অ ভাই আমারে এক গললাস (গ্লাস)…
লিখেছেন লিখেছেন তারেক আহমেদ ১৩ জুলাই, ২০১৫, ০৩:২১:৫২ দুপুর
‘অ ভাই আমারে এক গললাস (গ্লাস) পানি দেওরেবা, আমার গলা হুকাই গেছে (শুকিয়ে গেছে), আর আমারে মারিও না, আমার আত-পাও ভাংগি গেছে (হাত-পা)’। এত সব কথা বলার পরও খুনিদের পাষাণ হৃদয় গলেনি। গত ৮ জুলাই সিলেট-সুনামঞ্জ রোডের কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড এলাকার বড়গাঁওস্থ সুন্দর আলী মার্কেটের একটি ওয়ার্কশপের সামনে বারান্দার খুঁটিতে বেঁধে রেখে নির্যাতনে নিহত রাজনের। ওই দিন সকাল ৭টারয় শিশুটিকে এমন নির্যাতন করে লাশ গুমের চেষ্টা করা হয়। ওই দিন পর্যন্ত সেটি গুমই ছিল। রাত ১১টার দিকে একটি মাইক্রোবাস থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। খবর পেয়ে বুধবার রাত ১১টায় থানায় গিয়ে পরিবারের সদস্যরা লাশ শনাক্ত করেন। নিহত রাজন কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদেআলী গ্রামের মাইক্রোবাস চালক শেখ আজিজুর রহমানের ছেলে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবে রাজনকে নির্যাতনের এমন দৃশ্য প্রচারের পর সিলেটে চলছে তোলপাড়। বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠছে ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির। পুলিশের কাছে জব্দকৃত শিশু রাজনের নির্যাতনের ২৮ মিনিটের ভিডিও ফুটেজে এ মর্মান্তিক দৃশ্য দেখা গেছে। ভিডিওটি এতটাই নির্মম আর পৈশাচিক, যে কেউ দেখলে আঁতকে উঠবেন। কিন্তু পাষণ্ড নির্যাতনকারীদের মনে এতটুকুও মায়া হয়নি। তারা তাকে হত্যা করেই ান্ত হয়নি, তাকে অজ্ঞাত স্থানে ফেলে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু জনতা দেখে ফেলায় ঘাতকদের গাড়িসহ আটক করেন। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, রাজনকে নির্যাতন করছে আর ঘাতকেরা বলেছে, ‘তরে এমন শিা দিমু, জীবনে আর চুরি খরতে (করতে) ফারতে (পাড়বে) নায় (না)’। ঠিকই জীবন দিয়ে চুরির অপবাদের মূল্য দিয়েছে শিশুটি। কণ্ঠস্বর ও চিত্র থেকে অনুমেয় পাঁচ-ছয়জন ঘাতক মিলে শিশুটিকে নির্যাতন করে।
লোমহর্ষক এ নির্যাতনের ভিডিওচিত্র ফেসবুক-ইউটিউবের মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। গোপন কারও তোলা ভিডিও নয়। খোদ নির্যাতনকারীরাই সেটি পরিকল্পিতভাবে তোলে এবং উল্লাস করতে করতে তার ভিডিওধারণ করেছে। ‘লাইভ নির্যাতনের’ ভিডিওটি তারা নিজেরাই ফেসবুকে আপলোড করেছে। নির্যাতনকারীদের যে সঙ্গী ভিডিও ধারণ করছিল, তাকে উদ্দেশ করে নির্যাতনকারীরা জানতে চায়, ঠিকমতো ভিডিও ধারণ হচ্ছে কি না। ‘ফেসবুকে ছাড়ি দিছি, অখন সারা দুনিয়ার মানুষ দেখব’ জবাব দেয় ভিডিওধারণকারী।
রাজনকে তারা নির্যাতন করে হত্যা করেছে চুরির অপবাদে। সিনেমাটিক স্টাইলে চলা ওই নির্যাতনের সময় শিশুটির স্পর্শকাতর অঙ্গে বারবার খোঁচানো হয়েছে। রোলার দিয়ে সেখানে আঘাত করা হয়। এই সময় নির্যাতনস্থলের বন্ধ মার্কেটের একটি পিলারের সাথে তাকে পিঠমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছিল। বাঁধন খুলে মাটিতে ফেলেও তাকে নানাভাবে নিপীড়ন করতে দেখা গেছে।
