পর বাঙ্গালীরা যার উপর সবচেয়ে বেশী বিদ্বেষ পোষণ করেন তিনি হলেন, মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব৷ ভারতবর্ষে "ওহাবী" বলে একটি মতবাদ প্রচলিত আছে৷ পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ এই তিনদেশের নাগরিক ছাড়া আপনি অন্য কোন দেশের নাগরিকদের কাছে ওহাবী মতাদর্শের নাম শুনবেন না৷

মুসলিম ঐতিহাসিক গোলাম আহমেদ মোর্তজা তাঁর "ইতিহাসের ইতিহাস" গ্রন্থে উল্লেখ করেন, সুচতুর বৃটিশরা মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাবের নামে কুৎসা রটিয়ে ভারতবর্ষের মুসলমানদের ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্যই "ওহাবী" মতবাদ আমদানি করে৷

মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাবের আমাদের দেশের ইসলাম প্রিয় তৌহিদী জনগণ যে অভিযোগটি করেন তাহলো, তিনি মুহাম্মদ বিন সৌদের সাথে হাত মিলিয়ে মুসলিম খেলাফত ব্যবস্থা ধ্বংস করেন৷ মুসলিম খিলাফতের ভিতরের শিরক-বিদআত সেসব নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করবো তার আগে দেখি ইতিহাস কি বলে?

মুহাম্মদ বিন সৌদ এবং মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব ১৭৪৪ সালে দিরিয়া আমিরাত নামে প্রথম সৌদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন৷ মুহাম্মদ বিন সৌদ ১৭৬৫ সালে এবং মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব ১৭৯২ সালে মারা যান৷ ১৮১৮ সালে ওসমানীয় শাসক মুহাম্মদ আলী পাশা ও তার পুত্র ইবরাহীম পাশার সাথে সৌদী বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন সৌদের যুদ্ধ হয়৷

যুদ্ধে আবদুল্লাহ বিন সৌদ পরাজিত হন৷ বিদ্রোহের অপরাধে তাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয় এবং প্রথম সৌদী রাষ্ট্রের সেখানেই পতন হয়৷ এখানে দেখা যায় খেলাফতকে তারা ধ্বংস করেন নি, উল্টো খেলাফতই তাদের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রকে ধ্বংস করেছে৷ অর্থাৎ আমাদের খেলাফত প্রেমিক ভাইয়েরা বোঝে অথবা না বোঝেই তাদের বিরূদ্ধে খেলাফত ধ্বংসের অভিযোগ করে থাকেন৷

অনেক তথাকথিত ঐতিহাসিক মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাবকে বৃটিশদের দালাল তকমা দিয়ে থাকেন৷ আপনি যদি উপমহাদেশের বৃটিশ বিরোধী আন্দেলনের নেতা সৈয়দ আহমেদ, শাহ আহমেদ, হাজী শরীয়তউল্যাহ, তীতুমীরের আন্দেলন পর্যালোচনা করেন তাহলে দেখবেন তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে "ওহাবী আন্দোলনের নেতা" হিসেবে৷ এমনটা কি কল্পনা করা যায়? গুরু বৃটিশদের লোক, আর শিষ্যরা আন্দোলন করছে বৃটিশদের বিরূদ্ধে!

আমাদের এক শ্রেণীর তথাকথিত মুজাহিদ ভাইয়েরা ঊনাকে দরবারী আলেম উল্লেখ করে প্রায় সময় যে প্রশ্নটা করে থাকেন তাহলো, হাসান বসরী (রহঃ), আবু হানিফা (রহঃ), ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ) এর মত আলেমগণ যেখানে শাসকদের বিরোধীতা করে রোষানলে পড়েছেন, সেখানে তিনি কি করে মুহাম্মদ বিন সৌদের মত শাসকের সাথে হাত মিলিয়েছেন?

আমাদের বেশির ভাগ লোকের সমস্যা আমরা হয় অর্ধ গ্লাস পানি, না হয় অর্ধ গ্লাস খালি দেখি৷ পুরো গ্লাসের অবস্থাটা দেখি না৷ আমাদের ব্রেণটাও আমাদের দৃষ্টি ভঙ্গির মতই অর্ধেক৷

খাজা নিযামউদ্দীন তুসি ইতিহাসে যিনি নিজামূল মূলক নামে পরিচিত৷ নূরউদ্দীন জঙ্গী (রহঃ), সালাহউদ্দীন আইয়্যুবী(রহঃ), ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) এর মত জ্ঞাণী গুণী যার প্রতিষ্ঠিত নিজামিয়া মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন তিনি ছিলেন সেলজুক সালতানাতের উজীরে আযম৷ বাদশাহ আকবরের নবরত্নের মাঝে মোল্লা দো পেঁয়াজো নামে একজন আলেম ছিলেন, যিনি বাদশাহ আকবরকে অনৈসলামিক কাজ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিতেন৷ সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন মুজাদ্দেদ আলফে সানী (রহঃ) এক মুরীদ৷

শাসকের খারাপ কাজের বিরোধীতা করা যেমন আলেমগণের দায়িত্ব, তেমন শাসকের কাছে থেকে তাকে সদুপদেশ দেওয়াটাও আলেমগণের দায়িত্বের মাঝে পড়ে৷ আলেমরা যদি শাসকের দরবার থেকে সরে যান, তাহলে দরবারের আসনগুলো জালেমদের দখলে চলে যায়৷ যেমনটা স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশে হয়ে আসছে৷

খিলাফতের অধীনে তখন মানুষেরা ব্যাপক ভাবে কবর এবং পীর পূজা শুরু করেছিলো৷ যখন তিনি দেখলেন মানুষদের মাঝে শিরক-বিদআত ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে এবং কেউ এগুলোকে নিষেধ করছিল না, কেউ মানুষকে আল্লাহ্‌র পথে ডাকছিলও না, তখন তিনি শিরক-বিদআত থেকে মানুষকে মুক্ত করে আল্লাহর পথে আসার আহবান জানালেন৷অনেকেই ঊনার আহবানে সাড়া দিলেন আবার অনেকেই ঊনার বিরোধীতা শুরু করলেন৷ বিরোধীরা তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র শুরু করলে তিনি দিরিয়া হিজরত করেন৷ তখন দিরিয়ার রাজা ছিলেন মুহাম্মদ বিন সৌদ৷ তিনি মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাবকে তাঁর রাজ্যে চিরস্থায়ীভাবে থাকার অনুরোধ করেন৷ পরবর্তীতে দু'জনের সম্পর্ক বন্ধুত্ব থেকে বেয়াইয়ে উত্তীর্ণ হয়৷

এখানেও আমাদের দেশের অনেক অতি মুজাহিদ ভাইয়েরা বলতে পারেন, তিনি দিরিয়াতে হিজরতে না গিয়ে খিলাফতের অধীনে থেকে দ্বীনের দাওয়াত দিতে পারতেন৷ তিনি যদি এতই দ্বীনদার হতেন, তাহলে ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর মত জেলে জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন৷

প্রিয় জিহাদী দোস্ত ও বুযুর্গ, হাসান বসরী (রহঃ), ইমাম আবু হানিফা (রহঃ), ইমাম তাইমিয়্যা (রহঃ) দ্বীনের খিদমত করতে গিয়ে ঘর-সংসার করেন নাই বা করতে পারেন নাই৷ কিন্তু যেসব আলেমগণ ঘর-সংসার করেছেন তাদের পরিবার-পরিজনের দিকেও নজর দিতে হবে৷

আলেমরা জেলে গিয়ে মশার কামড়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হোক, তাদের সন্তানেরা ঠান্ডায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হোক, তাদের স্ত্রীগণ অসহায় হয়ে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করুক আর আমরা মশারীর ভিতর কম্বলের তলে বসে বসে জিহাদী স্ট্যাটাস দিব৷ এধরনের মুজাহিদের সংখ্যা আমাদের দেশে লাখে লাখে৷

যে জাতি আলেমদের তাবিজ, কবজ, পানি পড়া, ফিতরা, যাকাত ইত্যাদির উপর পর নির্ভরশীল হয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে দেখতে অভ্যস্ত, সে জাতি সৌদী আরবে আলেমদের ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারী অফিস-আদালতে সম্মানের সহিত কাজ করতে দেখে লজ্জা অনুভব না করে বিদ্বেষ পোষণ করতেই পারে৷

অনেকেই হয়ত জানেন না ইহুদী, খৃষ্টান, মুশরিক এবং নাস্তিকেরা মুসলমানের যত ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে শতগুণ বেশী ক্ষতি হতে হয়েছে শিয়া মুনাফিকদের হাতে৷ শিয়াদের উৎপত্তি হয় ইহুদী আব্দুল্লাহ ইবনে সাবার দ্বারা৷ তার নামটি মুসলিমের মত হলেও প্রকৃতপক্ষে সে ছিলো একজন ইহুদী গুপ্তচর৷ তখনকার সময়ে আরবীয় অঞ্চলের মুসলিম, খৃষ্টান, ইহুদী কিংবা মুশরিক সকলের নামই এমন ছিলো৷

সে বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করে৷ দু'হাতে দান করা থেকে শুরু করে মানুষের মন জয় করার জন্য যা যা করা দরকার তার কিছুই করতে সে বাদ রাখেনি। অল্পদিনেই অনেক সহজ-সরল মুসলমান তার ভক্ত হয়ে যায়৷ এদের নিয়ে সে শিয়া সম্প্রদায় গঠন করে৷ পরবর্তীতে তার ভক্তরা অর্থাৎ শিয়া সম্প্রদায় অসংখ্য দলে বিভক্ত হয়৷ জঙ্গে জামাল, জঙ্গে সিফফীন এবং কারবালার মত হৃদয় বিদারক যুদ্ধগুলো মূলত শিয়া মুনাফিকদের কূটকৌশলের কারনেই সংঘটিত হয়৷

ইসলামাবাদ গভঃ ডিগ্রী কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ রচিত "Historical sites of Madinah Munawwarah" গ্রন্থে শায়েখ আব্দুল হক মুহাদ্দীসে দেহলভী (রহঃ) এর "তারীখে মদীনা" কিতাবের রেফারেন্স দিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) পবিত্র রওজা মুবারককে নিয়ে তিনটি ষড়যন্ত্রের ঘটনা উল্লেখ করেন৷ এর মাঝে একটিতে ইহুদী এবং দু'টিতে শিয়া সম্প্রদায় জড়িত৷

৯৩০ সালে আব্বাসিয় খিলাফতের সময় আবু তাহের কারামতী নামক এক শিয়া হজ্বের মৌসুমে মক্কা শরীফ আক্রমন করে হাজরে আসওয়াদ ছিনতাই করে নিয়ে যায়৷ কাবা শরীফ তাওয়াফ রত মুসলিমদের উপর আক্রমন চালিয়ে প্রায় তিরিশ হাজার হাজীকে হত্যা করে। পবিত্র কাবা শরীফের দরজা ভেঙ্গে তছনছ করে দেয়। লন্ডভন্ড করে দেয় জমজম কূপকেও৷ আবু তাহের ঐ সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহকে বলেছিলো, কোথায় তোমার আবাবিল পাখি, কোথায়? তার কারনে প্রায় দশ বছর হজ্ব বন্ধ থাকে এবং এগার বছর মুসলমানরা হাজরে আসওয়াদ ছাড়া হজ্ব পালন করে৷ (বিস্তারিত: শয়তানের বেহেশত-১ by এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ)

সালাহউদ্দিন আইয়্যুবী (রহঃ) এর জেরুজালেম বিজয়ের ইতিহাস যারা পড়েছেন তারা জানেন যে অন্তত বিশ বার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে তাঁকে হত্যা করার জন্যে, বরাবরই মহান আল্লাহর সাহায্যে তিনি বেঁচে যান৷ যে ফেদাইন গোষ্ঠী তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে তাদের গুরু ছিলো হাসান আল সাবাহ এবং সেও একজন শিয়া৷ (পুরো "ক্রুসেড সিরিজ" গুগল প্লে ষ্টোরে পাওয়া যায়৷ ডাউনলোড করে পড়ে দেখতে পারেন)

বাগদাদের কসাই খ্যাত হালাকু খানের নাম অনেকেই শুনেছেন৷ তার স্ত্রী ছিলো ডোকুজ বা দোকুজ খাতুন৷ "খান" এবং "খাতুন" নাম শোনে অনেকেই তাদের মুসলমান ভাবতে পারেন৷ খান শব্দের অর্থ লিডার বা নেতা৷ খাতুন শব্দের অর্থ প্রিন্সেস বা রাজকুমারী৷ হালাকু খান ছিলো বৌদ্ধ এবং তার স্ত্রী ছিলো খৃষ্টান৷ তার উপদেষ্টা ছিলো ইবনুল আলকেমি এবং নাসিরূদ্দীন তুসী৷ এ দু'জনেই ছিলো শীয়া এবং এদের প্ররোচনায় হালাকু খান বাগদাদে প্রায় দশ থেকে বিশ লক্ষ নিরীহ মুসলমানকে হত্যা করে৷ (বিস্তারিতঃ আল-বিদায়া ওয়া আন-নিহায়া by ইবনে কাসীর, দ্যা-প্যান্থার রোকনউদ্দীন বাইবার্স by ইমরান আহমেদ)

শিয়া-সুন্নী দ্বন্ধ আমাদের দেশে চোখে না পড়লেও আরবে রাষ্ট্রগুলোতে এই দ্বন্ধটি অত্যন্ত প্রবল এবং প্রকট৷ শিয়ারা আরবের সুন্নীদের এখনও কি পরিমাণ ঘৃণার চোখে দেখে তার সামান্য নমুনা পাওয়া এক ইরাকি ভাইয়ের জবানিতে৷

কয়েক বছর আগে মিশরের একটি টিভিতে লাইভ অনুষ্ঠানে শায়খ জহবি হাম্মাদকে ইরাকের বাগদাদ থেকে একজন সুন্নি মুসলিম ফোন করে নিজের করুন কাহিনী বর্ণণা করে বলেন, “হে শায়খ, আমাদের মেয়েদেরকে বন্ধী করা হচ্ছে, আহলুস সুন্নাহর পুরুষদের দাঁড়ি ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে, তাঁদেরকে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে, বৃদ্ধাদের লাঠি দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে। তারা আমাদের উপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে কারন তারা চায় আমরা যেন মা আয়েশা (রাঃ) কে গালি দেই (নাউজুবিল্লাহ)। তারা আমার দাড়িতে ময়লা লাগিয়ে আমাকে অপদস্থ করেছে৷ তারা আমাদের মেয়েদেরকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে; আমাদের মাঝে যাদের নাম আবু বকর, ওমর, ওসমান আছে তাঁদেরকে তারা জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করছে। আমি একটি মেয়েকে দেখেছি যাকে ধর্ষণ করা হয়েছে, সে মেয়েটি আল্লাহর কসম করে বলেছে- ওয়াল্লাহি, আমি কুমারি ছিলাম! ওয়াল্লাহি আমি কোরআনের হাফিজ ছিলাম! সে চিৎকার করে বলে- কে আমার গল্প রসূল সাঃ এর কাছে পৌঁছে দিবে?হে শায়খ! এবার আমার নিজের কাহিনী শুনুন। রাফিজিরা আমার তিন বছরের ছেলেকে ওভেনের ভিতর দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। কারন তাঁর নাম রেখেছিলাম ওমর। এরপর তারা তাঁর পোড়া মৃত দেহ আমার কাছে রেখে যায়।”(নেট হতে সংগৃহীত)যে বাশার আল আসাদের ক্ষমতার বলি হয়ে সিরিয়া আজ ধূলোয় সাথে মিশে যাচ্ছে সে একজন শিয়া৷ ইয়ামেন-সৌদী যুদ্ধটা হচ্ছে মূলত হুতিদের সাথে৷ এই হুতিরা শিয়া মতাদর্শী৷ যুদ্ধ বন্ধের চেষ্টা করতে গিয়ে মাত্র কিছুদিন পূর্বে ইয়ামেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ সালেহকে প্রাণ দিতে হয়েছে হুতিদের হাতে৷

শিয়াদের সব চেয়ে ভালো গুণ হলো শিয়া নেতারা, ইমামরা, আলেমরা যা বলে ও লিখে, কোন শিয়া কখনোই তার প্রতিবাদ করে না৷ এরা কোরান ও হাদীসের চেয়ে তাদের নেতা এবং ইমামের কথাকে বেশি গুরত্ব দেয়৷ শিয়াদের বর্তমান সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু বা আধ্যাত্মিক নেতা হচ্ছে আয়াতুল্লাহ খোমেনী৷

আঠার শতকের রূশ সিংহ ইমাম শামিল (রহঃ) যখন জার সৈন্যদের হাতে গ্রেফতার হন, তখন তাঁকে রূশ সম্রাট জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁর শেষ ইচ্ছা কি? তিনি বলেছিলেন, তিনি হজ্ব পালন করতে চান৷ প্রতিটি মুসলমানের সাধারণত এমনই নিয়্যত থাকে, মৃত্যুর পূর্বে যেন একবার হলেও হজ্ব পালন করতে পারেন৷ কিন্তু আয়াতুল্লাহ খোমেনী এমনই এক ইসলামী নেতা যার সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থাকা সত্বেও হজ্ব পালন করে নি৷

অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে খোমেনী হজ্ব না করলে কি হয়েছে? শিয়ারাতো হজ্ব করে৷ শিয়ারা যখন হজ্ব ও ওমরাহ্ করতে আসে তখন তারা তাদের নিজস্ব ইমাম নিয়ে আসে এবং তার পেছনে নামায পড়ে৷ এরা সাধারণত মক্কা-মদীনার ইমামদের পেছনে নামায পড়ে না৷ আর যদি পড়েও তারা বাইতুল্লাহ এবং মসজিদে নববীতে সিজদা করে না৷ তারা ক্যারামের গুটির মত গোলাকার মাটির চাকা তাদের সাথে রাখে এবং এটিতে সিজদা করে৷ তাদের ভাষ্যমতে, এই গোলাকার মাটির চাকাটি কারবালার মাটি দিয়ে তৈরি এবং কারবালা তাদের কাছে মক্কা-মদীনার চেয়েও পবিত্র৷

আফসোসের বিষয় হলো, শিয়াদের পাশাপাশি আমাদের দেশের অনেক সুন্নী মুসলমানও খোমেনীকে বিশাল বড় ধর্মীয় নেতা মানে এবং মনে করে ইরান বা খোমেনীর নেতৃত্বে আরব থেকে ইহুদীদের বিতাড়িত করে জেরুজালেম পুনরূদ্ধার করা হবে৷ তাদের জন্য দুঃসংবাদ হলো ইসরাঈলের পরে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ইহুদীর বসত ইরানের ইস্পাহান প্রদেশে৷ এই ইস্পাহান প্রদেশ এক সময় হাসান আল সাবাহর গুরু শিয়া জাদুকর আবদুল মালিক আল আতাশের দখলে ছিলো৷ দুনিয়াতে শয়তানকে প্রথম এখানেই পাঠানো হয়৷

ইরানি শিয়ারা শুধু নিজ দেশে ইহুদীদের আশ্রয় দেয়নি ইসরাঈলের ইহুদীদের সুরক্ষার ব্যবস্থাও করেছে৷ ইসরাঈলী ডিফেন্স ফোর্সের বিরাট একটা অংশ ড্রুজ সম্প্রদায়৷ এই ড্রুজ সম্প্রদায় হচ্ছে ইসমাঈলী শিয়াদের একটা গ্রুপ৷ অনেকে এক্ষেত্রে লেবাননের হিজবুল্লাহর (এটিও শিয়াদের একটি গ্রুপ) সাথে ইসরাঈলের বিরোধকে সামনে নিয়ে আসবেন৷ আপনি যদি শেক্সপিয়রের "মার্চেট অব ভেনিস", চার্লস ডিকেন্সের "অলিভার ট্যুইস্ট" পড়ে থাকেন, সেখানে দেখবেন এক সময় খৃষ্টানদের সাথেও বিরোধ ছিলো ইহুদীদের সাথে৷ আজকে মুসলিম নিধনে তারা একে অপরের সহযোগী৷

আমরা যদি গত কয়েক দশকের ইরান-ইসরাঈলের সম্পর্ক পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যাবে তাদের সম্পর্কটা চলছে, "লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই লাগলে আমরা নাই" ভিত্তিতে৷ আরবের অন্যান্য দেশগুলোর দিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি মিশর, সুদান, লেবানন সহ আরবের অনেক দেশেই শিয়া-সুন্নী ছাড়াও খৃষ্টান বাস করে৷ অর্থাৎ পুরো আরবে এখন সুন্নী, শিয়া, ইহুদী, খৃষ্টান এই চার সম্প্রদায়ের বসবাস৷ এর মাঝে সুন্নীরা বিভক্ত আর এদের দমন করার জন্য বাকিরা সবাই ঐক্যবদ্ধ৷

শিয়ারা বাইতুল্লাহ এবং মসজিদে নববীতে নামায না পড়ার অন্যতম কারন হলো, এই পবিত্র মসজিদ দু'টিতে শিয়া পন্থী কোন ইমাম নেই৷ তারা চাইছে মধ্যপ্রাচ্যে যেকোন ভাবে একটা গোলযোগ বাধিয়ে এই পবিত্র মসজিদ দু'টির দখল নিতে৷ শিয়াদের উত্থান মুসলমানদের জন্য কি রকম বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে তা ইতিহাসের দিকে তাকালেই চোখে পড়ে৷ যার কারনে মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নী আলেমগণ ইহুদীদের চেয়েও বেশি সতর্ক শিয়াদের ব্যাপারে৷

অপ্রিয় হলেও সত্য, আমাদের দেশের মুসলমানদের প্রচুর ধর্মীয় আবেগ আছে কিন্তু ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয়, ইতিহাস জ্ঞান এখনো প্রাইমারী পর্যায়ে৷ এই প্রাইমারী পর্যায়ের জ্ঞান নিয়ে তারা পিএইচডি লেভেলের চিন্তা করে৷ অনেকের টাইম লাইনে প্রায় সময় একটা কার্টুন চিত্র দেখা যায়, যেখানে সৌদী আরবের একজন নাগরিক ডলারের উপরের দাঁড়িয়ে আছে আর ইরান গণিত, দর্শণ সহ বিভিন্ন বইয়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে৷ কার্টুনটির মূল থিম হচ্ছে শিক্ষা, দীক্ষা, জ্ঞানে, গুণে ইরান সৌদী আরবের চেয়ে অনেক অনেক গুণ উপরে৷

শিয়ারা এধরনের কার্টুন প্রচার করার পেছনে তাদের ভিসন আছে৷ কিন্তু সুন্নীরা কেন করছে? হুজুগে, আবেগে, অজ্ঞতা এবং অন্ধ বিদ্বেষ থেকে৷

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম ইরান সৌদী থেকে সব দিক দিয়ে অনেক অনেক উন্নত৷ তাদের এই উন্নতি বাংলাদেশের কি কাজে লেগেছে? বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগে ইরান থেকে কি পরিমাণ সাহায্য আসছে? বাংলাদেশ থেকে কতজন ছাত্র ইরানে গিয়ে পড়ালেখা করতে পারছে? ইরানে গিয়ে বাংলাদেশের কতজন যুবকের বেকারত্বের অবসান হয়েছে? বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইরানের অবদান কি?

আজকের বাংলাদেশের উন্নতির পেছনে এক নাম্বার বন্ধু রাষ্ট্র হলো সৌদী আরব৷ অথচ বাংলাদেশের মানুষ উঠতে বসতে সৌদী আরবকে গালাগালি করে! বাঙ্গালীর ইরান প্রীতির সাথে আমাদের আঞ্চলিক একটা প্রবাদের খুব মিল আছে ৷ আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় বলে, "ভাত খায় ভাতাইয়ার, হা টিবে নন্দাইয়ার" (স্বামীর ভাত খেয়ে ননদের স্বামীর গুণ গাওয়া)৷

যে দেশটির বাংলাদেশে তেমন কোন অবদান নেই, সে দেশের প্রেমে বাংলাদেশের মানুষের মুগ্ধ হওয়ার পেছনে বিশাল এক রহস্য লুকিয়ে আছে৷ সেই রহস্য জানতে হলে আমাদের উপমহাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে৷

দশম-একাদশ শতাব্দীতে ইরানের শিয়া ইসমাঈলী সম্প্রদায় আপন দল বাড়াবার জন্য চতুর্দিকে মিশনারি পাঠায় ৷ আরো অন্যান্য ধর্মের লোকেরও তখন এদেশে আগমন ঘটে ৷ শিয়া মিশনারীদের উপর কড়া হুকুম ছিল, দল বাড়াবার জন্য কারো ধর্মমত যদি খানিকটা গ্রহণ করতে হয় তাতে কোন আপত্তি নেই ৷ মোদ্দা কথা হচ্ছে, সংখ্যাবৃদ্ধি যে করেই হোক করতে হবে ৷

যে আবু তাহের কারামতি হাজরে আসওয়াদ ছিনতাই করেছিলো, তার বসতি ছিলো বর্তমান বাহরাইনে ৷ আব্বাসীয় খলিফাগণ তাকে অনেক অর্থ, সম্পদ দিয়ে হাজরে আসওয়াদ উদ্ধার করেন ৷ তার কাছ থেকে হাজরে আসওয়াদ ফিরিয়ে নেওয়ার পর পরই তার উপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হতে থাকে ৷ তার শরীরের বিভিন্ন অংশে পচন ধরে এমন দূর্গন্ধ বের হতে থাকে যে তার আশেপাশে কোন মানুষ ভীড়তে পারত না এবং এভাবেই তার মৃত্যু হয় ৷

তার এমন করুণ পরিণতি দেখে তার ভক্তরা অনেকেই তওবা করে খাঁটি মুসলমান হয়ে যায় ৷ আর বদ নসীবরা তাদের মতই থাকে ৷ উল্লেখ্য বর্তমান বাহরাইনে সুন্নীরা ক্ষমতাসীন হলেও সেখানকার ৬০ ভাগ শিয়া ৷ এই কারামতিয়া সম্প্রদায়ের একটা দল ভারতবর্ষের মুলতানে (বর্তমান পাকিস্তানে) এসে বসতি গড়ে ৷ এখানে এসেও তারা ইসলামের নামে অনৈসলামিক কার্যকালাপ পরিচালনা করতে থাকে ৷

ইসমাঈলী মিশনারীদের একজন এসে কাজ আরম্ভ করেন কাঠিয়াওয়াড় এবং কচ্ছের লোহানা রাজপুত সম্প্রদায়ের মধ্যে ৷ এই সম্প্রদায় ছিলো বৈষ্ণব ৷ বিষ্ণু মতবাদ এবং ইসমাঈলি শিয়া মতবাদের সংমিশ্রণে তৈরি হয় শিয়া খোজা সম্প্রদায় ৷ পাকিস্তানের কায়েদ-ই-আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং ভারতের মহাত্মা গান্ধী এরকম এক রাজপুত বংশের সন্তান ৷ পরে জিন্নাহের দাদা খোজা মতবাদ গ্রহণ করে মুসলমান হয় ৷

ভারত বর্ষে রাষ্ট্রীয় ভাবে শিয়া তোষণ শুরু হয় মোঘল সম্রাট হুমায়ুনের আমলে ৷ শের শাহের হাত থেকে রাজ্য পুনরূদ্ধারের জন্য তিনি পারস্য সম্রাটের দ্বারস্থ হন ৷ মিশরের সম্রাটদের উপাধি যেমন "ফারাও" বা "ফেরাউন" তেমনি পারস্যের সম্রাটদের উপাধি "শাহ" ৷ পারস্যের সম্রাট তখন শাহ তামাম্প ৷ তিনি ছিলেন শিয়া ইমামিয়া মাজহাবের একনিষ্ঠ অনুসারী এবং প্রচারক ৷ ইরানের তখনকার সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ও বিচারক কাজী জাহানের হাতে সম্রাট হুমায়ুন শিয়া ইমামিয়া মতবাদ গ্রহণ করেন ৷

এর বিনিময়ে শাহ তামাম্প তার এক ছেলে সহ বার হাজার সৈনিক সম্রাটকে প্রদান করেন, এবং শাহের এক ভাগ্নের মেয়েকে হুমায়ুনের হাতে সমর্পণ করে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করেন ৷ এই বার হাজার লোকের মাঝে উপদেষ্টা, ধর্ম প্রচারক এবং চিত্রকরও ছিলো ৷ ভারতবর্ষে চিত্রকলার আগমন হুমায়নের হাত ধরে ৷ এখানে পাঠকদের মনে রাখা প্রয়োজন, ছবি আঁকার ব্যাপারে সুন্নী আলেমগণের বিধি-নিষেধ আছে ৷

সম্রাট হুমায়ুনের শিয়া মতাদর্শ গ্রহণ ছিলো একটা রাজনৈতিক কৌশল ৷ রাজ্য পুনরূদ্ধারের পর তিনি আবার সুন্নী মতবাদে ফিরে আসেন ৷ কিন্তু যে জীবাণু তিনি সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন তা ততদিনে চতুর্দিকে সংক্রমিত হয়ে গেছে ৷ সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর সম্রাট আকবর যার তত্ত্ববধানে বড় হন, সে বৈরাম খাঁ ছিলো একজন শিয়া ৷ সম্রাট আকবর বৈরাম খাঁর কাছ থেকে রাজনীতি এবং সামরিক শিক্ষা লাভ করলেও ছিলো নিরক্ষর ৷সম্রাট আকবরের শাসনামলে ইরানে "মোলহেদ" নামে শিয়াদের আরেকটি আক্বীদার উৎপত্তি হয় ৷ সুন্নীদের মাঝে যেমন ওহাবী, সালাফী, হানাফী, মালেকী ইত্যাদি বিভাজন তৈরি করে একদল আরেক দলকে ভ্রান্ত প্রমাণ করতে ব্যস্ত শিয়াদের মাঝেও তেমন ৷ ইমামিয়া শাহ এদেরকে ভ্রান্ত আখ্যা দিয়ে এদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে এরা দলে দলে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে ৷

এদের একদল সম্রাট আকবরের সাথে দেখা করে তাকে বলে, আমরা জানি প্রতি এক হাজার বছরে একজন মোজাদ্দেদ বা ধর্ম প্রচারক পৃথিবীতে আসে ৷ আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখেছি আপনিই হতে যাচ্ছেন সেই মহান ব্যক্তি ৷ উল্লেখ্য সম্রাট আকবরের জন্ম আরবী ৯৪৯ হিজরীতে ৷ যেহেতু ধর্মীয় জ্ঞান ছিলো না এবং সে চাটুকারিতা পছন্দ করত ৷ তাই এদের অনেককে রাজদরবারে আশ্রয় ৷ আকবরের "দীন-ই-এলাহি" তৈরির পেছনে এদেরও প্ররোচনা ছিলো ৷

ইরান থেকে ভাগ্য অন্বেষণে বাংলায় এসেছিলেন আলীবর্দী খাঁ ৷ পরবর্তীতে তিনিই হন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব ৷ নবাবী আমলে ঢাকায় নিযুক্ত নায়েবে নাজেমদের (গভর্নর) অধিকাংশই ছিলেন শিয়া ৷ ঢাকার হোসনি দালান এখনো সে সাক্ষ্য বহন করে চলছে ৷ বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত কারি গাদ্দার মীর জাফরও ছিলো শিয়া ৷ শেরে মইসুর টিপু সুলতানের সাথে গাদ্দারী করে তাকে ব্রিটিশদের কাছে হারিয়ে দেওয়া মীর সাদিক ও একজন শিয়া ।

বৃটিশ আমলে মিথ্যে নব্যুওয়্যাতের দাবীদার আহমদীয়া শিয়া গোলাম আহমেদ কাদিয়ানী তার অনুসারীদের নিয়ে তৈরি করে কাদিয়ানী সম্প্রদায় ৷ পাকিস্তানের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান ছিলো এই কাদিয়ানীর অনুসারী ৷ এখানে মুসলিম ভাই-বোনদের গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় মনে করিয়ে দেই গোলাম হোসেন, গোলাম নবী নামের সাথে এধরনের গোলাম শব্দটি সংযোজন আমাদের সমাজে এসেছে শিয়া সংস্কৃতি থেকে ৷ বর্তমানে অনেক আলেমের এ ধরনের নামের ব্যাপারে নিষেধ আছে ৷

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহের দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলো জরাথুস্টীয় ৷ তার একমাত্র মেয়ে দিনা বিয়ে করে ওয়াদিয়া নামের আরেক জরাথুস্টীয়কে ৷ ইন্দিরা গান্ধীর স্বামী ফিরোজ গান্ধীও ছিলো এই সম্প্রদায়ের ৷ এই জরাথুস্ট্রীয়রাও ইরান থেকে ভারতবর্ষে আসে ৷ এদের পার্সীও বলা হয় ৷ এদের নাম কিছুটা মুসলমানের মত হলেও এরা অগ্নি উপাসক ৷ হযরত ওমর (রাঃ) এর ঘাতক আবু লুলু ছিলো এই সম্প্রদায়ের ৷

পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ছিলো শিয়া ৷ পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ছিলো মীর জাফরের নাতি এবং একজন শিয়া ৷ যাদের নির্দেশে ২৫শে মার্চ কালোরাতে বাংলার নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের উপর পাকিস্তানী বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে সে জুলফিকার আলী ভূট্টো এবং ইয়াহিয়া খান ও শিয়া ৷

বাংলাদেশের অন্যতম বহু জাতিক কোম্পানী প্রাণ ও আরএফএল প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার মেজর (অব) আমজাদ খান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পক্ষ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে যুদ্ধ করেছেন ৷ সে একজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীও শিয়া ৷ আলোচিত নায়ক সালমান শাহ হত্যার অন্যতম খলনায়ক বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রিজের মাফিয়া ডন আরেক ব্যবসায়ী অলিম্পিক গ্রুপের মালিক আজিজ মোহাম্মদ ভাই ইসমাইলি বাহাই সম্প্রদায়ের শিয়া ৷ ট্রান্সকম গ্রুপ ও প্রথম আলোর কর্ণধার লতিফুর রহমান একজন শিয়া ৷ বৃটিশ আমল থেকে দেশের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যবসায়ি পরিবার ইস্পাহানি গ্রুপও শিয়া ৷

বাংলাদেশের বর্তমান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কয়েকজন শিয়া উপদেষ্টা আছে ৷ হাতে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না থাকায় তাদের নামটা লিখতে পারছি না, তবে কিছু দিন আগে দেখলাম বাংলাদেশে আগা খান উন্নয়ন নেটওয়ার্ক ১০টি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার ব্যাপারে বর্তমান সরকারের সাথে চুক্তি করেছে ৷

বৃটিশ আমলে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন আগা খান তৃতীয় । সে ইসমাইলি শিয়াদের ৪৮তম ইমাম । তৎকালীন বৃটিশ রানী ভিক্টোরিয়া ১৮৯৭ সালে নাইট কমান্ডার অফ ইন্ডিয়ান এমপায়ার এবং পরবর্তীতে রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড নাইট গ্রান্ড কমান্ডার উপাধীতে ভূষিত করেন ৷ এই ইসমাইলি ইমাম সম্পর্কে জানতে গুগলে aga khan with girls লিখে সার্চ দিতে পারেন ৷ দেখে নয়ন জুড়িয়ে যাবে, দিল খোশ্ হয়ে যাবে ৷

আইনস্টাইন, সিগমন্ড ফ্রয়েড, মার্ক জুকারবার্গের মত জ্ঞানীদের কারনে আমরা যেমন সব ইহুদীকে দোষ দিতে পারিনা, ঠিক সেকারনে সব শিয়াকেও দোষারোপ করতে পারি না ঢালাওভাবে ৷ আবার এও বলতে পারছি না, ইহুদীরা যেভাবে আজ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেভাবে ইরান বা শিয়াদের দ্বারা বাংলাদেশের মুসলমানরা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ৷ কারন আমাদের অনেক অসাম্প্রদায়িক ভাইয়ের মনে আঘাত লাগবে ৷

আমাদের অসাম্প্রদায়িক ইসলাম প্রিয় তৌহিদী জনতাকে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর একটা বাণী স্মরণ করিযে দিচ্ছি- "নিশ্চয় কিয়ামতের অন্যতম নিদর্শন হলো, কিয়ামতের পূর্বে লেখালেখির বিস্তার দৃষ্টিগোচর হবে ।'' (মুসনাদে আহমাদ: ৩৬৭৬) ৷ ইহূদী, খৃষ্টানরা, মোনাফিকরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি কোরআন হাদীস নিয়ে গবেষণা করে ৷

বিশ্বের নামকরা সব মিডিয়া আজ ইহুদী, খৃষ্টানদের দখলে এটা আমাদের সবার জানা আছে, কিন্ত আমাদের মাঝে কয়জন জানে, ইরানি মতাদর্শ (শিয়া মতাদর্শ পড়তে পারেন) প্রচারের জন্য ২০ লক্ষ ব্লগ, ১৫ হাজার তথ্যনির্ভর সাইট, ২০০ টি সংবাদপত্র এবং ১০০ টি ম্যাগাজিন কাজ করছে!

"সৌদী রাজ পরিবার ইসরাঈলকে স্বীকৃতি দিয়েছে", "গ্র্যান্ড মুফতি ইহুদীদের হত্যা করা হারাম ফতোয়া দিয়েছেন", "সৌদি ধর্ম মন্ত্রী বলেছেন, ভারতবর্ষের মুসলমানরা সব হিন্দু ", "সৌদী আরবে মদের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে" "সৌদি বাদশাহ হাঁচি দিছে", "সৌদি প্রিন্স কাশি দিছে", সৌদি নিয়ে গবেষণা করাই এসব মিডিয়ার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ৷

এসব মিডিয়ার সাথে ফেসবুকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছে লাখ, লাখ শিয়া মতাদর্শী ৷ তারা কেন এই ব্রত গ্রহণ করেছে তা আমি পূর্বের লেখাতে উল্লেখ করেছি ৷ এতগুলো মিডিয়াতে এক দিনে এক যোগে যখন একই সংবাদ প্রচার হয় তখন অনেক সুন্নী ভাই মনে করে যেন আসমানী কিতাব নাযিল হইছে ৷ প্রচার করলে দো'জাহানের অশেষ কামিয়াবী হাসিল হবে ৷ আবার অনেকে জোশে হুঁশ হারিয়ে সৌদীর পাছায় বাঁশ বাগান উজাড় করে ৷

দো'জাহানের অশেষ নেকী হাসিল আর বাঁশ বাগান খালি করার পূর্বে একবার ভাবুন! মনে করুন, চেয়ারম্যানের সাথে আপনার কোন বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য, মতবিরোধ, মনে কষ্ট আছে ৷ আপনার কাছে কেউ একজন খবর নিয়ে আসলো চেয়ারম্যানের জারজ পোলা হইছে ৷ ধরুন, খবরটা সত্য এবং আপনি কূটনা বুড়িদের মত হেঁটে হেঁটে সবাইকে খবরটা জানিয়ে দিলেন ৷ এতে আপনার দোজাহানের অশেষ নেকী হাসিল হবে কি না এ ব্যাপারে বিজ্ঞ আলেমগণ ভালো বলতে পারবেন ৷

কিন্তু খবরটা মিথ্যা হলে তওবা না করা পর্যন্ত নিশ্চিত আপনি আল্লাহর দরবারে চিহ্নিত হবেন মিথ্যুক এবং জালিম হিসেবে ৷ আর আল্লাহ জালিমের দোয়া কবুল করেন না এবং জালিমকে পথও প্রদর্শন করেন না ৷ হয়ত মরার পর আপনার বাঁশগুলো আপনার পাছাতেই ভাঙ্গা হবে ৷ মুমিনগণ যেন জালিমের অন্তর্ভূক্ত না হয় সেজন্য আল্লাহ সাবধান করে বলেছেন- "মুমিনগণ!যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোন সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতি সাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও ।(সূরা হুজুরাত:৬)"

আপনি আমাকে চিনেন না, আমার আমল-আখলাক সম্পর্কে আপনার কোন ধারণা নেই, আমি যে সংবাদ দিচ্ছি তা যাচাই-বাছাই করারও কোন সুযোগও নেই আপনার কাছে ৷ অথচ আমার দেওয়া সংবাদ শেয়ার, কপি করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন অন্যদের মাঝে! এর কারন আপনি অন্ধভক্তি করেন আমাকে ৷ আল্লাহ আপনাকে হাত, পা, চোখ, বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান কোন কিছুই কম দেননি অন্যদের থেকে ৷ অথচ, আপনি অন্ধের মত অনুসরণ, অনুকরণ করছেন অন্যকে! বর্তমান বিশ্বে কাফের, মুশরিক, মোনাফিকদের চেয়ে আমাদের বড় শত্রু আমাদের এসব অজ্ঞতা ৷

কখনো কি মনে প্রশ্ন জাগে, মিশরের সামান্য একজন ক্রীতদাসী শাজরাতুদূর, ককেশাসের সামান্য ক্রীতদাস রোকনুউদ্দিন যদি জেরুজালেম উদ্ধার করতে পারেন, আপনি, আমি, আমরা কোটি কোটি মুসলমান কেন আজ বদ নসীবদের কাতারে? কারন তারা আল্লাহর দ্বীন যতটুকু পালন করেছে, সৌদী, বাঙ্গালী বা হিন্দী যে দেশের মুসলমানের কথাই বলুন না কেন আমরা তা থেকে যোজন যোজন দূরে ৷ আমরা যদি তাদের পথে আসতে পারি তাহলে ব্লেম গেম খেলতে হবে না ৷ সারা দুনিয়ার মুসলমানদের অবস্থা এমনিতেই পরিবর্তন হয়ে যাবে ৷

মুসলমানগণ বিভিন্ন অঞ্চল বিজয়ের সাথে সাথে সেইসব অঞ্চলের বিভিন্ন সাহিত্য, দর্শন সহ নানা শাস্ত্র আরবীতে অনূদিত করতে শুরু করে৷ বিজ্ঞানের সাথে গ্রীসের দার্শনিক সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটোদের দার্শনিক শাস্ত্রও আরবিতে অনূদিত হয়। এই গ্রীক দর্শনের প্রভাবে যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানকে কেন্দ্র করে মুসলিম ধর্মশাস্ত্রে "মুতাজিলা" নামে নতুন ঘরানার এক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হয়৷

আব্বাসীয় খলিফা মামুন (১৯৫-২১৮ হিঃ) ছিলেন "মুতাজিলা"র পৃষ্ঠপোষক৷ খলিফা মামুন তার উত্তরাধিকারী হিসেবে শীয়া ইমাম রেজা কে মনোনীত করেন৷ শীয়া আলেম ও দার্শনিকরা এ সুযোগ লুফে নিয়ে খেলাফতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়ে, শীয়া মাযহাবের প্রচার ও প্রসারের কাজে ব্যবহার করে৷

জনাব শেখ সাফী আর্দেবিলী (মৃত্যু ৭৩৫ হিঃ) ছিলেন শীয়া মাযহাবের তরিকত পন্থী সুফী সাধক৷ হিজরী ৯০৬ সনে ঐ পরিবারের এক তরুণ তার বাবার ভক্ত মুরীদদের থেকে ৩০০ জন দরবেশের সহযোগীতায় একটি শক্তিশালী শীয়া রাষ্ট্র গঠণের উদ্দেশ্য "আর্দেবিলে" বিদ্রোহ করেন৷ তারা একের পর এক দেশ দখল করে ইরানের গোত্রীয় প্রশাসন ধ্বংস করে খন্ড-বিখন্ড ইরানকে একটি পূর্ণাঙ্গ একটি দেশে রূপ দেয়, এবং শীয়া মাযহাবকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান করে৷

সূফীমতের উদ্ভব সম্পর্কে বিদ্ধানগণ নানামত পোষণ করেন৷ Von kremer ও Dozy এর মতে, "বেদান্তের প্রভাবেই ইরানে সূফীমতের উম্মেষ হয় ৷" Merx ও Nicholson এর ধারণা, " নিও প্লেটোনিজম থেকেই এর উদ্ভব৷" E.G.Brown মনে করেন, "শামীয় আরব ধর্ম ইরানের ভাবপ্রবণ আর্য মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিলো, তা-ই সূফীতত্ত্বে রূপ লাভ করেছে৷"

ঐতিহাসিকদের কারো মতে "আস সৌফ" থেকে সূফী শব্দটির উৎপত্তি৷ "সৌফ" বলা হয় পশমী কাপড়কে৷ হিন্দু সন্যাসীদের ন্যায় মুসলিমদের এক শ্রেণী এই ধরনের সৌফ বা পশমী কাপড় পৱে নিজেদের সাধু পরিচয় দিতে থাকে, তখন থেকেই এই ধরনের সন্যাসীদের সূফী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়৷

আবার কারো মতে আরবের খৃষ্টানদের বৈরাগ্য, ইহুদীদের তত্ত্ববাদ, ইরানী জোরাস্টার, মানী, মজদক, বাইবেল, কোরআন প্রভৃতি ধর্ম গ্রন্থের যৌগিক প্রক্রিয়ার সমন্বয়ে যে মতবাদ উদ্ভব হয় তাই সূফী মতবাদ৷ সূফীবাদের সংজ্ঞা যাই হোক, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর যুগ এবং সাহাবীগণের যুগে এটি ছিলো না৷ ইসলাম প্রচারের প্রায় ১৫০ বছর পরে এই মতবাদের উদ্ভব হয়৷

দশম-একাদশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে অন্যান্য ধর্মাবলী সম্প্রদায়ের সাথে এদেশে সূফীদেরও আগমন ঘটে৷ তখনকার দিনে জাহাজে করে ইরানের বন্দর আব্বাস থেকে ভারতবর্ষের সমুদ্র তীরবর্তী সিন্ধু প্রদেশে যাতায়াতের পথ অনেক সুগম ছিলো৷ ইরানী যৌগিক প্রক্রিয়া নির্ভর সূফী মতবাদের সাথে দক্ষিণ ভারতের "ভক্তিধর্ম", উত্তর ভারতের "সন্তধর্ম" আর বাংলার "বৈষ্ণব" ও "বাউল" মতবাদের প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফল ভারত বর্ষের "সূফীবাদ"৷

এ অঞ্চলে সাধারণত ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন সূফী-দরবেশগণ৷ যেহেতু অধিকাংশ মুসলমান এদেশী জনগণেরই বংশধর; সেহেতু পূর্ব পুরুষের ধর্ম, দর্শণ, সংস্কার ত্যাগ করা পুরোপুরি সম্ভব হয়নি৷ সঙ্গত কারনেই সূফী সাধকের কাছে দীক্ষিত মুসলমানরা শরীয়তের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেনি৷ এদেশে যত ধর্ম প্রচারক এসেছেন বেশীর ভাগের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় কেউ বাঘের পিঠে, কেউ জায়নামাযে, কেউ কুমিরের পিঠে করে বিভিন্ন কেরামতির গুণে৷

মুজিযা, কেরামত বা অলৌকিকত্ব নিয়ে ডঃ খন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহঃ) এক লেকচারে বলেন, "ক্বোরআন নিজেই একটি মুজিযা৷ মাস্টার্স পড়ুয়া বাংলা সাহিত্যে একজন ছাত্র গীতাঞ্জলী কাব্য গ্রন্থ মুখস্ত বলতে পারবেনা৷ কিন্তু সাত বছরের একটা ছাত্র নির্ভুল ভাবে ক্বোরআন মুখস্ত করতে পারে৷ ইসলাম পালন করতে হয় ক্বোরআন এবং হাদীস দিয়ে৷ মুজিযা বা কেরামত দিয়ে নয়৷"

সৌদী আরবে এতদিন সাধারণত "মুতাজিলা", "সূফীবাদ" এসবের চর্চা ছিলো না৷ এখানে সাধারণত ক্বোরআন এবং হাদীসেরই চর্চা হত৷ যার কারনে আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কেরামত প্রিয় মুসলমান ভাইদের কাছে সৌদী আরব ছিলো একটি ধর্মান্ধ মৌলবাদী, পশ্চাৎপদ, বর্বর রাষ্ট্র৷ এখন যখন তারা এসব থেকে সরে এসে মডারেট বা উদার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন আরেক দল "ধর্ম গেলো", "ধর্ম গেলো" বলে চিৎকার শুরু করছে৷

যেসব ধার্মিক ভাইয়েরা ধর্ম গেলো শোর তুলেছেন তাদের জেনে রাখা দরকার, সৌদি ব্যতিত প্রায় মুসলিম দেশেই সরকার অনুমোদিত পতিতালয় আছে৷ এতদিন সৌদি ব্যতিত কাতার, আমিরাত, ওমান, বাহরাইন সহ রাজতান্ত্রিক সকল দেশেই আমাদের দেশ সহ বিভিন্ন দেশের শিল্পীরা এসে কনসার্ট করত৷

যে ফিলিস্তিনের জন্য আমরা কান্না করি, সে ফিলিস্তিনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়৷ ইরানী চলচ্চিত্র অস্কার পুরষ্কার পায়, মিশর চলচ্চিত্রের চেয়েও বেলী ড্যান্সের জন্য বিখ্যাত, তুরষ্কে ১৮+ চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়৷ প্রায় মুসলিম দেশেই সিনেমা হল আছে৷ আমাদের মত মডারেট মুসলমানদের কাছে এসবই হলো আধুনিকতা৷

ধার্মিক ভাইদের একটু খেয়াল রাখা প্রয়োজন, দাজ্জালের আগ্রাসন থেকে "মক্কা" এবং "মদীনা" মাত্র দু'টো জায়াগাকে নিরাপদ ঘোষণা করা হয়েছে৷ দাম্মাম, রিয়াদ, জেদ্দা, মিশর, তুরষ্ক কিংবা আরবের অন্যান্য দেশগুলোর কথা বলা হয় নাই৷ তারপরেও সৌদী আরবের কথা শুনলে আমাদের দেশের ধার্মিক মানুষের মনে বিশাল এক পূণ্যভূমি ভেসে উঠে৷

সৌদী আরব যখন জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, সংস্কৃতির মত তথাকথিত আধুনিকতার নগ্ন থাবা থেকে দূরে ছিলো তখন আমাদের ধার্মিক ভাইয়েরা তাদের নেক নজরে দেখতেন কি? যদি তখন নেক নজরে দেখে থাকেন তাহলে এখন আপনার ব্যথিত হওয়া অবশ্যই জায়েয আছে৷

আর যারা তখন ধর্মান্ধ, মৌলবাদী ভেবে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকাতেন, এখন ধর্ম গেলো বলে ঢোল পিঠিয়ে নিজেকে সূফী প্রমাণ করতে চাইছেন! এটা তাদের ধার্মিকতা না অন্ধ বিদ্বেষ সেটা অন্তর্যামীই ভালো জানেন৷

শীয়া ইসমাঈলী সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, হযরত আদম (আঃ) কে সৃষ্টির পর, আল্লাহ তাঁর নূরের খানিকটা আদমের শরীরে ঢেলে দেন৷ সে নূর আদম থেকে বংশানুক্রমে মূসা (আঃ), নূহ (আঃ), ইব্রাহীম (আঃ), সোলেমান (আঃ), দাউদ (আঃ) থেকে শেষ পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পিতামহের নিকট পৌঁছায়৷

সেই নূরের এক অংশ মুহাম্মদ (সাঃ) এবং অন্য অংশ তাঁর চাচাত ভাই হযরত আলী (রাঃ) শরীরে স্থানান্তিরত হয়৷ হযরত আলী (রাঃ) মুহাম্মদ (সাঃ) এর মেয়েকে বিবাহ করার পর আলীর ছেলে হুসাইন (রাঃ) এর শরীরে আবার সেই দ্বিখন্ডিত নূর সংযুক্ত হয়৷ তারপর সেই নূর বংশানুক্রমে চলে এসেছে তাদের ইমাম প্রিন্স আগা খানের শরীরে৷ (ময়ূর কন্ঠী, ঋতালী: সৈয়দ মুজতবা আলী)

ইসমাঈলীদের বিশ্বাস অনুযায়ী হযরত আদম (আঃ), হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সহ অন্যান্য নবীগণ নূরের তৈরী বা তাঁদের শরীরে আল্লাহর নূর বিদ্যমান৷ (শীয়ারা কিভাবে ভারতবর্ষে প্রভাব বিস্তার করেছে, এই সিরিজের পূর্বের লেখায় তা নিয়ে সামান্য আলোকপাত ছিলো) বাংলাদেশের আলেমগণের মধ্যে এক দল মনে করেন রাসূল (সাঃ) নূরের তৈরি, আরেক দল মনে করেন রাসূল (সাঃ) মাটির তৈরি৷

রাসূল (সাঃ) কিসের তৈরি সে বিতর্কে আমরা যেতে চাই না৷ জীব বিজ্ঞান বা মেডিকেল শিক্ষার্থীরা যদি মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ নিয়ে আলোচনা করে সেটি দোষের কিছু নয়, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে তা প্রকাশ করতে গেলে অশ্লীলতার দোষে দুষ্ট হবে৷ কেমিস্ট্রির একজন ছাত্রের কাছে এ্যাসিড থাকতে পারে, কিন্তু তা জনসম্মুখে প্রদর্শণ করা দন্ডনীয় অপরাধ৷

ধর্মীয় গবেষণামূলক বিষয়গুলোও আলেমদের কাছে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত ছিলো, কিন্তু ঊনারা তা না করে এসব নিয়ে দলাদলিতে লিপ্ত হয়েছেন৷ অনেকে বলতে পারেন ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষায়তো গোপনীয়তার কিছু নেই৷ হ্যাঁ অবশ্যই নেই, তবে আমাদের এতটুকু মনে রাখতে হবে, যে কোন শিক্ষায় মানুষ ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়৷ কেউ প্রাইমারি না পড়ে, হাই স্কুলে ভর্তি হতে পারে না৷ আমাদের অধিকাংশ লোকের সূরা ফাতিহা পড়লে উচ্চারণ এবং ব্যাকরণগত ভুল হয়৷

এক শ্রেণীর বক্তা আছেন, যারা রাসূল (সাঃ) নূরের তৈরি? না মাটির তৈরি? সেসব নিয়ে আলোচনা করে ওয়াজের মাঠ গরম করেন৷ এ বিতর্কে শামিল হয়ে আমাদের মত মূর্খ মুসলমানরা একজন আরেকজনের মাথা ফাটিয়ে দেই৷ এতে মুসলমানদের লাভ হলো না ক্ষতি হলো? তা এসব বক্তাগণের ভাবার সময় নেই৷

সৌদী আরবে সাধারণত ধর্ম নিয়ে এধরনের দলাদলি, ফাটাফাটি বা ব্যবসা করার সুযোগ নেই৷ যারা হজ্ব বা ওমরাহ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, এবং যারা ভবিষ্যতে করার আশা পোষণ করেন, তারা একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন- কেউ বুকের উপর, কেউ পেটের উপর, কেউ নাভীর উপর, কেউ হাত না বেঁধে বিভিন্ন দেশের মানুষ বিভিন্নভাবে নামায পড়ছে৷ কেউ কাউকে বাধা দিচ্ছে না৷

এখানে তাহাজ্জুদের নামায সহ মোট ছয় ওয়াক্ত নামাযের আযান দেওয়া হচ্ছে৷ তাহাজ্জুদের নামাযকে তারা ফরয নামাযের মতই গুরুত্ব দেয়৷ আযানের পর থেকে জামাত শেষ হওয়া পর্যন্ত ব্যবসা, বাণিজ্য অফিস সহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ৷ এখানকার মানুষ মসজিদে আসার পর দুই রাকআত তাহিয়্যাতুল মসজিদের নামায আদায় করেন৷ কোন কারনে নামাযের জামাত না পেলে আমাদের মত যার যার নামায সে পড়ে বিদায় হয় না, দু'জন হলেই তারা জামাত করে নামায আদায় করে৷

আপনার কোন ধর্মীয় ভুল আচরণ তাদের চোখে পড়লে তারা আপনাকে বলবে, হাদা বিদআ্ অর্থাৎ এটি বিদআত৷ তারপর সঠিক পন্থা জানিয়ে বলবে, হাদা সুন্নাহ্ অর্থাৎ এটি সুন্নাত৷ এরপর মানা না মানা আপনার ব্যাপার৷ মানলে কেউ আপনাকে পুরুষ্কৃত করবে না, না মানলে আপনাকে কেউ বিদাতি বলে তিরষ্কারও করবে না৷ যেহেতু আরবী তাদের মাতৃভাষা, তাই ধর্মীয় প্রাথমিক শিক্ষাটা তারা পরিবার থেকেই পেয়ে যাচ্ছে৷ আর উচ্চতর শিক্ষার জন্যতো মাদ্রাসা আছেই৷

আলেমদের মত আমাদের মাদ্রাসাগুলোও বিভক্ত৷ যেসব মাদ্রাসায় রাসূল (সাঃ) নূরের তৈরি আক্বীদার ওস্তাদ আছেন তারা আবার ঈদে মিলাদুন্নবী, শবে বরাত, ফাতেহা ই ইয়াজদহম ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান জাঁকঝমকের সাথে পালনের শিক্ষা দিয়ে থাকেন৷ ঊনাদের মতে ঊনারা আওলাদে রাসূল, আশেকে রাসূল, সুন্নী ইত্যাদি৷

অন্যদিকে যারা রাসূল (সাঃ) মাটির তৈরি শিক্ষা দেন, তাদের মতে ঈদে মিলাদুন্নবী, শবে বরাত, ফাতেহা ই ইয়াজদহমের মত অনুষ্ঠানগুলি বিদআত৷ সৌদী আলেমগণের মতেও এগুলো বিদআত, এবং এখানে রমজান এবং ঈদ ব্যতীত আর কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদ্দীপণার সহিত পালন করা হয় বলে অধমের জানা নেই৷

মিলাদুন্নবী পালনকারীদের মতে যারা রাসূল (সাঃ) কে মাটির তৈরি মনে করে, তারা ওহাবী এবং সৌদীদের দালাল৷ যাদেরকে ওহাবী বলা হয় তাঁরা সাধারণত সীরাতুন্নবী পালনের পক্ষে৷ যেহেতু মিলাদুন্নবী ত্বরীকার আলেমগণের সাথে সৌদী আলেমগণের বিশাল মতভেদ রয়েছে, সেহেতু তাদের থেকে আপনি সৌদী সম্পর্কে কোন পজেটিভ ধারণা পাবেন না৷

ওহাবী বা সীরাতুন্নবী পালনকারীগণ কেন সৌদী আরবের প্রতি নেগেটিভ ধারণা পোষণ করেন?

ছোট্ট একটা গল্প বলি--

এক লোক তার স্ত্রীকে তালাক দিবে৷ বৈঠকে গ্রাম্য সালিশদাররা জিজ্ঞেস করলো, তুমি তাকে তালাক দিবা কেন? লোকটা উত্তর দিলো, সে কাইত হয়ে ঘুমায়৷ সালিশদাররা বললো, ঠিক আছে সে এখন থেকে চিৎ হয়ে ঘুমাবে৷ লোকটা বললো, সে চিৎ হয়ে ঘুমাইলে নাক ডাকে৷ সালিশদাররা বললো, ঠিক আছে সে এখন থেকে আলাদা বিছানায় ঘুমাবে৷ লোকটা বললো, এর চেয়ে তালাক দেওয়াইতো ভালো৷

স্ত্রীর কাইত, চিৎ বা নাক ডাকা লোকটার সমস্যা না৷ সমস্যা হলো তালাকের প্রতি সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ৷ একত্রে থাকার জন্য তাকে যত রকম সমাধানই দেওয়া হোক না কেন, সে কিন্তু ঘুরেফিরে তালাকই বেছে নিবে৷ কেউ যখন মনের মাঝে কোন বিষয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে, তখন আল্লাহ না চাইলে দুনিয়ার কেউ তাকে পরিবর্তন করতে পারে না৷

কেউ যদি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে থাকেন যে, সৌদী আরবের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা তার বিশাল বড় ঈমাণী দায়িত্ব এবং এর দ্বারা তিনি দোজাহানের অশেষ নেকী হাসিল করছেন, ঊনাকে অধম বিন্দু মাত্র বাধা দেই না৷ এই সিরিজের লেখাগুলো আল্লাহর সেসব ঈমাণদার বান্দাগণের জন্য নয়৷ যারা বিভিন্ন সময় সৌদী নিয়ে কৌতুহল প্রকাশ করে বিভিন্ন প্রশ্ন করে থাকেন, সেসব কৌতুহলী ভাই-বোনদের জন্য এই লেখা।

উপমহাদেশের কাওমী আলেমগণের সাথে সৌদী আরবের আলেমগণের অনেকাংশে মিল থাকায় "ঈদ এ মিলাদুন্নবীর" সমর্থকগণ সব সময় কাওমী মাদ্রাসার আলেমগণের বিরূদ্ধে "ওহাবী", "সৌদী দালাল", "দরবারী আলেম" ইত্যাদি অভিযোগ উত্থাপন করে আসছিলেন৷ কাওমী আলেমগণের সেসব নিয়ে তেমন কোন উচ্চবাচ্য ছিলো না৷ কিন্তু ইদানীং কাওমী আলেমগণের মাঝেেও একদল সৌদী বিদ্বেষী আলেম তৈরী হয়েছেন৷ তাদের এই বিদ্বেষের পেছনে কাজ করছে "আহলে হাদীস"৷

প্রায় গত চার বছর হজ্ব মৌসুমে ভারতীয় দূতাবাসের কিছু স্বেচ্ছাসেবক ভাইয়ের সাথে অধম একটা পার্ট টাইম জব করেছিলাম৷ এই স্বেচ্ছাসেবক ভাইদের প্রায় সবাই দেওবন্দ মাদ্রাসার সাবেক এবং বর্তমান মদীনা ইউনিভার্সিটির ছাত্র৷ ঊনাদের সাথে আলাপ করে যেটা জানলাম, সৌদী আরবে "আহলে হাদীস" বলে কোন মতবাদ নেই৷ তাহলে আমাদের দেশে "আহলে হাদীস" কিভাবে এলো?

মুসলিম ঐতিহাসিক গোলাম আহমেদ মোর্তজার মতে আঠারশ শতকে শাহ আহমেদ, সৈয়দ আহমেদ বেরেলভী, হাজী শরীয়তউল্যাহ সহ প্রমূখ যখন ইংরেজ বিরোধী জিহাদকে বেগবান করার জন্য মুসলমানগণকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছিলেন, তখন ইংরেজরা এসব আন্দোলনের নাম দেয়, "আহলে হাদীস আন্দোলন", "ওহাবী আন্দোলন", "ফরায়েজী আন্দোলন" ইত্যাদি ৷

মুসলমানরা যাতে ঐক্যবদ্ধ না হতে পারে সে জন্য এক শ্রেণীর ইংরেজ গুপ্তচর গুজব রটায় যে এসব আন্দোলনের সাথে মূল ইসলামের কোন সম্পর্ক নাই৷ দ্বিধায় পড়ে স্বাভাবিক ভাবেই মুসলমানগণ তখন বিভক্ত হয়ে যায়( বিস্তারিত: ইতিহাসের ইতিহাস, চেপে রাখা ইতিহাস)৷ ডঃ আহমেদ শরীফ তার "বাউল তত্ত্ব" গ্রন্থে বলেন, ঊনিশ-বিশ শতকে আহলে হাদীস আন্দোলনের ফলে মুসলমান বাউলেরা অনেকে শরীয়তী ইসলামে ফিরে এসেছে৷

ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যে আহলে হাদীসকে নিয়ে আমরা এখন নতুন করে আলোচনা করছি প্রায় দুই, আড়াইশ বছর আগেই এটির অস্তিত্ব ছিলো৷ ইতিহাস বিমুখতার কারনে এসব আমাদের সামনে আসেনি৷ ডাঃ জাকির নায়েককে কেন্দ্র করে এই বিতর্ক আমাদের সামনে নতুন ভাবে এসেছে৷

মানুষ হিসেবে ডাঃ জাকির নায়েক ভুলের উর্ধ্বে নয়, কিন্তু দ্বীনী স্বার্থে ঊনার ভুলের আলোচনা-সমালোচনা না করে, ঊনাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা এক শ্রেণীর কাওমী আলেমগণের ওয়াজের প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ঊনাদের ওয়াজ শোনে অনেকেই ডাঃ জাকির নায়েকেকে নিয়ে সংশয়ে ছিলেন৷ সৌদী সরকার কর্তৃক "কিং ফয়সাল এ্যাওয়ার্ড" প্রদানের মাধ্যমে অনেকের সে সংশয় দূর হয়েছে৷ ফলে এতদিন যারা ঊনার নিন্দা করতেন নিজেদের রক্ষা করার তাগিদেই তারা এখন ঊনাকে আহলে হাদীস উল্লেখ করে ঊনার সাথে সাথে সৌদী আরবেরও নিন্দা করে থাকেন৷

উপমহাদেশের কাওমী আলেমগণের মাঝে আরেক দল আছে পীর পন্থী৷ পীর ফার্সী শব্দ৷ এটি বাংলা মুরুব্বী, আরবী শায়খ এর সমার্থক শব্দ৷ উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে পীরগণের অবদান অনস্বীকার্য৷ উপমহাদেশে যত পীর ছিলেন সবাই ইসলামের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে স্ব স্ব মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন৷ কিন্তু বর্তমানে অনেকে পীরপ্রথাকে উত্তরাধিকার সম্পত্তির মত বন্টন শুরু করেছেন৷ কিন্তু পীর প্রথাতো কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় এটি ইলম বা জ্ঞানের বিষয়৷ আর জ্ঞান আল্লাহর দান, এটি কারো বেশি বা কম থাকতে পারে৷

বাইতুল্লাহ এবং মসজিদে নববীতে যদি আপনার পরিচিত কেউ কর্মরত থাকে, তাদের কাছ থেকে খোঁজ নিলে জানতে পারবেন এখানকার শায়খগণ রমজান এবং ঈদ উপলক্ষ্যে শ্রমিকদের বখশিস বা হাদিয়া প্রদান করে থাকেন৷ সৌদী আরবের শায়খগণ যখন গরীবদের দান করে নিজেদের পকেট খালি করছেন, আমাদের পীরগণ তখন গরীবদের দান গ্রহণ করে নিজেদের পকেট ভর্তি করছেন৷ কোনটি উত্তম? সেটা আমাদের বিজ্ঞ ইসলামী চিন্তাবিদগণ ভালো বলতে পারবেন৷

পীর পন্থার সাথে আবার সূফীবাদ জড়িত৷ সূফীবাদ সম্পর্কে এই সিরিজের পূর্বের লেখায় সামান্য ধারণা দিয়েছিলাম৷ সৌদী আলেমগণের মতে এটি ইসলাম বিধ্বংসী মতবাদ৷ পীর এবং সূফী পন্থী কাওমী আলেমগণ সাধারণত সৌদী আরবের প্রতি ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন না৷ বাংলাদেশের কাওমী আলেমগণের মাঝে অনলাইনে অফলাইনে বর্তমানে আহলে হাদীস বনাম মাযহাব লড়াইটাও চোখে পড়ার মত৷

প্রতি শুক্রবার FM রেডিওতে বাইতুল্লাহ এবং মসজিদে নববীর খুতবাকে বিভিন্ন ভাষায় তর্জমা করা হয়৷ যেহেতু বাংলায় তর্জমার ব্যবস্থা এখনো করা হয়নি তাই আমাদেরকে 105.0 MHz উর্দূটাই শোনতে হয়৷ এখানকার আলেমগণ বলেন, "সিহাহ সিত্তাহ"র বাইরেও অনেক হাদীস আছে, সেগুলোতেও আমল করতে হবে৷ আবার হাদীসের নামে অনেক জাল হাদীসও আছে, সেগুলো থেকেও সাবধান থাকতে হবে৷ কোনটি সহীহ এবং কোনটি জাল সেটি নির্ভর করছে বর্ণণাকারী এবং সমর্থকদের উপর৷ ঊনারা যখন কোন হাদীস বলেন, হাদীসের বর্ণণাকারী এবং এটি সহীহ হওয়ার পক্ষে কে কে সাক্ষ্য প্রদান করেছেন তা উল্লেখ করেন৷

মাযহাব সম্পর্কে দেওবন্দ মাদ্রাসার সাবেক এবং বর্তমান মদীনা ইউনিভার্সিটির তালেব ইলম ভাইদের সাথে আলাপ করে যেটা জানলাম, তাদের মতে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) ফীকহ শাস্ত্রবিদ৷ আমরা যে চার মাযহাবের ইমামগণকে জানি তারা সবাই ফকীহ৷ এর বাইরেও অনেক ফকীহ আছেন৷ যেসব বিষয়ে ক্বোরআন এবং হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে সেসব বিষয়ে ফীকহ শাস্ত্রের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে না৷

কোরআন এবং হাদীসের বাইরে কোন ফতোয়া নিয়ে তারা যখন গবেষণা করেন তখন চার মাযহাবের বাইরে অন্যান্য ফকীহগণ যেমন- ইমাম বুখারী (রহঃ), হাসান বসরী (রহঃ) ইমাম গাযযালী (রহঃ), ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ), ইমাম নাসিরূদ্দীন আলবানী (রহঃ) এরকম বিখ্যাত ফকীহগণ কি মতামত প্রদান করেছেন এবং অধিকাংশের মতামত কি, এর মাঝে কার মতামতটা কোরআন এবং হাদীসের কাছাকাছি পর্যায়ের তা থেকে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছান৷

আমাদের দেশে আহলে হাদীস এবং মাযহাব পন্থী যারা আছেন তারা গবেষণা করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার চেয়ে, একদল আরেকদলকে "বিদাতি", "আহলে খবিস" এ জাতীয় কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করে বেশি আনন্দ পান৷ তাদের এসব কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি দায়ভার ঊনারা সৌদীর উপর চাপিয়ে দেন৷

আমরা সাধারণত রমজানের সাতাইশ তারিখে শবে ক্বদর পালন করি, কিন্তু এখানকার মানুষ বিশ রমজানের পর থেকেই শবে ক্বদরের তালাশে নফল ইবাদত শুরু করে৷ সোম এবং বৃহঃবার সপ্তাহে দুই দিন, মাসে আট দিন রোজা রাখে৷ প্রায় জামে মসজিদে রোজাদারদের ইফতারের ব্যবস্থা থাকে৷ ইফতারের আয়োজককে অধিকাংশ লোকেই চিনেনা৷ অথচ আমাদের দেশে ইফতারের আয়োজন নিয়েও দলাদলি চলে৷

আমরা ধর্ম না বোঝলেও দলবাজি ভালোই বুঝি, যার কারনে বাংলাদেশর মত ছোট্ট দেশে ৫৪টি শুধু ইসলামী দলই আছে৷ এসব দলের নেতাদের নিজেদের বেহেশত ঠিক থাকুক বা না থাকুক সমর্থকদের কাছে এরা পাইকারী দরে বেহেশতের টিকেট বিক্রি করে যাচ্ছে৷ আপনি ব্যক্তি জীবনে ইসলাম পালন করতে পারেন আবার নাও করতে পারেন কিন্তু ইসলাম নিয়ে ব্যক্তিগত মতামত প্রদান করে নেতাগিরি, দলাদলি, দলভারী করার কোন সুযোগ নেই সৌদী আরবে৷

টঙ্গীর মাছিমপুরে "নুরে মদিনা হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা" নামে একটা মাদ্রাসা আছে৷ প্রতি বছর হাফেজদের পাগড়ী প্রদান উপলক্ষ্যে সেখানে একজন আলেমকে দাওয়াত দেওয়া হত৷ আলেম সাহেব ষাট বছর বয়সে হাফেজ হয়েছেন৷ তৎকালীন সময়ে একটা ইসলামী দলের মহাসচিব৷

পাগড়ী প্রদান অনুষ্ঠানে মাদ্রাসার ছাত্ররা গায়, "মনে বড় আশা ছিলো যাবো মদিনায়৷" আলেম সাহেব চিৎকার দিয়ে বলেন, মদিনায় যাই কি করবেন? ওহাবীর গোষ্ঠীরা মদিনাটা শেষ কইরা দিলো৷ আমার প্রিয় সাহাবীগো রওজা মুবারক ভাইঙ্গা গুঁড়া গুঁড়া কইরা দিছে৷ আহারে আমার সোনার মদিনা! বলেই তিনি বুক ফাটা কান্না শুরু করেন৷

বাঙ্গালীর নরম দিল৷ তারা ফিলিস্তিনের জন্য কাঁদে, ফ্রান্সের জন্য কাঁদে, শ্রীদেবীর জন্য কাঁদে, আফগানিস্তানের জন্য কাঁদে, খেলায় হেরে কাঁদে, সিনেমা দেখে কাঁদে, রাজনীতি দেখে কাঁদে, অন্যের সুখে কাঁদে, অন্যের দুখে কাঁদে, কারনে কাঁদে, অকারনে কাঁদে ৷ আর হুজুরের কান্না দেখে, না কেঁদে কি পারে? আমরা মনে মনে ভাবি, কবে যে এই ওহাবী সৌদীদের থেকে মক্কা-মদীনা রক্ষা পাবে! কবে আমরা মদীনায় যাই দুইটা আগরবাতি আর মোমবাতি জ্বালানোর সুযোগ পাবো!

আরেকজন বিখ্যাত আলেম, তৎকালীন সময়ে প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে তার ওয়াজের ক্যাসেট ছিলো৷ তিনি তার এক ওয়াজে বলেন- আমি মদিনা গেলাম৷ মদিনার ছোট ছোট ছেলেরা আমাকে জান্নাতুল বাক্বীতে দেখিয়ে দিচ্ছে এটা অমুক সাহাবীর কবর, ওটা তমুক সাহাবীর কবর৷ আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম, এত ছোট ছোট বাচ্চারা কিভাবে এত সাহাবীর নাম মুখস্ত করেছে!

ঊনার ওয়াজ শোনে নিজের প্রতি ধিক্কার আসে, আজ পর্যন্ত দুনিয়াতে বেহেশতের সুসংবাদ পাওয়া দশজন সাহাবীর নাম শেখা হলো না! সেই সাথে দ্বিধায়ও পড়ে যাই! হাফেজ সাহেব বললেন, ওহাবীরা সব কবর গুঁড়া গুঁড়া করে দিয়েছে৷ আবার বক্তা বলছেন, মদিনার ছোট ছোট বাচ্চাদের সব সাহাবীর নাম মুখস্ত৷ কেমনে কি!

মাদ্রাসার পাশেই অলিম্পিয়া মতি মসজিদ৷ মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি আবদুল কাইয়্যুম সাহেব৷ তিনি অন্যদের মত অত রসালো ওয়াজ করেন না৷ তিনি বলেন- কবর নিয়ে আমাদের দেশে যা হয় তা শিরক, বিদআত৷ কবরের ব্যক্তির কোন কিছু করার ক্ষমতা নেই৷ মুফতি সাহেবের উপর আমাদের কিছুটা বিরক্তিও আছে, ঊনি তবারক, মিষ্টি, মিলাদ এসবকেও বিদআত বলেন৷

আমাদের মত সাধারণ মানের মুসলমানদের ক্বোরআন-হাদীস থেকে ইসলামকে জানার সুবিধা খুবই কম, বা ক্বোরআন-হাদীস থেকে ইসলামকে জানতে আমরা ততটা আগ্রহী নয়৷ সেক্ষেত্রে বিভিন্ন আলেমগণই আমাদের ভরসা৷ কিন্তু একই বিষয়ে যখন ভিন্ন ভিন্ন আলেমের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায় তখন আমরা বিভক্ত হয়ে যাই৷ যে যে আলেমকে ভক্তি বা শ্রদ্ধা করেন তিনি তাকে অন্ধভাবে সমর্থন করতে থাকেন৷ আবার কেউ কেউ আমার মত সংশয়বাদী মন নিয়ে বড় হন৷

আলহামদুলিল্লাহ! এটি আমার সৌভাগ্য যে সাহাবীদের স্মৃতি বিজড়িত তিনটি স্থান আমার যিয়ারত করার সুযোগ হয়েছে৷ মদিনা থেকে প্রায় দুইশ কিঃ মিঃ দূরে বদর প্রান্তর৷ এর সাথে ছোট একটি মসজিদ রয়েছে, মসজিদের সামনে বদর যুদ্ধে শহীদ হওয়া ১৪ জন সাহাবীর নাম সম্বলিত একটি স্মৃতিফলক আছে৷ চারদিকে ইটের দেয়ালে ঘেরাও করা স্থানটি বর্তমানে স্থানীয়দের গোরস্থান হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷ এর এক কোনে সাহাবীগণের কবর সংরক্ষিত আছে৷

মসজিদে নববী থেকে প্রায় আট-দশ কিঃ মিঃ দূরে জাবালে উহূদ বা উহূদ পাহাড় অবস্থিত৷ এ পাহাড়ের পাদদেশে উহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়৷ এ যুদ্ধে রাসূল (সাঃ) এর আপন চাচা হযরত হামযা (রাঃ) সহ ৭০ জন সাহাবী শহীদ হন৷ উক্ত পাহাড়ের পাদদেশে হযরত হামযা (রাঃ) সহ শুহাদায়ের উহুদের কবর সংরক্ষিত রয়েছে৷ তবে আমাদের দেশের মত উঁচু না, সমতল ভূমিতে ইটের ঘেরাও করা৷ প্রতিদিন হাজার হাজার যিয়ারতকারীগণ উক্ত কবর যিয়ারত করেন৷

মসজিদে নববীর সামান্য পূর্ব দক্ষিণ দিকে ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ বিশাল কবরস্থান "জান্নাতুল বাক্বী" অবস্থিত৷ এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন অগণিত সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন, আউলিয়ায়ে কেরাম৷ এ কবরস্থানের বর্তমান বর্তমান আয়তন প্রায় ১৭৪৯৬২ বর্গ মিটার৷ এখানকার ভিতরের কবর গুলো ব্লকে ভাগ ভাগ করা৷ প্রবেশ মুখে হাতের ডান পাশে বেশ কিছু কবর সংরক্ষিত আছে, অনেকের ধারণা এগুলোই সাহাবীগণের কবর৷ তবে নির্ধারিতভাবে কারো নামের উল্লেখ নেই৷ আমি বেশ কয়েকবার এখানকার সিকিউরিটি গার্ডদের প্রশ্ন করেছিলাম, এগুলো সাহাবীগণের কবর কি না? প্রতিবারই একই প্রকার জবাব পেয়েছি, তারা বলেন- হতে পারে, আবার নাও হতে পারে, আল্লাহ অধিক ভালো জানেন৷

আরবের লোকদের কোন কিছু সম্পর্কে যদি ধারণা না থাকে তাহলে তারা সাধারণত বিষয়টা আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে বলে- আল্লাহ অধিক ভালো জানেন৷ কিন্তু আমাদের দেশের অনেক বড় বড় আলেমও অনুমানের উপর কথা বলে থাকেন৷ যেমন- উপরে দু'জন বক্তার কথা উল্লেখ করেছি৷ আল্লাহ পাক যদি আমাকে এই পূণ্য ভূমি যিয়ারতের সুযোগ না দিতেন, তাহলে আমাকে ঐ আলেমগণের কথার উপর বিশ্বাস করে সারা জীবন একটা মিথ্যা ধারণার উপর থাকতে হত৷

তাহলে কি সৌদী আরবে সাহাবীগণের কবর ধ্বংস করা হয় নি?হ্যাঁ, কিছু সাহাবীগণের কবরকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশের মত কবর কেন্দ্রিক শিরক, বিদআত জমে উঠেছিলো৷ সেগুলো মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব (রহঃ) নেতৃত্বে ধ্বংস করে দেওয়া হয়৷

এখানে আপনাকে বোঝতে হবে জমির সব কীট কিন্তু ফসলের জন্য ক্ষতিকর নয়, আপনি যদি সে উপকারী কীটের কথা চিন্তা করে জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ বন্ধ রাখেন তাহলে আপনি কখনো ভালো ফসল পাবেন না৷ একটা কবর ধ্বংস করে যদি হাজার হাজার মানুষকে শিরক, বিদআত থেকে ফেরানো যায়, তাহলে সেটি ধ্বংস করা জায়েয কি না সে ব্যাপারে বিজ্ঞ আলেমগণ ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন৷

মদিনাবাসীর মাঝে অপরাধী এবং আত্মহত্যাকারী ব্যতীত বাকি লোকদের জান্নাতুল বাক্বীতে দাফন করা হয়৷ সাধারণত আমাদের দেশের অনেকের আকাংখা থাকে জান্নাতুল বাক্বীতে দাফন হওয়ার, কিন্তু এখানকার রাজ পরিবারের কাউকে জান্নাতুল বাক্বীতে দাফন করা হয় না৷ বিষয়টাকে আপনি নেগেটিভভাবে দেখলে এভাবে বলতে পারেন- ওহাবীর বংশধরদের কপালে জান্নাতুল বাক্বীর মাটি নাই৷

কিন্তু বিষয়টাকে আপনি যদি পজেটিভভাবে দেখেন তাহলে- আপনাকে মনে রাখতে হবে মদীনাতে যদি কোন হাজী বা আমাদের মত কোন প্রবাসী শ্রমিক মারা যায় তাহলে দূতাবাসের অনুমতিক্রমে তাদেরও এখানে দাফন করা যায়, এবং প্রতিদিন ফরয নামাযের পর একাধিক লাশ এখানে দাফন করা হচ্ছে৷ সুতরাং চাইলেই জান্নাতুল বাক্বীতে দাফন হওয়া রাজ পরিবারের জন্য কোন ব্যাপার না, কিন্তু তারা যেটা করছে জান্নাতুল বাক্বী মদিনাবাসীর হক্ব এবং এটি মদিনাবাসীর জন্যই সংরক্ষিত করে রেখেছে৷

প্রতি ফরয নামাযের যদি নূন্যতম দুই জনের লাশ দাফন করা হয় তাহলে জান্নাতুল বাক্বীতে দৈনিক দশ, মাসে তিনশ লাশ দাফন করা হচ্ছে (প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে)৷ এত লাশের কবর যদি সংরক্ষণ করতে হয় তাহলে মদিনাতে শুধু কবর ছাড়া আর কিছুই থাকবে না, যার কারনে প্রতি কয়েক বছর পর তারা পুরাতন কবরগুলো সংস্কার করে সেখানে নতুন কবরের জায়গা করে৷

আমাদের দেশের বিশাল এক গোষ্ঠী আলেম আছেন যারা কবরের প্রতি বিশেষ ভক্তি করে থাকেন৷ এই কবর ভক্ত আলেম এবং তাদের অনুসারীদের কাছে আপনি কখনো সৌদী আরবের কোন সুনাম পাবেন না৷

স্যার হুমায়ুন আহমেদ তখনো এত জনপ্রিয় হননি৷ বই বিক্রি বাবত একটা প্রকাশনী থেকে কিছু টাকা ঊনার হাতে আসে৷ এ টাকা দিয়ে তিনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভারতের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমনে বের হন৷ যার মধ্যে আজমীর শরীফও ছিলো৷

আজমীর শরীফ যাওয়ার পর ঊনার ছোট মেয়ে বিপাশা বিরক্ত হয়ে বললো, "কোথায় নিয়ে এলে? চারদিকে ফকির৷" তিনি বিপাশাকে বললেন, "এখানে একজন অতি বড় সাধু মানুষের কবর আছে৷ এখানে এলে আল্লাহর কাছে যা চাওয়া যায়, তা পাওয়া যায়৷"এই কথা শোনে বিপাশা মানসিকভাবে স্বস্তিবোধ করলো৷ এরপর স্যার তাকে নিয়ে কবর যিয়ারত করলেন৷

কবর যিয়ারত শেষে তিনি চলে আসবেন, কিন্তু বিপাশা আসতে চাইছিলো না৷ তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, "ব্যাপার কি?" সে বললো, "আমি আল্লাহর কাছে যেটা চেয়েছি সেটা পাইনি৷ না পেলে যাব না৷" স্যার জিজ্ঞেস করলেন, "মা, তুমি কি চেয়েছ?" সে বললো, "আমি আল্লাহর কাছে এক বস্তা টাকা চেয়েছি৷" বাড়িতে গেলে আল্লাহ টাকা পাঠিয়ে দিবে, স্যার তাকে এসব বলে বুঝিয়ে শুনিয়ে সেখান থেকে নিয়ে আসলেন৷ আজমীর থেকে আসার পর অবিশ্বাস্যভাবে স্যারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং সেই সাথে দু'হাতে টাকাও আসতে থাকে৷

আমাদের দেশের বিশাল একটা জনগোষ্ঠী আছে যাদের ধ্যান, জ্ঞান, ধর্ম স্যার হুমায়ুন আহমেদ কেন্দ্রিক৷ তাদের কাছে স্যারের এই ঘটনায় যে মেসেজ যাবে তা সংক্ষেপে বর্ণণা করতে গেলে অর্থ দাঁড়ায়- "খাজা তোমার দরবারে, কেউ ফিরে না খালি হাতে৷" আমরা অনেকে বিভিন্ন কারনে এসব দরবারে ছুটে যাই৷ অধমেরও এক সময় দরবারে যাতায়াত ছিলো৷ দরবারে যাতায়াতের হাতেখড়ি হয়েছিলো টঙ্গীর মাছিমপুর কো-অপারেটিভ মার্কেটের পাশের এক দরবার থেকে৷ দরবার শরীফের নাম যথাসম্ভব হাফেজ আবদুর রশিদ সাহেবের দরবার শরীফ৷ হাফেজ সাহেব কবে গত হয়েছেন সেটা জানি না, তবে দরবারে ঊনার খাদেম আছে৷

দরবারের এক পাশে পুরুষ এবং অন্য পাশে নারীরা বসতেন, মাঝখানে কাপড়ের পর্দা ছিলো৷ প্রতি বৃহস্পতি বার সেখানে হালকায়ে জিকিরের আয়োজন করা হত৷ আমাদের দেশের অনেক মসজিদ এবং মাহফিলেও এধরনের হালকায়ে জিকির হয়৷ জিকিরের নিয়ম হলো, নিঃশাস টান দিয়ে মাথাকে উপরের দিকে তোলে "আল্লা" এবং নিচে নিঃশ্বাস ছেড়ে "হু" বলতে হবে৷ আবার নিঃশ্বাস টান দিয়ে মাথাকে ডান দিকে নিয়ে "লা ইলাহা" বাম দিকে নিঃশ্বাস ছেড়ে "ইল্লাললা" বলতে হবে৷ এভাবে বেশ কয়েক বার জিকির করলে আপনি মনে শান্তি অনুভব করবেন৷

অনেক কিছুই আমাদের মনে শান্তি নিয়ে আসে, কিন্তু মনের শান্তিটাইতো ধর্ম নয়৷ এভাবে উচ্চস্বরে, হেলে দুলে, জিকির করা সম্পর্কে স্যার ডঃ খন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহঃ) বলেন, "উচ্চ স্বরে জিকির করা আবু জাহেলের সুন্নাত৷" পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, আবু জাহেলের আবার সুন্নাত আছে না কি? সুন্নাত কি, কত রকম হতে পারে এসম্পর্কে ঊনার "এহইয়াউস সুনান" গ্রন্থে বিস্তারিত বিবরণ আছে৷

বাইতুল্লাহ এবং মসজিদে নববী ছাড়াও, মসজিদে মীক্বাত, মসজিদে ক্বোবা, মসজিদে ক্বীবলাতাইন, মসজিদে গামামা, মসজিদে ইজাবার মত ঐতিহাসিক মসজিদগুলো দেখার সৌভাগ্য অধমের হয়েছে৷ কিন্তু কোন মসজিদে আমাদের দেশের মত এমন উচ্চস্বরে জিকির আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি৷ সৌদী প্রবাসী অন্যান্য ভাইদের হয়েছে কি না তা তারা ভালো বলতে পারবেন৷

মাহরাম ব্যতিত নারীদের কন্ঠ যেন অন্য পুরুষ না শোনেন, বিজ্ঞ আলেমগণ সে বিষয়েও সতর্ক করে থাকেন৷ নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে একটা দরবার শরীফ আছে, আমি সেখানেও দেখেছি নারী-পুরুষদের এভাবে উচ্চস্বরে জিকির করতে৷ দরবার শরীফের মূল মাজারের পাশে সম্পূর্ণ মোজাইক পাথরে বাধানো অনেকগুলো কবর আছে৷ মাজারের মূল কবরটিও গিলাফ দিয়ে ঢেকে দেওয়া, তবে ধারণা করা যায় সেটিও মোজাইক বা সিমন্ট দিয়ে পাকা করা; কারন কবরটি মাটির হলে আশেপাশে ধুলোবালি থাকত বা গোলাপ জল ছিটানোর কারনে গিলাফে কাদা লাগত৷

যে পীরের নামে মাজারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বেগমগঞ্জের অনেকের ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আমি তাঁর ছবি ঝুলতে দেখেছি৷ তাঁর দেহটা ছিলো শীর্ণ, কিন্তু কবরের প্রশস্ততা দেখলে মনে হয় সেখানে কোন হাতিকে সমাহিত করা হয়েছে৷ কবরের উপর পাকা করা, সেটিকে উঁচু করা এবং চওড়া করা এসব বিষয়েও আলেমগণ নিষেধ করে থাকেন৷

দরবার শরীফের পাশেই মাজার কমিটির অফিস৷ অফিসে ঢুকতেই কমিটির একজন এক হিন্দু ভদ্রলোককে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো, "আজকের ওরশের গরুটা দাদা দিয়েছেন৷" হিন্দুদের দাদার গোমাতাকে বাবার দরবারে উৎসর্গ করতে শোনে অনেকেরই হয়ত মনে খটকা লাগতে পারে৷ সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজীর "রায়নন্দিনী" থেকে জানা যায় হিন্দুদের মাজার ভক্তি অনেক পুরনো৷ আজমীর শরীফেও অনেক হিন্দু ধর্ণা দেয়৷

মাজারের বাইরে দোকানগুলোতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আসর বসেছে৷ আসরের নিয়ম হলো আপনার যদি কল্কি টানার অভ্যাস থাকে তাহলে একটান দিয়ে পাশের জনকে দিবেন, না টানলেও আপনি হাতে নিয়ে পাশের জনকে দিবেন৷ আসরের আদব রক্ষার্থে কল্কি দু'হাতে ধরে আদান-প্রদান করতে হবে৷ সাধারণত মাদ্রাসার ছাত্ররা আদব রক্ষার্থে এভাবে দু'হাতে ওস্তাদদের কাছে খাতা, কিতাব ইত্যাদি প্রদান করে থাকে৷ একতারার টুন টুন শব্দে আসরের শিল্পী গান শুরু করেন৷ গানের অন্তরায় শিল্পী বলছে- "তুমি খোদা, তুমি রাসূল, তুমি মালিক রাব্বানা, দোজাহানের বাবা মাওলানা৷"

আমরা অনেকেই আল্লাহকে বোঝাতে খোদা শব্দ ব্যবহার করি, কিন্তু সালাফী আলেমগণ এ ব্যাপারে নিষেধ করে থাকেন; কারন আল্লাহর নিরানব্বই নামে খোদা শব্দটি নেই৷ গানের কথা গুলো যদি আমরা একটু লক্ষ্য করি, শিল্পী তার পীর বা মুর্শিদ কে উদ্দেশ্য করে বলছে, তার মুর্শিদই আল্লাহ, রাসূল, দুই জাহানের মালিক (নাঊজুবিল্লাহ)৷ যে কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মুসলমানই জানেন আল্লাহ স্রষ্টা, রাসূল তাঁর সৃষ্টি৷ আল্লাহর সাথে কারো তুলনা করা মানেই শিরক্৷ দরবার ভিত্তিক যত গান আছে তার প্রায় অধিকাংশই এমন শিরক, বিদআত পূর্ণ যা কল্কির নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা অসুস্থ মুসলমান ভাইয়েরা বোঝেন না৷ যাদের এসব বোঝানোর দায়িত্ব তারা নিজেরাই দরবারে গিয়ে মাথা ঠেকায়৷

বাংলাদেশের সাবেক একজন রাষ্ট্রপতি আটরশির দরবারে পড়ে থাকতেন৷ প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয় হযরত শাহজালাল (রহঃ) এর মাজার যিয়ারতের মাধ্যমে৷ অধমেরও শাহজালাল (রহঃ) এর মাজারেও যাওয়া হয়েছে৷ এখানকার বাইরের দোকানগুলোতে দোয়া, দুরূদ ছাড়া রেডিমেড তবারক পাওয়া যায়৷ মনোবাসনা পূরণের জন্য লাল এবং হলুদের মিশ্রণে এক ধরনের সূতা পাওয়া যায়, সাধারণত হিন্দুরা রাখি উৎসবে এ ধরনের সূতা হাতে বাঁধে৷

ভিতরে বিশাল বড় পাতিল দেখে ভেবেছিলাম দর্শনার্থীদের জন্য বিরিয়ানির আয়োজন করা হয়েছে, কাছে গিয়ে দেখি সেটা দান বাক্স৷ তার পাশে গজার মাছকে খাওয়ানোর জন্য কুছো চিংড়ি বিক্রি চলছে৷ মূল মাজারে উঠার মুখে সাদা লুঙ্গি, সাদা শার্ট, সাদা টুপি, ক্লিন শেভড এক দল লোক দেখতে পেলাম৷ তারা না কি দরবারের খাদেম! সাধারণত হিন্দি মুভিতে এমন সাদা কাপড় পরিহিত পলিটিক্যাল লিডারদের দেখা যায়৷ মাজারের সাথে অবশ্য হিন্দি মুভির মিল আছে৷ তামিল, তেলেগু, হিন্দি মুভিতে নায়ক/নায়িকা যখন কোন বিপদে পড়ে তখন মায়ের দরবারে গিয়ে প্রার্থনা করে৷ এই মুভিগুলো যখন আমাদের দেশে কপি করা হয়, তখন মায়ের দরবারের স্থলে বাবার দরবারের দৃশ্য আনা হয়৷ খাদেমদের কাজ হলো দরবারে দান করা এক থেকে হাজার টাকার নোটগুলো আলাদা আলাদা করা৷

হযরত শাহপরাণ (রহঃ) এর দরবারটা পাহাড়ের উপর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়৷ আপনি যেভাবে উঠবেন সেভাবেই নামতে হবে, কবররে পিঠ দিয়ে নামতে পারবেন না৷ কথিত আছে, ঊনার কবরকে পিঠ দেখিয়ে নামলে অভিশাপে জ্বলে যাবেন৷ অথচ ইসলামের ইতিহাস বলে, জীবিত রাসূল (সাঃ) কে পাথর মেরে রক্তাক্ত করার পরেও তিনি কাউকে অভিশাপ দেননি৷ রাসূল (সাঃ) এবং সাহাবীগণের কবরে লক্ষ লক্ষ মানুষ যিয়ারত করছে, কবররের দিকে পিঠ দিয়ে চলে যাচ্ছে, অভিশাপে জ্বলে গেছে এমন নজির আজও দেখা যায় নি৷

অনেক পিএইচডি ডিগ্রীধারী লোক থেকে শুরু করে নিরক্ষর লোক দরবার ভক্তিতে জড়িত৷ আমাদের এসব দরবার ভক্তি ধর্মহীনতা নয়৷ আমাদের প্রচুর ধর্মীয় আবেগ আছে কিন্তু ধর্মীয় শিক্ষা নেই৷ আর আমাদের এই অজ্ঞতাকে পুঁজি করে কিছু লোক ধর্মের নামে বিনা পুঁজির ব্যবসা শুরু করেছে৷ সৌদী আরব যদি ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করতে চাইত, তাহলে রাসূল (সাঃ

এর রওজার সামনে একটা দান বাক্স বসিয়ে রাখলেই হত৷ দুনিয়ার মুসলমানদের সব সম্পত্তি এসে এখানে জমা হত৷

আমাদের এসব দরবার ভক্তরা হজ্ব, ওমরাহ করতে এসে জান্নাতুল বাক্বীর মাটি নিয়ে টানাটানি শুরু করে, রাসূলের রওজার দিকে হাত তুলে নিজের মনোবাসনা পূরণের আকুতি জানায়৷ এদের দেখে সেখানকার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ বাধা দিয়ে থাকেন৷ তাদের কথা হলো, কবরে আমল যাবে মাটি যাবে না৷ আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে মনেবাসনা পূরণের প্রার্থণা করা শিরক৷

যেহেতু হাজীদের অধিকাংশই আরবী জানেন না, তাই না বোঝে অনেকেই মনঃক্ষুন্ন হয়৷ আর মনঃক্ষুন্ন হওয়ারই কথা, কারন মনের মাঝে বিদ্বেষের বীজতো দেশে দরবারের হুজুর কেবলা বপন করেই দিয়েছেন- "সৌদী আরব যান হজ্ব, ওমরাহ করেন, কিন্তু সৌদী যাই ঈমাণ নষ্ট কইরেন না৷" এসব ধর্ম ব্যবসায়ীগোষ্ঠী এবং তাদের ভক্তদের কাজ হলো সারাদিন সৌদীকে গালি গালাজ করে নিজেদের ঈমাণ মজবুত করা৷

মক্কা-মদীনার অধিকাংশ আবাসিক হোটেল মহররম থেকে রমজান পর্যন্ত ইরানীদের কাছে ভাড়া থাকত৷ সৌদী সরকারের সাথে বিভিন্ন ইস্যুতে মনোমালিন্যের জের ধরে তারা সৌদীকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রায় চার-পাঁচ বছর ধরে ইরান ওমরাহ্ এবং হজ্ব বন্ধ করে দিয়েছে৷ এতে ফল হয়েছে উল্টো৷

হোটেল কোম্পানীগুলো ইরানীদের সাবান, শ্যাম্পু, তোয়ালে, হিটার, চায়ের কাপ, গ্লাস, প্লেট সহ বিভিন্ন বাড়তি সুযোগ সুবিধা প্রদান করে যে রুম প্রায় সারা বছরের জন্য প্রতিদিন মাত্র সত্তর রিয়াল ভাড়া পেত, সে একই রুম কোন প্রকার সুযোগ সুবিধা প্রদান ব্যতীত অন্যান্য দেশের লোকদের কাছে দুইশ-পাঁচশ রিয়াল ভাড়া পাচ্ছে৷

আমাদের দেশের এক শ্রেণীর মুজাহিদ ইরানীদের মত মনে করে হজ্ব, ওমরাহ বন্ধ হলে সৌদী আরব বিশাল একটা শিক্ষা পাবে৷ এসব মুজাহিদ ভাইদের ধারণা মসজিদ কমিটির সাথে অভিমান করে ঘরে নামায পড়লে জামাতে সওয়াব হাসিল হবে৷ আল্লাহ পাক যে পবিত্র ক্বোরআনে ধারণা থেকে দূরে থাকতে বলেছেন সেটা আমাদের এই মুজাহিদ ভাইগণ জানেন না, অথবা জানলেও আমল করতে মন চায় না৷

জাতি হিসেবে আমরা যে কি পরিমাণ ধারণা প্রিয় তা বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন ইস্যুর দিকে খেয়াল করলেই বোঝা যায়৷ বিশেষ করে বিউটির ঘটনাটা বন্ধুদের স্মরণ না করিয়ে দিলেই নয়৷ পুরো জাতি ধারণা করেছিলো তাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে৷ কিন্তু তদন্তে দেখা গেল ধর্ষণটা ছিলো প্রেম, আর হত্যাটা তার বাবার সহযোগিতাতে হয়েছে৷

আমাদের ধারণা যে মিথ্যা এবং ভুল প্রমাণিত হয়েছে, এতে কি আমাদের বিন্দুমাত্র শিক্ষা বা অনুশোচনা অনুভব করি? মোটেই না৷

আমাদের যেসব মুজাহিদ বন্ধুগণ কয়েক দিন পর পর হজ্ব বা ওমরাহ বন্ধের আহবান জানান তারা কি ধর্মীয় অনুভূতি থেকে হজ্ব, ওমরাহ বন্ধ করার আহবান করছেন? না অবচেতন মনে ইরানী এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য মাঠে নেমেছেন, সে বিষয়ে অধম সন্দিহান!

ইরানী বা শিয়া মতাদর্শ মুসলিম বিশ্বের জন্য কতটা মারাত্মক ক্ষতিকর, কিভাবে তাদের মতাদর্শ বাস্তবায়নের জন্য তারা ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলছে, আমাদেরকে তারা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে তা এই সিরিজের পূর্বের লেখাগুলোতে সামান্য আলোচনা করেছিলাম, তাই সেদিকে যাচ্ছি না৷

আমাদের মুজাহিদ ভাইদের সৌদী বিদ্বেষের অন্যতম প্রধান কারন ফিলিস্তিন-ইসরাঈল সংঘর্ষ নিয়ে৷ সাদা-কালো টেলিভিশনের যুগে এক সময় আমরাও জুমা'র নামাযের পর এসব মুজাহিদ ভাইদের পেছনে স্লোগান দিয়েছি৷ এখন এসব মুজাহিদ ভাইরা ফেসবুকে স্লোগান দেয়, অনুজরা তাদের পেছনে সুর তোলে৷ সময় বদলাচ্ছে, পৃথিবী বদলাচ্ছে কিন্তু ফিলিস্তিনিদের মায়েদের ভাগ্য বদল হয় নি!

যেসব মুজাহিদ ভাইয়েরা ফিলিস্তিনি মায়েদের ভাগ্য বদল করতে গিয়ে সৌদীকে একহাত দেখে নেন, তেমন কিছু মুজাহিদ ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- আচ্ছা আপনার কি জীবনে কোনদিন কোন একজন ফিলিস্তিনের নাগরিকের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে? তারা সৌদী সম্পর্কে কি মনোভাব পোষণ করে সরাসরি জানতে পেরেছেন? সবার কাছ থেকে উত্তরটা না বোধকই এসেছে৷

তাহলে আপনি কার কথা শোনে ফিলিস্তিনি দরদী সেজে সৌদীকে এভাবে দিগম্বর করে ফেলছেন? সেক্ষেত্রে তারা গতানুগতিক ধারায় বিভিন্ন মিডিয়াকে সাক্ষী হাজির করেন৷ টাইম লাইনে ঘুরলে, এসব মুজাহিদ ভাইদের রাজনৈতিক পরিচয় ভালোই পাওয়া যায়৷ তো এদেরকে যখন এদের দলের বিরূদ্ধে আসা সংবাদগুলো দেখানো হয়, তখন এরা সবাই একেকজন সেলিম ওসমান৷

তাদের আদর্শ বিরোধী সংবাদ পরিবেশন করার কারনে তারা যে মিডিয়াকে মিথ্যাবাদী আখ্যায়িত করে, সৌদী আরবের ক্ষেত্রে একই মিডিয়াকে তারা সত্য মনে করে! সত্যটা অনেকটা মনঃস্তাত্ত্বিক ব্যাপার৷ আপনি যা দেখছেন, যা শোনেছেন, যা শিখেছেন সেটাকে যদি আঁকড়ে ধরে থাকেন সেটাই সত্য৷ যেমন- একজন মূর্তি বা মাজার পূজারীর কাছে তারটাই সত্য৷

ইন্ডিয়া থেকে একজন লোক ১৫ দিনের প্যাকেজে ওমরাহ্ করতে আসলে তার খরচ হয় মাত্র পঞ্চান্ন থেকে পঁয়ষট্টি হাজার রুপি (১ রিয়াল=১৮ রুপি)৷ পাকিস্তান থেকে একই প্যাকেজে খরচ হয় পঁচাত্তর থেকে আশি হাজার রুপি (১ রিয়াল= ৩০ রুপি)৷ বাংলাদেশ থেকে এক সপ্তাহের প্যাকেজে খরচ হয় সর্বনিম্ম আশি হাজার৷

কারেন্সীর হিসাবে তিনদেশের খরচটা প্রায় সমপর্যায়ের হলেও ফারাকটা অন্যখানে৷ পঁয়ষট্টি হাজার রুপির মাঝে ইন্ডিয়ান একজন হাজীকে তিন বেলা খাবার দেওয়া হয়৷ সকালের খাবারের আইটেমে যা থাকে- দুধ, কর্ণ, মধু, জেলি, পরোটা, পাউরুটি, পায়া, সব্জী, ডিম, চা৷ দুপুরে- ভাত, সব্জী, গরু বা মুরগীর মাংশ, ডাল, ক্ষীর, ফল, চা; রাতেও প্রায় একই মেনু৷ এর মাঝে এজেন্সীর পক্ষ থেকে দুই বা তিন বার তাদের কাপড়গুলো লন্ড্রী থেকে ওয়াশ করে আনা হয়৷

পাকিস্তানীদের খাবারে অত আইটেম না থাকলেও ভাত, মাংশ, ডাল, চা থাকে৷ ইন্ডিয়া হিন্দু রাষ্ট্র, পাকিস্তান রাজাকার আর আমরা পাক্কা মুমিন মুসলমান৷ এই মুমিন মুসলমানদের যদি জিজ্ঞেস করি আমাদের ওমরাহ্ খরচ এত বেশি কেন? তখন তাদের উত্তর সৌদী সরকাররে অনেক টাকা দিতে হয়৷ আর সেটা শোনে আমাদের মুজাহিদ ভাইয়েরা তিন হাত লাফ মেরে সৌদীর বিরূদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন৷

টাকা কি শুধু আমাদের দিতে হয়? ইন্ডিয়া, পাকিস্তানীদের দিতে হয় না? এত অল্প খরচে তারা কিভাবে এত ভালো সার্ভিস দিচ্ছে? সৌদী হজ্ব মিনিস্ট্রির ভাষ্য মতে, প্রথমবার কেউ হজ্ব এবং ওমরাহ্ করলে ভিসা বাবত কোন অর্থ প্রদান করতে হয় না৷ দ্বিতীয়বার করতে চাইলে দুই হাজার রিয়াল ফি দিতে হবে৷ তাহলে আমাদের খরচ এত বেশি কেন?

এর কোন সদুত্তর আপনি পাবেন না৷ কারন আমাদের পাছায় বাঁশ দেওয়া ছাড়া রাষ্ট্রীয়ভাবে আর কোন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি৷ জনগণ হিসেবে আমরা বাঁশ খাওয়ার উপযুক্তই বটে, যারা আমাদের উপকার করে আমরা তাদের পাছায় বাঁশ দেই তাহলে আমরা বাঁশ খাবো না কেন!

আপনি যদি গুগলে গিয়ে "Saudi aid for Palestine", বা "Saudi aid for Muslims countries" সার্চ দেন তাহলে অনেক তথ্য পাবেন৷ যে তথ্যগুলো সেখানে দেওয়া আছে সেগুলো অনেক কম৷ কারন তারা দান করে আমাদের মত সেল্ফী খিঁচে না৷ হাদীস বলে দানে যত গোপনীয়তা থাকে ততই সওয়াব৷

আমরাতো হাদীসই বুঝি না, চিলে কান নেওয়া মুজাহিদ৷ আমাদের কাছে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কেটে টুকরো টুকরো করে তার গোশত কুত্তাদের খাওয়ানো অনেক সহজ৷ কিন্তু সৌদী থেকে আসা মসজিদ-মাদ্রাসার অনুদান, খেজুর বা দুম্বার গোশত যে কুত্তার পেটে তার পাছায় লাথি মারা অনেক কঠিন৷ এরা সহজ কাজটা করেই বাহবা কুড়াতে চায়৷ এইসব হুজুগে মুজাহিদ দিয়ে ধর্ম এবং দেশের কতটুকু কল্যাণ হবে সেটা আল্লাহ পাক ভালো জানেন৷

আরবের এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলো বিশেষ করে সৌদী, আমিরাত, ওমান, বাহরাইনের খাবার সবাই খেতে পারলেও; আফ্রিকা অঞ্চলের মিশর, লিবিয়া, সুদানের খাবার অনেকের রুচিতে বাধবে৷ আবার আরবের লোকেরা আমাদের খাবার খেতে চায় না৷ এমন না যে ওদের খাবার হালাল, আমাদেরটা হারাম; বা আমাদেরটা হালাল ওদেরটা হারাম৷ ব্যবধানটা হচ্ছে রন্ধন প্রণালীতে৷ আমাদের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের লোকদের মত অত মশলাযুক্ত খাবার আর পৃথিবীর আর কেউ খায় বলে জানা নেই৷

রন্ধন প্রণালীর মত রাঁধুনীদের সাজ সজ্জাও ভিন্ন৷ আরবের মেয়েরা আমাদের উপমহাদেশের মেয়েদের মত নাক, কান ফুটো করে না৷ যদিও ইদানিং আরবের কিছু কিছু দেশে কান ফুটো করার প্রচলণ ঘটেছে৷ তবে সেটা ব্যাপক নয়৷ আফ্রিকা অঞ্চলের কিছু দেশে আবার মেয়েদের খতনা করানো হয়৷ কিছু অঞ্চলে বিয়ের পর এ্যাসিড বা অন্য কোন পদ্ধতিতে স্থায়ী ভাবে মেয়েদের মুখে এক ধরনের বিশেষ চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয়৷ যাতে সবাই বুঝতে পারে মেয়েটি বিবাহিত৷

পোশাক ব্যবহারেও আছে ভিন্নতা৷ আরবের পুরুষেরা সবাই জুব্বা পৱলেও, সেলাইয়ে আছে ভিন্নতা৷ অভিজ্ঞ লোকেরা সাধারণত পোশাক দেখেই বলতে পারবেন কে সৌদী, কে মিশরী, কে সুদানী৷ আরবের মেয়েরা ভিতরেই যাই পড়ুক, বাইরে আসলে তারা বোরকা পড়বে৷ সুদান, মৌরাতানিয়ার মত কিছু দেশের মেয়েরা সেলোয়ার কামিজের উপর শাড়ি পড়ে৷ ইন্দোনেশিয়া এবং মালেশিয়ার মত দেশগুলোতে নারী, পুরুষ সবাই লুঙ্গি এবং ফতুয়া পড়ে৷

ইন্দোনেশিয়াতে বিয়ের পর সন্তান ইচ্ছে হলে মা-বাবার ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিতেও পারে আবার নাও নিতে পারে৷ বিয়ের পরেও স্বামী-স্ত্রী দু'জনেই উপার্জন করে৷ আরবে দেখা যায় এক ভাই ফুফুকে বিয়ে করেছে, আরেক ভাই চাচাত/মামাত/খালাত ভাতিজিকে বিয়ে করেছে, অর্থাৎ এথানে ফুফু-ভাতিজির সম্পর্ক হচ্ছে জা৷ কিন্তু আমাদের সমাজে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও চারদিকে ছিঃ ছিঃ রব পড়ে যাবে৷

'ভারতবর্ষের বিবাহের ইতিহাস' বইয়ে ডঃ অতুল সুর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের হিন্দুদের ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে বিবাহ, আলাদা চাল চলন, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি বৈষম্য নিয়ে আলোচনা করেছেন৷ মুসলমানদের মাঝে সাধারণত এমন কোন ভিন্নতা নেই৷ নেই কোন বৈষম্য৷ গ্র্যান্ড মুফতির জন্য যা বৈধ, আমাদের জন্যও তা বৈধ৷ ঊনার জন্য যা অবৈধ, আমাদের জন্যও তা অবৈধ৷ রাজা-প্রজা, আমির-ফকির, সাদা-কালো, বিশ্বের সকল মুসলমানের জন্য এক আইন৷ মুসলমানদের একেক অ়ঞ্চলে একেক রকম খাদ্যাভ্যাস, ভিন্ন ভিন্ন পোশাক, সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদি আলাদা কেন?

বিশ্বের একেক অঞ্চলের আবহাওয়া একেক রকম৷ আবহাওয়া এবং জলবায়ুর উপর নির্ভর করে প্রত্যেক অঞ্চলের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য গড়ে উঠে৷ সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের কারনে একেক অঞ্চলের মানুষের সামাজিক রীতিনীতি একেক রকম, যার কারনে আপনি চাইলেও বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর বা সৌদী আরবের মত করতে পারবেন না৷ ইসলামী চিন্তাবিদগণ সাধারণত সুক্ষ্মভাবে স্থান, কাল, পাত্র চিন্তা করে ফতোয়া দিয়ে থাকেন৷ যার কারনে একই বিষয়ে একেক অঞ্চলে একেক রকম রীতিনীতি পরিলক্ষিত হয়৷

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “ইসলাম যেথায় গিয়েছে, সেথায়ই আদিম নিবাসীদের রক্ষা করেছে। সেসব জাত সেথায় বর্তমান। তাঁদের ভাষা, জাতীয়ত্ব আজও বর্তমান।” আমাদের দেশের বর্তমানে অনেক ইসলামী চিন্তাবিদগণ স্থান, কাল, পাত্রের চিন্তা না করেই ফতোয়া দেওয়া শুরু করেন৷

আরবের লোকেরা সাধারণত যখন কোন ব্যক্তির কাজে খুশি হয় তখন এই বলে দোয়া করে, আল্লাহ আপনাকে বিয়ে করার তৌফিক দান করুক৷ অনেক সময় ছেলেও বাবাকে এভাবে দোয়া করে৷ এতে তারা দোষের কিছু মনে করে না, এটা তাদের সংস্কৃতি৷ কিন্তু আমাদের দেশে কোন সন্তানের কাছেই বাবার দ্বিতীয় বিয়ে কাম্য নয়৷ যদি কেউ ফান করেও এমন দোয়া করে, বাবা কিছু না বললেও মা ঝাড়ু নিয়ে দৌড়ে আসবে৷ সৌদীদের বিয়ে নিয়ে নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি-

আমাদের বাসার পাশে অনেকগুলো লেডিস টেইলার্স আছে৷ এক পাকিস্তানী টেইলারের মোবাইলে কিছু প্রোগ্রাম ডাউনলোড করে দিচ্ছিলাম৷ এমন সময় মাঝ বয়সী এক সৌদী মহিলা আসলো৷ একটা কাগজে মাপ আর একটা ব্যাগে কাপড় দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কবে শেষ হবে? টেইলার বললো, পনের দিন পর৷ ভদ্রমহিলা তার পাশে দাঁড়ানো মাঝ বয়সী লোকটাকে দেখিয়ে বললো, আগামী সপ্তাহে আমার স্বামীর বিয়ে, টাকা পয়সা কোন সমস্যা না আমাকে এই সপ্তাহের মাঝেই জামাটা দিতে হবে৷ নেকাবে মুখ ঢাকা থাকলেও বোঝা যাচ্ছে মহিলা স্বামীর দ্বিতীয় বিয়েতে সে খুবই উৎফুল্ল৷ আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম!

এখানে বিয়ে করাটা অত সহজ নয়৷ এক আফগানীকে জানি, যে আরেক আফগানী মেয়েকে বিয়ে করেছে চল্লিশ হাজার রিয়াল বাংলা প্রায় নয় লক্ষ টাকা দেনমোহর দিয়ে৷ সৌদীদের ক্ষেত্রে দেনমোহরের পরিমাণ আশি হাজার রিয়াল থেকে আরো বেশি হয়৷ এছাড়া গাড়ি, বাড়ির ব্যবস্থাতো আছেই৷ দুই বিয়ে করলে দুই বৌ এর দেনমোহর, দুইটা বাড়ি, দুইটা গাড়ি৷ সৌদীদের সবাই একাধিক বিয়ে করে না৷ আমার পরিচিত প্রায় পঞ্চাশজন লোকের মাঝে একজনের কপিলকে দেখেছি যার দুই স্ত্রী, বাকি সবারই এক স্ত্রী৷ অথচ এদের সবারই দ্বিতীয় স্ত্রী রাখার মত আর্থিক সামর্থ্য আছে৷

সৌদীরা মেয়ে হলে খুশি হয়, নিঃশ্চিন্ত থাকে; আর আমাদের মেয়ে হওয়া মানে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়া৷ মেয়ের বিয়ের যৌতুকের টাকা জোগাড় করার জন্য বাবার রক্ত মাংশ পানি করা৷ আমাদের দেনমোহরের প্রচলণ কাগজেই সীমাবদ্ধ৷ দেনমোহর আমাদের জন্য ফরয, যৌতুকের প্রচলণটা এসেছে মুশরিকদের কাছ থেকে৷ এসব নিয়ে কথা না বলে আমরা আছি একাধিক বিয়ে করা যায় তা নিয়ে৷

বাবার দ্বিতীয় বিয়েতে সন্তানদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহণ, কিংবা স্বামীর বিয়েতে স্ত্রীর উৎফুল্ল হওয়ার মত একটাও নজির নেই আমাদের দেশে৷ আবার যারা দ্বিতীয় বিয়ে করেন তাদের প্রথম স্ত্রী আর ভালো লাগে না, প্রথম স্ত্রীর সন্তানদের আর খোঁজ খবর নেন না৷ আবার প্রথম পক্ষের স্ত্রী যদি দাপুটে হয়, তাহলে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর স্থান হয় রাস্তাঘাটে৷ দ্বিতীয় স্ত্রী এবং তার গর্ভের সন্তান হারিয়ে যায় গহবরে৷

সৌদীদের সাথে আমাদের ধর্মীয়, ঐতিহ্য, শাসন ব্যবস্থায় অনেক অনেক পার্থক্য৷ আমাদের বাসার পাশে মদীনা কোবা রোডে লেডিস মার্কেটে অবস্থিত৷ যথাসম্ভব এটি মদীনার ব়ৃহত্তম লেডিস মার্কেট৷ এখানে একটা মোবাইল মার্কেটও আছে৷ প্রথম যখন সেখানে মোবাইল কিনতে যাই এক মুরুব্বী সাবধান করে বললেন, ঐদিকে সাবধানে যাইও এখানকার আইন-কানুন বড় খারাপ৷ কি খারাপ! আসরের পর থেকে সেখানে মহিলারা গিজগিজ করে৷ কিন্তু ইভটিজিংতো দূরের কথা কেউ তাকিয়ে থাকারও সাহস পায় না৷ কারন এখানে মহিলাদের অভিযোগকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়৷ সেক্ষেত্রে সাক্ষী, প্রমাণ ছাড়াই সাজা হয়ে যেতে পারে৷ আমরা যারা গার্লস স্কুল, লেডিস মার্কেটের সামনে ভীড় করতে পছন্দ করি তাদের জন্যতো এসব আইন খারাপই৷

এখানকার প্রায় মসজিদেই মেয়েদের জন্য নামাযের ব্যবস্থা থাকে৷ আমাদের দেশের অনেকেই এখন মেয়েদের মসজিদে নামাযের ব্যবস্থার দাবী তুলেছেন৷ একদল তাদের দাবীকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন, আরেকদল বিরোধীতা করছেন৷ যারা সাধুবাদ জানাচ্ছেন তারা সামাজের ভয়াবহ পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারছেন না৷ কাল যদি সংবাদের শিরোনামে আসে, মসজিদে যাওয়ার পথে তরুণী লাঞ্চিত; তাহলে আজ যারা তাদের মসজিদে যেতে উৎসাহ দিচ্ছেন তারা কিন্তু এই লাঞ্চণার বিচার করতে পারবেন না৷ সেই ক্ষমতা তাদের নেই৷ সেক্ষেত্রে অনেক মেয়ের ধর্মের প্রতি বিশ্বাস উঠে যাবে৷ আর যারা বিরোধীতা করছেন তারা করছেন ধর্মীয় গোঁড়ামী থেকে৷ ইসলামে মেয়েদের মসজিদে যেতে বাধা নেই৷ উভয় পক্ষের উচিত ছিলো মেয়েদের মসজিদে যাওয়ার পথকে নিরাপদ করা৷

আমাদের এসব অজ্ঞতা, অক্ষমতা, বিভক্তি, ফরয বিধান বাদ দিয়ে নফল নিয়ে লাফালাফির মূল কারন হলো আমাদের দ্বীনি শিক্ষা ফুটবলের মত৷ বাংলাদেশ জীবনে কখনো বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না, সে গ্যারান্টি নেই কিন্তু আমাদের ঘরে ঘরে ফুটবল বিশেষজ্ঞ৷ ইসলামের ইতিহাসে এমন কোন বাঙ্গালী বীর বা আলেমের কথা আমার জানা নেই যিনি বাংলার বাইরে ইসলাম প্রচার এবং প্রসারে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন৷ অথচ বাংলার ঘরে ঘরে ইসলামী বিশেষজ্ঞ৷

এই ইসলামী বিশেষজ্ঞরা আবার সবকিছুতে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, জার্মানীর ভক্তদের মত বিভক্ত৷ সৌদী ফুটবল খেলায় অংশগ্রহণ করার পরেও তাদের মাঝে এটা নিয়ে তেমন কোন উচ্ছ্বাস এবং উদ্দীপনা আমার চোখে পড়েনি৷ আর আমরা ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চার মত লাফালাফি করতে করতে একজন আরেকজনের রক্ত ঝরাতেও দ্বিধা করি না৷ যে কোন বিষয়ে না বোঝে লাফালাফি, বিভক্তি, বিশৃঙ্খলতা প্রিয় ধার্মিকদের কাছে সৌদী আরবকে অনৈসলামিক দেশ মনে হতেই পারে৷

বাঙ্গালী সেক্যুলার সমাজের মুসলমানরা দুই ভাগে বিভক্ত৷ একদল কমিউনিস্ট বা বামপন্থী৷ নাস্তিক এবং ইসলাম বিদ্বেষীরা এই দলের অন্তর্ভূক্ত৷ আরেক দল হলো ধর্ম যার যার উৎসব সবার টাইপের মুসলমান৷ এদেরকে নাস্তিকও বলা যায় না, আবার কাফেরও বলা যায় না৷ এরা মদিনা সনদেও বিশ্বাস করে, আবার মা দূর্গার আশীর্বাদেও বিশ্বাস করে৷ শুক্রবারে মসজিদে যায়, আবার পূজোর সময় মন্দিরে গিয়েও ঢোল পেঠায়৷

কমিউনিস্টদের একদল রাশিয়া পন্থী, আরেকদল চীনপন্থী৷ শিক্ষা, মিডিয়া, প্রশাসন, পররাষ্ট্রনীতির মত দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো কিন্তু এই সেক্যুলারদের দখলে৷ এরাই আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবী৷ ইহুদীরা যেভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিশ্বটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তদ্রুপ বাংলাদেশটাও এদের নিয়ন্ত্রণে৷ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ইস্যুতে এদের মত বিরোধ থাকলেও সৌদী বিদ্বেষ এবং সৌদী বিরোধী প্রচারণার ক্ষেত্রে এরা একই গোয়ালের গরু৷

এসব সেক্যুলারদের ব্যবসার মূলধন হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা৷ ইরাক ব্যতীত আরব বিশ্বের কোন মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের সময় সমর্থন করে নি, তাই সেক্যুলারদের দৃষ্টিতে সৌদী আরব পাকিস্তানের মত মৌলবাদী এবং জঙ্গী রাষ্ট্র৷ আরব বিশ্বের মুসলমান রাষ্ট্রগুলো কেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করে নি, সেটি বোঝতে হলে আপনাকে তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতি দেখতে হবে৷

তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতি আমেরিকা এবং সেভিয়েত ইউনিয়ন এই দুই পরাশক্তিতে ভাগ ছিলো৷ দক্ষিণ এশিয়ার দুই বৃহত্তর শক্তি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি আমেরিকা মুখী, অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি রাশিয়া মুখী৷ বিশ্ব পরিস্থিতি লক্ষ্য করলে দেখবেন মুসলিম দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতি সব সময় আমেরিকা পন্থী৷

এর বাইরে পাকিস্তানের চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, ভারতের ইসরাঈলের সাথে৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসরাঈল অস্ত্র দিয়েছিলো যা ভারতের মাধ্যমে বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে এসে পৌঁছায়৷ ভারতীয় গবেষক শ্রীনাথ রাঘবানের লেখা ‘১৯৭১ অ্যা গ্লোবাল হিস্টোরি অব দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ’ নামক বইটিতে এই তথ্য উঠে এসেছে।

রাশিয়া, ইসরাঈল, ভারতের মত অমুসলিম দেশগুলোর বাংলাদেশীদের সহায়তা মুসলিম বিশ্ব সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেছিলো৷ দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও সে সন্দেহের অবসান ঘটেনি৷ স্বাধীনতার পর আমেরিকা, চীনের ক্ষেত্রে সেক্যুলাররা নমনীয় হলেও সৌদী আরবের যে কোন বিষয় এদের কাছে অমার্জনীয় অপরাধ৷ যেহেতু এরা তেমন ধর্ম-কর্মের ধার ধারে না, তাই এদের কাছ থেকে ইসলামী রাষ্ট্র সম্পর্কে কোন ইতিবাচক ধারণা আমরা আশা করি না৷

জাতীয়তাবাদীদের বিষয়টা যদি ইসলামী দৃষ্টিকোন থেকে আমরা দেখতে যাই, তাহলে ইসলামে জাতীয়তাবাদকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে৷ বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে এক কথায় মূল্যায়ন করতে গেলে বিদ্রোহী কবির সেই অমর বাণীটি স্মরণ করতে হয়, "মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আরেক হাতে রণ তূর্য্য৷"

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একপাশে যেভাবে আলেমগণকে রেখেছেন, সেভাবে অন্যপাশে সেক্যুলার, কমিউনিস্ট সহ অন্যদেরও জায়গা করে দিয়েছেন৷ এখানে আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে একজন ডাকাত আর একজন ডাক্তার উভয়ের মূল্য মাত্র এক ভোট৷ যেহেতু তিনি দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, সেহেতু তাকে উভয় দিকে ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়েছে৷

সৌদী আরবের সাথে জিয়াউর রহমানের সম্পর্ক এত ঘনিষ্ঠ ছিলো যে, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর হতে সৌদী রাজ পরিবারের আতিথেয়তায় জিয়া পরিবারকে প্রতি বছর রমজানে ওমরাহ করার সুযোগ দেওয়া হয়৷ আপনি যদি দলকানা না হন, তাহলে আপনাকে মেনে নিতে হবে এটি জিয়া পরিবার এবং বাংলাদেশের জন্য একটি বিরল সম্মাননা৷ তাহলে জাতীয়তাবাদী দলের সমর্থকরা সৌদী বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করে কেন?

একটু পূর্বে যেটা বললাম, গণতান্ত্রিক রাজনীতি৷ একটি গণতান্ত্রিক দলে বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ থাকে৷ এই দলটিতেও আছে মাজার পূজারী, পীর পূজারী, বিদআতি, সেক্যুলার, কমিউনিস্ট সহ বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ যাদের বিষয়ে এই সিরিজের পূর্বের লেখাগুলোতে বলেছিলাম৷ এদের সাথে যোগ হয়েছে হতাশাগ্রস্ত এবং সুবিধাবাদী নেতা-কর্মীরা৷

হতাশাগ্রস্ত লোকরা সব সময় অন্যের দোষ ধরায় পারদর্শী৷ আর সুবিধাবাদী লোকেরা অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে শিকার করতে পছন্দ করে৷ এই হতাশাগ্রস্ত এবং সুবিধাবাদীদের কথা হলো কেউ তাদেরকে গদিতে বসিয়ে দিলে, তারা ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করবে৷ এই লক্ষ্যে তারা নিজেদের ব্যর্থতাকে আড়াল করার জন্য কখনো হেফাজত, কখনো জামাত-শিবির, কখনো সৌদী আরবকে দোষারোপ করে সান্ত্বনা খোঁজে৷

গত এক দশকে বাংলাদেশের মানুষ যখনই কোন ন্যায্য দাবী তুলেছে তখনই সেক্যুলাররা তাকে জামাত-শিবিরের ষড়যন্ত্র বলে প্রত্যাখ্যান করেছে৷ যখন কেউ সত্য এবং ন্যায়ের পক্ষে কথা বলেছে তাকে জামাত-শিবিরের লোক বলে টুটি চেপে ধরেছে৷ ফলে সাধারণ মানুষের কাছে জামাত-শিবির হয়ে গেছে সুপারম্যানের মত কাল্পনিক শক্তিশালী৷ আর জামাত-শিবিরের কর্মীরা মনে করতেছে যে, আমরাতো দেশীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে, এবার বিশ্ব রাজনীতি শুরু করি৷

বাস্তবে সাধারণ মানুষ জামাত-শিবিরের রাজনীতিকে কতটুকু বুঝতে পেরেছে সে বিষয়ে সন্দেহ আছে৷ দলটির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক গোলাম আযমের রাজনৈতিক দূরদর্শীতাকে উপমহাদেশের আরেক কিংবদন্তী রাজনীতিবিদ মাওলানা আবুল কালামের আযাদের সাথে তুলনা করা যায়৷ ভারতের স্বাধীনতার জন্য মাওলানা আবুল কালাম আযাদ জেল খেটেছেন, ইংরেজদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কিন্তু ভারত-পাকিস্তান আলাদা হোক এটি তিনি সমর্থন করেন নি৷

কারো সাথে রাজনৈতিক মতাদর্শের মিল না থাকলে তাকে যদি দেশদ্রোহী বলা যায় তাহলে মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, সুভাষ চন্দ্র বসুর মত অনেক নেতাই দেশদ্রোহী৷

অনেকেই গোলাম আযম সাহেবের ৭১ এর ভূমিকা টেনে আনেন৷ ৭১ এ তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার আগে তিনি বলেছিলেন, "১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে না পারা রাজনৈতিক নেতাগণ জনগণকে জুলুম থেকে রক্ষা করার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। নির্বাচনে বিজয়ী নেতৃবৃন্দ দেশে না থাকায় সাহায্যপ্রার্থী অসহায় জনগণের সমস্যার সমাধান করাই তাদের একমাত্র দায়িত্ব ও চেষ্টা ছিল। আমিও এ চেষ্টাই করেছি।"

স্যার হুমায়ুন আহমেদ স্বীকার করেন যে ,তাঁর নানা একজন রাজাকার ছিলেন৷ এবং তাঁর নানা এবং মামাদের মত ভালো মানুষ অত্র তল্লাটে ছিলো না৷ নিজের নানা যখন রাজাকার তখন তিনি সম্মানী ভালো মানুষ, কিন্তু অন্যের বেলায় "তুই রাজাকার"৷ এটি হচ্ছে আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ ব্যবসায়ী চেতনাবাদী মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের আসল রূপ৷

বৈরি মিডিয়ার কারনে মাওলানা গোলাম আযমের রাজনৈতিক চিন্তাধারা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায় নি৷ আজ যখন সবার হাতে হাতে সোশ্যাল মিডিয়া এসে গেছে, তখন জামাত-শিবিরের কর্মীরা নিজেদের আদর্শ-উদ্দেশ্য প্রচার করার চেয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজেদের দক্ষতা প্রমাণে বেশি ব্যস্ত৷ সেক্ষেত্রে তাদের সৌদী বিদ্বেষী মনোভাব শিয়াদেরকেও হার মানিয়েছে৷

জামাত-শিবির টিভি চ্যানেল চালু করলে ঠিক আছে, সৌদী সিনেমা হল চালু করলে ইসলাম ধ্বংস হয়ে গেছে৷ বাংলাদেশের মেয়েরা ছাত্রীসংস্থা করলে ঠিক আছে, সৌদী মেয়েরা চাকুরী করলে এটা উচিত না৷ নিজেদের কর্ম পদ্ধতির দিকে না তাকিয়ে এভাবেই তারা সৌদী সমালোচনায় মুখর৷ সাধারণত কলেজ এবং আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্ররা এই দলটির সমর্থক৷ এদের মাঝে অনেকেই আবার আহলে হাদীসের সমর্থক৷ আহলে হাদীসদের শায়খদের প্রায় সবাই সৌদী পন্থী৷ তাহলে জামাত-শিবিরের কেন এই সৌদী বিদ্বেষ?

আমরা দেখেছি, বিচারের নামে প্রহসন করে জামায়েতে ইসলামীর বেশ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে৷ এটা নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশই নিন্দা জানিয়েছে কিন্তু সৌদী আরব ছিলো নিরব৷ এটিই হচ্ছে তাদের সৌদীর প্রতি আক্রোশের কারন৷

জামাত-ইসলাম প্রায় সময়েই নিজেদেরকে ব্রাদারহুডের অনুসারী পরিচয় দিয়ে থাকে৷ প্রথম প্রথম ব্রাদারহুডের সাথে সৌদীর সম্পর্ক ভালো থাকলেও পরে অবনতি ঘটে৷ রাজনীতিতে রাজার সাথে রাজার সম্পর্ক, দলের সাথে দলের৷ সৌদী যেহেতু রাজতান্ত্রিক দেশ সেহেতু তারা যে কোন দেশের সরকারের সাথেই সম্পর্ক বজায় রাখে৷

আমেরিকা, ভারত এদেরকে আমরা কেন ঘৃণা করি? কারন এরা আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, খনিজ সম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ সব বিষয়ে নাক গলায়৷ সৌদীকে কেন ঘৃণা করি? কারন তারা আমাদের অভ্যন্তরীণ কোন বিষয়ে নাক না গলিয়ে দেশের সব দলের জনগণের প্রতি ভ্রাতৃত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়৷

স্বাধীনতার পর সেক্যুলার সরকারের প্রতি ভ্রাতৃত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো, অহংকারের বশে তারা সে হাত মিলায় নি৷ জিয়াউর রহমান সে ভুল করেন নি৷ সেই ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আজ পর্যন্ত অটুট আছে৷ যদি সেটি ছিন্ন করতে চাইত তাহলে এরশাদের সাথে তারা কোন সম্পর্ক রাখত না৷ কাউকে ক্ষমতায় বসানো বা নামানোর রাজনীতি যদি তারা করত তাহলে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বেগম খালেদা জিয়াকে রাজপথে নামতে হত না৷

আমাদের জামাত-শিবিরের ভাইযেরা এতই ধার্মিক যে, তারা শিয়া-সুন্নী বিভেদ মানেন না; কিন্তু ক্বাওমী আলেমরা মোনাফেক, দরবারী, বিদআতী, বেঈমান এসব বলে খুব সুন্দরভাবে ক্বাওমী আলেমদের সাথে বিভেদের দেয়াল তুলে দিতে পারেন৷ অথচ ইতিহাস বলে শিয়া-সুন্নী বিভেদ তৈরী হয়েছে সাহাবীগণের আমলে, আর কলেজ-আলিয়া-ক্বাওমী বিভেদ হয়েছে ইংরেজ আমলে৷

যারা তিনশ বছর আগের বিভেদ মীমাংসা করতে পারেন না, তারা চৌদ্দশ বছর আগের বিভেদ মীমাংসা করতে পাররবেন! এটি কি আদৌ সম্ভব, নাকি ভোটের রাজনীতিতে ভোট পাওয়ার ধান্ধা?

উপমহাদেশের রাজনীতিতে ক্বাওমী আলেমগণের ঐতিহাসিক, ঐতিহ্যবাহী, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে৷ একটা সময় ক্বাওমী আলেমগণ সৌদীপন্থীই ছিলেন, সেজন্য বিদআত পন্থীরা ক্বাওমী আলেমগণকে ওহাবী বলে গালিগালাজ করত৷ ইদানীং সৌদীদের সাথে আমাদের ক্বাওমী আলেমগণের দূরত্ব বেড়ে চলেছে৷

কিছু আলেমের সাথে আক্বীদা বা বিশ্বাসগত কারনে দূরত্ব৷ আর কিছু আলেমের সাথে রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির কারনে দূরত্ব৷ বিশ্বাসগত কারনে যে দূরত্ব সেটা ইনশাআল্লাহ এক সময় ঠিক হয়ে যাবে৷ আর রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির কারনে যে দূরত্ব সেটা আদৌ ঠিক হবে কি না, আল্লাহ ভালো জানেন৷

ব্যবসায়িক বিষয়গুলো হলো মাজার, পীর, সূফী, দরবেশ ইত্যাদি৷ আর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কারো যদি একটা মাদ্রাসা আর কিছু ছাত্র থাকে তিনিই রাজনৈতিক দলের দোকান খুলে বসেন৷ অথচ আল্লাহ পাক পবিত্র ক্বোরানে বলেছেন, "তোমরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ো না৷" ঊনারা বলেন, গণতন্ত্র হারাম, কিন্তু ঊনাদের মার্কায় ভোট দিলে পাবেন বেহেশতের আরাম৷

এই গণতন্ত্র আমাদের কি দিয়েছে তার সামান্য ঊদাহরণ দেই- বাবা ছেলেকে বলছে, "সেক্যুলাররা কোন মানুষের বাচ্চাই না৷" ছেলে বাবাকে বলছে, "জাতীয়তবাদীরা সব পাগল৷" ভাই ভাইকে বলছে, "জামাত-শিবির রগ কাটা রাজাকারের দল৷" অপর ভাই বলছে, "পীর হইলো ঈমাণ চোর, ভন্ড৷" এদের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক৷

অনলাইনেও আমরা প্রতিদিন অহরহ জারজ, কুত্তা, শুয়োর এ ধরনের শব্দে একজন আরেকজনকে গালাগাল করছি৷ ধর্মীয় দিক দিয়ে আমাদের মাঝে একজন অপরজনকে সংশোধনের যতটুকু না উদ্দেশ্য থাকে তার চেয়ে বেশি থাকে দলীয় উদ্দেশ্য৷

আমরা প্রায় সবাই গণতান্ত্রিক দলের জন্য জীবন দেওয়া, জীবন নেওয়া, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা মুসলমান৷ অথচ রাসূল (সাঃ) বলেছেন, "আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী বেহেশতে প্রবেশ করবে না৷" যারা নিজেদের রাসূল (সাঃ) ওয়ারিশ পরিচয় দিয়ে আমাদেরকে ইসলামের পথে আহবান করেন তারা নিজেরাই একে অপরের কাপড় খুলতে ব্যস্ত৷

রাসূল (সাঃ) বলেছেন, "খাঁটি মুসলমান ঐ ব্যক্তি যাহার হাত ও মুখ থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ থাকে৷" আর আমাদের কাছে, "খাঁটি মুসলমান ঐ ব্যক্তি যে আমার দল করে৷" দলের জন্য নিজের বাবা-মেয়েকে, মা-ছেলেকে, স্বামী-স্ত্রীকে, ভাই-ভাইকে ছোট করার সামান্য প্রবণতাও সৌদীদের মাঝে নেই৷

এখানে ধর্মের বাণীকে বিকৃত করে নিজের ব্যক্তি স্বার্থ বা দলের স্বার্থ হাসিল করতে গেলে সৌদী শরীয়াহ পুলিশ পিঠাই পাছা লাল কইরা দিবে৷ তো আমাদের মত দলবাজ ধার্মিক এবং আমলহীন আলেমদের কাছে সৌদীকে অমুসলিম, ইহুদী, আমেরিকার দালাল মনে হতেই পারে

"ইসরাইল বিরোধী মিছিল করা হারাম”—সৌদী গ্র্যান্ড মুফতি

“ইসরাইলকে অভিশাপ দেওয়া যাবে না”— সৌদী মুফতি

২০১৪ সালের দিকে এমনই দু'টো খবর বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো৷ আর তা নিয়ে আমাদের অনলাইনভিত্তিক ধার্মিকরা সৌদী মুফতিকে ইহুদীদের দালাল, কানা দাজ্জাল, দরবারী আলেম যার মুখে যা আসে তা বলা শুরু করলো৷ তাদের সাথে সাথে তাদের ফ্যান, ফলোয়ার্সরাও এসবে শরীক হয়ে দোজাহানের অশেষ নেকী হাসিল করেছিলো৷

এসব ধার্মিক সেলিব্রেটিদের পোস্টে গিয়ে আমি সৌদী গ্র্যান্ড মুফতীর ফতোয়া উল্লেখ করলাম৷

সৌদী গ্র্যান্ড মুফতি বলেছিলেনঃ

"এই ধরণের মিছিল-সমাবেশ ফিলিস্তিনীদের কোন উপকারে আসে না। এই ধরণের গণতান্ত্রিক কার্যক্রম কোন সাহায্য করতে পারবে না। এসব করার চেয়ে তাদের সাহায্যের জন্য ফান্ড গঠন করা, তাদেরকে সাহায্য ও অনুদান দেওয়া, এসবই বেশি কাজে আসবে৷"

বাস্তবতার ভিত্তিতে আমরা যদি লক্ষ্য করি সেই কবে থেকে বাংলাদেশে ইসরাইল বিরোধী মিছিল, মিটিং সমাবেশ হচ্ছে এগুলো কি সত্যি ফিলিস্তিনীদের কাজে আসছে? এই যে আমরা বায়তুুল মোকারম থেকে বিরাট বিরাট মিছিল বের করছি, এগুলোতে রোহিঙ্গাদের জন্য বেশি উপকারী হয়েছে? না যারা বিভিন্ন অনুদান সংগ্রহ সাহায্য করেছন তাদেরটা বেশি উপকারী হয়েছে?

গ্র্যান্ড মুফতি অনর্থক কাজ করতে বারণ করে, উপকারী কাজ করতে বলেছেন৷ কিন্তু আমাদের মিডিয়া সেটাকে বিকৃতভাবে প্রচার করেছিলো আর সেই সাথে আমরাও আমাদের বিকৃত ভাষা প্রয়োগ শুরু করেছিলাম৷ একই রকম বিকৃতি করা হয়েছিলো দ্বিতীয় ফতোয়ার ক্ষেত্রেও৷

ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেছেন, “সমস্ত ওলামারা একমত হয়েছেন যে, ইসরাইল হচ্ছে ইয়াকুব আঃ (ইসহাক আঃ এর পুত্র, ইব্রাহীম আঃ এর নাতি)।”

হিব্রু ভাষায়, ইসরাইল অর্থ হচ্ছে – আল্লাহর বান্দা৷ ইয়াকুব আঃ এর অন্য আরেক নাম ছিলো ইসরাইল। আর জায়োনিস্ট ইয়াহুদীরা নিজেদেরকে ইয়াকুব আঃ এর অনুসারী হিসেবে দাবী করার কারণে ফিলিস্থিন দখল করে তাদের সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের নাম রাখে ইসরাইল।

শায়খ সালেহ আল-ফাওজান (হাফিঃ) ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, "ইসরাইলকে অভিশাপ দেওয়া যাবে না কারণ ইসরাইলকে অভিশাপ দেওয়া মানে একজন নবীকে অভিশাপ দেওয়া (নাউযুবিল্লাহ)৷ ইসরাইলকে অভিশাপ না করে, বলতে হবে ইয়াহুদী বা ইয়াহুদী রাষ্ট্রের উপর আল্লাহর অভিশাপ।" কারো যদি মাথায় সামান্য ধর্মীয় জ্ঞান থাকে তার অবশ্যই জানা আছে নবী রাসুলদের গালি দেওয়া কুফুরী৷

এখানেও মিডিয়া তথ্য বিকৃত করেছে, সেই সাথে প্রকাশ পেয়েছিলো আমাদের বিকৃত রূচির৷ গত কয়েক বছর ধরে একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি রমজান এবং হজ্বের সময় হলেই আমাদের মিডিয়াগুলো সৌদীর খবর নিয়ে সরব হয়৷ এই মিডিয়াগুলো কিভাবে শীয়া, কাফের, ইহুদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তা আমি এই সিরিজের পূর্বে উল্লেখ করেছিলাম৷ যেহেতু আমাদের মগজগুলা মিডিয়া পূজা, ব্যক্তি পূজা, দল পূজা, দেশ পূজায় বন্দী তাই এর বাইরে চিন্তা করার ক্ষমতা আমাদের নেই বললেই চলে৷পূর্বেই বলেছি এই ফতোয়া দু'টো নিয়ে আমি বেশ কয়েকজন সেলিব্রেটির পোস্টে গিয়ে মন্তব্য করেছিলাম৷ সেখানে আমাকে তাদের মুরীদদের কাছ থেকে সৌদী দালাল, ওহাবী, ইহুদী ইত্যাদি কথা শোনতে হয়েছে৷ তবে এর দ্বারা আমার উপকারই হয়েছে৷ ২০১০ থেকে ফেসবুক ব্যবহার করলেও লেখালেখির কোন পরিকল্পনাই ছিলো না৷ কিন্তু এসব সেলিব্রেটি এবং তাদের মুরীদদের আচরণে মনে হলো, আমি কেন অন্যের পোস্টে গিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করবো? এর চেয়ে আমি নিজেই লেখি, যার পছন্দ হবে তিনি গ্রহণ করবেন, যার পছন্দ হবে না তিনি বর্জন করবেন৷

এই সেলিব্রেটিদের মাঝে বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত হাসপাতালের একজন মহিলা ডাক্তার ছিলেন৷ তার পোস্টে আমার কমেন্টে যে রিপ্লাই এসেছিলো তার জন্য আমি একেবারেই অপ্রস্তুত ছিলাম৷ তিনি রিপ্লাইতে বললেন, "আপনি জানেন না সৌদীরা কত খারাপ! তারা রাস্তা ঘাটে *ক্স করে, এনাল করে, কাজের মেয়েদের এরা যৌনদাসীর মত ব্যবহার করে, এদের মত বিকৃত যৌনাচারী দুনিয়াতে আর নেই" ইত্যাদি ইত্যাদি৷

ঊনি পোস্টটা করেছিলেন ধর্মীয় আমার মন্তব্যটাও ছিলো ধর্মীয় কিন্তু তিনি চলে গেলেন তাদের ব্যক্তিগত জীবনে৷ ঊনার ঐ ব্যাপারেও আমি ব্যাখ্যা দিলাম৷ ঊনি একটার পর একটা প্রসঙ্গ আনলেন, আমি একটার পর একটা ব্যাখ্যা দিলাম৷ শেষ পর্যন্ত তিনি আমাকে ব্লকই করে দিলেন৷

এই সিরিজটা লিখতে গিয়েও লক্ষ্য করেছি, আমি হয়ত ধর্মীয় প্রসঙ্গ আলোচনা করছি, অনেকে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ টেনে আনেন৷ রাজনৈতিক প্রসঙ্গ নিয়ে লিখলে অভ্যন্তরীণ প্রসঙ্গ টেনে আনেন৷ এসবের দুইটা কারন থাকতে পারে একটা হলো কৌতুহল, আরেকটা হলো বিদ্বেষ পোষণ করার মত উসিলা খোঁজা৷ যারা কৌতুহলী তাদের অপেক্ষা করতে হবে৷

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই এই সিরিজটা লিখছি৷ আমার জানা, শোনা, দেখার সাথে অন্যেরা একমত হবে এমনটা আশা করি না৷ তাই যারা বিদ্বেষ পোষণ করে দোজাহানের কামিয়াবী হাসিল করতে চাইছেন, তাদেরকে আমি বাধা দেই না৷

আমাদের আঞ্চলিক প্রবাদে আছে, "এক গপ করে হুতের বৌর কাছে, আরেক গপ করে না দেইয়ার কাছে" অর্থাৎ, "ছেলের বৌ আর না দেখা লোকের কাছে মানুষ বেশি গল্প করে৷" এক সময় প্রবাসীদের কাছে গল্প শোনতাম বিমান বালারা হাতা, পা টিপে দেয় শরীর ম্যাসেজ করে দেয়৷ এখন সেসব গল্প মনে পড়লে হাসি আসে৷

সৌদী আরব নিয়েও আমাদের দেশে এমন এমন অনেক মুখরোচক গল্প প্রচলিত আছে৷ এসব শোনে শোনে আমাদের দেশের নারী-পুরুষরা ভাবে সৌদী একটা খোলামেলা যৌনদেশ৷ সৌদী আরবের বড় বড় রাস্তাগুলোতে স্থায়ী এবং অস্থায়ী দু'ধরনের ক্যামেরা বসানো, সেই সাথে স্থায়ী এবং অস্থায়ী চেক পয়েন্ট৷ আছে গাড়িতে টহলরত ট্রাফিক পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ৷ এত প্রকার নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে কে যাবে গাড়িতে সন্তান উৎপাদনের কর্ম করতে!

এখানকার পার্কগুলোতে নারী-পুরুষের হাত ধরাধরি করে হাঁটতে দেখে আপনার মনে বিন্দুমাত্র কুচিন্তা আসবে না, কারন ভদ্র মহিলার পুরো শরীর কালো বোরকা দ্বারা আবৃত৷ যেহেতু তারা স্বামী-স্ত্রী তাই ঘর ছেড়ে আমাদের দেশের মত তাদের পার্কে কুকর্মে লিপ্ত হওয়ার প্রশ্নই আসে না৷

কেউ ঘরে উঁকি দিলে রাসূল (সাঃ) খোঁচা মেরে তার চোখ কানা করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, তারপরেও যেহেতু আমাদের অন্যের ঘরে উঁকি মারার বদঅভ্যাস সেহেতু আসি ঘরোয়া ব্যাপারে৷ সৌদীদের হোটেল রূমগুলোতে কোন কাজের প্রয়োজন হলে নারীদের তারা অন্য রূমে বা বাথ রূমে ঢুকিয়ে রাখে৷ নারীবাদীদের কাছে এটি বন্দীত্ব মনে হতে পারে, কিন্তু ইসলামপন্থীদের কাছে নারীকে পর পুরুষের নজর থেকে রক্ষা করার শরীয় বিধান৷

বাসা বাড়িগুলোতে দরজায় নক করলে পাঁচ-ছয় বছর বয়সী বাচ্চারা এসে জিজ্ঞেস করবে কি চাই? কাকে চাই? ভিতর থেকে নির্দেশ না আসা পর্যন্ত বাচ্চারা দরজা থেকে সরবে না, আপনাকে ঘরেও ঢুকতে দিবে না৷ আপনার মাঝে ধর্মীয় জ্ঞান না থাকলে আপনার মনে হবে এগুলা চুল পাকনা পোলাপাইন, আর ধর্মীয় জ্ঞান থাকলে মনে হবে মুসলিম বাচ্চাদের এমনই সতর্ক হওয়া উচিত৷

প্রতিটা বাসার নিচে দারোয়ান এবং ড্রাইভারের জন্য আলাদা রুম আছে৷ কোন প্রয়োজন হলে তারা বাচ্চা, কাজের মেয়ে বা ফোন করে লিফটে টাকা পাঠিয়ে দিবে৷ কোন অনৈতিক সম্পর্কে লিপ্ত হলে শিরোচ্ছেদের মত শাস্তির বিধান আছে৷ এত সব ঘটনার পরেও হয়ত দু'একটা অঘটন ঘটে যায়, আর তা নিয়েই আমাদের মাতামাতি৷

আসি গৃহকর্মীদের ব্যাপারে৷ সৌদী আরবের বেশিরভাগ হাউজ ড্রাইভার, গৃহকর্মী ইন্দোনেশিয়ান৷ তিন কি চার বছর আগে ইন্দোনেশিয়া সৌদী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দেয়৷ এমনকি তাদের যেসব গৃহকর্মী এবং হাউজ ড্রাইভার ছুটিতে গিয়েছিলো ইন্দোনেশিয়ার সরকার তাদের ভিসাও গুলোও বাতিল করে দিয়েছিলো৷

এ বিষয়ে আমার ইন্দোনেশিয়ান কলিগরা বললো, এক ইন্দোনেশিয়ান গৃহকর্মীকে সৌদী রেপ করতে গেলে মেয়েটা সৌদীকে খুন করে৷ বিচারে ইন্দোনেশিয়ান মেয়েটির ফাঁসি হয়৷ ইন্দোনেশিয়ান দূতাবাসকে না জানিয়ে মেয়েটির বিচার কার্য এবং ফাঁসি কার্যকর করার প্রতিবাদে ইন্দোনেশিয়ান সরকার সৌদীতে গৃহকর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দেয়৷

ইন্দোনেশিয়ার গৃহকর্মীদের ভিসা বন্ধ করে দেওয়ার পর, অনেক পুরাতন গৃহকর্মী ওমরাহ ভিসায় তাদের কফিলের কাছে ফেরত গেছে৷ এদের অনেকের সাথে অধমের কথা হয়েছিলো৷ আমরা যেমনটা মনে করি সৌদীতে গৃহকর্মীর কাজ করা মানেই যৌনদাসী, আসলে তেমন টা না৷ আর এটি আপনি স্বাভাবিক জ্ঞানেই বুঝে নিতে পারেন কফিল অত খারাপ হলে এই মেয়েরা অবৈধ ভাবে ফিরে আসত না৷

ইন্দোনেশিয়ান জটিলতার পর সৌদী সরকার বর্তমানে আইন করেছে, একজন গৃহকর্মীর সাথে স্বামী এবং ভাই বা দু'জন নিকটাত্মীয়কে কাজ দিতে হবে৷ এবং এই ভিসার বিমান ভাড়া থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ কফিলকে বহন করতে হবে৷ ইন্দোনেশিয়ানরা এই সুযোগকে সৎ ভাবে গ্রহণ করলেও আমরা এর মাঝে দূর্নিতী ঢুকিয়ে দিয়েছি৷ আমরা তিনটা ভিসা তিনজনের কাছ বিক্রি করে তিনগুণ মুনাফা অর্জন করি৷ আমাদের দেখিয়ে দেওয়া পথে কিছু সৌদীরাও হাঁটছে৷ সব দেশেই কিছু অসৎ লোক থাকে৷

যৌন সমস্যা ছাড়া আমাদের দেশের মেয়েদের যে সমস্যাগুলোতে পড়তে হয় তার মধ্যে প্রথম হলো কথা বলা৷ ছেলেরা একে অপরের সাথে কথা বলতে পারলেও মেয়েদের অন্তত এক বছর বোবার মত জীবন যাপন করতে হবে৷ কারন ভাষা বুঝতে তার অনেক সময় লাগবে৷ খাবারের সমস্যা আছে, সৌদীরা যা খাবে তাকেও তাই খেতে হবে৷ ঘুমেরও সমস্যা আছে, কারন সৌদীরা রাত বারটায় ঘুমায় আবার তাহাজ্জুদের সময় উঠে যায়৷ দিনে তারা ঘুমাতে পারলেও গৃহকর্মী ঘুমাতে পারছে না৷

প্রবাসে বিশেষ করে সৌদীতে এসে দুই ফোঁটা চোখের পানি ঝরায় নি, এমন একজন বাঙ্গালী পুরুষ আমার মনে হয় পাওয়া যাবে না, সেখানে মেয়েদের অবস্থাটা কেমন হতে পারে? তারপরেও আমরা আসছি বা আসতে বাধ্য হচ্ছি৷

কিছু দিন পূর্বে কুয়েতে ফিলিপাইনের এক গৃহকর্মীকে নির্যাতনের প্রতিবাদে সে দেশের সরকার কুয়েতে গৃহকর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দেয়৷ ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন আমাদের মত অত উন্নত নয় কিন্তু তারা প্রতিবাদ করতে শিখেছে৷ একে বলা হয় বীরত্ব৷ এই যে আমাদের দেশে সৌদীতে এত এত নারী নির্যাতনের সংবাদ প্রচার করেছে কোন একটা ঘটনা নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন প্রতিবাদ করা হয়েছে?

আপনি, আমি, আমরা যতই রাজনৈতিকদের পূজা করি, তারা কিন্তু আমাদের মানুষই মনে করে না৷ তারা চায় আপনি আপনার শ্রম বিক্রি করেন, আপনার মেয়ে তার ইজ্জত বিক্রি করুক সেই অর্থ দিয়ে তারা আপনাকে কাঙ্গালী ভোজের এক টুকরো হাড্ডি নতুবা জন্মদিনের এক টুকরো কেক ছুঁড়ে দিবে যেভাবে কুকুরের সামনে তার প্রভু খাবার ছুঁড়ে মারে৷

আমরা যতই নিজেদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বীর, বাঙ্গালী বীরের জাতি এসব বলি বাস্তবতা হলো আমরা সুবিধাবাদী, কাপুরুষের, গোলামের জাত৷ আমরা আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আলেকজেন্ডার, জুলিয়াস সীজার, মোহাম্মদ বিন কাসেম, সালাহউদ্দীন আইয়ুব, চেঙ্গিস খান, বাবরের সমতুল্য একজন বীর দাঁড় করাতে পারবো না৷ আমাদের ইতিহাস হলো শাসকরা যখন শোষণ করতে করতে আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেয় তখন তীতুমীরের মত মুষ্টিমেয় লোক প্রতিবাদ জানায়৷ বাকিরা লুটপাট, মোসাহেবী, তামাশা, সমালোচনা, সুযোগ খুঁজতে ব্যস্ত থাকে৷

আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এসব প্রতারক, মিথ্যাবাদী, সুবিধাবাদী, লম্পট, চরিত্রহীন, ধর্মীয় জ্ঞান বিবর্জিত লোকদের দখলে৷ কিন্তু ধার্মিকদের অবস্থানটা কি?

আমাদের ধার্মিকরা ফতোয়া দেয় চুরি করলে হাত কেটে দিতে হবে, কিন্তু ইসলাম যে তার চুরি করার কারন দূর করার নির্দেশও প্রদান করে সেটা বলেন না৷ ইসলামে মেয়েদের উপর সংসারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পড়ে না৷ মাহরাম ছাড়া মেয়েদের সফরও নিষিদ্ধ করে৷ এই মেয়েগুলো কেন দেশ ছেড়ে প্রবাসী হচ্ছে, দেশে এদেরকে সাবলম্বী করার কোন চিন্তা আমাদের ধার্মিকদের মাঝে নেই৷

আপনি সৌদীর কোন মেয়েকে কটূক্তি করলে স্বাক্ষী, প্রমাণ ছাড়াই সাজা হয়ে যাবে৷ অথচ আমাদের দেশে রাস্তা-ঘাটে, স্কুল-কলেজে, হাটে-বাজারে মেয়েরা কত রকম বাজে ব্যবহারের শিকার হয়৷ যেসব ধার্মিকরা সৌদীর নারীর নির্যাতন নিয়ে বিশাল বিশাল প্রতিবাদ রচনা করেন, সেসব ধার্মিকরা কি কখনো এসব প্রতিরোধ করেছেন? আমরা আসলে আত্মসমালোচনা করতে পারি না, যেটা পারি সেটা হলো অন্যের সমালোচনা৷ যার কারনে আমাদের কোন উন্নতি হয় না, আর এসবের ফল ভোগ করতে হয় আমাদের মা-বোনদের৷নতুন বৌ এর ঘর ঝাড়ু দেখে শ্বাশুড়ির প্রতিক্রিয়া, "কেমন মায়ের মেয়ে তুমি, ঘর ঝাড়ু দেওয়াটাও শেখায়নি?" রান্না দেখে, "এই রান্না মানুষতো দূরের কথা হাঁস-মুরগীও খেতে পারবে না৷" গোসলে, "ও লো নবাবের বেটি গোসল করতে কতক্ষণ লাগে?" বৌ এর উঠতে দোষ, বসতে দোষ৷ সব দোষ কিন্তু বৌ এর না, শ্বাশুড়িরও কিছু দোষ আছে৷ সে দোষটা হলো মানসিক৷

প্রতিটা মানসিক দোষের একটা অতীত আছে৷ শ্বাশুড়ি যেদিন বৌ হয়ে এসেছিলো, সেদিন তার শ্বাশুড়িও তাকে এভাবে নিপীড়ন করেছিলো৷ তার অবচেতন মনে সেদিন প্রতিশোধের যে স্পৃহা কাজ করছিলো, আজ নতুন বৌ কে নিপীড়ন করে তিনি বদলা নিচ্ছেন৷ সৌদী আরবের সাথে আমাদের সম্পর্কটা হলো বৌ-শ্বাশুড়ির মত৷ আর এই বৌ-শ্বাশুড়ির সম্পর্ক তৈরিতে আমাদের মত প্রবাসীদের বিরাট ভূমিকা আছে৷

এক সময় দেশে থাকতে সৌদী প্রবাসীদের কাছে শোনতাম, সৌদীরা এত খারাপ যে বাবার ভয়ে মা- মেয়েকে আলাদা রুমে রাখে, ভাইয়ের ভয়ে বোনকে নিয়ে মা-বাবা শংকিত থাকে৷ শুক্রবারে হজ্ব হলে সৌদী বাদশাহ হাজীদেরকে অনেক উপঢৌকন দিতে হয়, তাই শুক্রবার যাতে হজ্ব না হয় সেজন্য সৌদী সরকার চাঁদের তারিখ পরিবর্তন করে৷ সৌদী নিয়ে এ ধরনের অনেক মিথ আমাদের দেশে প্রচলিত আছে৷

রাসূল (সাঃ) বলেছেন, "তোমাদের সন্তানদেরকে নামাযের আদেশ দাও যখন তাদের বয়স সাত বছর হবে। আর দশ বছর বয়স হলে নামাযের জন্য তাদেরকে প্রহার কর এবং তাদের পরস্পরের বিছানা আলাদা করে দাও।" উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ফকীহগণ সাত বছর আবার কেউ দশ বছরে বিছানা আলাদা করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন৷ তবে দশ বছর বয়সে যে বাচ্চাদের বিছানা আলাদা করা ওয়াজিব এ বিষয়ে সকলে একমত৷ আধুনিক যৌন বিজ্ঞানীরাও বাচ্চাদের আলাদা বিছানায় ঘুমানোর ব্যবস্থা করার গুরুত্ব স্বীকার করেন৷

রাসূল (সাঃ) সাহাবীগণকে প্রতি চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ রোযা রাখতে বলেছেন৷ আমাদের দেশে এটা প্রচলিত না থাকলেও আরবের অনেকে এই সুন্নাহটি পালন করেন৷ এছাড়া রমজান, ঈদুল ফিতর, হজ্ব, ঈদুল আযহার মত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতগুলো চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল৷ সেজন্য সৌদীতে চাঁদ দেখা কমিটি আছে৷ মেঘলা আকাশ বা কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারনে কমিটি যদি চাঁদের অবস্থান নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয় তাহলে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিগণ এব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিবেন৷

শায়খ আবদুর রহমান আল সুদাইসীর মত যাদের ইসলামী শরীয়াহ সম্পর্কে জ্ঞান আছে তাদেরকেই সাধারণত এখানে বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়৷ কোটি কোটি মুসলমানদের ইবাদত যে চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল সে চাঁদ নিয়ে এসব আলেমগণ হঠকারী সিদ্ধান্ত নিবেন, এসব বিশ্বাস করার মত কোটি কোটি বাঙ্গালী পাবেন আমাদের দেশে৷ এসব খবর কিভাবে ছড়ায় সেটা বলার আগে, যারা ছড়ায় তাদের সম্পর্ক বলি—আমাদের জাতিগত বদঅভ্যাস হলো অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে জানা এবং অন্যকে নিজের ব্যক্তিগত বিষয়ে জানানো৷ অন্যান্য দেশের লোকেরা হজ্ব ওমরাহ করতে আসলে জিয়ারত করার জন্য ঐতিহাসিক স্থান সমূহের নাম জানতে চায়, আর আমাদের দেশে লোকেরা এসে জিজ্ঞেস করবে বেতন কত? মাসে কত থাকে? কয় ঘন্টা ডিউটি? বাড়িতে কি কি করছেন? বৌ আছেনি? বাচ্চা-কাচ্চা কয়জন? ইত্যাদি ইত্যাদি যার সাথে ইবাদতের কোন সম্পর্কই নাই৷

ইউরোপ, আমেরিকা থেকে যারা আসেন তারা এখানকার শ্রমিকদের কষ্ট শোনে আফসোস করেন৷ তারপর ইউরোপে হেন আছে, আমেরিকায় তেন আছে গল্প শুরু করেন৷ ইউরোপ, আমেরিকার হেন-তেন গল্প বলা এসব ভাইদের যদি বলি আমাকে একটা ভিসা দেন, তখন তারা আবার নতুন কাহিনী শুরু করেন৷ এসব দেশের ভিসা পাওয়া কি এত সোজা? ভিসা পাইলে দূতাবাসের কর্মীরা গিয়ে চেক করে, বিশ-তিরিশ লাখ ব্যাংক এ্যাকাউন্ট শো করা লাগে, বিয়া করলে বৌ ঐখানে যাই মামলা করবে তারপর মামলার রায় হলে ভিসা আসবে ইত্যাদি, ইত্যাদি মানে আবারো হেন-তেন৷

এসব কাহিনীওয়ালা লোকদের আমি মুখের উপরই বলে দেই, ভাই, আমাদের এখানে আসতে অতকিছু লাগে নাই৷ ভিসা পাইছি, মেডিকেল ওকে তারপর বিমান উঠে গেছি৷ সৌদী বিমানে আমাকে দুইবার অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে৷ আমার সীটে অন্য যাত্রী বসে গেছেন৷ আমি ঊনাকে বললাম, এটা আমার সীট, আপনি আপনার সীটে যান৷ তিনি বললেন, আমাকে বিমান বালা বসতে বলছে৷ ফিলিপিনো বিমান বালাকে বললাম, আমার সীটে আপনি অন্যকে বসতে দিলেন কেন?

এবার বিমান বালা লোকটাকে উঠতে বললো, কিন্তু তিনি উঠলেন না৷ অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি তার মিশরীয় কলিগের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন৷ মিশরীয় লোকটা তাকে কিছু না বলে আমাকে বললেন, সরি, সীট নাম্বার ঠিক করতে করতে প্রতিবার ঢাকা ফ্লাইটে ১৫-৩০ মিনিট দেরী হয়৷ তাই যে যেখানে খালি সীট পাও সেখানে বসে যাও৷ নিজেদের সীট নাম্বারটা দেখে বসার মত নূন্যতম অক্ষরজ্ঞান নেই, আইন বোঝে না এমন ৮০% বাঙ্গালী সৌদীতে জব করেন৷

আসার সময়ও অন্যজনকে দেখি আমার সীটে, পূর্ব অভিজ্ঞতার কারনে এবার আর কিছু বলা হয় নি৷ আমি প্রায় পাঁচ বছর আগের কথা বলছি, বর্তমানে এ অবস্থার উন্নতি হয়েছে কি না, যারা ইতিমধ্যে ভ্রমণ করেছেন তারা ভালো বলতে পারবেন৷ ইউরোপ-আমেরিকায় এমন নিরক্ষর বাঙ্গালী কয়জন আছেন তা সেখানকার প্রবাসী ভাইরা ভালো জানেন৷

আমার এক আত্মীয় দেশে মানুষের জমিনে হালচাষ করতেন৷ সৌদীতে তার চার, পাঁচটা দোকান হয়েছে৷ দেশে কোটি টাকার উপরে সম্পদ হয়েছে৷ ঊনাকে যদি সৌদীর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতাম বলতেন, সৌদীদের মত অমানুষ দুনিয়াতে আর নেই৷আরেক লোক এক সৌদী প্রবাসীর বাড়ির রাখাল ছিলো৷ বর্তমানে বাংলাদেশেই তিনি মাসে এক লক্ষ টাকা বাড়ি ভাড়া পান, সম্পদের হিসাব নাইবা বললাম৷ এই ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলে বলে, সৌদীতে মানুষ থাকে নাকি? এই লোক ডায়বেটিস এবং হার্টের রোগে ভূগছেন, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন এখনো সৌদী আরব ছাড়েন নাই৷

অন্য একজন দেশে মাছ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন৷ বর্তমানে তার উত্তরায় একটা, নারায়নগঞ্জে একটা, কুমিল্লায় দুইটা বাড়ি৷ "সৌদীদের মত জানোয়ার আর নেই" এটাই তার জপ কিন্তু আজও সৌদীতেই আছেন৷

কারো ব্যক্তিগত জীবন উল্লেখ করে তাকে ছোট করা আমার উদ্দেশ্য নয়, আর কোন হালাল কাজকেই আমি ছোট মনে করি না৷ শুধু লোকগুলো কোথায় ছিলো? আজ কোথায় এসেছে? এবং তাদের মনোভাব বোঝানোর জন্যই এসবের অবতারণা করা৷ এসব লোকগুলোকে যদি সৌদী আরবের বাদশাহীও দেওয়া হয় তবু এরা সন্তুষ্ট হবে না৷ কারন রাসূল সাঃ বলেছেন, "আদম সন্তানের যদি দুইটি স্বর্ণ ভরা পাহাড় থাকে, তবে সে তৃতীয় পাহাড়ের আশা করবে৷"

সীমাহীন লোভের বাইরে আছে আমাদের ব্যক্তিগত ব্যর্থতাকে অপরের উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা৷ শুধু মাত্র বিমান ভাড়ার বিনিময়ে আমার খালু তার ছোট ভাইকে এনেছিলেন ঊনার কফিলের কাজে৷ দুই মাস যেতে না যেতেই ঊনার ভাই দেশে চলে গেলেন৷ ছোট ভাইয়ের উপকার করতে গিয়ে বেচারা এখানে কফিলের কাছে ছোট হলেন৷ ওখানে দেশে মা এবং ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর বকা শোনলেন, বিমান ভাড়ার টাকাটাও আর পান নি৷ ঊনার ছোট ভাই দেশে গিয়ে কফিল সম্পর্কে যা বললেন, তা যাচাই করার সুযোগ ছিলো না৷

এখানে আসার পর প্রতি বছরই দুই একবার ঊনার কফিলের মাজরায় যাওযা হয়৷ সেখানে গেলে আমাদের জন্য ডিম, মুরগী, কবুতর, উটের দুধ, গাওযা, খেজুর, লেবু যা পাওয়া যায় সবই খাওয়া এবং নিয়ে আসা ফ্রী৷ অতিথি আপ্যায়নে আরবরা অত্যন্ত আন্তরিক৷ কারো কারো মনে হতে পারে এসব খেয়ে আমি ঊনার কফিলের সুনাম করছি, কিন্তু ঐ কফিলের বাঙ্গালী ছাড়াও পাকিস্তানী এবং সুদানী শ্রমিক আছে তাদের সাথেও আমার আলাপ হয়েছে৷ আসলে বৌ ছেড়ে বিদেশ করা সবার পক্ষে সম্ভব না, এই সহজ বিষয়টা সহজে বলা যায় না৷ তার চেয়ে সৌদী কফিলকে বলির পাঁঠা বানানো সহজ৷

আরেক লোক তার কফিলের ভিসায় আপন ভাগিনাকে এনেছিলো৷ তিন মাস না যেতেই ভাগিনা দেশে চলে গেছে৷ তারপর আর কি! সেই পারিবারিক কলহ৷ তার ভাগিনা ছিলো মাদকাসক্ত৷ সৌদীতে আপনি সিগারেট আর মোবাইল ছাড়া সহজে আর কোন নেশা পাবেন না৷ মাদকাসক্তদের জন্য সৌদী মাদক নিরাময় কেন্দ্র, উচ্ছৃঙ্খলদের জন্য জেলখানা৷ বন্দী জীবন সবাই মেনে নিতে পারে না সেক্ষেত্রে, দেশে গিয়ে নির্মম নির্যাতনের একটা গল্প বলে দিলেই সিমপ্যাথি দেখানোর লোকের অভাব হবে না৷

টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ডে একটা পতিতা পল্লী আছে৷ ওখানে কয়দিন পর পরই উচ্ছেদ, পূনর্বাসন চলে৷ বছর দেড়েক পূর্বে সেখানকার মেয়েদের উচ্ছেদ করে দেওয়ার পর, ওখানকার এক মেয়েকে এক ভদ্রলোক গৃহকর্মীর ভিসায় সৌদীতে নিয়ে আসেন৷ অনেক কষ্টে সে ছয় মাস ছিলো তারপর চলে গেছে৷ তার সমস্যা ছিলো কফিলের স্ত্রী তাকে স্মার্ট ফোন না দিয়ে সাধারণ মোবাইল দিয়েছে৷ সৌদীরা যদি দুপুরে ব্রুস্ট (চিকেন ফ্রাই) খায় তাকেও ব্রুস্ট খেতে হয়৷ তার জন্য আলাদা ভাত-তরকারী রান্না হয় না৷ দেশে এত কিছু না বলে একটা নারী নির্যাতনের গল্প বললে খুব সহজেই সিমপ্যাথি পেয়ে যাবে৷দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ৬ই এপ্রিল ২০১৮ এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, "পুলিশ সদর দপ্তরের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৭ সালে নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে ১৫ হাজার ২১৯ টি, ২০১৬ সালে ১৬ হাজার ৭৩০টি, ২০১৫ সালে ১৯ হাজার ৪৮৬টি, ২০১৪ সালে ১৯ হাজার ৬১৩টি, ২০১৩ সালে ১৮ হাজার ৯১টি, ২০১২ সালে ১৯ হাজার ২৯৫টি এবং ২০১১ সালে ১৯ হাজার ৬৮৩টি। তদন্তে দেখা গেছে, এসব মামলার ৯০ ভাগই ভুয়া।" এটি বাংলাদেশের হিসাব, বিদেশের মামলাগুলো কতটুকু ভূয়া কতটুকু সঠিক এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত সরকার কোন উদ্যোগ নেয়নি৷

এখানে কোন কফিল শ্রমিক নির্যাতন করলে কফিলের অর্থদন্ড এবং কারাদন্ড উভয়ের বিধান রয়েছে৷ সেক্ষেত্রে যেসব গৃহকর্মীরা নির্যাতিত হচ্ছে তাদের পক্ষ নিয়ে দূতাবাস মামলা করলে মেয়েগুলো যেমন স্বাবলম্বী হতে পারবে তেমনি দেশও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে৷ কিন্তু দূতাবাস মামলা করবে কি করে? ৯ই নভেম্বর ২০১৫ কালের কন্ঠের এক প্রতিবেদনে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম এর বরাত দিয়ে প্রকাশ করা হয়, "মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে সৌদি আরবের বিভিন্ন বাড়িতে কর্মরত নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানির তথ্য সঠিক নয়৷"

অনেকে এখানে ইমোশনাল হয়ে মন্ত্রীর উদ্দেশ্যে কটু বাক্য শুরু করবেন কিন্তু আপনাকে মনে রাখতে হবে এসব মন্ত্রীরাই বাহিরের দেশে আপনার, আমার, আমাদের প্রতিনিধিত্ব করেন৷ এদের পেছনেই আমরা স্লোগান দেই৷ নিজের পোলা যেমন তেমন হোক, বৌ ভদ্র হতে হবে এমন আবেগী বাঙ্গালী মায়ের অভাব নেই৷ নিজের দেশের শাসকরা যেমনই হোক সৌদী শাসকরা ভদ্র হতে হবে এমন আবেগী বাঙ্গালীরও অভাব নেই৷

যে কোটিপতি ভদ্রলোকদের কথা বললাম, সারা দিন উঠতে বসতে সৌদীকে গালি গালাজ করে এরা প্রত্যেকেই আবার নিজের সন্তানকে সৌদী আরব নিয়ে এসেছে৷ সৌদী যদি এতই খারাপ, তাহলে এরা নিজেদের সন্তানকে আবার সৌদীতে কেন এনেছে? এদের সন্তানদের মুখেও বাপদের মত সেই পুরাতন বুলি৷ এধরনের লোকদের দেখার জন্য আপনাকে সৌদী আসতে হবে না চোখ, কান খোলা রেখে আপনার আশেপাশে লক্ষ করলেই এমন অনেক সৌদী প্রবাসী পাবেন৷

সৌদী আরবের লোকেরা ছিলো আমাদের দেশের আদিযুগের মানুষদের মত সহজ-সরল৷ পুরাতন দিনের জায়গা-জমির কাগজপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে দেখা যায় একটা বড় ইলিশ মাছ, এক হাঁড়ি মিষ্টি, এক প্যাকেট বিড়ির বিনিময়ে অনেকে জায়গা জমি দান করে দিয়েছেন৷ নাতির যুগে এসে তাদের ভিটেমাটি ছাড়া আর কিছুই নেই৷

কিং সালমান ক্ষমতায় আসার পর থেকে তার ছেলে মুহাম্মদ বিন সালমানই পরোক্ষভাবে দেশ শাসন করেছে৷ এই তরুণ উপলব্ধি করতে পেরেছে সৌদীরা যদি কাজ না করে অলসভাবে বসে থাকে আর প্রবাসী শ্রমিকরা কাজ করে তাহলে একদিন তাদেরও ভিটেমাটি ছাড়া আর কিছু থাকবে না৷ কিভাবে সৌদীদের কাজে লাগানো যায়, এ চিন্তায় সে নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করছে৷ এর ফলে আমাদের মত লক্ষ লক্ষ প্রবাসী বেকার হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে৷ চাকুরীচ্যূত শ্রমিক মালিকের সুনাম করেছে এমন নজির খুবই কম৷ বাংলার চিরায়ত বৌ-শ্বাশুড়ির দ্বন্ধের মতই আমাদের সৌদী বিদ্বেষ চলতে থাকবে৷

শুরুতেই যেটা বলেছি এখানে যারা কাজ করতে আসে বেশিরভাগ লোকই নিরক্ষর৷ ব্যক্তিগত সমস্যা, অভ্যন্তরীণ সমস্যা, রাষ্ট্রীয় সমস্যা, রাজনৈতিক সমস্যা, ধর্মীয় সমস্যা এসবকে আলাদা আলাদাভাবে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা অনেকেরই নেই৷ কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষিতদের অবস্থাটা কেমন?

এইতো কিছু দিন আগে মুহাম্মদ বিন সালমান মারা গেছে প্রচার করে শিক্ষিত সমাজ ফেসবুকে তোলপাড় করে ফেললো৷ কিন্তু এ খবরটা যখন মিথ্যা প্রমাণিত হলো যেসব শিক্ষিত সমাজ এই সংবাদ প্রচার করেছিলো এবং বিশ্বাস করেছিলো, তাদের কারো মাঝে কি এই মিথ্যা খবর নিয়ে কোন প্রকার অনুশোচনা বা ক্ষমা চাওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে? মোটেই না৷ বরং নতুন নতুন আর কি কি গুজব নিয়ে মাতোয়ারা হওয়া যায় তার সন্ধানে মাঠে নামলো৷ এরা আবার নিজেদের দাবী করে ইসলামের সৈনিক!এদের ইসলাম কায়েমের নমুনা দেখলে পুরাতন এক ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়৷ আমার এক ফ্রেন্ড এক হিন্দুকে বলছে, শালা মালাউনের বাচ্চার কত বড় সাহস আমার বাড়ির সামনে মদ খায়! তাকে যতই বাধা দেই ততই সে ক্ষিপ্ত হয়ে মারতে যায়৷ অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম যে, তার নিজের পকেটেই গাঁজার পুরিয়া আছে৷ পরে জেনেছি ঐ হিন্দুর ভাইয়ের সাথে তার নারী ঘটিত বিরোধ ছিলো৷ এধরনের গাঁজাখোরের কথায় ধর্ম যুদ্ধে নেমে যাওয়ার মত মূর্খের অভাব নাই দেশে৷

পবিত্র কাবা শরীফের ইতিহাসে বহু রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে৷ পুরো দশ বছর হাজরে আসওয়াদ ছাড়া মুসলমানরা হজ্ব পালন করেছে৷ হাজরে আসওয়াদ ভেঙ্গে যথাসম্ভব চার কি আট টুকরো হয়ে গেছে যা পরবর্তীতে জোড়া লাগানো হয়েছে৷ এত কিছুর পরেও আলহামদুলিল্লাহ! চব্বিশ ঘন্টার মাঝে এক মিনিটও বিরতি নেই মানুষ তাওয়াফ করছে৷ ঈদুল আজহার সময় সাধারণত হাজীরা মক্কা থাকে না, যারা তাওয়াফ করে তারা স্থানীয়৷

দূর-দূরান্ত থেকে হজ্ব-ওমরাহ করতে আসা মানুষের তাওয়াফে যাতে কষ্ট না হয় সেজন্য প্রতি বছর ঈদুল আজহার সময় কাবার গিলাফ পরিবর্তন হয়৷ এই সাধারণ বিষয়টা নিয়ে আমাদের কিছু কিছু আলেম যে প্রতিক্রিয়া দেখালেন এতে ঊনাদের ইলম কতটুকু আছে সেটা নিয়েই আমি চিন্তিত৷ অবশ্য এসব আলেমগণ ইসলাম প্রচারে হাদীস-কোরআনের চেয়ে গাঁজাখুরি গল্প বেশি ফাঁদে৷ আমাদের মত মূর্খ প্রবাসী, গাঁজাখোর মুজাহিদ আর গাঁজাখুরি গল্পের আলেমগণ নিয়েই আমাদের ইসলামী সমাজ৷

এক ছেলে হজ্বে যাওয়ার পথে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে আকামা বাতিল করে দেয়৷ আকামা ঠিক করতে তার বিশ হাজার রিয়াল বাংলার প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ হয়৷ এর ফলে তার মনে যে প্রতিক্রিয়াগুলো সৃষ্টি হয়েছে- "হায় আল্লাহ! সৌদী কেমন ইসলামী দেশ?", "হজ্ব করতে যাওয়া কি অপরাধ নাকি?", "ইসলামের নামে সৌদীরা মানুষের উপর জুলুম করছে" ইত্যাদি, ইত্যাদি৷

তার মুখ থেকে ঘটনাটা শোনার উপর শ্রোতাদের মনেও ঠিক একই রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে৷ কেউ কেউ তীব্র ঘৃণায় ফেটে পড়বেন, কেউ কেউ সৌদী বাদশাহর ফাঁসির রায় দিয়ে দিবেন৷ যার অন্তর ঘৃণায় পূর্ণ, আল্লাহ না চাইলে আপনি, আমি সারা জীবন চেষ্টা করেও তার অন্তরে মহাব্বত সৃষ্টি করতে পারবো না৷ বিচারের যোগ্যতা থাক বা না থাক কিছু মানুষ সব কিছুতে বিচারক সেজে যায়৷ মানসিক প্রশান্তির জন্য আবেগী আর বিচারক এই দুই ধরনের লোককে এড়িয়ে চলাই উত্তম৷

সৌদীতে প্রবাসী শ্রমিকদের বলা হয় আজনবী৷ আজনবীদের ওমরাহ্ পালনে কোন বাধা না থাকলেও, সহজে হজ্ব করতে পারে না৷ কেন পারে না? সে ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে, আমাদের দেশের জনগণের অবস্থা বলি কিছু দিন পূর্বেও এখানকার বাঙ্গালীদের মুখে মুখে খবর রটে গেলো আজনবীদের ওমরাহ্ করতে সৌদী সরকার জনপ্রতি তিনশ রিয়াল করে ধার্য্য করেছে৷ পরবর্তীতে প্রমাণ হলো যে খবরটা সম্পূর্ণ ভূয়া৷

অনেকে এ রকম বিভিন্ন লেখায় মেনশন দিয়ে জানতে চায় এটা নিয়া আপনার মতামত কি? ওটা নিয়া আপনার মতামত কি? আসলে সৌদী সম্পর্কে আমাদের দেশে এত এত বেশি মিথ্যাচার আর গুজব রটেছে যে, কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা আমি সেটা নিয়েই কনফিউজড৷ এগুলো যদি সত্যও হয় প্রচার করলে কি পরিমাণ নেকী হাসিল হবে সেটা আমাদের আল্লামা, পীরে কামেল, বাতিলের আতংক, আওলাদে রাসূল, মুফতী ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষায়িত বুজুর্গগণ ভালো জানেন, কিন্তু মিথ্যা হলে যে গোনাহ হবে নিশ্চিত, এটা জানার জন্য আপনাকে ইসলামী স্কলার হতে হবে না৷ আর আপনি বার বার চিলের পেছনে দৌড়াবেন আর আমি আপনার পেছনে দৌড়াবো অত বেকার সময় নাই সেজন্য আমি দুঃখিত৷

যারা এসব সংবাদ তৈরি করে তাদের উদ্দেশ্য কি এবং কিভাবে এসব সংবাদ ছড়ায় সে সম্পর্কে আমি পূর্বের লেখাগুলোতে বলেছি৷ আপনার যদি এ ধরনের উদ্দেশ্য না থাকে, তাহলে আপনার উদ্দেশ্য কি? নেকী হাসিল? ইসলামের প্রচার এবং প্রসার? অথচ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক স্পষ্ট করে সংবাদ যাচাই না করে বিশ্বাস করতে নিষেধ করেছেন৷ রাসূল (সাঃ) যা শোনে তা বলতে নিষেধ করেছেন৷ আপনি আর আমিতো কোরআন -হাদীসই বুঝি না, অথচ বীর মুজাহিদ৷ এই লেখার শুরু থেকেই আমি বলে আসছি, যারা জানতে চায় শুধু তাদের জন্য, বদ হজমের রোগীদের জন্য না৷ ছেলেটার সমস্যা বলার আগে আজনবীদের হজ্ব করতে সমস্যা কোথায় সেটা বলি—

আজনবীদের হজ্ব করতে কয়েকটি নিয়ম মেনে চলতে হয়৷ প্রথমে, কফিলের অনুমতি নিতে হবে৷ যারা বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন তারা বুঝতে পারবেন, আপনাকে কোথাও যেতে হলে অবশ্যই আপনার কর্মরত প্রতিষ্ঠান থেকে মৌখিক বা লিখিত অনুমোদন নিতে হবে৷ ওমরাহ করতে একদিনের বেশি সময় লাগে না বলে, এটি নিয়ে কোন সমস্যা হয় না৷ কিন্তু হজ্ব করতে নূন্যতম পাঁচ থেকে সাত দিন লাগে৷ এ ধরনের দীর্ঘ মেয়াদী ছুটির ক্ষেত্রে লিখিত অনুমোদনই অগ্রাধিকার প্রাপ্য৷

দ্বিতীয়ত হজ্ব মিনিস্ট্রির অনুমোদন নিতে হয়৷ আপনি যদি বাংলাদেশের কোন সংরক্ষিত এলাকার ভিতরে প্রবেশ করতে চান যেমন ধরুন- সংসদ ভবন, ক্যান্টর্মেন্ট, বিমানবন্দর তাহলে আপনার অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদনপত্র লাগবে৷ যদি কোন কোম্পানীর মিলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে চান সেখানেও আপনার অনুমোদন লাগবে৷ আবাসিক এলাকার ফ্ল্যাটগুলোতে একই অবস্থা৷ এগুলো সাধারণত নিরাপত্তা বিধানের জন্যই করা হয়ে থাকে৷ হজ্বের সময় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারনে হজ্ব মিনিষ্ট্রির অনুমতি ছাড়া কোন আজনবী যেমন হজ্ব করতে পারে না, তেমন কফিলের সুপারিশ ছাড়া কোন আজনবীকে মক্কা প্রবেশও করতে দেওয়া হয় না৷ আপনার মা-বাবা আসলেও কফিল জিম্মাদার না হলে আপনি মক্কা যেতে পারবেন না৷

তৃতীয়ত, একলা বা কাফেলাবদ্ধ যে কোন উপায়ে ওমরাহ পালনের অনুমতি থাকলেও একলা হজ্ব পালনের অনুমতি নাই৷ আপনার যদি ইজতেমায় বা পিকনিকে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থাকে তাহলে আপনি সহজেই বিষয়টা বুঝতে পারবেন৷ কেউ আবার হজ্বের সাথে ইজতেমা, ইজতেমার সাথে পিকনিকের তুলনা করে প্যাঁচিয়ে ফেলবেন না৷ প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা সহজে বোঝার জন্য আমি ঊদাহরণটা এনেছি৷ ইজতেমায় বা পিকনিকে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন মুরুব্বী বা লিডার নির্ধারণ করা হয় যিনি অন্যদের সুবিধা-অসুবিধাগুলো দেখে থাকেন৷ হজ্ব কাফেলাতে এ ধরনের একজন মুয়াল্লিম বা গ্রুপ লিডার থাকেন৷ আমরা যদি সাধারণ একটা সভাতেও যোগ দেই প্রত্যেকে কিন্তু একটা নির্দিষ্ট গ্রুপের সাথে যাই, এতে সভার সুশৃঙ্খলতা বজায় থাকে৷ আর এটাতো মুসলমানদের মহা সম্মেলন এখানে যদি সবাই যার যেভাবে খুশি সেভাবে যেতে চায় তাহলে বিশাল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে৷

পূর্বেই বলেছি এখানে যারা আসে বেশিরভাগই নিরক্ষর৷ এদের মাঝে এমনও লোকও আছেন যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা জীবনেও ঢাকাতে আসেনি৷ এমনও লোকও আছে সৌদীতে যাদের প্রথম কর্ম দিবস৷ এমনও লোক আছেন বিশ বছর হয়ে গেছে এখনো আরবী বোঝেন না, বুঝলে বলতে পারেন না৷ এতসব ঝক্কি-ঝামেলা তারা বোঝেন না, বোঝলেও মোকাবেলা করতে চান না, আমি নিজেও এসব ঝামেলা মোকাবেলা করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত নয় বলে হজ্ব করা হয়ে উঠেনি৷ এক্ষেত্রে সৌদী আরবে আজনবীদের হজ্ব করতে দেয় না বলে খুব সহজে পাশ কাটিয়ে দেওয়া যায়৷ অনেকেই এই সহজ কাজটা করে থাকেন৷যে ছেলেটার কথা বলছিলাম, এসব নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করেই সে প্রথমে এক বার হজ্ব করেছিলো৷ নিয়ম না মানায় তার হজ্ব কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে আল্লাহ ভালো জানেন, তবে আমি একজন আলেমের কাছ থেকে শুনেছি হজ্বের সময় কর্তৃপক্ষের নির্দেশাবলীর প্রতি শ্রদ্ধা পালন করা উচিত৷ সাধারণত প্রথমবার হজ্ব করাই মুসলমানদের উপর ফরয৷

দ্বিতীয়বারও সে একই পন্থায় হজ্ব করতে গিয়েছিলো৷ হজ্বটা যদি ধর্মীয় কারনে হয়ে থাকে তাহলে আমরা ধর্মের কথায় আসি, এখানে তার চাচা আছেন আর হাদীসে চাচাকে পিতৃতুল্য বলা হয়েছে৷ তার চাচা তাকে যেতে নিষেধ করেছেন৷ তাকে ভিসা দিয়ে এখানে যিনি নিয়ে এসেছেন, তিনি নিষেধ করেছেন৷ আমি তাকে কিছু দিন পড়িয়েছিলাম সে হিসেবে আমি তার ওস্তাদও৷ আমি তাকে নিষেধ করেছি৷ আমাদের আরো যারা আছে তারা নিষেধ করেছে৷ সে আমাদের কারো কথাকে কোন পাত্তাই দিলো না৷ রাসূল (সাঃ) বলেছেন যে, "বড়দের সম্মান করে না, ছোটদের স্নেহ করে না সে আমার দলভূক্ত নয়৷"

আজনবীদের হজ্ব করার যে নিয়মাবলীর কথা বললাম, এগুলো অনেক পুরাতন৷ কোন ঝামেলা না হওয়ার কারনে সৌদীরা এসব দিকে তেমন নজর দেয়নি৷ যার কারনে তার প্রথমবার হজ্বে কোন সমস্যা হয়নি৷ দ্বিতীয়বার হজ্ব করার সময় লিবিয়া, মিশর, তিউনিসিয়া সহ মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশেই উত্তপ্ত পরিস্থিতি ছিলো৷ পরিস্থিতি যত উত্তপ্ত হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা তত জোরদার হয়৷ হজ্ব মিনিষ্ট্রি থেকে সেবার সব আজনবীর মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে দিয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিলো, কেউ যাতে প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র ছাড়া হজ্ব করতে না যায়৷ এবার কিন্তু কাউকে মেসেজও পাঠানো হয়নি, যারা বিনাঅনুমতিতে হজ্ব করতে গেছে কাউকে আটকও করা হয়নি৷

বিনাঅনুমতিতে হজ্ব করার জন্য অর্থদন্ড, কারাদন্ড (পরিমাণ মনে নেই) এবং সেই সাথে দশ বছর সৌদী প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা জারি করে আইন করা হয়েছে৷ তাকে কিন্তু কিছুই করা হয়নি শুধু তার আকামা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে৷ আকামা ছাড়া সে প্রায় চার-পাঁচ বছর কাজ করছে তাকে পুলিশ গ্রেফতারও করেনি৷ যে বিশ হাজার রিয়াল সে দিয়েছে সেটা ছিলো ঘুষ৷ সৌদী আরবে ঘুষখোর অফিসার দূর্লভ, যারা এই ঘুষখোরদের দালালী করে এরা বেশিরভাগ বাঙ্গালী, হিন্দি, পাকিস্তানী৷ বাদশাহ সালমান ক্ষমতায় আসার পর অবৈধ আজনবীদের দেশে যাওয়ার অথবা কাগজপত্র ঠিক করার সুযোগ দিয়েছিলো, সেই সুযোগে সে আকামা ঠিক করেছে৷

এইযে তার আইন অমান্য করার প্রবণতা, মুরুব্বীদের প্রতি অশ্রদ্ধা, আইন অমান্য করার অপরাধে তাকে যে কোন কঠোর সাজা দেওয়া হয় নাই, দেশে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া সত্ত্বেও সে যে সৌদীতে ছিলো এসব কিছু বাদ দিয়ে তার বিশ হাজার রিয়ালই তার কাছে বড় এবং এটা নিয়ে সে সারাদিন মাছির মত ফ্যানর ফ্যানর করে৷ পুরো শরীর ভালো থাকলেও মাছির নজর শরীরের ক্ষত অঙ্গে৷

এটা অবশ্য আমাদের জাতীয় রোগ৷ এইতো সেদিন বাচ্চাদের আন্দোলনের ভাষা নিয়ে দেখলাম কত ধার্মিক, নীতিবানদের মাতামাতি অথচ ৪৬ বছরে দেশে কত খারাপ কাজ হয়েছে সেগুলোতে ধার্মিকদের ধর্মে, নীতিবানদের নীতিতে আঘাত হানেনি৷ এখানকার জেলখানায় আমার সাথে কলকাতার এক ভদ্রলোকের পরিচয় হয়েছিলো৷ তিনি বিন লাদেন কোম্পানীতে কাজ করেন৷ মসজিদে নববীর দেখাশোনার দায়িত্ব বিন লাদেন কোম্পানীর হাতে৷

তার অপরাধ ছিলো, তিনি মসজিদে নববীতে একটা বাচ্চাকে সরিয়ে তার জায়গায় বসেছিলেন সেজন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে৷ গ্রামের একটা কমিউনিটি স্কুলে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ আমার হয়েছিলো৷ স্কুলটা মসজিদের পাশে৷ সামনের কাতারটা খালিই থাকত, তবু তাদের সামনে যাওয়ার অধিকার নেই৷ পেছনে বসলে বাচ্চারা সাধারণত গল্প গুজব করত, তখন এদের মসজিদে আসতে কে বলছে?

বাচ্চাদের মসজিদে না নিলে তারা মাঠে দৌড়াদৌড়ি করত, এতে আবার মুসল্লীদের নামাযের ব্যাঘাত হয়৷ নামাযের সময় পড়ালে আবার মাস্টারদের কি নামায, কালাম লাগে না? অর্থাৎ যে পদ্ধতিই অবলম্বন করি, একটা না একটা দোষ আবিষ্কার হয়ে যায়৷ এখানে কোন বাচ্চার সাথে আপনাকে কোন তর্ক বা নালিশ করতে গেলে, বাচ্চার যতই অপরাধ থাকুক পুলিশ বা সৌদীরা বলবে, "তুমি কি পাগল? বাচ্চার বয়স আর তোমার বয়স কি সমান? তোমার বয়স হলে সে ঠিক হয়ে যাবে৷" সামান্য মুলা চুরির অপরাধে আমরা যারা বাচ্চাদের পিঠিয়ে মেরে ফেলার পক্ষে তাদের কাছে এসব দৃষ্টিকটু লাগে৷

পুরো রমজান মাস এখানকার মাদ্রাসাগুলো বন্ধ থাকে৷ সে সময় তারা কিশোরদের জন্য বিভিন্ন সরকারী- বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে পার্ট টাইম জবের ব্যবস্থা করে৷ যে পোস্টে নিয়োগ পায় তাকে ঐ পোস্টের স্কেল অনুযায়ী বেতন প্রদান করা হয়৷ সৌদীদের জন্য সর্বনিম্নের কাজ হলো দারোয়ান৷ কেউ যদি দারোয়ানের চাকুরীও নেয় তাহলে তার বেতন পড়ে এখানকার আড়াই হাজার রিয়াল আমাদের দেশের প্রায় পঞ্চান্ন হাজার টাকা৷ তার কর্ম দিবস প্রথম রমজান থেকে সাতাইশ রমজান পর্যন্ত্য৷ ছয় ঘন্টা ডিউটি এর মাঝে চার দিন ছুটি৷ কাজের জন্যও তাদের কোন চাপ প্রয়োগ করা হয় না৷ কোম্পানীগুলোর পার্মানেন্ট লোক আছে৷ এদের কোম্পানীর প্রয়োজন নেই, অর্থনৈতিক হিসাবে এরা কোম্পানীর লস প্রজেক্ট৷ তবু তারা কেন এদের হাসি মুখে গ্রহণ করছে বোঝেন? এদের মাঝে তারা আগামী দিনের বীজ বুনছে৷

আমাদের দেশে অনেকে বলেন, সৌদীতে আন্দোলন করতে দেয় না, মিছিল করতে দেয় না৷ আন্দোলন কেন করবে? অন্নের প্রয়োজন, বস্ত্রের প্রয়োজন, বাসস্থানের প্রয়োজন, চিকিৎস্যার প্রয়োজন, চাকুরীর প্রয়োজন সরকারী অফিসে যোগাযোগ করলে পেয়ে যাচ্ছে৷ তাহলে কিসের জন্য তারা আন্দোলন করবে? ছোটবেলা থেকেই তাদের চাহিদাগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে৷ আর আমাদের কি দেওয়া হচ্ছে?

সেদিন একটা জরিপে দেখলাম, ২০১৮ সালে বই মেলায় বই বিক্রি হয়েছে ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকার আর নেশার পেছনে দৈনিক খরচ হচ্ছে সাড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা৷ হ্যাঁ, এ জিনিষটাই আমাদের জন্য সহজ লভ্য করে দেওয়া হয়েছে৷ বাংলাদেশের সামাজিক ব্যবস্থা ধ্বংসের প্রধান কারন এই নেশা৷

অনলাইনেতো অনেক বীর মুজাহিদ, বিপ্লবী, নেতা, পীরে, কামেলকে দেখলাম সৌদীর বিরূদ্ধে জিহাদের ডাক দিতে দিতে ফেনা তুলে ফেলছেন৷ সৌদীতে আসতে আপনার অনেক সময় লাগবে অথচ ঘরের পাশেই আপনার জিহাদের ক্ষেত্র পড়ে আছে৷ এগিয়ে যান না বাচ্চাদের জন্য সুন্দর একটা দেশ গড়ার জিহাদে৷ আদৌ কি আপনার এসবের প্রতি আগ্রহ আছে? নাকি সৌদীতে ইসলাম থাকলেই আপনাদের বেহেশত মিলে যাবে?

জাযিরাতুল আরবের কিছু দেশ এশিয়া অঞ্চলে, কিছু দেশ আফ্রিকা অঞ্চলে অবস্থিত৷ এদের আরবী উচ্চারণও ভিন্ন ভিন্ন৷ ভাষার ভিন্নতার মত রাজনৈতিক মতাদর্শও ভিন্ন৷ আরবের রাজনৈতিক মতাদর্শকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায় একটা রাজতান্ত্রিক শাসন, অন্যটা রাজনৈতিক দলের শাসন৷ রাজতান্ত্রিক শাসনটা বংশ পরম্পরায় চলে আসছে এবং এসব নিয়ে আমাদের দেশে বহু আলোচনা- সমালোচনা আছে৷ রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে তেমন একটা সমালোচনা হয় না বললেই চলে৷

আরবের রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে আমরা প্রধানত দুটি দলে বিভক্ত করতে পারি একটি বাথ পার্টি, অন্যটি মুসলিম ব্রাদারহুড বা ইখওয়ানুল মুসলিমীন৷

১৯৪৭ সালে মিশেল আফলাক (খৃষ্টান), সালাহউদ্দিন আল বিতার ও জাকি আল আরসুজি সিরিয়ায় এই দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে এর শাখা আরবের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে যায়৷ এই দল বাথিজমকে অনুসরণ করে যা আরব জাতীয়তাবাদ, প্যান আরবিজম, আরব সমাজবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরোধী উপাদান নিয়ে গঠিত। বাথিজম আরব বিশ্বকে একটি একক রাষ্ট্র হিসেবে একীভূত হওয়ার ডাক দেয়। এর নীতিবাক্য হল, “একতা, স্বাধীনতা, সমাজবাদ”। এর দ্বারা আরব ঐক্য এবং অনারব নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব থেকে স্বাধীন থাকা বোঝায়।

১৯২৮ সালে হাসান আল বান্না মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠা করেন৷ শুরুতে এরা শিক্ষা এবং চ্যারিটির কাজে মনোযোগী ছিলো, অনেকটা আমাদের দেশের তাবলীগের মত৷ ধীরে ধীরে এটি রাজনৈতিক দলরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে৷ এই দলটি বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে সবচেয়ে প্রভাবিত ও বৃহৎ ইসলামপন্থী আন্দোলন। দলটির নেতা-কর্মীদের দাবী অনুসারে তারা ইসলামের মৌলিক আদর্শকে সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে৷ এদের দৃষ্টিতে বাথ পার্টি সেক্যুলার পার্টি৷ আবার বাথ পার্টির দৃষ্টিতে ব্রাদারহুড একটি জঙ্গী (সন্ত্রাসী) সংগঠন৷

১৯১৮ সাল পর্যন্ত সিরিয়া উসমানীয় সম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিলো৷ ফয়সাল বিন হুসাইন আরব জাতীয়তাবদের ঢেউ তোলে স্বাধীন এবং বৃহত্তর সিরিয়া গঠনের সংগ্রাম শুরু করেন৷ ফয়সালের পিতা হুসাইন বিন আলী ১৯০৮ সাল থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত মক্কার আমির ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি নিজেকে মক্কার বাদশাহ ঘোষণা করেন৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহের সূচনা করেন। ১৯২৪ সালে উসমানীয় খিলাফত বিলুপ্ত হলে তিনি নিজেকে মুসলিমদের খলিফা ঘোষণা করেন। ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি হেজাজে শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯২৫ সালে তিনি আবদুল আজিজ ইবনে আবদুর রহমান সৌদের কাছে পরাজিত হন৷

বৃটিশদের সহযোগিতায় আরব বিদ্রোহীদের নিয়ে ফয়সাল বিন হুসাইন ১৯২০ সালে সিরিয়াতে হাশেমী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন৷ এই রাজতন্ত্রের মেয়াদ ছিলো মাত্র চার মাস৷ এরপর ফরাসিরা সিরিয়া দখল করে নেয়৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে উপনিবেশবাদের পতনের মাধ্যমে অন্যান্য অঞ্চলের মত এটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে৷ এরপর অভ্যুত্থান, পাল্টা-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাথ পার্টি ক্ষমতায় আসে৷ বাথ পার্টির অভ্যন্তরে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পিতা হাফেজ আল আসাদ ক্ষমতায় আসেন৷ হাফেজ আল আসাদ নিজেও বাথ পার্টির একজন নেতা ছিলেন৷

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উসমানীয় ইরাকের কিছু প্রদেশ বৃটেনের নিয়ন্ত্রণে আসে। বৃটিশ সম্রাজ্যের অধীনে ইরাকে বিদ্রোহ দেখা দিলে ইরাক শাসন করা কঠিন হয়ে উঠে। তাই বৃটিশপন্থি শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯২১ সালে ফয়সাল বিন হুসাইনকে ইরাকের রাজা ঘোষণা করা হয়৷ সিরিয়াতে ফয়সাল বিন হুসাইন ব্যর্থ হলেও ইরাক প্রায় ৩৭ বছর হাশেমি রাজতন্ত্রের অধীনে থাকে৷ ১৯৫৮ সালে ইরাকি জাতীয়তাবাদি অভ্যুত্থানে রাজতন্ত্র উৎখাত করে ব্রিগেডিয়ার আল কাসিম ক্ষমতা দখল করেন এবং ইরাককে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেন৷

১৯৬৩ সালে আল কাশিমকে বাথ পার্টির সদস্যরা খুন করে দেশের মূল ক্ষমতা হস্তগত করে। বাথপার্টির নেতা জেনারেল আহমেদ আল বকর দেশটির রাষ্ট্রপতি এবং সাদ্দাম হোসেন আবদুল মাজিদ আল তিকরিতি উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন৷ ১৯৭৯ সালে জেনারেল আহমদ আল বকরকে সরিয়ে সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতায় আসেন৷ শুরুর দিকে তিনি বেশ সুশাসকই ছিলেন। কিন্তু কুর্দিদের বিরুদ্ধে একের পর এক সামরিক অভিযান, গ্যাস হামলা, ইরান-ইরাক যুদ্ধ, উপসাগরীয় যুদ্ধ, একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম সবকিছু মিলিয়ে শেষের দিকে তিনি একা হয়ে পড়েন৷

১৯১১ সাল পর্যন্ত লিবিয়া উসমানীয় খেলাফতের অধীনে ছিল। এরপর ইতালির অধীন হয়৷ মুহাম্মদ ইদ্রিস আল-সেনুসিকে রাজা ঘোষণা করে ১৯৫১ সালের ২৪ শে ডিসেম্বর লিবিয়া স্বাধীনতা লাভ করে৷ ১৯৬৯ সালের পহেলা সেপ্টেম্বরে মুহাম্মদ ইদ্রিস আল সেনুসি চিকিৎস্যার জন্য তুরস্কে সফরে গেলে মাত্র ২৭ বছর বয়সী কর্ণেল মোয়াম্মার আল গাদ্দাফী তার অল্প কয়েকজন সামরিক অফিসারের সহায়তায় রাজধানী ত্রিপলীতে এক প্রতিরোধহীন এবং রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লিবিয়ার শাসন ক্ষমতা দখল করেন।

রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করলেও গাদ্দাফী কিন্তু কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা লিবিয়ায় বিকশিত হ’তে দেননি এবং সেখানে কোন বিরোধী দলের অস্তিত্বও রাখেননি। অনেকটা বাথ পার্টির অনুকরণে বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করে তিনি দেশ চালান। যেখানে গাদ্দাফী ও তার গুটিকয়েক পরিষদের কথাই চূড়ান্ত। বিভিন্ন আরব দেশকে একসঙ্গে জুড়ে ‘ফেডারেশন অব আরব রিপাবলিক’ গঠন করার চেষ্টাও করেন। কিন্তু আরব নেতাদের কোন্দল, পারস্পরিক প্রতিহিংসা তার সে চেষ্টা সফল হ’তে দেয়নি এতে আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে দূরত্ব তৈরি হয়৷

ফিলিস্তিন নিয়ে আমাদের ইতিহাস জ্ঞান গাজী সালাহউদ্দীন আইয়্যুবী (রহঃ) পর্যন্ত থমকে আছে৷ কিন্তু ইতিহাস বলে বায়তুল মোকাদ্দাস বা জেরুজালেম শহরটি কমপক্ষে দুইবার ধ্বংস হয়েছে, ২৩বার অবরোধ হয়েছে, ৫২বার আক্রমণ হয়েছে এবং ৪৪বার দখল এবং পুনর্দখল হয়েছে ১১৮৭ খৃষ্টাব্দে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ূবী এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ক্রুসেডারদের ৮৮ বছরের জবর দখলের হাত থেকে জেরুজালেম উদ্ধার করেন৷ উদ্ধারের মাত্র ৪২ বছরের মাথায় ১২২৯ সালে তারই অযোগ্য ভাতিজা আল কামিল জেরুজালেম ক্রুসেডারদের হাতে তুলে দেয়৷ ১২৪৪ সাল জেরুজালেম হাতছাড়া হবার পনের বছর পর, সুলতান আস সালিহ মাত্র এগার বছর বয়সী কিশোর সেনাপতি রোকনউদ্দীন বাইবার্সকে সাথে নিয়ে পূনরুদ্ধার করেন৷ এভাবে বিভিন্ন শাসকদের হাত ঘুরে অবশেষে উক্ত এলাকা উসমানীয় খেলাফতের অন্তর্ভূক্ত হয়৷

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় খেলাফত বৃটিশ সাম্রাজ্যের কাছে পরাজিত হলে ফিলিস্তিন বৃটিশদের আওতায় চলে যায়৷ বৃটিশ সরকার যে সময় ফিলিস্তিন দখল করে সে সময় ফিলিস্তিনে বসবাসকারী ইহুদিদের আনুমানিক সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র ১১ শতাংশ। মুসলমান, খৃষ্টান ও ইহুদী তিন ধর্মের লোকের জন্যই এটি পবিত্র ভূমি৷ এছাড়া এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা এই তিন মহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থানে রয়েছে ফিলিস্তিন৷ এসব গুরুত্বকে মাথায় রেখে উসমানীয় খেলাফতের সময় থেকেই ইহুদীরা ফিলিস্তিনের পতিত জলাশয় ও অনুর্বর ভূমি গণহারে কিনতে শুরু করেছিল৷ পরবর্তী বছরগুলোতে বৃটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদিদের অনেকে ফিলিস্তিনে আসতে শুরু করে এবং ১৯৩১ সাল নাগাদ ফিলিস্তিনে ইহুদি জনসংখ্যা বেড়ে প্রায় ১৭ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায় ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করে এবং তাদের মাসাধিক কাল গবেষণালব্ধ পরামর্শ অনুযায়ী ১৯৪৭ সালে ইহুদি অধ্যুষিত ‘ইসরাইল’ ও মুসলিম অধ্যুষিত ‘ফিলিস্তিন’ নামের দুটো পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব করা হয়৷ ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ সম্মেলনে ৩৩ বনাম ১৩ ভোট এর মাধ্যমে বিলটি পাস হয়। নবগঠিত আরবলীগ তথা আরব দেশগুলো বিলের বিপক্ষে ভোট দেয়। ১৯৪৮ সালের মে মাসে ব্রিটিশ ইসরাইল স্বাধীনতা ঘোষণা করে। স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই আমেরিকা ও ইরান ইসরাইলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দান করে। পরবর্তীতে অন্যান্য অনেক অমুসলিম দেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দান করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই খৃষ্টানদের সহযোগীতায় ইহুদীরা ফিলিস্তীনের মুসলমানদের উপর নিপীড়ন, নির্যাতন, উচ্ছেদ, খুন, জেল, জুলুম চালিয়ে আসছে৷ ইহুদীদের প্রতিরোধ করার জন্য ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে ১৯৫৯ সালে গঠিত হয় "ফাতাহ"৷ এটিও অনেকটা বাথ পন্থীদের মত সেক্যুলার দল৷ প্রাথমিকভাবে দলটি ইসরায়েলের অস্তিত্বের সম্পূর্ণ বিরোধী থাকলেও পরে আরাফাত ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেন। ফাতাহ এর বিতর্কিত রাজনৈতিক কর্মকান্ডের উপর অনাস্থা জ্ঞাপন করে সেখানে "হামাস" নামে আরেকটি দলের আবির্ভাব হয়৷ হামাস এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন শেখ আহমেদ ইয়াসিন, যিনি মূলত ছিলেন ইখওয়ানুল মুসলিমীনের ফিলিস্তিন শাখার নেতা৷ বর্তমানে ফিলিস্তিনের কিছু অংশ ফাতাহ এবং কিছু অংশ হামাসের নিয়ন্ত্রণে৷ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই দুই দলের মাঝে কখনো কখনো গোলাগুলিও হয়ে থাকে৷ একদিকে ইসরাঈলী আগ্রাসন, অন্যদিকে দুই দলের হামলা-পাল্টা হামলা এভাবেই চলছে ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলন৷

১৮৮২ সাল পর্যন্ত মিশর উসমানীয় খেলাফতের অংশ ছিল৷ ১৮৮২ সালে বৃটিশ সেনারা মিশর দখল করে। এরপর প্রায় ৪০ বছর মিশর বৃটিশ উপনিবেশ ছিল। ১৯২২ সালে দেশটি রাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে স্বাধীনতা অর্জন করলেও বৃটিশ সেনারা মিশরে থেকে যায়। ১৯৫২ সালে জামাল আব্দেল নাসের-এর নেতৃত্বে একদল সামরিক অফিসার রাজতন্ত্র উৎখাত করে এবং প্রজাতন্ত্র হিসেবে মিশর প্রতিষ্ঠা করে। এরপর এখানেও অভ্যুত্থান, পাল্টা-অভ্যুত্থান চলতে থাকে৷ প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পতনের পর ২০১২ সালে ব্রাদারহুডের নেতা মুহাম্মদ মুরসিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়৷ নির্বাচনের এক বছরের মাথায় সামরিক অভ্যত্থানের মাধ্যমে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যূত ও বন্দী করা হয়৷

আরবের বাথপার্টি এবং ব্রাদারহুড কর্মীদের মাঝে শুরু থেকেই বিভক্তি এবং মতবিরোধ চলে আসছে৷ আমাদের দেশের সমাজতন্ত্রবাদী, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, গণতন্ত্রকামী, খেলাফতকামী কর্মীদের মাঝে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বিভেদ থাকলেও সৌদী বিদ্বেষের ক্ষেত্রে এরা প্রায় সবাই ঐক্যবদ্ধ৷ এবং আরবের যত বিশৃঙ্খলা সব কিছুর জন্য এরা সৌদী আরবকে দোষারোপ করে খুব আত্মতৃপ্তি অনুভব করে৷

এধরনের লোকদের যদি প্রশ্ন করি, ইরাকের জনসংখ্যা কয়ভাগে বিভক্ত? সাদ্দাম হোসেন পরে ইরাকের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি কে ছিলেন? তিনি কোন ধর্মের? জাতিসংঘের শান্তি রক্ষী বাহিনী কিভাবে আরবে প্রবেশ করেছে? আরবে কতভাগ অমুসলিম বাস করে? ব্রাদারহুডের মুরসি শতকরা কত ভোট পেয়েছে? আল জাজিরা চ্যানেলে কত ভাগ মুসলিম সাংবাদিক আছে? ইত্যাদি

সেক্ষেত্রে দেখবেন পাশ কেটে যাবে বা প্রসঙ্গ বদল করে ব্যক্তিগত আক্রমনে লিপ্ত হবে৷ এর কারন হচ্ছে তারা মূলত বিষয়টা জানেই না, দলের কোন নেতা কর্মী সমর্থক থেকে শোনে হয়ত প্রচারে নেমে গেছে৷ অন্যের মুখ থেকে শোনে প্রচার করার সমস্যা হচ্ছে, নির্দিষ্ট গন্ডির বাইরে চিন্তা করার ক্ষমতা থাকে না৷

ইরাকের জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ লোক (শিয়া এবং কুর্দি) ছিলো সাদ্দাম বিরোধী৷ ইরাকে সাদ্দামের পরে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি উপ রাষ্ট্রপতি তারেক আজিজ ছিলো খৃষ্টান৷ এতে বোঝা যায় ইরাকে কিছু খৃষ্টানও আছে৷ যুদ্ধের সময় শিয়া এবং কুর্দিরা সাদ্দামকে কোন সহযোগিতা করেনি এটা আমি নিশ্চিত, কিন্তু তারেক আজিজ এবং সেখানকার খৃষ্টানদের ভূমিকা সম্পর্কে আমার জানা নেই৷ সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত দখলের মত হঠকারী সিদ্ধান্তের কারনেই মধ্যপ্রাচ্যে জাতিসংঘের মূলত আমেরিকার সৈন্য প্রবেশের সুযোগ পায়৷

আরবলীগের দেশগুলোতে শতকরা ১০ ভাগ খৃষ্টান এবং অন্যান্য ধর্মের লোক বাস করে৷ আর যে ৯০ ভাগ মুসলিম আছে তারা আবার শিয়া-সুন্নী দুই ভাগে বিভক্ত৷ আমাদের দেশের লালন ভক্ত মানবধর্মের অনুসারীরা সাধারণত মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ এসব ধর্মীয় ভেদাভেদ মানে না, একই রকমভাবে ব্রাদারহুডের অনুসারীরা আবার শিয়া-সুন্নী ভেদাভেদ মানে না৷ এখানে আপনাকে মনে রাখতে শিয়া-সুন্নী ব্যবধানটা ১৪০০ বছর আগে সাহাবীগণের আমলেই হয়ে গেছে এবং ব্রাদারহুডের সমর্থক ব্যতীত প্রায় সকল সুন্নী আলেমগণই শিয়াদের মুসলিম হিসেবে মানতে নারাজ৷ আরবে শিয়াদের শতকরা হার আমার জানা নেই৷ শিয়াদের শতকরা হার যদি ৩০ ভাগও হয়, তাহলে আরবে অমুসলিমের সংখ্যা প্রায় ৪০ ভাগ এর সাথে ইহুদীদের শতকরা হার যোগ করা হয় তাহলে মুসলিম-অমুসলিমের সংখ্যাটা প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ের দাঁড়ায়৷

আরবে যেসব সুন্নী মুসলিম আছে এরা আবার সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, খেলাফত বিভিন্ন মতবাদে বিভক্ত৷ সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়াতে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্রের নামে বাথপার্টি যেটা কায়েম হয়েছে সেটা হলো স্বৈরতন্ত্র৷ ব্রাদারহুডের কর্মীরা যেটির জন্য সংগ্রাম করছে সেটি হলো গণতন্ত্র৷ অধিকাংশ ব্রাদারহুড কর্মী শিয়া-সুন্নী বিভেদকে রাজনৈতিক বিরোধ মনে করে৷ আবার গণতন্ত্রকে ধর্মীয় দর্শন মনে করে৷ এদের যেকোন মতবাদের ধর্মীয় রূপ দাঁড় করাতে এরা সিদ্ধহস্ত৷

আরব বসন্তের বাহক হিসেবে ব্রাদারহুড খুব গর্ব করে৷ লিবিয়া, তিউনেশিয়া, সিরিয়ার মত দেশগুলোতে আরব বসন্ত বিশৃঙ্খলা আর সাধারণ মানুষের দুঃখ দূর্দশা ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসেনি৷ মিশর ব্যতীত আরবের আর কোন দেশে ব্রাদারহুড ক্ষমতায় যেতে পারেনি৷ মিশরে ব্রাদারহুড সমর্থক মুরসি প্রথম দফা ২৫% ভোট আর দ্বিতীয় দফা ৫১% ভোট পেয়েছিলেন৷ অর্থাৎ প্রথমদফা অনুযায়ী ৭৫% এবং দ্বিতীয় দফা অনুযায়ী ৪৯% লোক ব্রাদারহুড বিরোধী বা ব্রাদারহুডকে সমর্থন করে না৷ জনগণের সমর্থনের চেয়ে বড় কথা হলো আহমেদ নজীব থেকে শুরু করে সিসি পর্যন্ত মিশরে মোট ছয় জন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন এর মাঝে মুরসি ব্যতীত বাকি পাঁচ জনই সামরিক বাহিনীর৷ মিশর এখনো বেসামকরিক শাসনের উপযুক্ত হয়ে উঠেনি৷ পুরো আরবেই সাধারণত দু'টো তন্ত্র চলছে হয় রাজতন্ত্র, না হয় স্বৈরতন্ত্র৷

বাথপার্টি, ব্রাদারহুড, আলকায়দা প্রথম প্রথম সবগুলো দলের সাথেই সৌদী আরবের সুসম্পর্ক এবং পৃষ্ঠপোষকতা ছিলো৷ যখনই তাদের মতবাদ সৌদী রাজতন্ত্রের জন্য হুমকি স্বরূপ মনে হয়েছে তখনই সম্পর্কে ছেদ পড়েছে৷ বাহরাইন এবং ইয়ামেনে সৌদী আরবের যেভাবে সেনা প্রেরণ করেছে, আরবের অন্য দেশগুলোতে কিন্তু সৌদী আরব সেনা প্রেরণ করেনি৷ মিশরের সিসিকে সৌদী সরকারের সমর্থন, বাহরাইন, ইয়ামেনে সেনা প্রেরণ এসব নিয়ে আলোচনা করার আগে আমাদের অবশ্যই ধর্মীয় আক্বীদা, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক বিষয়গুলো দেখতে হবে৷

সৌদী আরব এবং মিশর এশিয়া এবং আফ্রিকার এ দু'টি পাশাপাশি রাষ্ট্র৷ সৌদীতে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, এ্যাকাউন্টেট, বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে মিশরীয়রা কর্মরত৷ স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎস্যার জন্য বেশিরভাগ সৌদীর প্রথম পছন্দ মিশর৷ সৌদী আরবের বেশিরভাগ কৃষিজাত পণ্য মিশর থেকে আমদানী করা৷ আরব উপসাগরের কিছু দ্বীপের মালিকানা নিয়েও তাদের মাঝে দ্বন্ধ আছে৷ বিভিন্ন কারনে সৌদীকে মিশরের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হচ্ছে৷ সম্পর্কটা রাখবে কার সাথে?

নওয়াজ শরীফ যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি সৌদীতে ওমরাহ করতে আসলে তাকে স্পেশাল নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিলো৷ পদ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর আবার যখন সৌদীতে আসলেন তখন তাকে কেউ জিজ্ঞেসও করেনি৷ রাজনীতি পরাজিত লোকের কোন কদর নেই৷ মুরসি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি এটা তার ব্যর্থতা, সিসি ক্ষমতায় টিকে আছে এটা তার সফলতা৷ যেকোন রাষ্ট্র থেকে কিছু আদায় করতে হলে তার সরকারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হয়৷ সিসির পরে যদি অন্য কেউও মিশরের ক্ষমতায় আসে সৌদী সরকার তাকেও সাধুবাদ জানাবে৷

গুজরাটের কসাইখ্যাত নরেন্দ্র মোদী যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছে তখন বাংলাদেশের অন্যান্য দলগুলোর পাশাপাশি ব্রাদারহুডের সমর্থক দাবীদার রাজনৈতিক দলটিও তাকেও অভিনন্দন জানিয়েছে৷ ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও অভিনন্দন জানিয়েছে৷ ব্রাদারহুড যখন ভিন্ন মতাদর্শের চিহ্নিত সন্ত্রাসীকে সমর্থন দেয় সেটা হয় রাজনৈতিক শিষ্টাচার, আর সৌদী আরব দিলে হয় দালালী৷

মিশরের মত ইয়ামেনও সৌদী আরবের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র৷ ইয়েমেনের পাশে দক্ষিণ পশ্চিমে আফ্রিাকার দেশগুলো অবস্থিত, যেগুলোতে সর্বদা গৃহযুদ্ধ লেগে আছে৷ সোমালিয়া ও ইথিওপিয়ার মত দেশগুলোতে অর্থের বিনিময় সহজে অস্ত্র কেনা যায়। দ্বিতীয় লোহিত সাগরের প্রবেশদ্বার, সৌদী আরবের বেশিরভাগ বিজনেস ঐ সাগরকে কেন্দ্র করে৷

বহুকাল ধরে উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেন বিভক্ত ছিল, তখন দু’টি দেশের মধ্যে সম্পর্ক ছিল কখনও সম্প্রীতির আবার কখনো বৈরিতার। ১৯৯০ সালের দিকে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি একীভূত হয়। জার্মানির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেই ১৯৯০ সালে উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেন একদেশে পরিণত হয় এবং ঐক্যবদ্ধ ইয়েমেনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। শুরু হয় নতুন ইয়েমেনের অগ্রযাত্রা। তবে সহিংস গৃহযুদ্ধে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছিলো৷ সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা ছিল সৌদি আরব সীমান্তবর্তী দেশটির উত্তরাঞ্চলে। শিয়া ধর্মাবলম্বী জাইদি সম্প্রদায়ের লোকজন ওই অঞ্চলে বসবাস করে। জাইদি সম্প্রদায় হুতি নামেও পরিচিত।

আরব বসন্তের প্রেক্ষিতে ইয়েমেনেও গণতন্ত্রের দাবি উঠেছিল। প্রচন্ড বিক্ষোভের মুখে স্বৈরাচারী শাসক প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ শাসনক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। আশা করা হয়েছিল তার পদত্যাগের পর দেশটিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হবে, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। দেশটির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় শিয়া হুতিদের হাতে৷ সৌদী আরব তার আশেপাশে শিয়াদের উত্থান কখনোই ভালোভাবে দেখে না এবং তাদের শাসন ব্যবস্থার জন্য হুমকি মনে করে, যার জন্য তারা বাহরাইনের মত ইয়ামেনেও সৈন্য প্রেরণ করে৷ ইয়ামেন- সৌদী যুদ্ধ বিরতির পরিকল্পনা নিয়ে আবদুল্লাহ সালেহ ইয়ামেন গেলে হুতি বিদ্রোহীরা তাকে হত্যা করে৷ (শিয়াদের উত্থান সুন্নীদের জন্য কি রকম ভয়ংকর পরিণতি নিয়ে আসতে পারে তা, এই সিরিজের পূর্বের লেখাতে উল্লেখ করেছিলাম৷)

ইয়ামেন, মিশরের লক্ষ লক্ষ লোক সৌদীতে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরী করছে এসব নিয়ে তাদের কোন সমস্যা হয় না, সমস্যা হচ্ছে আমাদের বাঙ্গালী মুজাহিদদের৷ বাংলার কমিউনিস্টদের নিয়ে প্রবাদ চালু আছে, "মস্কোয় বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা ধরে৷" একই ভাবে আরবে বসন্ত হলে বাংলার মুজাহিদদের ফুল ফোটে৷

যেকোন জিনিষের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ থাকে৷ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর সৌদী রাজতন্ত্রও শেষ হয়ে যাবে৷ কিন্তু এর আগে বাংলার যেসব মুজাহিদ সৌদী রাজতন্ত্র উচ্ছেদের যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন তারা আসলে এখানে কি ধরনের শাসন ব্যবস্থা চান? বাথ পার্টির সমাজতন্ত্র? ব্রাদারহুডের গনতন্ত্র? ইরানের বিপ্লব? সৌদী আরবে আল সৌদ পরিবারের বিকল্প কোন শাসক তাদের নজরে আছে কি?

মিশরে মুরসির বিকল্প সিসি থাকাতে সেখানে মোটামুটি একটা স্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে৷ ইরাকে সাদ্দামের বিকল্প কোন শাসক তৈরি হয়নি, লিবিয়াতে গাদ্দাফীর বিকল্প কেউ ছিলো না, সিরিয়াতে বাশারের বিকল্প কেউ নেই, ইয়ামেনে আবদুল্লাহ বিন সালেহর বিকল্প কেউ তৈরি হয়নি৷ যেসব দেশে বিকল্প শাসক তৈরি হয়নি সেসব দেশে এখনো অস্থিরতা বিরাজ করছে৷ বাংলার মুজাহিদরা কি সৌদী আরবকে এমন একটা অস্থিতিশীল দেশ হিসেবে দেখতে পছন্দ করবেন?

আল কায়দা ও ওসামা বিন লাদেন, রাজতন্ত্র এবং আল সৌদ পরিবারের বিকল্প হতে পারত৷ সেক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারে সৌদী সরকারতো তাকেও দমন করেছে৷ সৌদী সরকার যাকেই তাদের ক্ষমতার জন্য ক্ষতিকর মনে করেছে তাকেই দমন করেছে৷ যে কোন শাসক সাধারণত তাই করে৷ কিন্তু আরবের অন্য দেশ গুলোতে আল কায়দা আশ্রয় পায়নি কেন? সৌদীর সাথে বাথপার্টির সম্পর্ক ভালো না, ব্রাদারহুডের সম্পর্ক ভালো না, হিজবুল্লাহর সাথে সম্পর্ক ভালো না, হামাসের সাথে সম্পর্ক ভালো না, আইসিস এর সাথে সম্পর্ক ভালো না, কিন্তু আল আয়দা ছাড়া এরা সবাই আরবের বুকে রাজনীতি করছে৷

আরবের রাজনীতি যদি সৌদী সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকত তাহলে এরা কেউ রাজনীতি করতে পারত না৷ আরবের বিভিন্ন মতাবলম্বী দলগুলোর মাঝে কারা আসলে সত্যিকার অর্থে কোরআন এবং সুন্নাহর আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছে সেটি অত্যন্ত গভীরভাবে ভাবনার বিষয়, যে ক্ষমতা আমাদের নেই বললেই চলে৷ সেক্ষেত্রে হালকা মুখস্ত বুলি ছেড়ে দিলাম সৌদী আরব ইসলামকে ধ্বংস করে দিয়েছে, বিশ্বস্ততার জন্য আমেরিকা আর ইসরাঈলকে যোগ করে দিলাম, ব্যস হয়ে গেলাম আন্তর্জাতিক ইসলামী চিন্তাবিদ৷ ফেসবুকে এধরনের আন্তর্জাতিক ইসলামী চিন্তাবিদ লাখে লাখে৷

আবুধাবি, আজমান, দুবাই, আল ফুজাইরাহ, রাআস আল খাইমাহ, আশ শারিকাহ এবং উম্ম আল ক্বাইওয়াইন আরবের এই সাতটি দেশ বৃটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিলো৷ ১৯৭১ সালে দেশগুলো স্বাধীনতা লাভের পর আবুধাবির শাসক শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহইয়ানকে প্রেসিডেন্ট এবং দুবাইয়ের শাসক শেখ রশিদ আল মাখতুমকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে "সংযুক্ত আরব আমিরাত" নামে আত্মপ্রকাশ করে৷

শুরুতেই এই দুই শেখ বুঝতে পারেন, তেল এবং তেলের টাকা বেশিদিন থাকবে না, অতএব এ টাকা অপচয় করা চলবে না৷ এ টাকা এমনভাবে ব্যয় এবং বিনিয়োগ করতে হবে যাতে তেল ফুরিয়ে গেলেও আরব আমিরাতের অর্থনীতিতে কোন মন্দা প্রভাব না পড়ে৷ সেজন্য শুরুতেই তারা পর্যটিন শিল্পের দিকে গুরুত্ব দেন৷ পর্যটকদের আসা- যাওয়ার জন্য এমিরেটস, ইতিহাদের মত এয়ারলাইন্স গড়ে তুললেন৷ দুবাই বিমান বন্দর এখন আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের প্রধান জংশন৷ বুর্জ আল খলিফার মত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র, পার্ক, স্টেডিয়াম বিভিন্ন দিক দিয়ে আরব আমিরাত এখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে উন্নত৷

আরব দুনিয়ার সবচেয়ে ছোট দেশ কাতার৷ সৌদী আরবের পর উপসাগরীয় অঞ্চলে সবচেয়ে রক্ষণশীল সমাজ ছিলো কাতারে৷ ১৯৯৫ সালে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কাতারের আমির শেখ খলিফা বিন হামাদ আল-থানিকে অপসারণ করে তার জৈষ্ঠ্যপুত্র যুবরাজ হামাদ ক্ষমতা দখল করেন৷ ক্ষমতায় বসেই আমির হামাদ বিভিন্ন সংস্কার মূলক কাজ হাতে নেয়৷

আমির হামাদ নারীদের ভোটাধিকার দিয়েছেন, যা আরব বিশ্বে বিরল। তার দেশে আমেরিকান কলেজের ক্যাম্পাস খোলারও ব্যবস্থা করেছেন। এছাড়া আমেরিকান সেনাঘাঁটি স্থাপন, আলজাজিরা চ্যানেল, কাতার এয়ারওয়েজ, দোহা এয়ারপোর্ট, স্টেডিয়াম ইত্যাদি কাতারকে বিশ্ব দরবারে দিন দিন পরিচিত করে তুলছে৷ গ্যাস থেকে অর্জিত রাজস্ব এর অর্থনীতিকে ফুলিয়ে- ফাঁপিয়ে দিয়েছে৷ ফলে কাতার এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধনাঢ্য দেশগুলোর একটি।

আমিরাত এবং কাতারের তুলনায় আয়তনে বড়, শক্তিশালী এবং সম্ভাবনাময় হওয়া সত্ত্বেও সৌদী আরব এ দু'টো দেশ থেকে পিছিয়ে আছে৷ যদিও প্রত্যক্ষভাবে সৌদী আরবের সিংহাসনে কিং সালমান বসে আছেন, কিন্তু পরোক্ষভাবে তেত্রিশ বছর বয়ষ্ক তার পুত্র ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটি শাসন করেছেন৷ বিন সালমানের পূর্বে আল সৌদ পরিবারের আর কেউ এত কম বয়সে ক্রাউন প্রিন্সের মর্যাদা লাভ করেনি৷

সৌদী আরবকে একটি আধুনিক এবং উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে এই তরুণ বেশ কিছু সংস্কারমূলক কাজে হাত দিয়েছেন৷ এর মাঝে ৫% ভ্যাট, দ্রব্যমূল্য, পানি, বিদ্যুতে, আকামা ফি বৃদ্ধি, কিছু কিছু সরকারী ভাতা বন্ধ, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৩০% সৌদীকে বাধ্যতামূলক চাকুরী প্রদান, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আজনবী নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি৷ এই সংস্কারের কিছু প্রভাব সৌদীদের উপর পড়ছে আর শতভাগ প্রভাব পড়ছে আমাদের উপর৷ আমাদের উপর বলতে শুধু বাংলাদেশী না ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মিশর, তুরষ্ক সহ বিশ্বের যত দেশের আজনবী (প্রবাসী) সৌদীতে বাস করে সবার উপর৷

এই সংস্কারের ফলে অনেক আজনবীকে ব্যবসা, চাকুরী ছেড়ে দেশে চলে যেতে হচ্ছে৷ আবার অনেকে কাজ কর্ম না পেয়ে ভিক্ষুকের মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন, খোলা আকাশের নিচে ঘুমাচ্ছেন৷ এই বিষয়টাকে যদি আমরা প্রবাসী শ্রমিক এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি তাহলে বিষয়টা অমানবিক৷ কিন্তু সৌদী নাগরিকদের দৃষ্টিতে যাচাই করার আগে আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি একটু যাচাই করি-

বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে দশ থেকে পঁচিশ লক্ষ ভারতীয় লোক কাজ করে৷ এই ভারতীয়দের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান উভয় ধর্মের লোক আছে৷ এদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে যদি আমাদের দেশের যুবকদের নিয়োগ করা হয়, তাহলে আমাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? অন্যদের বিষয়টা আমার জানা নেই, তবে আমি বিষয়টাকে পুরোপুরি সমর্থন করবো৷ সৌদী নাগরিকরাও তাই করছে৷ এগুলো ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয় সমস্যা৷

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য নদীতে যখন সেতু নির্মাণ করা হয়, তখন খেয়া পাড়ের মাঝিরা বেকার হয়ে যায়৷ বাচ্চাদের উন্নত স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে আমরা যখন বিডি, প্রাণের মত কোম্পানীগুলার প্যাকেটজাত আচার, ঝালমুড়ি, বাদাম কিনছি তখন এসব বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা হকারেরা বেকার হচ্ছে৷ নির্মাণ শিল্পে উন্নতির জন্য আমরা যখন ক্রেনের মত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছি, তখন অনেক রাজমিস্ত্রী কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে৷ এগুলোর মানবিক দিক বিবেচনা করে আমরা কিন্তু অনুন্নত থাকছি না৷ বিন সালমানের সংস্কার কার্যক্রম প্রথম প্রথম সৌদীদের অসুবিধা সৃষ্টি করলেও এখন অনেকেই মেনে নিচ্ছে৷

যেহেতু সিরিজটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লেখা, তাই নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার কথা বলি, আমার এই সময় দেশে থাকার কথা৷ আজ এক মাস আমার ছুটির দরখাস্ত পড়ে আছে, কোম্পানীতে ছাঁটাই চলছে৷ আমি নিজেও জানি না, আমাকে ছাঁটাই করা হবে না ছুটি দেওয়া হবে৷ এখনো দেশে না আসাতে আমার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন এবং শুভাকাংখীরা উদ্বিগ্ন আছেন৷ এটা হলো আমার ব্যক্তিগত সমস্যা৷ ব্যক্তিগত সমস্যাকে আমি যদি একটু আবেগ মিশিয়ে প্রকাশ করি, তাহলে আমার শুভাকাংখী যারা আছেন, তারা শোনে সৌদী সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন৷

ব্যক্তিগত সমস্যাকে ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় রূপ দিয়ে অন্যদের সহানুভূতি আদায় করার প্রবণতা আমার মাঝে খুবই কম৷ আমি জানি, আজ অথবা কাল আমাকে এখান থেকে যেতেই হবে৷ ধান কাটার মৌসুমে আমাদের এলাকায় বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন এসে কাজ করে৷ মৌসুম শেষে তারা আবার চলে যায়৷ এখানে আমাদের মত প্রবাসী কামলারা এর চেয়ে বেশি কিছু না৷ একজন দায়িত্ববান রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব হলো তার দেশের জনগণের কল্যানের কথা চিন্তা করা৷ বিন সালমান আমার দেশের রাষ্ট্রপ্রধান না, আর আমিও সৌদীর নাগরিক না যে আমার কল্যানের কথা চিন্তা করবেন৷

আমার কল্যানের চিন্তা করার দায়িত্ব আমার এবং দেশের সরকারের৷ খেয়াপারের মাঝি যদি শুধু নৌকা চালানোর চিন্তা নিয়ে বসে থাকে তাহলেতো তাকে না খেয়েই মরতে হবে৷ জীবন এবং জীবিকার জন্য যে হাতে বৈঠা ধরেছিলো, সে হাতে তাকে কোদাল, কাস্তে তুলে নিতে হবে৷ অথবা অন্য কোন বিকল্প চিন্তা করতে হবে৷

বিন সালমানের সংস্কারমূলক কাজগুলোর মাঝে সামাজিক বনায়ন আছে, মিশর এবং পাকিস্তানের লোকেরা যা দেখাশোনা করে৷ দশটা গাছ লাগালে মাস শেষে তিনটা টিকে বাকি সাতটা মরে যায়৷ আমরা যদি এগুলো দেখাশোনার সুযোগ পেতাম তাহলে দশটার মাঝে আটটাই বাঁচত৷

চামড়া শিল্পে এদেশে একটা সম্ভাবনা আছে৷ প্রতি বছর শুধু মাত্র কোরবানীতে বিশ থেকে ত্রিশ লক্ষ পশু জবাই করা হয়৷ এদের চামড়াগুলো কি করা হয়, এ ব্যাপারে আমার সঠিক ধারণা নেই৷ আমরা যখন ছাগল জবাই করি, তখন চামড়া ডাস্টবিনে ফেলে দেই৷ এ চামড়া দিয়ে চামড়াজাত পণ্য তৈরি করা যেতে পারে৷ কোরবানী চামড়ার ক্ষেত্রে জায়েয, নাজায়েজের প্রশ্ন আসতে পারে, সেক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে ইসলাম অপচয়ও সমর্থন করে না৷ এ চামড়ার অর্থ তাদের যাকাত-ফিতরাহ ফান্ডে দান করা যেতে পারে৷ আমাদের রাষ্ট্রীয় উচ্চ পর্যায়ের আলেম এবং শিল্প প্রতিনিধিরা এ ব্যাপারে যোগাযোগ করতে পারেন৷

আধুনিক সৌদী গঠনের জন্য এখানে আবাসিক এলাকা, পর্যটন শিল্প, বাণিজ্যকেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল গড়ে উঠছে৷ সেগুলো পরিচালনার জন্য শিক্ষক, চিকিৎস্যক, প্রকৌশলীর মত গুরুত্বপূর্ণ পদে লোকের প্রয়োজন হবে৷ এক রিপোর্টে দেখলাম সৌদী যুবকদের প্রায় ১০% বেকার৷ এই বেকার যুবকসহ শতভাগ সৌদী কাজে যোগ দিলেও ভবিষ্যতে সৌদীতে প্রবাসী শ্রমিক প্রয়োজন হবে৷ সেই প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য আমাদের দেশে কি পরিমাণ দক্ষ জনশক্তি আছে, কূটনৈতিকভাবেই বা আমরা কতটুকু প্রস্তুত?

আমিরাতের জনসংখ্যার সাতাইশ ভাগ ভারতীয়, কাতার এবং মালেশিয়াতেও উচ্চ পর্যায়ের চাকুরীগুলো ভারতীয়দের দখলে৷ দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে কিভাবে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করা যায়; তারা যখন সেই চিন্তায় ব্যস্ত, আমরা তখন "প্রিয়াংকা চোপড়া বঙ্গভবনে আইলো না ক্যারে" এই চিন্তায় মগ্ন৷

আমাদের এই অমনোযোগীতার সুযোগ নিয়ে ভারত, চীন, জাপানের মত দেশগুলো যখন সৌদী আরবের উন্নতির অংশীদার হবে, আমরা তখনও সমালোচনা করে বলবো, "আমাদের সাথে না মিলে সৌদী আরব কাফেরদের সাথে মিলছে৷" যেদেশে ব্যবসায়ীরা ধর্ম শেখায়, ষাঁড়েরা শিক্ষা দেয়, ভাঁড়েরা দেশ চালায়, সেদেশের জনগণের কাছে সবকিছুই হায় হায়৷

শায়খ মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাবের পিতা তাঁর সংস্কার কার্যক্রমে বাধা প্রদান করেছিলেন৷ তাঁর ভাই সোলায়মান বিন আবদুল ওয়াহাব শায়খের সমালোচনা করে "আস্ সওয়ায়েকুল এলাহিয়াহ্ ফিরর্রদ্দে আলাল ওয়াহ্হাবিয়াহ্" নামক একটি বই লেখেন৷ উয়ায়নার আমীর ওসমান বিন হামদ বিন মোআম্মার যিনি শায়খের বন্ধু এবং আত্মীয় ছিলেন তিনি শায়খকে তার এলাকা থেকে বের করে দেন৷

আমাদের দেশে যারা শায়খের বিরোধীতা করেন, তারা সাধারণত শায়খকে খেলাফত ধ্বংসের জন্য দোষারোপ করেন৷ কেউ কেউ ঊনাকে বৃটিশদের দালালও বলে থাকেন, কেউ ঊনার বিরূদ্ধে ইসলাম ধ্বংসের অভিযোগও করে থাকেন, কেউ আবার ঊনাকে জঙ্গীবাদী (সন্ত্রাসবাদী) আখ্যা দিয়ে থাকেন৷ শায়খের বিরোধীতাকারীদের জবাব দেওয়ার আগে ওসমানী খেলাফতের সময় ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু আরবে কি হচ্ছিলো আমরা সেই চিত্রগুলো একটু দেখে নেই—

জাবিলায় ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদ যায়দ বিন খাত্তাব এর কবরে পূজা হচ্ছিল৷ গোবায়রা উপত্যকায় জেরার বিন আজদরের কবর বিদ'আতের প্রদর্শনীতে পর্যবসিত হয়েছিলো৷ বলিদাতুল ফিদা নামক স্থানে বান্ধ্যা নারীরা সন্তান লাভের আশায় একটি প্রাচীন বৃক্ষের সাথে আলিঙ্গন করত৷ দরঈয়াতে কোন কোন সাহাবার কবর জাহেলী আকীদাসমূহের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়েছিলো৷ দরঈয়ার নিকটবর্তী একস্থানে একটি গুহায় লজ্জাকর ব্যভিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো৷ এক কথায় বলতে গেলে আরবের অনেকেই নৈতিক সীমা অতিক্রম করে জাহেলিয়াতের যুগে ফিরে যাচ্ছিলো৷ পরিতাপের বিষয় এই যে, সব কিছুই ইসলামের নামে হচ্ছিলো৷

শতাব্দীব্যাপী শিরক ও বিদআ'তে লিপ্ত থাকায় শিরকী আকীদাসমূহ তাদের অন্তরে এরূপ বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিলো যে, তাদের বিরাট একটা অংশ এসব অনাচারকেই আসল দ্বীন বা প্রকৃত ইসলাম বলে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছিলো৷ পক্ষান্তরে যে কতিপয় আলেম ফীকহ এবং হাদীস সম্পর্কে অবগত ছিলেন, তারা সত্য প্রচারের শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন৷ মোহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব যখন এসব অনাচারের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন তখন অনেকেই তাঁর শত্রু হয়ে যায়৷ তাঁর আত্মীয় এবং আপনজনেরা তাকে বিপদে নিক্ষেপ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়৷

আবদুল ওয়াহাব ছিলেন সেই সময়ের একজন বিখ্যাত আলেম, তিনি হুরায়মালার কাজী পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি শায়খের ওস্তাদও৷ তবে সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো তিনি শায়খের পিতা৷ সন্তান যত বড়ই হোক সব পিতাই সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে৷ শায়খের পিতাও এই মানবিক গুণের উর্ধ্বে ছিলেন না৷ শায়খের জীবনের কথা চিন্তা করে তাঁর পিতা আতংকিত হলেন৷ পিতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শণপূর্বক শায়খ দাওয়াতের গতি কিছুটা মন্থর করেন কিন্তু পশ্চাদপসরণ করলেন না৷ পিতার মৃত্যুর পর তিনি অবিরাম গতিতে দাওয়াতের কাজ শুরু করেন৷

শায়খের পিতার মৃত্যুর পর তাঁর ভাই সোলায়মান বিন আবদুল ওয়াহাব হুরায়মালার কাজী হন৷ প্রথম দিকে তিনিও শায়খের বিরোধীতা করেন এবং তাঁর সংস্কার কার্যক্রমের সমালোচনা করে পুস্তক প্রণয়ন করেন৷ সোলায়মানের বিরোধীতা তীব্র আকার ধারণ করলে শায়খ বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের সমবেত করে তাঁর সংস্কার কার্যক্রম সম্পর্কে খোলাখুলি আলোচনা শুরু করেন৷ জ্ঞান পিপাসু ছাত্ররা দলে দলে শায়খের নিকট আসতে শুরু করে৷ এসব যুবকেরা স্বপ্রণোদিত হয়ে শায়খের বিভিন্ন উপদেশমূলক বক্তব্য, আন্দোলনের উদ্দেশ্য বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দিতে শুরু করে৷ সোলায়মান বিন আবদুল ওয়াহাব তাঁর ভুল বুঝতে পেরে স্বীয় ভ্রাতার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন৷

দাওয়াতের প্রাথমিক স্তর অতিক্রম করার পর শায়খ অনুভব করলেন, মুসলিম জাহানের প্রত্যেক প্রান্তে ভিন্ন ভিন্ন শাসনকর্তা থাকায় আন্দোলনে সাফল্য লাভ কঠিন হবে৷ অবস্থা এমন ছিলো যে হুরায়মালার মত ছোট্ট একটি ভূখন্ডের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য দু'টি গোত্র পরষ্পর দ্বন্ধে লিপ্ত ছিলো৷ তিনি অনুভব করলেন কোন শাসনকর্তার সহযোগিতা না পেলে আন্দোলন সর্বত্র দ্রুত সম্প্রসারিত করা সম্ভব হবে না৷ এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি উয়ায়নার শাসনকর্তা আমীর ওসমান বিন হামদ্ বিন মোআম্মাররে সাথে পত্র বিনিময় করলেন, এবং আমীরকে সত্য গ্রহণে সম্মত দেখে উয়ায়নায় হিজরত করলেন৷ সেখানে তিনি জওহরা বিনতে আবদুল্লাহ বিন মোআম্মারের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন৷

উয়ায়নানাতে শায়খের আন্দোলন ও সংস্কার প্রচেষ্টা যখন সাফল্য ও পূর্ণতা লাভের পথে অগ্রসর হচ্ছিলো এমন সময় সেখানে একটি ঘটনা ঘটলো৷ জনৈকা বিবাহিত নারী ব্যভিচারে লিপ্ত হলে শায়খ প্রস্তারাঘাতে তার মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করেন৷ এই ঘটনায় দূর্বল চিত্তের মুসলমান বিশেষ করে যারা ব্যভিচারে অভ্যস্ত তাদের মধ্যে দারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়৷ তাদের একদল এহ্ছা ও কোতায়ফের শাসনকর্তা সোলায়মান বিন মোহাম্মদ আজিজুল হুমায়দীর নিকট গমন করে তাকে শায়খের বিরূদ্ধাচরণে প্রস্তুত করে৷ এ লোকটি উচ্ছৃঙ্খল এবং লম্পট প্রকৃতির ছিলো৷

তার আশংকা ছিলো মোহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব তার রাজ্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারেন৷ ফলে সে উত্তেজিত হয়ে শায়খকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়ে আমীর ওসমানের নিকট পত্র লিখলো৷ আমীর ওসমান সোলায়মান হুমায়দীর নিকট হতে মোটা অংকের বাৎসরিক সাহায্য পেত৷ ফলে ওসমানের উপর এর দারুণ প্রভাব পড়লো৷ সে শায়খকে উয়ায়নানা থেকে চলে যেতে বললো৷

উয়ায়নানা হতে শায়খ দরঈয়ায় হিজরত করেন৷ দরঈয়ার আমীর মোহাম্মদ বিন সউদ অতি চরিত্রবান বলে বিখ্যাত ছিলেন৷ তাঁর স্ত্রী মোজা বিনতে আবু দাহতান অতি বিদুষী এবং ধর্মপরায়না ছিলেন৷ তিনি স্বামী আমীর মোহাম্মদ বিন সউদকে পরামর্শ দিয়ে বললেন, "আল্লাহ আপনার নিকট নেয়ামত হিসেবে শায়খকে প্রেরণ করেছেন৷ তাঁকে সাহায্য সহায়তায় করুন, ইনশাআল্লাহ আপনার ইহকাল ও পরকাল কল্যাণকর হবে৷"

স্ত্রীর কথাগুলো তাঁর অন্তরে দাগ কাটলো৷ তিনি শায়খের সাথে দেখা করলেন৷ মুসলমানদের মাঝে প্রচলিত শিরক, বিদআ'ত, অনাচার এবং এসব প্রতিরোধে করনীয় বিষয় নিয়ে শায়খ তাকে নাতিদীর্ঘ উপদেশ প্রদান করেন৷ শায়খের তেজোদৃপ্ত ভাষনে অভিভূত হয়ে আমীর তখনই বললেন, "হে শায়খ! আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের মনোনীত সঠিক দ্বীনের পথে আমি আপনার অনুসরণ করবো৷ এমনকি তাওহীদের বিরোধীদের সাথে জিহাদ করতেও আমি প্রস্তুত৷ তবে আমার দু'টি শর্ত আছে:—

১. আমরা যদি আপনাকে সহায়তা করি এবং আল্লাহ যদি আমাদের বিজয়ী করেন, তাহলে আপনি আমাদের পরিত্যাগ করবেন না৷

২. ফসল তোলার সময় দরঈয়াবাসীর নিকট হতে আমি নির্দিষ্ট পরিমাণ কর আদায় করে থাকি, আপনি তাতে বাধা দিবেন না৷"

জবাবে শায়খ বললেন, "আপনার প্রথম শর্ত সর্বান্তঃকরনে গ্রহণ করছি৷ আমাদের ভালো-মন্দ ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকলো৷ আর দ্বিতীয় শর্ত সম্পর্কে বক্তব্য এই যে, আল্লাহ বিজয়ী করলে গণীমতের এত সম্পদ হস্তগত হবে যে, ইনশাআল্লাহ সামান্য কর গ্রহণের ধারণাও আপনার মনে জাগবে না৷"

শায়খ যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন মোহাম্মদ বিন সৌদ গণীমতের মালের এক পঞ্চমাংশ ও যাকাতের সমস্ত অর্থ শায়খের নিকট প্রদান করতেন এবং শায়খ তা আল্লাহর পথে নিঃসঙ্কোচে ব্যয় করতেন৷ মোহাম্মদ বিন সউদের ইন্তেকালের পর তাঁর স্থলাভিষক্ত আমীর আবদুল আজীজ বিন মুহাম্মদ বিন সউদ শায়খের অনুমতি ছাড়া কোনরূপ ব্যয় করা জায়েয মনে করতেন না৷

ঐতিহাসিক ইবনে বিশর বলেন, "গণীমত এবং যাকাতের যে অর্থ পেতেন শায়খ তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে দিতেন৷ ফলে শায়খ সর্বদা ঋণী থাকতেন৷ রিয়াদ বিজয়ের সময় শায়খের ঋণের পরিমাণ ছিল চল্লিশ হাজার যা পরে গণিমতের মাল থেকে পরিশোধ করা হয়৷" রিয়াদ বিজয়ের পর যখন আন্দোলনের সাফল্য সম্পর্কে শায়খ আশ্বস্ত হলেন, তখনই তিনি আবদুল আজীজ বিন মুহাম্মদ বিন সউদকে সর্ব বিষয়ে দায়িত্ব প্রদান করে নিজে বায়তুল মালের দায়িত্ব হতে সম্পূর্ণরূপে অব্যাহতি লাভ করলেন৷

এভাবে একজন আলেম, একজন আল্লাহভীরু শাসক এবং একজন ধর্মপরায়না নারী এই ত্রয়ীর নেক নিয়্যতের সমন্বয়ে দরঈয়া আমিরাত (বর্তমান সৌদী আরব) নামক রাষ্ট্রটির বীজ বপিত হয়৷ [বিস্তারিতঃ শায়খ মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব, মূল লেখকঃ আল্লামা মাসউদ আলম নদভী, অনুবাদঃ মুনতাসীর আহমদ রহমানী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, ৯০, হাজী আবদুল্লাহ সরকার লেন, বংশাল, ঢাকা]

অনেকেই বৃটিশ সম্রাজ্যের উত্থানের জন্য সৌদীকে দায়ী করে, আবার কেউ কেউ মধ্যপ্রাচ্যে সৌদী তার সম্রাজ্যবাদ বিস্তার করছে বলে অভিযোগ করে থাকেন৷ আমরা যদি গ্রীক, রোমান, মিশরীয় সভ্যতা থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত্য পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যাবে যে, পৃথিবী কখনো সম্রাজ্যবাদ মুক্ত ছিলো না৷ প্রতিটি রাষ্ট্র কোন না কোন সম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে৷ এক সম্রাজ্যের পতন হচ্ছে তো, আরেক সম্রাজ্যের উত্থান হচ্ছে৷ "সম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক" জাতীয় স্লোগান কিছু লোকের উর্বর মস্তিষ্কের কাল্পনিক ফসল৷

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্নভাবে সম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞা দিয়ে থাকেন৷ আমরা সাধারণভাবে সম্রাজ্যবাদ বলতে বুঝি, রাজ্য বিস্তার বা অন্য রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করা৷ সম্রাজ্যবাদ জায়েজ কি নাজায়েজ এই বিতর্কে যাওয়ার আগে আমাদের মনে রাখতে হবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামের বাণী পৌঁছে দিতে মুসলিম সম্রাটগণ অস্ত্র দিয়ে পথ পরিষ্কার করেছেন, আলেমগণ জ্ঞানের আলো দিয়ে মানুষকে পথ দেখিয়েছেন৷ তাই মুসলিম রাজা, বাদশাহ, সম্রাটদের অবদানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই৷ এক সময় পৃথিবীজুড়ে মুসলিম সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিলো, গত শতাব্দী ছিলো বৃটিশদের, বর্তমান সময় আমেরিকার এর পর কার উত্থান হয় সেটা দেখার বিষয়৷

যারা বৃটিশ সম্রাজ্যের উত্থানের জন্য আল সৌদ পরিবারকে দায়ী করেন, তাদেরকে যদি প্রশ্ন করি আল সৌদ পরিবার মোট কত বার ক্ষমতায় এসেছে? সেক্ষেত্রে অনেকেই ভুল উত্তর দিয়ে থাকেন৷ আল সৌদ পরিবার মোট তিন তিনবার সৌদী আরবের ক্ষমতায় এসেছে৷

মোহাম্মদ বিন সৌদের প্রতিষ্ঠিত প্রথম রাষ্ট্রটির নাম ছিলো, "দরঈয়া আমিরাত"৷ এর স্থাযিত্ব ছিলো ১৭৪৪-১৮১৮ সাল পর্যন্ত৷ মিশরের উসমানীয় শাসক মুহাম্মদ আলি পাশার আক্রমনে প্রথম সৌদি রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যায়। দ্বিতীয় সৌদী রাষ্ট্রের নাম ছিলো "নজদ আমিরাত"৷ ১৮২৪ সালে তুর্কি বিন আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন সৌদ মিশরীয়দের কাছ থেকে নজদ (রিয়াদ) পুনরায় দখল করে নেন। ১৮৯০ সালে রশিদিরা রিয়াদ দখল করে নেয় এবং আল সৌদের সদস্যদের পরাজিত করে। রশিদিরা ছিল আরব উপদ্বীপের জাবাল শামার আমিরাত নামক রাষ্ট্রের শাসনকারী রাজবংশ। রিয়াদের উত্তরের হাইল শহর ছিল আল রশিদিদের রাজধানী৷

তৃতীয় রাষ্ট্রটি হলো বর্তমান "সৌদী আরব"৷ ১৯০২ থেকে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে আরব উপদ্বীপের অধিকাংশ অঞ্চলের বিভিন্ন গোত্র, শেখ শাসনাধীন এলাকা ও রাজ্য জয় করে একত্রীকরণ সম্পন্ন করার মাধ্যমে আধুনিক সৌদি আরব জন্মলাভ করে। এতে নেতৃত্ব দেন আবদুল আজিজ বিন আবদুর রহমান বিন ফয়সাল বিন তুর্কি বিন আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন সৌদ৷

আবদুল আজিজ বিন আবদুর রহমান যখন আরব উপদ্বীপের ছোট ছোট গোত্র এবং রাজ্যগুলো একত্র করছিলেন তখন খেলাফতের অবস্থা ছিলো অত্যন্ত নাজুক৷ খেলাফতের অধীনে থাকা আরব উপদ্বীপের রাজ্যগুলো বৃটিশ, ফরাসীদের দখলে চলে যাচ্ছিলো, আবার কেউ কেউ নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করছিলো৷ খেলাফতের অধীনে হুসাইন বিন আলি ছিলেন মক্কার আমীর৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি উসমানীয় খেলাফতের বিরূদ্ধে আরব বিদ্রোহের সূচনা করেন এবং নিজেকে মক্কার বাদশাহ ঘোষণা করেন৷

তুরষ্কের খেলাফত বিলুপ্ত হলে হুসাইন বিন আলি নিজেকে "খলিফাতুল মুসলিমীন" (মুসলমানদের খলিফা) ঘোষণা করেন৷ ১৯২৫ সালে এই স্বঘোষিত খলিফাকে পরাজিত করে আবদুল আজিজ বিন আবদুর রহমান হেজাযের ক্ষমতায় আসেন৷ বৃটিশদের সহযোগিতায় হুসাইন বিন আলির ছেলে ফয়সাল বিন হুসাইন প্রথমে সিরিয়া এবং পরে ইরাকে হাশেমী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন৷

প্রথম এবং দ্বিতীয় সৌদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের দিকে আমরা লক্ষ্য করলে দেখবো তখনো মধ্যপ্রাচ্যে বৃটিশদের উত্থান অত প্রবল হয়নি৷ তৃতীয় সৌদী রাষ্ট্রের সময় আরবের রাষ্ট্রগুলো ছিলো এলোমেলো যে যেভাবে পেরেছে দখল করেছে (সিরিজের ১৬ তম পর্বে এ ব্যাপারে সামান্য বলেছি)৷ আবদুল আজিজ বিন আবদুর রহমান কিন্তু খেলাফত থেকে হেজাযের ক্ষমতা দখল করেনি৷ হাশেমী রাজতন্ত্রের ফয়সাল বিন হুসাইনের মত আল সৌদ পরিবারের কেউ বৃটিশদের সহযোগিতায় রাজা হয়নি৷ তাহলে বৃটিশদের নামটা কিভাবে এলো?

১৯১৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর আবদুল আজিজ ও বৃটিশ সরকারের মধ্যে পারস্য উপসাগরের দারিন দ্বীপে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, একে "দারিন চুক্তি" বলা হয়৷ ১৯২৭ সালের ২০ মে স্বাক্ষরিত জেদ্দার চুক্তি দারিনের চুক্তির স্থলাভিষিক্ত হয়। এতে তৎকালীন নজদ ও হেজাজ রাজতন্ত্র বলে পরিচিত সমগ্র অঞ্চলে আবদুল আজিজের সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়। এর বিনিময়ে আবদুল আজিজের সেনাবাহিনী প্রতিবেশী বৃটিশ আশ্রিত রাষ্ট্রসমূহে আক্রমণ করবে না বলে সম্মতি প্রদান করা হয়৷ ইতিহাসে এধরনের রাজনৈতিক সমঝোতার উদাহরণ ভুরি ভুরি পাওয়া যাবে৷

আমি কোন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী না, আমার দৃষ্টিতে যে কোন সরকার তিনটি সু সম্পর্কের উপর টিকে থাকে, ১.জনগণ, ২. প্রশাসন, ৩. আন্তর্জাতিক অঙ্গন৷ নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মরার উপক্রম না হওয়া পর্যন্ত জনগণ সরকারের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ করে না, তাই সরকারের উত্থান-পতনে জনগণের ভূমিকা গৌণ৷ প্রশাসন যতক্ষণ নিয়ন্ত্রণে আছে ততক্ষণ জনগণ সরকারের কিছুই করতে পারবে না৷ জনগণ এবং প্রশাসন শতভাগ সরকারের পক্ষে থাকলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বন্ধু রাষ্ট্র না থাকলে সরকারের পতন অনিবার্য৷

বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ফেঁসে গেছে৷ আমরা যদি আমাদের সমাজ ব্যবস্থাটা দেখি, একজন মুয়াজ্জিনকে তার সামাজিক অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিতে হয় অসামাজিক মাতাল মেম্বারকে৷ একজন ইমামের চারিত্রিক সনদপত্র আনতে হয় চরিত্রহীন চেয়ারম্যান থেকে৷ একজন মুফতির শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র সত্যায়িত করতে হয় ঘুষখোরের কাছে৷ বিশ্বজুড়ে এখন এই রাজনীতি চলছে৷ সমাজে খারাপ চরিত্রের মোড়ল শ্রেণীর অনেক লোক আছে আত্মরক্ষার্থে যাদের সাথে আমরা সুসম্পর্ক রাখি, এর মানে এই নয় যে তারা আমাদের বন্ধু৷ আমরা অপেক্ষা করছি সুসময়ের৷

মুসলিম বিশ্বের এই দূর্দিনে যারা অসৎ উদ্দেশ্য সৌদী বিরোধী প্রচারণায় লিপ্ত আছে, তাদের কিছু বলার নেই৷ কিন্তু যাদের উদ্দেশ্য সৎ তাদের মনে রাখতে হবে, গত একশ বছরে মাত্র দু'টি রাষ্ট্র সিংহভাগ কোরআন এবং সুন্নাহ অনুসারে পরিচালিত হয়েছে একটি আল সৌদ পরিবার শাসিত সৌদী আরব, অন্যটি তালেবান শাসিত আফগানিস্তান৷ আফগানিস্তান আন্তর্জাতিক অঙ্গনের রাজনীতির সাথে খাপ খাইয়ে মিশতে পারেনি, এছাড়া তালেবানদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারনে শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেনি৷

যারা আল সৌদ পরিবারের বংশানুক্রমে শাসনকে বাঁকা চোখে দেখেন, সেসব ভাইরা একটু ইতিহাসে চোখ বুলিয়ে দেখবেন ইসলামের পূর্ব থেকে পৃথিবীতে বংশানুক্রমে শাসন ব্যবস্থা চলে আসছে৷ খোলাফায়ে রাশেদীনের পর থেকে বংশানুক্রমেই খেলাফত ব্যবস্থা চলে আসছে৷ নবুওয়তের যে ধারা তাও বংশানুক্রমে৷ হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর পর পৃথিবীর যত নবী এসেছেন সবাই ছিলেন ঊনার বংশধর৷ কেউ ভাববেন না আমি নবুওয়ত এবং রাজনীতি এক করে দেখছি, আমি শুধু বংশগত গুণাবলীর ধারা বোঝাতে চেয়েছি৷ সাহাবীর ঘরে সাহাবীই হয়েছে, আলেমের ঘরে আলেম হয়, কেনানের মত দূর্ভাগা খুব কমই হয়৷ উত্তরাধিকার সূত্রে শাসক হওয়াকে ঘৃণার চোখে দেখা আমরা কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি কে আল্লাহর ওয়াস্তে বিলিয়ে দেই না, বরং সেগুলো কিভাবে দ্বীগুণ করা যায় সে চিন্তায় মশগুল থাকি৷

পাঠকদের এখানে আরেকটু লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন খেলাফতের শাসনামলে স্পেন, বাগদাদ, কায়রোতে যেভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে হেজাযে কিন্তু উল্লেখ করার মত কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি৷ আমি খেলাফতের শাসকদের দোষারোপ করছি না৷ বর্তমান সময়ে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছাত্রদের মদীনায় আগমন, "সাপ যেভাবে গর্তে ফিরে আসে, ইসলাম সেভাবে মদীনায় ফিরে আসবে" রাসূল (সাঃ) এর বাণীকে ইঙ্গিত করছে কি না সে বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে বলছি৷

আল সৌদ পরিবারের বাদশাহগণ নিজেদের খলিফা নয় খাদেম হিসেবে পরিচয় দেন৷ সৌদী রাজার উপাধী "খাদেমুল হারামাইন" অর্থাৎ দুই হারাম শরীফের (মক্কা-মদীনা) খাদেম৷ আধ্যাত্মিক ভাবে মক্কা এবং মদীনা রক্ষার দায়িত্ব আল্লাহ পাক নিজ দায়িত্বে নিয়েছেন এবং এটা নিয়ে আমাদের চিন্তিত হওয়ার কোন কারন নেই৷ তিনি যাকে পছন্দ করবেন তার হাতেই এর সেবা করার দায়িত্ব দিবেন৷ বাহ্যিকভাবে আমরা যদি ভাবি, বর্তমানে আল সৌদ পরিবারের বাইরে এমন কোন শাসক বা ব্যক্তি আছে কি যার হাতে আমরা মক্কা-মদীনার দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিত হতে পারি?

আমাদের দেশের অনেক বক্তা ওয়াজ মাহফিলের মাঠে শায়খ মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব (রহঃ) এবং মোহাম্মদ বিন সৌদ সম্পর্কে প্রচুর অপপ্রচার করে থাকেন এদের মাঝে একদল হলেন সোলায়মান বিন আবদুল ওয়াহাবের মত, যারা শায়খের আন্দোলন সম্পর্কে স্পষ্ট জানেন না৷ আরেক শ্রেণী হলো সোলায়মান বিন মোহাম্মদ আজিজুল হুমায়দীর মত জাহেল, যারা সাধারণ মানুষের অবচেতন মনে সুক্ষ্মভাবে সৌদী বিদ্বেষী বীজ বপন করে চলেছে৷

সিরিজের পূর্বের লেখাগুলোতে দ্বিতীয় পক্ষের লোকগুলো সম্পর্কে সামান্য ধারণা দিয়েছি৷ এদের সম্পর্কে এর বেশি বলতে গেলে ফ্যাসাদ সৃষ্টি হবে৷ কারো সাথে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, যারা জানতে চায় তাদের জন্যই লেখাগুলো৷ যারা শুধুমাত্র দ্বীনের স্বার্থে সৌদী বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করেন, তারা বর্তমান ফিতনার যুগে কোন ধরনের দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে চান এবং সে রকম দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন একটি দেশের নাম বলবেন কি?

একই সমাজে কেউ গাঁজা খায়, কেউ হিরোইন খায়, কেউ ফেন্সিডেল খায়, কেউ ইয়াবা খায়, কেউ পান খায় একেকজন একেক নেশায় জড়িত৷ এর মাঝে আপনি কাকে ভালো বলবেন? নিশ্চয়ই পানখোরকে৷ বর্তমান মুসলিম বিশ্বের এমন কোন রাষ্ট্র আছে কি, যারা কোরআন এবং সুন্নাহর ক্ষেত্রে সৌদী আরবের চেয়ে অগ্রসর আছে? হ্যাঁ, আমরা তাদের আরো ভালো করতে বলতে পারি কিন্তুু তার পূর্বেতো আমাদের ইয়াবার নেশা ছাড়তে হবে৷

আল্লাহ তৌফিক দিলে চলবে ইনশাআল্লাহ

আবারো কৃতজ্ঞতা সাইদুর রহমান ভাই কে।।

বিষয়: আন্তর্জাতিক

৪১৪০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File