অসমাপ্ত গল্প
লিখেছেন লিখেছেন তৈয়েবুর রহমান গালিব ১৩ আগস্ট, ২০১৫, ০৩:১০:০৭ রাত
অনেকদিনের পরিচিত সেগুন কাঠের চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসে আছে সুমন । তিনবছর আগেও চেয়ারটা যেমন ছিলো ঠিক তেমনই আছে । সামনের টেবিলটায় একটা চায়ের কাপ রেখে গেছে এদের কাজের মেয়েটা । কাপের ভেতর তিনটা লাল পিপড়া ভাসছে । পিপড়া অবশ্য সুমনকে চা খাওয়া থেকে কোনদিনও আটকাতে পারে নি , আজও পারবে না । কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায় । সুমন দুপুর থেকে কিছু খায়নি । ভেবেছিলো রাস্তায় খেয়ে নিবে । দেরী হয়ে গেলো বলে আর খাওয়া হয়নি । এখন পেটের ভেতর রীতিমতো বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে । উপায় না দেখে ইতিমধ্যে দুগ্লাস পানি খেয়ে ফেলেছে । কাজ হচ্ছে না ।
পৃথাকে ডাকলে অবশ্য কাজটা হয়ে যায় । কিন্তু কেমন যেনো সংকোচ লাগছে ।
- আপনের চা কিন্তু ঠান্ডা হয়া যাচ্ছে ।
চমকে উঠলো সুমন । কাজের মেয়েটা ফিরে এসেছে ।
- তুমি একটু পৃথাকে ডেকে দিবে ?
মেয়েটা কোন কথা না বলেই চলে গেলো । অদ্ভুত তো !
সুমনের মুখে থুতু জমছে । কিন্তু ফেলার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না । রুমের এক কোনায় একটা ফুলদানি আছে । ওটায় ফেলা যায় । কিন্তু উঠতে ইচ্ছা করছে না ।
এই বাসার ছোট্ট বিড়ালটা রুমের ভেতর একবার ঢুকছে , আরেকবার বের হচ্ছে । বিড়ালটা পায়ে বোধহয় সামান্য ব্যাথা পেয়েছে । খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটছে । বিড়ালটাকে খুব ভালো লাগে সুমনের । বিড়ালটার গায়ের রঙটা এক্সেপশনাল । সাদার ভেতর নীলচে ছাপ। অদ্ভুত কালার !
সুমন এই বাড়িতে প্রথমবারের মতো যখন ঢুকেছিলো তখন ও সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র । বিশাল বাড়িটায় ঢুকে ও একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলো । তবে সমস্যা হয়নি । এরা সবাই খুব ভালো । দরজায় পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে । বোধহয় কাজের মেয়েটাই আবার আসছে ।
- স্যার , দেখেন তো । আমাকে কেমন দেখাচ্ছে ?
সুমন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো । নীল শাড়ি পরে এসেছে পৃথা ।
- সুন্দর দেখাচ্ছে ।
- ঘোড়া ! অনেক চেষ্টা করেও কুচিটা ঠিকমতো পড়লো না ।
হাসলো সুমন । এই মেয়েটাকে শাড়ি পরা অবস্থায় কোনদিন দেখেনি সে । মেয়েটা আসলেই অনেক বড়ো হয়ে গেছে । শাড়ি তে কম বয়সী মেয়েদের একটু উগ্র দেখায় । এই মেয়েটাকে লাগছে না ।
সুমনের আজ পৃথাকে পড়ানোর শেষ দিন । গত তিনবছর ধরে সপ্তাহে তিনদিন এই বাসায় ওর আসাযাওয়া । শুধু আসা যাওয়া নয় , একবেলা খাদ্যের সংস্থানও তার এই বাড়ি । বিশাল এই বাড়িটায় মফস্বলের ছেলের জন্য ভালোবাসার কোন কমতি ছিলো না । পৃথার বাবা মা সবাই খুব ভালো মানুষ । ওকে অনেক স্নেহ করেন ।
- স্যার ! আপনি কি শাড়িটা চিনতে পেরেছেন ?
সুমন অবাক চোখে তাকালো , কই ! চেনা তো লাগছে না ।
- ধুস । এই শাড়িটা পরেই প্রথম আপনার কাছে পড়তে বসেছিলাম আমি ।
- বলো কি ! আমি তো তোমাকে শাড়ি পরে দেখিইনি কোনদিন ।
- বলছে আপনাকে !
পৃথা ইন্টারে কমার্স নিচ্ছে । তাই সুমনের আর পড়াতে আসার প্রয়োজন নাই । পৃথার মা অবশ্য বলেছিলেন অন্য সাবজেক্টগুলো পড়াতে । কিন্তু সুমন রাজি হয়নি ।
এরই ফাকে একটা চেয়ার নিয়ে সামনে বসে পড়েছে পৃথা , স্যার ! আপনি কিন্তু মাঝে মাঝে আসবেন ।
- আচ্ছা আসবো । এখন তুমি পড়তে বসো ।
পৃথার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেলো , আজ আবার কি পড়বো ? আজ পড়বো না ।
সুমন অবাক হলো , তবে ? আজকে আবার কি করবা !
- কিছুই না ।
এতো খেয়ালী মেয়ে জীবনে দেখেনি সুমন । যা বলবে তাই করবে । এই কারনে অনেকবার বিব্রতও হতে হয়েছে ওকে । তবুও সুমন পছন্দ করে পৃথাকে । একেবারেই সোজাসাপ্টা , অকপট । বড়োলোকের মেয়েগুলা বোধহয় এরকমই হয় ।
- স্যার ! আপনি কিন্তু আমাকে এখনো সেই গল্পটার শেষটা শোনাননি ।
- কোনটা ?
পৃথা চোখ উল্টে দিলো , ও ! মনে নাই ! তমালের ঘটনাটা ?
সুমন হেসে দিলো । কী সহজসরল মেয়ে । দুবছর আগের একটা বানানো গল্পকে আজও ধরে বসে আছে ! সুমনের নিজেরই মনে আসছে না ।
- আরে নাহ । মনে আছে নাকি অতোদিন আগের কথা ?
- তাহলে আরেকটা বলেন ।
সুমনের পেটটা বারবার মোচড় দিয়ে উঠছে । কিন্তু কেমন যেনো সংকোচ বোধ হচ্ছে । অথচ আগে কখনো হয়নি । অধিকারটা উঠে যাচ্ছে বলেই কি এমন হচ্ছে ! অবশ্য কিসের অধিকারই বা ছিলো ? সামান্য গৃহশিক্ষক ছাড়া সে কি এদের কাছে আসলেই কিছু ছিলো !
সুমন নড়েচড়ে বসলো পৃথার ডাকে , কী ভাবেন এতো ?
- আরে নাহ । গল্প মনে আসছেনা ।
কিন্তু পৃথাও ছাড়বেনা , বানিয়ে বলেন ।
সুমন একটু ঘুরে বসলো , আচ্ছা বলতেছি । বানানো লাগবেনা । একটা সত্যি কাহিনীই বলি ।
সুমন একটু থামলো , আচ্ছা তুমি তার আগে দুগ্লাস পানি নিয়ে আসো তো । আমার খুব পিপাসা পেয়েছে ।
- আচ্ছা বলছি ।
পানি খেয়ে বোধহয় পেটের ব্যাথাটা আরো বেড়ে গেলো । এরমধ্যে পৃথার মা এসে বলে গেলেন রাতের বেলায় খেয়ে যাবার কথা । পৃথাদের বাসায় খাওয়াদাওয়ার আয়োজনটা হয় রাজাবাদশাদের মতো । প্রথম প্রথম যখন আসতো খাবারের আয়োজন দেখে লজ্জা পেয়ে যেতো । পরে বুঝে গেছে এদের ভোজন বিলাসিতার একটা ব্যাপার আছে ।
- স্যার এবার শুরু করেন ।
নাহ এই মেয়ে দেখি ছাড়বেনা আজ । সুমন প্রথম যখন পড়ানো শুরু করেছিলো তখন খুব গল্পের আসর বসতো । শেষদিকে অবশ্য পড়ার চাপ বেড়ে যাওয়ায় গল্পের ভূত নেমে গিয়েছিলো । সুমন ভয় পেয়ে গেছিলো । পৃথাদের স্কুলে বিশাল সিলেবাস । শেষ করাই কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো । কিন্তু মেয়েটা খুব ভালো ছিলো । তাই ওইযাত্রা পার পেয়ে গেছে ।
সুমন আস্তে আস্তে শুরু করলো , শোনো হাসবানা কিন্তু । আগে থেকে বলে দিলাম ।
পৃথা হেসে ফেললো , শুনাবেন হাসির গল্প । আর বলছেন হাসবানা । ছিংছাং কথাবার্তা বইলেন না তো । আমি আর সেই ছোট্ট পৃথামনি নাই । বুঝছেন ?
এই মেয়েটাকি আসলেই বড়ো হয়ে গেছে ? কখনোই ধরতে পারেনি সুমন । নাকি কাছাকাছি থেকে মেয়েদের বড়ো হওয়াটা সহজে ধরা যায় না !
গল্পের শুরুটা ঠিক করতে কিছুটা সময় দরকার । কিন্তু কিছুই মাথায় আসছে না । সুমন একটু হাতাটা ঘুচিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করলো ,আমি একবার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেছি । বুঝলা ?
- আজকেও গ্রামের বাড়ি !
সুমনের সব গল্পেরই শুরু হয় গ্রামের বাড়ি বেড়ানো দিয়ে । অন্য কিছু মাথায়ই আসে না । কী আর করা যাবে ! সুমন চোখ বড়ো করলো , কেনো ? সমস্যা কি ?
- নাহ । কোনো সমস্যা নেই , বলেন ।
- আমাদের বাড়িতে আবার একটা পুরাতন ঘর আছে । রাতের বেলায় ওই পুরাতন ঘরে ঘুমাতে গেছি ।
- এইটাও আগে বলছেন ।
সুমন ভ্রু কুচকে ফেললো , আগে শোনো তো । রাতের বেলায় ঘুম থেকে উঠে বাইরে যাবো , দেখি দরজা খুলে না । আমিতো ভয় পেয়ে গেলাম । বিছানার দিকে তাকায়ে দেখি এক মেয়ে বসে আছে ।
পৃথা হেসে ফেললো , ধুস ! আজগুবি গল্প । বাদ দেন এইটা ।
সুমন চুপ হয়ে গেলো । ওর গল্প বলার মুড আসছে না । গল্প বলার জন্য মুড একটা বড়ো ব্যাপার ।
ল্যাংড়া বিড়ালটা আবার ফিরে এসেছে । বিড়ালটার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া লাগছে । এই বিড়ালটার মা’টাও একসময় এই বাড়িতে থাকতো । হঠাৎ একদিন গেটের কাছে মরা পাওয়া গেলো । বিড়াল বলে কেউ আর মাথা ঘামালো না । পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে এলো ।
অল্প কিছুক্ষন পরেই পৃথা হাল ছেড়ে দেয়ার মতো কন্ঠে বললো , কী আর করা যাবে । ওইটাই বলেন ।
সুমন হেসে ফেললো । তারপর মুখ শুকনো করে বললো , কী আর হবে ? আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম । কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো মেয়েটাও ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলো । আমি আবার দরজা খুলার চেষ্টা করলাম । খুললো না । চিৎকার দেবার চেষ্টা করলাম । গলা থেকে বের হলো না । আর কি করা ! একটু সাহসী হয়ে মেয়েটার দিকে তাকালাম ।
পৃথা নাকমুখ কুচকে ফেললো , মেয়েটাকি অনেক সুন্দর ছিলো ?
- ছিলো তো ।
- আমার চেয়েও !
সুমন হাসতে গিয়েও হাসলোনা , তুমি আবার সুন্দরী হলে কবে ?
পৃথার মুখটা একটু গোমড়া হয়ে গেলো, আচ্ছা ঠিক আছে । বলেন আপনার বিশ্বসুন্দরীর গল্প ।
সুমনের গল্প বলার সময় একটা বদভ্যাস আছে , খুব হাত নাড়ায় ও । মাঝে মাঝে চেষ্টা করে বন্ধ করতে । কিন্তু কেনো যেনো এমনিতেই আবার শুরু হয়ে যায় । আজও এই সমস্যাটা দেখা যাচ্ছে । হাতটা যথাসম্ভব আটকে রেখে আবার শুরু করলো , আর কি ! মেয়েটা ছিলো পরী ।
- পরী ! বলেন কি ! অচেনা এক পরীর সাথে রাত কাটায় দিলেন ?
- ফাজলামি কইরো না । এক রাত কাটাই নাই । বারো দিন বারো রাত ছিলো আমার ঘরে । এরপর চলে গেলো ।
পৃথা চোখ উল্টালো , কই গেলো ? যাবার সময় আপনাকে বলে যায়নি ?
পৃথার প্রশ্নের ধরণ শুনে মজা লাগলো সুমনের । এমনভাবে প্রশ্নটা করলো যে মনে হলো সে গল্পটা বিশ্বাস করা শুরু করেছে । পৃথাকে গল্প বলার মজাটাই এখানে । সব গল্পের মাঝখানে সে ঢুকে যেতে পারে । সুমনের নিজেরই এই গুনটা নাই ।
সুমন আর কী বলবে । বললো , নাহ বলেনি । পারিবারিক সমস্যা হওয়ায় এখানে এসে লুকিয়েছিলো । হয়তো মিটে গেছে । তাই চলে গেছে ।
পৃথাকে একটু দুঃখিত মনে হলো , এইটা একটা কথা হলো ! আমি হলে নিশ্চয়ই বলে আসতাম ।
সুমন একটু গম্ভরি হবার চেষ্ঠা করলো , তবে একটা চিঠি দিয়ে গেছিলো ।
পৃথা মনে হয় লাফ দিয়ে উঠলো , কী চিঠি !
সুমনের পেটের ব্যাথাটা আরও বেড়ে গেছে । সুমন পৃথাকে আরও দুই গ্লাস পানি আনতে পাঠিয়েছে । এবার আর কাজের মেয়েকে আনতে বলেনি পৃথা । নিজেই গেছে ।
পায়ে ব্যাথা পাওয়া বিড়ালটা এক কোনায় গিয়ে শুয়ে পড়েছে । এই বিড়ালটা আগে সুমনের ধারেকাছে ঘেসতো না । কিন্তু এখন আর ভয় পায় না । সুমন পড়াতে আসলে এক কোনায় এসে বসে থাকে । বিড়ালটা আগামীকাল থেকে আর হয়তো এখানে এসে বসবে না । অদ্ভুত এই জীবন !
পৃথা ফিরে এসেছে । গ্লাস টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বললো , স্যার ! বলেননা চিঠিতে কী লেখা ছিলো ?
সুমন গ্লাসটা উঠাতে উঠাতে বললো , নাহ বলা যাবে না । কাউকেই বলি না আমি । হাসাহাসি করবে ।
- ধুর ! এমন গল্প বললেন যেটার আবার শেষটা বলবেন না । আপনি একটা ফাউল !
সুমন বিরক্ত হলো , আমি কী চিঠি নিয়ে এসেছি নাকি ?
পৃথাও খেপে গেলো , আনতে বলছে কে ? বললেইতো হয় ।
সুমন চুপচাপ থাকলো । কিছুক্ষন পর বললো , আচ্ছা একটা কাগজ এনে দাও । লিখে দেই ।
সুমন খুজে পাচ্ছিলো না কী লিখবে । তারপরও লিখে দিলো । লিখতে গিয়ে হাতটা একবার কেপে উঠেছিলো । সুমনের অবাক লাগছিলো । এটাই বোধহয় পৃথার খাতায় সুমনের শেষ লেখা । শেষ লেখাটা যে এরকম একটা কিছু হবে কোনদিন চিন্তাও করেনি সুমন ।
পৃথা কাগজটা নিয়ে অনেকক্ষন তাকিয়ে ছিলো । তারপর বললো , সত্যিই এই কথা লিখেছিলো মেয়েটা ?
সুমন মৃদু ধমকের কন্ঠে বললো , আরে ! তুমি এতো সিরিয়াস হয়ে যাও কেনো ? ওতো আর মানুষ না , পরী ।
পৃথার মুখ শুকিয়ে গেলো , যাই হোক । মেয়েতো মেয়েই । একটা মেয়ে কখন এই কথা লেখে আপনি জানেন ?
সুমন হো হো করে হেসে দিয়েছিলো । কিন্তু পৃথা আর একটা কথাও বলেনি ।
সুমন রাতের বেলায় না খেয়েই বের হয়ে আসলো । পৃথার মা অনেকবার বলেছিলেন । সুমনের কেনো যেনো ইচ্ছা করলো না । অথচ ক্ষিধায় পেট ওলোটপালোট হয়ে যাচ্ছিলো । আসার সময় পৃথাকে বলে আসলো বেশীবেশী পড়াশুনা করতে । পৃথা হেসেছিলো , আপনি কিন্তু এখন আর আমার স্যার না । এইগুলা আমি আর শুনবো না ।
সুমন রাস্তা থেকে পৃথাদের বাসার দিকে একবার তাকালো । সুমন জানে , তার এই ছোট্ট ছাত্রীটির বাসায় তার আর কখনোই ফিরে আসার দরকার হবে না । আর পরীর লেখা চিঠির বদলে সুমনযে নিজের লেখা চিঠিটাই ভুল করে পৃথাকে লিখে দিয়ে এসেছে কোনদিন সে কথাটাও পৃথাকে আর বলার দরকার হবে না ।
বিষয়: সাহিত্য
১৩৯৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
They are living happily ever after
মন্তব্য করতে লগইন করুন