টানা ২৮ মিনিটের ওই ভিডিও চিত্রের প্রতি মুহূর্তের নির্যাতনের নানা ‘পদ্ধতি’ পরিলতি হয়েছে। নির্যাতন সইতে না পেরে শিশুটির আর্তচিৎকারের সময়, সিনেমার ভিলেনদের মতো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে ঘাতকেরা। আঘাত করতে করতে তারা ঘেমে উঠেছে। এমন নিষ্ঠুর নির্যাতনের সময় শিশুটি যখন ‘পানি’ খাওয়ার জন্য তাদের কাছে বারবার অনুনয় করেছে, তখন নির্যাতনকারীরা বলছে, ‘ঘাম’ খা।
কয়েক মিনিটের জন্য রাজনকে হাতের বাঁধন খুলে রশি লাগিয়ে হাঁটতে দেয়া হয়। ঘাতকেরা ভেবেছিল, এত নির্যাতনের পর তার আর হাঁটার শক্তি নেই। সে মাটিতে ধপ করে পড়ে যাবে। কিন্তু ভয়ে হাঁটতে থাকা শিশুটিকে উদ্দেশ করে তখন তারা বলে, ‘আড়গোড় (হাড়গোড়) দেখি এখনো ঠিক আছে, ইগুরে (ওকে) আরো মারো’ এরপর রাজনের বাঁ হাত খুঁটির সাথে বেঁধে রেখে আরেকদফা পেটানো হয়। এইভাবে দফায় দফায় শিশুটির নখ, মাথা, পেট ও উরুসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে রোলার দিয়ে আঘাত করা হয়। একসময় বাঁ হাত ও ডান পা ধরে মুচড়াতেও দেখা যায়।
খুন হওয়া শিশু রাজনের বাবা আজিজুর জানান, তিনি যে দিন ভাড়ায় মাইক্রোবাস চালাতে পারেন না, সে দিন সংসার খরচ চালাতে সবজি বিক্রি করতে বের হয় রাজন।
মা লুবনা আক্তার জানান, ওই দিন (৮ জুলাই) রাজনের বাবা গাড়িতে (ভাড়ার ট্রিপে) ছিলেন বলে বাড়ি ফিরেননি। ভোরে টুকেরবাজার থেকে সবজি নিয়ে বিক্রির জন্য রাজন বের হয়েছিল। সারা দিন ছেলের খোঁজ পাননি তারা। রাতে থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার সময় এক কিশোরের লাশ পাওয়ার সূত্র ধরে রাজনকে শনাক্ত করা হয়। লুবনা বলেন, ‘আমার পুয়া (ছেলে) চোর না, ই কথা সারা এলাকার মানুষ জানে। প্রবাসী অখলতের চোর ধরার শখ পূরণ করতে গিয়া জীবন দিছে! আমি এর উচিত বিচার চাই।’
এ দিকে নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই জালালাবাদ থানায় চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। হত্যার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠছেন এলাকাবাসীও। হত্যার সাথে জড়িতদের বিচারের দাবিতে স্থানীয় এলাকাবাসী কুমারগাঁও বাইপাস এলাকায় বিােভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করে।
এ ঘটনায় রাজনের বাবা বাদি হয়ে জালালাবাদ থানায় একটি হত্যা মামলা (নং-২৯৭/১৫) দায়ের করেন। ওই মামলায় আসামি করা হয়েছে আটক মুহিত আলমকেও। জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আক্তার হোসেন বলেন, ‘নির্যাতনের ভিডিওচিত্র ধারণ করার বিষয়টি শুনেছি। এটি দেখেছেন এমন কয়েকজনের সাথে কথাও হয়েছে।’
ওসি আরো জানান, ঘটনার সাথে মামলার আসামি চারজনই সম্পৃক্ত বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভিডিওচিত্র ধারণসহ পুরো ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মুহিতকে আদালতে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। আজ সোমবার আদালতে রিমান্ড আবেদনের শুনানি হবে।
বিষয়: বিবিধ
১১৫৬ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন