মায়ের জন্য , বাবার জন্য
লিখেছেন লিখেছেন তৈয়েবুর রহমান গালিব ১৫ আগস্ট, ২০১৫, ০৫:১৯:৩৫ বিকাল
বিকালে বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিলো । মাথা ঝিমঝিম করছে । হালকা ঘুম ধরছে । মা বললেন , তোর বাবা মসজিদে গেছে রে । বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আসবে । এক কাজ কর , একটা ছাতা নিয়ে যা । বাবাকে নিয়ে আয় ।
আমি একরকম হা করে থাকলাম । হুট করে বলে ফেললাম , এই বৃষ্টিতে কেউ ভিজে কিভাবে মা ? বাবা এমনিতেই চলে আসবেন ।
মনে হলো মায়ের মুখটা কালো হয়ে গেলো । দেখে নিজেরই খারাপ লাগলো । ধুর ! এই সুন্দর বিকালটা এখন রাস্তায় গিয়ে মাটি করে ফেলবো !
বাইরে আসলেই বৃষ্টি নাই । বের হবার পর অবশ্য খুব একটা খারাপ লাগছে না । মনে হচ্ছে , মা ভালোই করেছেন । ঘরে শুয়ে শুয়ে আলসেমিটা বেশি হয়ে যাচ্ছে । কমাতে হবে । বাইরের সবকিছুই এত সুন্দর লাগছে ! ঘরে শুয়ে থাকলেই বরং মিস হয়ে যেতো ।
মসজিদের কাছে আসতেই দেখলাম , বাবা বের হচ্ছেন । আমাকে দেখে অবাক হলেন , বাইরে বের হয়েছো কেনো ? দেখো না , কেমন মেঘ করেছে ? আমি একটু বাসার জন্য একটা নুডলসের প্যাকেট নিয়ে আসি । তুমি যাও ।
আমি আর কি বলবো ! তার জন্যই তো বের হলাম !
- জি । আর যাবো না । চলেন । নুডলস নিয়ে আপনার সাথেই বাসায় ফিরবো ।
এই বাবাটাকে দেখে আমি অবাক হই । বাবা বেশ কিছুদিন যাবত বিভিন্ন অসুস্থতায় ভুগছেন । তার শরীরের শক্তি কমে আসছে । নিজের অতি জরুরী কাজ ছাড়া চলাফেরা কম করেন । অথচ আজো আমাদের যেকোন প্রয়োজনে বলার আগেই ছুটে যাচ্ছেন । আমরা জানার আগেই এমনিতেই কেমন করে যেন সব হয়ে যাচ্ছে ।
অথচ এই বাবা আমাদের কারো কাছে কোনদিনও কিছু চাইবেন না । শুধুই দিয়ে যাবেন । ভুতগ্রামের এক অর্ধস্বচ্ছল পরিবার থেকে দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করার মতো মেরুদন্ড তিনি দেখিয়েছেন । অবলীলায় দুইবেলা না খেয়ে , একবেলা খেয়ে কিভাবে ভার্সিটির টিউশন ফিশ জমিয়েছেন সেসব কথা তিনি বলতে পারেন ! বছর বছর স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে ঢাকা শহরে টিউশনি করার গল্প তিনি বলতে পারেন ! অথচ আমাদের বেলায় এসবে জড়ানো নিষেধ !
কয়েক বছর আগে মা বেশ কিছুদিন যাবত মেরুদন্ডের সমস্যায় ছিলেন । অসুস্থ শরীর নিয়ে এই বাবাটি তখন আমার মাকে কাধে করে নিয়ে সারাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন । সারা ইন্ডিয়া ঘুরে বেড়িয়েছেন । শেষ পর্যন্ত সুস্থ মাকে নিয়ে ফিরে এসেছেন । আমার মায়ের সেই ভয়াবহ দুর্দিনে পাশে দাড়ানোর মত শক্তি আমাদের দুই ভাইয়ের কারোরই তখন ছিলো না । কিন্তু আমার বাবা তাতে ভেঙ্গে পড়েন নি । একজন অচল অথর্ব মানুষকে সুস্থ করার যে প্রানান্তকর লড়াই , সেটা দেখার বয়সটাই শুধু আমাদের ছিলো ।
মাকেও একটু বুঝি । আমার মা কলেজ জীবনের পরিপূর্ন রাজনীতির মানুষ সংসারে ঢুকে একেবারে ঘরোয়া হয়ে গেছেন । বাবার সাথে ঘুরেছেন জেলার পর জেলা , বিভাগের পর বিভাগ ! আমরা যখন যে জেলায় পা রেখেছি , দেখেছি বাবা আর মায়ের পরিচিত কেউ থাকতো না । আমি , বাবা আর মা । বাবার নতুন অফিস , আমার নতুন স্কুল । আস্তে আস্তে যখন শহরটা চিনতে শুরু করেছি , তখনই আবার বাবার হাত ধরে আরেক শহর । আরেক স্কুল ।
যেদিন আমরা শহর পরিবর্তন করতাম , রেলস্টেশন থেকে রেলস্টেশন পার হতাম , বাবার মুখে থাকতো একটা শুন্য দৃষ্টি । মা বাবার দিকে চেয়ে , আর আমরা ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে ঘাসফুলের নড়াচড়া দেখতাম । এখন একটু বুঝি কিসের বন্ধনে বাবার সাথে আমার মা বেঁধে গিয়েছেন ।
অথচ আমার বাবা মার বিবাহটি ছিলো নিতান্তই সাদামাটা । পরিবার থেকে দেয়া বিয়ে । বাবাকে যখন আমার মায়ের আত্মীয়রা প্রথম দেখতে গিয়েছিলেন , তখন নাকি বাবা অসুস্থ ছিলেন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে গিয়ে বড় মামা বাবাকে আবিস্কার করলেন নাক ফাঁটা অবস্থায় । ভার্সিটিতে মারামারিতে বেচারা নাক ফাঁটিয়ে বসে আছে । বাবা মামার পরিচয় পেয়ে লজ্জা পেয়ে গিয়েছিলেন । আর মামার নাকি বাবাকে অনেক রুক্ষ আর কাঠখোট্টা মনে হয়েছিলো । এসব শুনে বাড়ির আর সবার কি মনে হয়েছিলো জানি না , মা নাকি একবাক্যেই ওই নাক ফাটা মানুষটার সাথেই বিবাহে রাজী হয়ে যান । আর আমার দরিদ্র ছা-পোষা কেরানি বাবা সেই বিয়ে করতে দুইশ কিলোমিটার সরকারি রাস্তা আর মাইল বিশেক কাদামাটি , বর্ষা পার হয়ে ত্রিশজন বরযাত্রী নিয়ে দিন পনেরো পরেই ফরিদপুর থেকে খুলনা চলে আসলেন ।
শেষ দুইটা বছর আমি আমার সমস্ত পরিবারকে বিভিন্ন রকম দৌড়ের উপর রেখেছি । বাবা কিছুই বলেন নি । মাও কিছুই বলেন নি । ছোটভাইকে নিয়ে গত ছয়টা মাস একধরনের অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে । বাবা শুধু সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন । কোন মতামত চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেন নি ।
কিন্তু বাবা না হয় গণ্ডগ্রামের অতিশয় সাদামাটা আরেকজন বাবার সংগ্রাম করে আসা একটা ছেলে । তিনি চুপচাপ থাকতে পারেন । কিন্তু মা কিভাবে পারেন ? এখন বুঝি , বাবা আছেন বলেই পারেন । বাবার দিকে তাকিয়েই পারেন । শুধু পারেন না বাবার কোন দুঃখ দেখতে । বাবার কোন সমস্যা দেখতে । তার শেষ আশ্রয়টাও যে তাহলে হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়বে !
একবার বিরামপুর রেলস্টেশনে একটা ছোট্ট ভুলের জন্য আমার মা আর ছোট ভাই হারিয়ে যায় । আমরা সেবার বদলি হয়ে প্রথম বাগেরহাট থেকে লালমনিরহাটে যাচ্ছি । সেদিন আমার সেই অবুঝ মনেই ভয় বাসা বেধে গেছে । মা না জানি কোথায় হারিয়ে গেলেন !
বিরামপুরের বিশাল স্টেশনে প্রায় ঘন্টাখানেক পর মাকে খুজে পাওয়া গেলো । মা এককোনায় তার তিনবছরের ছোটছেলেকে নিয়ে বসে আছেন । সেই মিলনদৃশ্যটি আমার জীবনে দেখা সর্বশ্রেষ্ট দৃশ্য । সারাজীবন মনে থাকবে । আমি আম্মাকে পেয়ে কেঁদে ফেললাম । ছোটভাই হা করে চেয়ে রইলো । আর আমার কান্না দেখে কিছুক্ষন পর সেও মহাশক্তিতে প্যা প্যা করে কাঁদতে শুরু করলো । আর আম্মা শান্ত স্বরে বাবাকে বললেন , ট্রেনটা কি আছে না আমাদের বাসেই যেতে হবে ?
এতবছর পরেও আজো কিন্তু আমার সেই কঠিন মা কঠিনই রয়ে গেছেন , শক্তই রয়ে গেছেন । মায়ের ছোট ছেলেকে জেলে ঢুকানো হয় , মায়ের ভয় লাগে না । মায়ের নিজের সমস্যাগুলো জটিল হয়ে উঠে , মায়ের ভয় লাগে না । মায়ের শুধু ভয় লাগে সেই রুক্ষ , কাঠখোট্টা বাবাটার জন্য । তার যদি কিছু হয়ে যায় ! মা যদি একা হয়ে যান !
আমারো ভয় লাগে । কষ্ট হয় । কিন্তু খুব খারাপ লাগলেও একটা অদ্ভুত প্রার্থনা আমি করি তাদের জন্য ।
সারাজীবন যেভাবে শহর থেকে শহরে তারা একত্রে ছিলেন , এভাবেই যেনো সারাজীবন তাদেরকে রেখো খোদা । যেভাবে দুরের দুটো অচেনা মানুষকে একসাথে মিলিয়েছো , সেভাবেই রেখো খোদা । চলে যাবার দিনেও একসাথেই রেখো । আমার মাকে কক্ষনো একা করোনা । কক্ষনো না ।
বিষয়: বিবিধ
১২২১ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন