পরীক্ষার রেজাল্ট সবসময়েই সব নয়/তৈয়েবুর রহমান গালিব
লিখেছেন লিখেছেন তৈয়েবুর রহমান গালিব ০৯ আগস্ট, ২০১৫, ১১:৩৮:১১ সকাল
আজ এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিচ্ছে ।
দুমাস আগেই পরীক্ষা হলো । পরীক্ষার হলের সামনে টেলিভিশন ক্যামেরা গেলো । খুব আগ্রহ নিয়ে দেখলাম । তারুন্যের উচ্ছ্বাস ! সবার উত্তেজনা , অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা ।
কিন্তু যখন রেজাল্ট হবে , তখন সবার মুখে হাসি থাকবে না । তারা সবাই হয়তো আজকের নায়ক হবে না । অনেকেই দুঃখ পাবে । আমার এক বান্ধবী পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যাই করে ফেলেছিলো । খুব কষ্ট পেয়েছিলাম । নিজেকে বুঝিয়েছিলাম , দুঃখ পাওয়ার কি আসলেও কিছু আছে ?
জীবনে এরপর অনেকবার ব্যর্থ হয়েছি । কিন্তু কিছুই মনে হয়না । শুধু ওই বান্ধবীর মুখটা মনে পড়ে । মায়া হয় খুব । আর আসলেও কিন্তু জীবন কোন পরীক্ষার রেজাল্টের উপর নির্ভর করে না । জীবন চলে কর্মের উপর । জীবনের প্রতিটা বাঁকেই মানুষের জন্য অপেক্ষা করে আছে বিস্ময় । আমাদের শুধু একটা বিস্মিত হবার ক্ষমতা থাকলেই চলে ।
নয়া দিগন্তে শফিক রেহমানের "দেশে দেশে ফাসি" বিষয়ে একটা অতি ফরমায়েশি লেখা পড়েছিলাম । যুদ্ধাপরাধ এবং শাহবাগ আন্দোলনের পর এ বিষয় নিয়ে তার এই উলঙ্গ লেখাগুলি আমার কাছে কখনোই সময়োপযোগি বলে মনে হয়নি । এরই মধ্যে কলামের একটি পর্বে একজন রবার্ট স্ট্রাউডকে নিয়ে লেখা হয়েছে । কলামটির শ্রেষ্ট লেখাটিই বোধহয় রেহমান লিখে ফেলেছিলেন ! কি আকর্ষনীয় সেই জীবন !
রবার্ট স্ট্রাউড মাত্র তের বছর বয়সে বাবামায়ের দাম্পত্য কলহ এবং দুর্বিষহ মানসিক তাড়নায় বাড়ি থেকে পালিয়ে যান । এরপর টানা পাঁচবছর জীবনের সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েন তিনি । শেষমেষ সহজে অর্থউপার্জনের চিন্তায় কিটি এবং ব্রায়েন নামে দুই যৌনকর্মীর দালালের কাজ শুরু করেন । এই কাজেরই এক পর্যায়ে কিটি নামের সেই বার ড্যান্সারের কোন একজন প্রভাবশালি খদ্দেরের সাথে কথা কাটাকাটির মধ্যে স্ট্রাউড তাকে গুলি করে বসেন । বারোবছরের কারাদন্ড হয় তার ।
প্রায় আটবছর জেল খাটার পরে জেলের ভেতরে আরো একটি হত্যাকান্ড ঘটিয়ে বসেন স্ট্রাউড । স্ট্রাউডের ছোটভাই তার সাথে দেখা করতে এসে এক স্টাফের কারনে বিফল হন । একথা শোনার পর রাগান্বিত হয়ে স্ট্রাউড তাকে ছুরিকাঘাত করেন । স্টাফটি মারা যায় এবং বিচারে স্ট্রাউডের ফাসির আদেশ হয় । সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হয় । কিন্তু মৃত্যুদন্ড বহাল থাকে । ১৯১৫ সালের ২৩ এপ্রিল তার ফাসি কার্যকরের ব্যবস্থা করা হয় ।
এরপর ঘটে এক অভুতপূর্ব ঘটনা । স্ট্রাউডের সেই ভুলে যাওয়া মা দৃশ্যপটে হাজির হন । তার নিরবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় প্রেসিডেন্ট উড্রো ইইলসন তাকে ফাসি মওকুফ করে আজীবন কারাদন্ড দেবার সুপারিশ করেন । স্ট্রাউডকে জনবিচ্ছিন্ন একটি সেলে রাখার সিদ্ধান্ত হয় ।
মানুষ থেকে আলাদা হয়ে যাবার নির্দেশে বিচলিত হয়ে পড়েন রবার্ট স্ট্রাউড । কিন্তু তাড়াতাড়িই গুছিয়ে নেন । ১৯২০ সালটি তার জীবনের একটি বিশেষ বছর । এই বছরে তিনি জেল প্রাঙ্গনে কুড়িয়ে পাওয়া তিনটি আহত চড়ুইকে সুস্থ করে তোলেন । এবং পর্যায়ক্রমে জেলকর্তৃপক্ষের কাছে আরো কিছু পাখি কেনার অনুমতি চান । অনুমতি পাবার পর শুরু হয় রবার্টের অন্য রকম জীবন । রবার্ট বিশাল বিশাল পাখির খাচা তৈরি করেন । খাচাগুলো এতোই বিশাল ছিলো যে , এর ভেতরে অনায়াসে শত শত পাখি রাখা যেতো । জমা হতে থাকে পাখি । কিচিরমিচিরে ছেয়ে যায় সমস্ত কারাগার । কিছুদিন পরে পত্রপত্রিকায় এসব ঘটনা প্রকাশ পেয়ে গেলে জেলে দর্শনার্থিরা এগুলি দেখতে আসতেন । রবার্টের কাছ থেকে চোরাইপথে পাখি কিনতেন ।
এরই মধ্যে আরেকটি ভয়াবহ কাজ করে বসেন রবার্ট । তার প্রায় ছয়শ পৃষ্ঠার বই ডিজিজেস অফ ক্যানারিজ ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত হবার পর আমেরিকা কাপিয়ে দেয় । ব্যাপক ব্যাবসায়িক সাফল্য অর্জন করে ।
রবার্টের কাজ আমেরিকার জেলকর্তৃপক্ষের ভেতরেও বিশাল আলোড়ন তৈরি করে । জেলের ওয়ার্ডেন বেনেট তার কাজে মুগ্ধ হয়ে শুরু করেন প্রগতি এবং পুনর্বাসন নামে এক জেলভিত্তিক কার্যক্রম ।
তবে রবার্টের কাজ জেল কর্তৃপক্ষকে একটি বিপদেও ফেলে দিয়েছিলো । তার নামে আসা হাজার হাজার চিঠি চেক করা , এবং বোঝার জন্য বিভিন্ন ভাষার অনুবাদক প্রয়োজন হয়ে পড়ে । রবার্টের পাখি ব্যাবসা এত প্রসার হয়েছিলো যে , তার জন্য সেক্রেটারি নিয়োগ দেয়া হয় ।
কিন্তু কিছুদিন পরেই ঘটে বিপদ । বেনেট বদলি হয়ে যান । নতুন ওয়ার্ডেন বন্দীর এরকম খ্যাতিতে বিরক্ত হন । জেল কর্তৃপক্ষ রবার্টকে নোটিশ দেয় পাখি সরিয়ে ফেলতে । কিন্তু এ সিদ্ধান্ত কিভাবে যেনো ডেলা নামে এক নারী পাখি গবেষকের মাধ্যমে পত্রিকায় প্রকাশ পেয়ে যায় । আমেরিকা জুড়ে ঝড় ওঠে । প্রায় লক্ষাধিক সাক্ষর নিয়ে চিঠি যায় তৎকালিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হুভারের কাছে । গনচাপে প্রেসিডেন্ট তাকে পুনরায় অনুমতি দিতে বাধ্য হন । তার পাখি পোষার জন্য একটি অতিরিক্ত সেলও বরাদ্দ করা হয় । ১৯৩২ সালে ডেলা নামের সেই নারী স্ট্রাউসকে জেলের ভেতরেই বিয়ে করেন ।
কিন্তু এবার আরেকটা ভুল করে ফেলেন স্ট্রাউড নিজেই । পাখির ওষুধ বানানোর ল্যাবে অনৈতিকভাবে মদ তৈরি করার সময় ধরা পড়ে যান । শাস্তিস্বরূপ তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় আলকাতরাজ দ্বীপে । মাত্র দশমিনিটের নোটিশে স্ট্রাউডকে ছেড়ে যেতে হয় তার প্রিয় সমস্ত পাখিকে ।
এরপরের এগারো বছরের জীবন তিনি একাই কাটিয়ে দেন । লেখেন একের পর এক বই । কিন্তু এগুলো প্রকাশের অনুমতি না পাওয়ায় তার মৃত্যুর পূর্বে আর মানুষের কাছে পৌছায়নি ।
১৯৬৩ সালে যখন তিনি ৫৪ বছরের কারাজীবনের সমাপ্তি ঘটান প্রিজনার্স হসপিটালের বিছানায় , তখন তার নামে সারা আমেরিকায় 'কমিটি টু রিলিজ স্ট্রাউড' নামে লক্ষাধিক সদস্যের একটি সংগঠন তৈরি হয়ে গিয়েছিলো ।
রবার্ট বেচে থাকতেই তার জীবনি বের হয় । সেই জীবনির উপর বানানো মুভি অস্কার জিতে । কিন্তু কারাকর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞায় সেটি স্ট্রাউড দেখে যেতে পারেন নি ।
হসপিটালের বেডে বসে নার্সকে বলা রবার্টের জীবনের শেষ বাক্য ছিলো , আলো নিভে গেলে সবাইকে পাখি হয়ে যেতে হয় ।
স্ট্রাউডের ৭৩ বছরের জীবন এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার পর আমার মনে হলো , বাহ ! কি মোহময় জীবন ! মনে হলো , জেলে গেলেও তো মন্দ হয় না । কিন্তু আসলেও কি তাই ?
আসলেও তাই । জীবনকে উপভোগ করতে শিখে গেলে জীবনের সমস্ত বাঁকে দাড়িয়েই স্ট্রাউড হওয়া যায় । কেবল বুঝতে হয় নিজের আত্মাকে । আর বুঝতে হয় , শেষ মিনিট পর্যন্ত তুমি আসলেই জানো না , কি ঘটতে যাচ্ছে । তুমি সফল হও অথবা না হও দিনশেষে তোমাকে ঘুমাতে যেতে হবে , জীবন শেষে তোমাকে মৃত্যুর কাছে যেতে হবে ।
বুঝতে হবে সবার জীবনই আসলে একরকম , শুধু স্ট্রাউডদের জীবন অন্যরকম ।
পরীক্ষার্থীরা , best of luck
বিষয়: বিবিধ
১৩৫০ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন