ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৪ বছর: প্রত্যাশা-প্রাপ্তির সাথে নতুন সংযোজন আধিপত্যবাদের থাবা, শ্রেণি বৈষম্য আর ছাত্র নির্যাতন

লিখেছেন লিখেছেন রাফিদ জাওয়াদ ০৭ জুলাই, ২০১৫, ১২:০৬:০২ দুপুর

১লা জুলাই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। ১৯২১ সালের এই দিনটি উপমহাদেশের মুসলমান তথা সকল পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির জন্য একটি ঐতিহাসিক স্মরণীয় দিন। তৎকালীন বাংলার মুসলিম নেতৃবৃন্দের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নাথান কমিশনের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষায় এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। হিন্দু জনগোষ্ঠীর চরম নিষ্পেষণের শিকার মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নকল্পেই এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। যদিও এদেশের একশ্রেণী আছেন, যাদেরকে অনেকেই বিশেষ মদদপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন, তারা বরাবরই বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পরিচয়টিকে রহস্যজনক কারণে স্বীকার করতে চান না বা তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমাজ থেকে এই পরিচয়টিকে মুছে দিতে চান।

বিগত কয়েক বছর থেকে বেশ ঢাকঢোল পিটিয়েই এই দিবসটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পালন করার চেষ্টা করছে। যদিও এই দিবসে অনুপস্থিত থাকছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সেই মহান উদ্দেশ্যটি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ঐতিহাসিক ভূল সংগঠিত হয়েছে যা এটির বৃহৎ অর্জনগুলো ছাপিয়ে এটিকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। ভিন্নমত দমনের নামে এটি এখন টর্চার সেলে পরিণত হয়েছে। এখান থেকেই এখন উচ্চকিত হচ্ছে “মব লিঞ্চিং” এর মত মধ্যযুগীয় ঘৃণ্য পশুত্বের চর্চার আহ্বান। এখানে দাঁড়ি-টুপি, নামায আর পোশাকের সুন্নাত পালন করতে চাওয়া মুসলমান ছাত্রদের উপর প্রায়শই করা হচ্ছে ঘৃণ্য বর্ণবাদী নির্যাতন। যদিও বাংলাদেশের বর্ণবাদী মিডিয়াগুলোতে এই সকল নির্যাতনের খবর খুব কমই আসতে দেখা যায়।

আধিপত্যবাদ, সামাজিক অবিচার আর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে এক গৌরবজ্জল ইতিহাস। এই বিশ্ববিদ্যালয় সবসময়ই এই অঞ্চলের খেটে খাওয়া, পিছিয়ে পড়া সুবিধা বঞ্চিত মানুষগুলোকে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা যুগিয়েছে এবং নেতৃত্ব প্রদান করে গেছে। সর্বশেষ ২০০৭ সালের ছাত্রবিক্ষোভ একটি ঐতিহাসিক নজির। কিন্তু এরপরের বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জালিমের বিপক্ষে এক ভংঙ্কর নিরবতার প্রতিরূপ।

১৯২১ সাল: একটি ভিন্ন পটভূমি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেকেই ভারতের একশ্রেণীর এলিট হিন্দু এবং বৈশ্বিক নিপীড়কগোষ্ঠী পশ্চিমাদের মতবাদ ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিবিম্ব হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেন। মূলত তাদের এই প্রচেষ্টা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস এবং এই অঞ্চলের মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। তারা ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পটভূমিকে মাঝেমাঝেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর চাপিয়ে দিতে চান। তাদের এই প্রচরণার সহায়ক হয়েছে এক শ্রেণীর শহুরে ভোগবাদী শ্রেণী। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত ইতিহাসকে সবসময় ধামাচাপা দিতে চান। অথচ ১৯২১ সালে সম্পর্ণূ ভিন্ন এক পটভূমিতে হিন্দু শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে মজলুম মুসলমানদের জন্য এক নতুন সমাজ বিপ্লব হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবির্ভাব হয়েছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্যবাদের থাবা:

এই বিশ্ববিদ্যালয় বরাবরই এ অঞ্চলের জন্য ছিল মুক্তির সংগ্রামী আর এর বার্তাবাহক। তাই এটির উপর সবসময়ই এসেছে আধিপত্যবাদের থাবা। এর প্রভাব এখন খুবই সুস্পষ্ট। সর্বশেষ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমণের পর তার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সহ সকলের অসহায় আত্মসমর্পণই আধিপত্যবাদের, সাম্রাজ্যবাদের সফলতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় তার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ আর আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন আর বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি আর জাতীয় অবমূলায়ণে কোন প্রতিবাদ করার সাহস করেন না। ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের হতভাগা বোন ফেলানীর হত্যার বিরুদ্ধে শপথ নেয়ার চেয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে হর্ষধ্বনী দিতে ব্যস্ত। তার মুখে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ‍বিকৃতিকে এখন জাতির কথিত নেতৃত্ব বলে খ্যাত সবাই হাততালি দিয়ে ধন্য ধন্য বলে বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নেন।

শ্রেণি বৈষম্য এবং ছাত্র নির্যাতন:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন বৈষম্যের এক উৎস কেন্দ্র। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শ্রেণি বৈষম্যের এক ঘৃণ্য উদাহরণ তারাই জাতির সামনে উচ্চকিত করেছে। বৈষম্যের শিকার ভূক্তভোগী মাদরাসার শিক্ষার্থীরা এর জ্বলন্ত উদাহরণ। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন মাঝেমাঝেই দাঁড়ি-টুপি আর নামায পড়ার জন্য ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হতে হয়। শিক্ষকরা ছাত্রীদেরকে ধর্মীয় বই রাখার কারণে গভীর রাতে নির্যাতনের ব্যবস্থা করে পুলিশের হাতে তুলে দেন। এখানে ভিন্নমতাবলম্বী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে স্থান দেওয়ার মত মনমানসিকতা হারিয়ে গেছে। পুঁজিবাদ, পশ্চিমা সংস্কৃতি আর ভোগবাদীরা এবং তাদের দোসররা এখন ক্যাম্পাসে বীরদর্পে বুক ফুলিয়ে হাঁটে। ২০১০ সাল পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসটি প্রত্যক্ষ করেছে ভয়ঙ্কর সব অভিজ্ঞতার। ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে এই সময়টাতে চরম সহিংসতা, নির্যাতন আর বৈষম্যের শিকার হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিশেষত স্বাধীন বাংলাদেশ পরবর্তী সময় থেকে একশ্রেণীর উগ্রচিন্তার গোষ্ঠী এবং তাদের উগ্র ধর্মনিরপেক্ষবাদী চিন্তা-চেতনা ক্যাম্পাসে সবসময়ই উদার চিন্তা-ভাবনা কে বাধাগ্রস্থ করেছে।

সবশেষে, অনেক হতাশার মাঝেও আশার জায়গাটা কখনই ধ্বংস হয়ে যায়নি। ক্যাম্পাসে এখনও সেই তরুণরা আছে যারা আধিপত্যবাদ আর বেইনসাফির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়। হয়তো তারা নগণ্য সংখ্যক। তবুও আশা হারানোর সুযোগ নেই। ইতিহাস বলে এই ক্যাম্পাস বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের দু:খ-দূর্দশা আর সার্বভৌমত্বের হুমকির কাছে কখনই মাথা নত করেনি। তারা এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেই। সেই নিয়তির দিকেই চেয়ে থাকলাম।

বিষয়: বিবিধ

১০৯৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File